শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর, ২০০৮

সুদের ব্যবসা মু’মিনের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়


সুদের ব্যবসা মু’মিনের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়



আলস্নাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের রব। তিনি আমাদেরকে সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। অন্য সকল সৃষ্টির মধ্যে মানব জাতিকে বেশি ভালবাসেন। আলস্নাহতায়ালা কখনোই চান না যে, তার কোন বান্দা জাহান্নামের আগুনে ভস্মিভূত হোক। সে জন্য তিনি এই পৃথিবীতে আমাদের চলার পথের গাইড বুক দান করেছেন। যার নাম কুরআনুল কারীম। এই কুরআনুল কারীমে ৬৬৬৬টি আয়াত রয়েছে। যার প্রতিটি আয়াত মেনে চলা মুমিন মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। অথচ মনের অজান্তেô অসতর্ক মুহূর্তে প্রতিদিন অসংখ্য আয়াত আমরা লঙ্ঘন করে চলেছি। যেমন সুদের বিষয়টিই ধরম্নন। কুরআনে কিন্তু সুদকে হারাম করা হয়েছে তার পরেও মানুষ তা অনায়াসে গ্রহণ করে চলেছেন।

এর মাধ্যমে যে, তার সকল ইবাদত বন্দেগী, দান সাদকা বা আমলসমূহ ধ্বংস হচ্ছে সে ব্যাপারে যেন তার কোন মাথা ব্যথা নেই। এ কারণেই সতর্কতার জন্য এই আলোচনা । মহান আলস্নাহতায়ালা কুরআনে ঘোষণা করেছেন। আহালস্নালস্নাহুল বাইয়া অ হাররামার রিবা অর্থাৎ ব্যবসাকে হালাল করা হলো আর সুদকে হারাম করা হলো। (সুরা বাকারা-২৭৬ আয়াত)। কুরআনে এভাবে সাত এর অধিক আয়াত ও চলিস্নশটির বেশি সহীহ হাদীসে সুদকে স্পষ্ট হারাম হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এখন কুরআনে একটি আয়াতের দিকে লড়্গ্য করম্নন যেখানে বলা হচ্ছে মানলাম ইয়াহকুম বিমা আনযালালস্নাহু ফাউলাইকা হুমুল কাফেরম্নন। অর্থাৎ যারা আলস্নাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার ফায়সালা করে না তারা কাফের হিসাবে বিবেচিত হয়। যদি কুরআনের একটি আয়াত অমান্য করলে কেউ কাফেরে পরিগণিত হয়।

তাহলে যারা সুদ খাওয়া বন্ধ না করে আলস্নাহর কুরআনের ঐ সমস্তô আয়াতগুলো অস্বীকার করে চলেছেন। তারা কিভাবে মুসলমান থাকেন? পরিপূর্ণ মুসলমান হওয়ার পূর্বশর্ত হলো তিনি ইসলামে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রবেশ করবেন। যদি কেউ ইসলামের সুবিধামূলক বিষয়গুলো গ্রহণ করেন। আর কঠিন ও কষ্টকর বিষয়গুলো অবজ্ঞা ও অমান্য করেন। তাহলে তার পরিণিতি সম্পর্কে আলস্নাহতায়ালা সুরা বাকারায় বলেন, যদি তোমাদের কেউ কুরআনের এক অংশ মান্য করে ও অন্য অংশ ভুলে যায় বা অমান্য করে তাহলে তাকে দুনিয়ায় লাঞ্ছনাগঞ্জনা অপমানের জীবন দেয়া হবে আর পরকালে তাকে কঠিন আজাবে পাকড়াও করা হবে। সুতরাং প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমান হতে হলে অবশ্যই তাকে কুরআনের প্রতিটি আদেশ নিষেধ মেনে চলতে হবে। সুদ তেমনি নিষিদ্ধ বিষয়ের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য একটি। সুদ কেবল ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ তাই নয়। অন্যান্য ধর্মেও সুদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন খৃষ্টধর্মে সুদ সম্পর্কে বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি সুদ ও সুদের বৃদ্ধি নিয়ে ধন বাড়ায় তার সকল প্রার্থনা ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যাত ।

অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি ধার্মিক হয়, সুদের লোভে ঋণ না দেয়, তবে সে ব্যক্তি ধার্মিক, সে অবশ্যই বাঁচবে। আরো বলা হয়েছে, ঋণ দাও, বিনিময়ে কিছু প্রত্যাশা করো না। দার্শনিক এ্যারিস্টোটল তার পলিটিক্স গ্রন্থের মধ্যে উলেস্নখ করেছেন, সুদ হলো মানুষের সাথে এক ধরনের জালিয়াতি করা, অন্য আর একজন দার্শনিক পেস্নটো তার ল’স নামক গ্রন্থের মধ্যে উলেস্নখ করেছেন, সুদ হলো সমাজের সবচেয়ে নিন্দনীয় কাজ। থমাস বলেন, সুদ হলো এক প্রকার অবিচার। হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রাণ পুরম্নষ মনু বলেন, কোন উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণও যদি সুদ খায় তাহলে তার সাথে নিম্নবর্ণের শুদ্রের মত আচরণ করবে। হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ পুরাণে বলা হয়েছে চিকিৎষস্য ভিড়্গোশ্চ তথা বার্ধুষিকস্য চ, পাষন্ডস্য নৈবান্নং ভুঞ্জিত নাস্তিôকস্য চ’ অর্থাৎ চিকিৎসক, ভিড়্গুক, সুদখোর, পাষন্ড ও নাস্তিôকের অন্ন ভড়্গণ করবে না। এখানে উলেস্নখ্য যে, সুদকে হিন্দু শাস্ত্রে এতটাই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে যে, তার বাড়িতে ভড়্গণ করতেও নিষেধ করা হয়েছে। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্লমার্কসও সুদ ও সুদখোরদের তীব্র সমালোচনা ও ঘৃণার চোখে দেখেছেন এবং বলেছেন, সুদখোরদের শাস্তিô প্রদান ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার। এমনিভাবে বৌদ্ধ ধর্মে ও ইহুদী ধর্মসহ সকল ধর্ম এবং ধর্ম বিশেষজ্ঞদের অভিব্যক্তির মাধ্যমে সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উচ্চারিত হয়েছে।
আমাদের প্রিয় নবীজী (সঃ) যিনি আমাদের আদর্শ। তিনি আমাদের জন্য এ বিষয়ে কি বাস্তôব নিদর্শন রেখে গিয়েছেন। একদিন মহানবী (সঃ)-এর সমীপে হযরত বেলাল (রাঃ) কিছু উন্নতমানের খেজুর নিয়ে হাজির হলেন, রাসুল (সঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথা হতে এ খেজুর আনলে? বেলাল উত্তর দিলেন, আমাদের খেজুর নিকৃষ্টমানের ছিল। তাই আমি দ্বিগুণ পরিমাণ খারাপ খেজুরের পরিবর্তে একগুণ ভাল খেজুর বদলিয়ে নিয়েছি। রাসুল (সঃ) বললেন, এতো নির্ভেজাল সুদ (সহীহ বুখারী)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আলস্নাহর নবী (সঃ) বলেছেন মিরাজের যে রাত্রে আমাকে যখন জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আমি কিছু লোককে দেখলাম, যাদের পেট ঘটের মত এবং বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল তাদের পেটগুলো সাপে পরিপূর্ণ। আমি জিব্রাইল (সঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? জিব্রাইল (আঃ) আমাকে বললেন, এরা ঐ সকল লোক, যারা দুনিয়ায় সুদ খেত (ইবনে মাজাহ)।

অপর হাদীসে বলা হয়েছে সুদের সত্তর প্রকার গোনাহ আছে তার মধ্যে ছোট গোনাহ হলো নিজের আপন মায়ের সাথে ব্যভিচার করা (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)। হযরত আবদুলস্না ইবনে হানজালা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুলস্নাহ (সঃ) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যদি এক দিরহাম সুদ জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে তাহলে তা ছত্রিশবার ব্যভিচার করার চেয়েও কঠিন গোনাহ তার নামে লেখা হবে। (মুসনাদে আহমাদ, মেশকাত)। রাসুল (সঃ) বলেছেন, চার প্রকার লোককে আলস্নাহর জান্নাতে যাওয়ার জন্য কোন প্রকার অনুমতি নেই।

১। যারা অতিরিক্ত মদ পান করে

২। যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতিমের মাল গ্রহণ করে।

৩। যারা মাতা-পিতার অবাধ্য।

৪। যারা সুদখোর বা সুদী কারবারে জড়িত।

হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, যদি তুমি কোন লোককে ঋণ দাও এবং সে তোমাকে একবেলা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে, তবে তার বাড়ীতে খাবে না, কারণ এটি সুদ। কিন্তু যদি সে তোমাকে ঋণ নেওয়ার আগে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানায় তাহলে খেতে পার (বায়হাকী)। রাসুলুলস্নাহ (সঃ) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যদি কারো ধার বা কর্য প্রদান করে সেই ধার গ্রহণকারীর নিকট হতে কোন প্রকার উপহার সামগ্রী গ্রহণ করা যাবে না। (সহীহ বুখারী)। হযরত আবু উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত মহানবী (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আপন ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করে এবং তার বিনিময়ে কোন উপহার গ্রহণ করে, সে যেন কোন এক বড় দরজা দিয়ে সুদের মধ্যে প্রবেশ করল (আবু দাউদ, মেশকাত)। রাসুলুলস্নাহ (সঃ) বলেছেন, যদি কেহ বেশি বেশি সুদে লেনদেন করে তবে তার পরিণতি লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। তাছাড়া বিদায় হজ্বের ভাষণের সময় মহানবী (সঃ) বলেছিলেন।
আজকের দিবসে সকল প্রকার সুদ রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমার চাচা আব্দুলস্নাহ ইবনে আব্বাস এর সুদ রহিত করা হলো। রাসুলুলস্নাহর (সঃ) এই ঘোষণার পর উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফতের পরও প্রায় নয়শত বছর পর্যন্তô অর্ধ পৃথিবীতে সুদের কোন অস্তিôত্ব ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে এই সুদের বিষবাষ্প দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। সুদখোরদের বোঝা উচিত যেহেতু সুদ হারাম। এর মাধ্যমে উপার্জিত অর্থও হারাম। আর তা খেয়ে যতই তারা ইবাদত বন্দেগী করম্নক না কেন।

কোন ইবাদত তাদের কবুল হবে না। তাছাড়া পরকালে আলস্নাহর সামনে জবাবদিহিতার মন-মানসিকতা নিয়ে সবাই যদি আমরা চলতে পারি তাহলে অবশ্যই সুদের অভিশাপ হতে মুক্ত হয়ে আমরা আলস্নাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবো।


হোসাইন আল -খলদুন

কোন মন্তব্য নেই: