সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০০৮

প্রযুক্তি মুসলমানদের হারানো

প্রযুক্তি মুসলমানদের হারানো সম্পদ



আধুনিক যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যারা যত সমৃদ্ধ তারা তত উন্নত ও শক্তিধর। বর্তমানে মুসলমানরা পৃথিবীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে দ্বিতীয় হলেও বাস্তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অথচ বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, চিকিৎসা, সাহিত্যসহ আরো অনেক শাস্ত্রে মুসলমানরাই সর্বপ্রথম অগাধ জ্ঞান লাভ করেছিল। মুসা আল খাওয়ারিজমি, ইবনেসিনা, জাবির ইবনে হাইয়ান, আবু বকর আল রামি, হাসান ইবন হাইসাম, আল বিরুনি, ইমাম বোখারি, ইবন জারির তাবারি, ইমাম গাজ্‌জালি, ওমর খৈয়াম, কবি ফেরদৌস প্রমুখ ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয়ে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। কিন্তু বর্তমান মুসলমানরা জ্ঞান আহরণের অভাবে কুসংস্কারসহ বিভিন্ন গোঁড়ামির কারণে সেসব ইতিহাস ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছেন। আমাদের সবার জানা উচিত, ইসলাম নির্দেশিত জ্ঞান বলতে কেবল ধর্মীয় জ্ঞানকেই বোঝায়নি। ‘যারা হিকমত (বিশেষ জ্ঞান) লাভ করেছে তারা পরম সম্পদের অধিকারী।’ এ হিকমতের মুখ্য অর্থ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। মহানবী সাঃ-এর ইন্তেকালের পর তার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে আরো মহিমান্বিত করে তোলেন। জ্ঞানের দীপশিখা হাতে নিয়ে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েন। প্রতিষ্ঠা করেন অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞানাগার। স্রষ্টা জীবন-প্রকৃতি সব কিছু নিয়েই গবেষণা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ‘তোমরা যে বীজ বপন করো সে বিষয়ে ভেবেছ কি?’ (সূরা ওয়াকিয়া-৬৩)। ‘তোমরা যে পানি পান করো সে বিষয়ে চিন্তা করেছ কি?’ ‘(সূরা ওয়াকিয়া-৬৮)। এক কথায় বিশ্ব জগতের সব কিছু নিয়ে আল্লাহ মানুষকে ভাবতে ও গবেষণা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ‘আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি বিষয়ে এবং দিন ও রাতের আর্বতনে সেসব বুদ্ধিমান লোকদের জন্য অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে, যারা উঠতে বসতে ও শুতে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি এবং গঠন সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণা করে। তারা বলে ওঠে হে আল্লাহ, তুমি এর কোনো কিছু বৃথা সৃষ্টি করোনি।’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৯০-১৯১)। মানব কল্যাণের বাহক সব ধরনের এলেমই জরুরি। মানবতার কল্যাণ হবে এমন সব ধরনের এলেমই ইসলামে কাম্য। মৌলিক মানবিক জ্ঞান সব মানুষের জন্য এক ও অভিন্ন। ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরজ।’ ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ করো।’ মহানবী সাঃ-এর বাণী সবার জন্য প্রযোজ্য। আল কুরআনে বিরাশি বার নামাজের তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি নিরানব্বই বার জ্ঞান চর্চার বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাই ধর্মীয় জ্ঞানের সাথে সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ ব্যবহারিক জীবনের জ্ঞান অর্জনও অতীব জরুরি। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম শিক্ষাদীক্ষায় বেশি প্রসার ঘটেছিল স্পেন ও ইরাকের বাগদাদে। কিন্তু এখন সেসব দেশের মুসলমানদের কাছেও শিক্ষা-দীক্ষা অবহেলার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মুসলিম বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। মধ্যপ্রাচ্যের ২২টি মুসলিম দেশে যেখানে বছরে মাত্র ৩০০টির মতো বই অনুবাদ করা হয় সেখানে ইউরোপের একটি ক্ষুদ্র দেশ গ্রিসে বছরে ৫০০টির মতো বই অনুবাদ করে। রাশিয়া, ইতালি, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানির মাতৃভাষা কিন্তু ইংরেজি নয়, এসব দেশের বিজ্ঞানীরা একমাত্র মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করেই নিজেদের পৃথিবীতে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশগুলোতে ভাষান্তর করার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা গোটা পৃথিবীর যেকোনো বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য প্রকাশিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই মাতৃভাষায় রূপান্তর করে সরবরাহ করে থাকে। সে রকম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশসহ সবগুলো মুসলিম রাষ্ট্রেই জরুরি। নচেত সৃজনশীল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় অগ্রগতি আসবে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে ইরান ও মালয়েশিয়ার মতো কয়েকটি দেশ ছাড়া আর সব মুসলিম দেশের অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। গ্রহ-গ্রহান্তরে বিভিন্ন মহাশূন্যযান প্রেরণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মহাশূন্যে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করছে আমেরিকা, রাশিয়া। সম্প্রতি ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে বিগ ব্যাং পরীক্ষার মাধ্যমে সৌরজগৎ সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। চীন ও জাপান প্রযুক্তিগত উন্নতির মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্যে অভাবনীয় আধিপত্য বিস্তার করছে অথচ মুসলিম দেশগুলোর কোনো বিষয়েই উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই। সিঙ্গাপুর পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশে মোট প্রয়োজনের সবটুকু পানিই কিনতে হয়। তবুও সিঙ্গাপুরের জিডিপি বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রায় ৪০ গুণ। প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস, তেল, ইউরেনিয়াম থাকা সত্ত্বেও উন্নত প্রযুক্তির অভাবে বাংলাদেশ গরিব দেশ। যেমন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ আইভরি কোস্ট, ইথিওপিয়া, সিয়েরালিওন, সোমালিয়ায় অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আছে কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি নেই বিধায় গরিব দেশের তালিকায় পড়ে রয়েছে। এ দিকে প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন না থাকলেও উন্নত প্রযুক্তি থাকার কারণে সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি প্রভৃতি দেশ অনেক উন্নত। বর্তমানে চীন ও জাপানের প্রযুক্তি সবচেয়ে উন্নত। তাই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে যে পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হয় জাপানে একই পরিমাণ জমিতে চার গুণ আর চীনে তিন গুণ ফসল উৎপন্ন হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে যে ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে তা উঠাতে পারলে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম একটি ধনী দেশে পরিণত হবে। কিন্তু উঠাবে কিভাবে, আমাদের তো সে রকম প্রযুক্তি নেই। বরং পাট শিল্পের মতো বিশাল শিল্পকে আমরা প্রযুক্তির অভাবে ধ্বংস করে ফেলেছি। এভাবে চললে বাংলাদেশসহ সব মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে বাধ্য। এ দোষ কার! স্রষ্টার, না আমাদের! মুসলমানরা বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে কিন্তু চেষ্টা, পরিশ্রম ও গবেষণা করে না। মসজিদে, মাদ্রাসায় দারিদ্র্য দূরীকরণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো ভূমিকা নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রতি কোনো উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ করা যায় না। অলস, অকর্মণ্য আর পরনির্ভরশীল হওয়ার শিক্ষা ঠিকই চলছে। ইহকালের বাস্তবতাকে ভুলে পরকালের সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছে। ফলে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, খেলাধুলা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ছে। ইবাদতের উছিলায় খানকায় বা মসজিদে বসে থেকে স্বেচ্ছায় দরিদ্রতা বরণ করে নিতে, লোকদের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা চাইতে বা মানুষের সাহায্যের ওপর বেঁচে থাকতে বলেনি ইসলাম। অলসতা আর ভিক্ষাবৃত্তির শিক্ষা ইসলামে নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ইসলামের শিক্ষা কর্মের শিক্ষা, চিন্তা ও গবেষণার শিক্ষা। ‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো, আর আল্লাহর অনুগ্রহ তথা জীবিকা অন্বেষণ করো।’ (সূরা জুমআ, আয়াত-১১)। ধর্মকর্মও করতে হবে আবার আমলে সালেহও করতে হবে। ‘যারা ঈমান এনেছে এবং আমলে সালেহ (সৎ কাজ, ভালো কাজ বা মানবকল্যাণ) করেছে তারাই জান্নাতি।’ ইহকালে যখন মুসলিম দেশগুলো অন্য ধর্মাবলম্বীদের মন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে, কুরআন অবমাননা হচ্ছে, নবীজীকে অবমাননা করা হচ্ছে, বায়তুল মুকাদ্দাসের মতো পবিত্র স্থান মুসলমানদের হাতছাড়া, অমুসলিম শক্তিগুলো মুসলমানদের গ্রাস করতে চলেছে, তখন মুসলমানরা পরকালে বেহেশতে যাওয়ার দোয়া করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছে। এসবই ঘটছে মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল কুরআনে প্রায় সাড়ে সাত শ’ আয়াত রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত। আজ ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও মূর্খতাকে ঝেড়ে ফেলে মুসলমানদের উচিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা, গবেষণাসহ সর্ববিষয়ে অগাধ জ্ঞান লাভ করে শির উঁচু করে দাঁড়ানো। জুমার নামাজসহ প্রত্যেক নামাজে, ওয়াজ মাহফিলে, মিলাদে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য দোয়া করা এবং তদানুযায়ী চেষ্টা, গবেষণা ও পরিশ্রম করা। তাহলেই মুসলমানদের তাদের হারানো ঐতিহ্য, শৌর্য-বীর্য এবং ক্ষমতা ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজেরাই সচেষ্ট হতে হবে। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়।’ (সূরা জুমআ, আয়াত-১১)।

কোন মন্তব্য নেই: