সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০০৮

মাতা - পিতার প্রতি কর্তব্য


মাতা - পিতার প্রতি কর্তব্য


শিশু কিশোর বন্ধুরা, তোমরা কি জানো- আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পর এ পৃথিবীতে আমাদেরকে কারা সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেন ? তোমরা হয়তো দু'চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্তেই বলে দিচ্ছো- কারা আবার! বাবা-মাই তো আমাদেরকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেন। হ্যাঁ বন্ধুরা, তোমরা ঠিকই বলেছো। কারণ জন্মের পর থেকেই প্রতিটি বাবা-মা নিজেদের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে সন্তানের সুখ ও নিরাপত্তার জন্য যতটা পেরেশান হয়ে পড়েন অন্য কেউই এমনটি করেন না। সন্তান যেন আদর্শ মানুষ হয় এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয় সেজন্য বাবা-মা শৈশব থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আর এজন্যই পৃথিবীর সব ধর্মই বাবা-মাকে বিশেষ সম্মান দিয়েছে।
পবিত্র কোরআনের অন্ততঃ পনের জায়গায় পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। সুরা লোকমানের ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, "আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জোর নির্দেশ দিয়েছি কেননা তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। আমি আরো নির্দেশ দিয়েছি আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। অন্যদিকে সূরা বনি ইসরাইলের ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ' শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিওনা। তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণভাবে কথা বলো।'
অন্যদিকে রাসূলে খোদা মায়ের মর্যাদা দিতে গিয়ে বলেছেন, জান্নাত মায়ের পদতলে। পিতার মর্যাদা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, পিতার সন্তুষ্টির ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টির ওপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি নির্ভর করে। পিতামাতার সাথে অসৎ আচরণের পরিণাম সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ কী তা কি আমি তোমাদের জানাব ? তা হচ্ছে- আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা ও পিতা-মাতার সঙ্গে অসদাচরণ। এ প্রসঙ্গে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, পিতামাতাকে অসম্মান করা বড় ধরণের পাপ।
বন্ধুরা, পিতামাতা দুজনই সন্তানের কাছে মর্যাদাবান হলেও ইসলামে মায়ের মর্যাদা পিতার চেয়েও বেশী দেওয়া হয়েছে। কারণ সন্তানকে লালনপালন করার ক্ষেত্রে মা-ই বেশী ভূমিকা পালন করে থাকেন।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো, আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর জন্মের আগেই বাবা এবং মাত্র ছয় বছর বয়সেই মাকে হারান। বাবার স্নেহ ও মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হলেও নবীজি তাঁর দুধমা হালিমাকে মায়ের মতোই ভালোবাসতেন। এ সম্পর্কে এখন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলছি ।
‘রাসূল (সাঃ) একদিন তাঁর সাহাবীদের সাথে আলাপ করছিলেন। এমন সময় এক বৃদ্ধা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। নবীজি বৃদ্ধাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং তাঁর গায়ের চাদরটি মাটিয়ে বিছিয়ে তাকে বসতে দিলেন। তারপর অত্যন্ত দরদ দিয়ে বৃদ্ধার সাথে কথাবার্তা বললেন। বৃদ্ধা চলে গেলে সাহাবীরা বিষ্মিত হয়ে নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন,‘ কে এই মহিলা যার জন্য আপনার এতো দরদ, এতো আন্তরিকতা?' নবীজি উত্তরে বললেন, তিনি আমার দুধমাতা হালিমা। তিনি আরো জানালেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরেই মায়ের স্থান এবং মায়ের পায়ের নিচেই সন্তানের বেহেশত। '
কেবল রাসূল (সাঃ)-ই নন, যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ মাতৃভক্তির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তোমরা নিশ্চয়ই ইরানের বিখ্যাত সাধক হযরত বায়েজীদ বোস্তামীর নাম শুনেছো। ইরানের মাজানদারান প্রদেশের বোস্তাম নগরে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। কবি কালিদাস রায় তার ‘মাতৃভক্তি' কবিতায় বায়েজিদ বোস্তামীর মাতৃভক্তির এক বিষ্ময়কর কাহিনী তুলে ধরেছেন। এই কবিতায় আমরা দেখতে পাই- একদিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর মা হঠাৎ করে রাতে ঘুম থেকে জেগে পানি খেতে চাইলেন। বালক বায়েজিদ দেখলেন, ঘরের কলসিতে পানি নেই। তখনি তিনি ছুটলেন বহু দুরের ঝর্ণা হতে পানি আনতে। পানি নিয়ে এসে দেখলেন, মা এরই মধ্যে ঘুমিয়ে গেছেন। মায়ের ঘুম ভাঙানো অপরাধ হবে ভেবে তিনি সারারাত পানির গ্লাস হাতে মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে রইলেন। আর প্রতিক্ষা করতে লাগলেন- কখন মায়ের ঘুম ভাঙবে? এক সময় রাত কেটে গেল। ফজরের আযান হলো। মা জেগে দেখলেন, বায়েজিদ দাঁড়িয়ে আছেন। মায়ের প্রতি ভক্তি দেখে আনন্দে মা কেঁদে ফেললেন। কবি কালিদাসের ভাষায়-কহিল মা, মরি মরি!বাছারে আমার পানি হাতে করে সারা রাত্রটি ধরিদাঁড়াইয়া আছো? ঘুমাওনি আজ? চোখে এলো জল ভরি।
এ ঘটনার পর কান্না ভেজা চোখে মা সেদিন বায়েজিদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আর মায়ের দোয়ার বরকতে হযরত বায়েজিদ বড় হয়ে বিশ্ব বিখ্যাত আউলিয়াদের একজন হয়ে গেলেন।
এতো গেল মানুষের কথা। তোমরা কি জানো-সন্তানের প্রতি মা মাকড়সার আত্মত্যাগের কাহিনী ? মা মাকড়সার ডিম ফুটে যখন বাচ্চা বের হয় তখন তারা ক্ষুধার জ্বালায় মা-মাকড়সার শরীর ঠুকরে ঠুকরে খেতে থাকে। এভাবে খেতে খেতে এক সময় মায়ের পুরো শরীরটাই তারা খেয়ে ফেলে। সকল যন্ত্রণা মা নীরবে সহ্য করে। এভাবে নিজের জীবন দিয়ে তারা সন্তানের জীবন বাঁচায়।বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছে, বাংলা সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে মায়ের উপস্থিতি। এমন কোন কবি হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি মাকে নিয়ে কবিতা লিখেন নি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন-যেখানেতে দেখি যাহামায়ের মতন আহাএকটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,মায়ের যতন এতআদর সোহাগ সে তোআর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই।
অন্যদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-


মা বুঝি গান গাইতো আমারদোলনা ঠেলে ঠেলেমা গিয়েছে, যেতে যেতেগানটি গেছে ফেলে।
আমাদের সবার উচিত মা-বাবাকে সম্মান করা এবং যাদের মা নেই তাদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে চাই-
মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাইইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভূবনে নাই।

কোন মন্তব্য নেই: