শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০০৮

লাব্বায়েকা আলস্নাহুম্মা লাব্বায়েকা


লাব্বায়েকা আলস্নাহুম্মা লাব্বায়েকা



হজ্বের আভিধানিক অর্থ কোন স্থান দর্শনের সংকল্প করা। ইসলামের পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনসমূহে পবিত্র কাবাগৃহ ও নির্দিষ্ট কয়েকটি সম্মানীত স্থানে আলস্নাহ ও আলস্নাহর রাসূলের নির্দেশ অনুসারে অবস্থান করা, জিয়ারত করা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার নামই হজ্ব্‌। হজ্ব একটি গুরম্নত্বপূর্ণ ইবাদত। হজ্ব ইসলামের পঞ্চ রম্নকনের একটি অন্যতম রম্নকন। হজ্বের ফরজ তিনটি। যথা (১) ইহ্‌রাম বাঁধা অর্থাৎ হজ্বের নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করা (২) আরাফার ময়দানে উকুফ (অবস্থান করা) (৩) তাওয়াফে জিয়ারত করা। হজ্বের ওয়াজিব পাঁচটি । যথা (১) মুজদালিফায় অবস্থান করা(২) সাফা-মারওয়ায় সাঈ করা (৩) রমী করা (কংকর মারা) (৪) মাথার চুল মুন্ডানো অথবা ছোট করা (৫) বিদায়ী তাওয়াফ করা। এছাড়াও হজ্বে অনেকগুলো সুন্নত কাজ রয়েছে। ইসলামে হজ্বের তাৎপর্য ও গুরম্নত্ব অপরিসীম। হজ্ব সম্পর্কে আলস্নাহ-তায়ালা বলেন, “মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থø আছে আলস্নাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহে হজ্ব করা তার অবশ্য কর্তব্য”।
মহান আলস্নাহ তায়ালা হাকিম ও প্রজ্ঞাময়। ভূমণ্ডল এবং নভোমণ্ডলের কোন কিছুই তাঁর হেকমত এবং রহস্য থেকে বঞ্চিত নয়। আলস্নাহ তায়ালার লড়্গ লড়্গ হেকমতের মধ্যে কল্যাণ ও রহস্য লুকায়িত রয়েছে, যা মানুষের ধ্যান-ধারণার বাইরে। পবিত্র হজ্বের হুকুম প্রবর্তনের মধ্যে দু’টি বিষয় সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণঃ (১) হজ্ব পরকালের সফরের এক বিশেষ নিদর্শন (২) আলস্নাহর ইশ্‌ক ও মহব্বত প্রকাশ করা এবং রম্নহকে প্রেম ও ভালবাসার রঞ্জিত করার এক অপূর্ব দৃশ্য।
হজ্ব পরকালের সফরের এক বিশেষ নিদর্শনঃ আলেমগণ হজ্বের সফরকে পরকালের সফরের সাথে তুলনা করেছেন। কালের যাত্রীকে আত্মীয়-স্বজন, ঘর-বাড়ী, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী-সন্তôান সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হয়। হজ্ব পালনকারী যখন হজ্বের সংকল্প করে বের হয় অনুরূপ পরকালের যাত্রীর ন্যায় এসব কিছু ত্যাগ করে যেতে হয়। পরকালের যাত্রীকে যেমন সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে খাটিয়ায় সাওয়ার করানো হয়, তেমনি হজ্ব যাত্রী মৃত ব্যক্তির কাফনের ন্যায় ইহ্‌রামের দু’টুকরা শ্বেত শুভ্র সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করে যানবাহনে আরোহণ করে। কিয়ামত দিবসে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেয়ার মত হজ্ব পালনকারীর কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে “লাব্বায়কা আলস্নাহুম্মা লাব্বায়ক লা শারীকা লাকা লাব্বায়ক; ইন্নাল হামদা ওয়ান্‌নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মূল্‌ক। লা শারীকা লাক্‌। মৃত্যুর পর যেমন ছোয়াল জওয়াবের সম্মুখীন হতে হবে তেমনি হজ্বের সফরে হাজীদেরকে বিমান বন্দরসহ সংশিস্নষ্ট স্থানে সরকারি-বেসরকারি লোকদের নিকট বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণাসহ পরীড়্গা-নিরীড়্গার সম্মুখীন হতে হয়। মক্কা শরীফে প্রবেশ করা যেন ঐ জাহানে প্রবেশ করা যেখানে শুধুই আলস্নাহর রহমত। বায়তুলাহ শরীফের চতুরদিকে প্রদড়্গিণ করা আরশে আজিমের চুতুরদিক প্রদড়্গিণ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সাফা ও মারওয়া সাঈ করা হাশরের ময়দানে দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছুটা-ছুটি করার ন্যায়। সূর্যের প্রচণ্ড খরতাপে আরাফার ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অবস্থান যেন হাশরের মাঠের সাদৃশ্য। হজ্বের প্রতিটি আমলেই হাজীগণের সামনে কিয়ামতের চিত্র ভেসে উঠে।
আলস্নাহর ইশ্‌ক ও মহব্বত প্রকাশ করা এবং রম্নহকে প্রকৃত প্রেম ও ভালবাসায় রঞ্জিত করার এক অপূর্ব দৃশ্যঃ হজ্ব আলস্নাহ্‌ পাকের ইশ্‌ক ও মহব্বত প্রকাশ করার এক অপূর্ব দৃশ্য। প্রেম আকর্ষণে মাতোয়ারা প্রেমিকের ন্যায় হাজীর অন্তর্ôআত্মায় আলস্নাহ রাব্বুল আলামীনের ইশ্‌কের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। দারম্নণ আগ্রহ-উদ্দীপনায় হাজী সাহেবগণ তাঁর মহান দরবারে ভিড় জমায়। আলস্নাহ্‌ পাকও চান তাঁর ইশকে প্রেমিকগণ পাগল বেশে এভাবে তাঁর নিকট ছুটে আসুক।

হাজীগণ আলস্নাহর সান্নিধ্য পেতে তাঁর ইশকে মাতোয়ারা হয়ে সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরিধান করে পাগল ও ফকিরের বেশে এলোমেলো চুল-দাড়ি নিয়ে মাঠ-ঘাট, পাহাড়-পর্বত, নদী, সাগর-মহাসাগর, বন-জঙ্গল, মরম্ন প্রান্তôর অতিক্রম করে চিৎকার দিয়ে “লাব্বায়কা আলস্নাহুম্মা লাব্বায়ক ------- উচ্চারিত করে ছুটে চলে বায়তুলার উদ্দেশ্যে। পবিত্র মক্কা এবং মদিনায় পৌঁছে একজন হাজী মনে করে জান্নাতে পৌঁছে গেছিআর আবেগ সমুদ্র এতটাই ত্বরঙ্গায়িত হয় যা বর্ণনা করা এবং অনুধাবন করা কঠিন। ইহ্‌রাম বাঁধা প্রকৃত প্রেমিক হওয়ার এক জ্বলন্তô নিদর্শন। হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া, মুল্‌তাজামে জড়িয়ে ধরা, কা’বার চৌকাঠে মাথা ঠুকে কান্না-কাটি করা, বায়তুলার চতুর্দিকে প্রদড়্গিণ করা ইশ্‌কে ইলাহীর অনুপম দুশ্য। তারপর সাফা-মারওয়া দৌড়া-দৌড়ি, মিনায় গমন, আরাফায় অবস্থান, খোলা আকাশের নিচে ধূলি-ধূসরিত কঙ্করময় মুযদালিফায় রাত্রি যাপন প্রতিটি আমলেই আলস্নাহর প্রেমের প্রতিফলন। জামরাতে শয়তানকে প্রতীকী পাথর নিড়্গেপ, পশু কোরবানী ও মাথা মোন্ডানোর মাধ্যমে অনুরাগের শেষ মঞ্জিল অতিক্রম করে নিষ্পাপ শিশুর মত হাজী সাহেবগণ নিজ মোকামে ফিরে আসলেও তাঁদের অন্তôরে জ্বলতে থাকে পুনঃমিলনের অর্নিবাণ শিখা।
হজ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তôর্জাতিক গুরম্নত্বঃ রাজনৈতিক, আন্তôর্জাতিক ও সামাজিক প্রেড়্গাপটে হজ্বের গুরম্নত্ব অপরিসীম। বর্তমান সমস্যা সংকুল বিশ্বে ইসলামের উন্নয়নের ড়্গেত্রে ইসলামী চিন্তôাবিদগণ হজ্ব মৌসুমে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। হজ্ব মুসলিম উম্মার ধর্মীয় চেতনায় উদীপ্ত হওয়ার এবং আপোষ একতা ও সম্পর্ক স্থাপনের সিঁড়ি।

হজ্বের সমাবেশে ইসলামী জনতা, দেশ, জাতি, ভাষা, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি বৈষম্য অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের মহান সুযোগ পায়। হজ্বের বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন “মুুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই” এর বাস্তôব দৃশ্য। হজ্বের পোশাক চাল-চলন সুশৃংখল জীবন ব্যবস্থার নিদর্শন। বিশ্ব রাজনীতিতে মানব গোষ্ঠীর মধ্যে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হজ্ব একটি সার্থক এবং সফল আমল। এখানে ধনী-গরীব, বাদশা-ফকির, সাদা-কালো, ভিন্ন শারীরিক কাঠামো, ভিন্ন ভাষার মানব জাতির একই বেশ ভূষা, একই আমল এবং একই স্থানে একত্রে জীবন যাপন। সারা বিশ্বের মানুষের সামাজিক জীবন ব্যবস্থার খোঁজ-খবর নেয়ার, বিভিন্ন দেশের আলেম, জ্ঞানী-গুণীদের সান্নিধ্য পাওয়ার বিশেষ সুযোগ এনে দেয় হজ্ব। ইসলামের পবিত্র স্থান মক্কা মদিনায় ঐতিহাসিক বহু ইসলামিক নিদর্শন দর্শনসহ রসুল পাক (সাঃ), তাঁর আওলাদ ও তাঁর সাহাবা একরামদের (রাঃ) স্মৃতিসমূহ স্ব-চড়্গে দর্শনের অপূর্ব ব্যবস্থা হজ্ব। বিশ্ব মানবতার ঐক্য সংহতি চেতনা জাগ্রতসহ পরকালের মুক্তির মহান ব্যবস্থা হজ্ব।
মহান আলস্নাহপাক যেন আমাদের সকলকে হজ্বের তাৎপর্য ও গুরম্নত্ব অনুধাবন করে সঠিক ভাবে হজ্ব পালন করার তওফিক দান করেন।

আলহাজ্ব মোঃ ইমান আলী

কোন মন্তব্য নেই: