সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০০৮

মেয়েদের ইসলামী শিক্ষা


মেয়েদের ইসলামী শিক্ষা

নর-নারীকে আল্লাহতায়ালা এমন গঠন, আকৃতি ও স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যা সম্পূর্ণ ভিন্নতর, অথচ একের প্রতি অপরের আকর্ষণ অত্যন্ত প্রবল। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতামূলক ভূমিকার অবদানেই গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন এ পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম আঃ-কে দ্বীনের বাহক মনোনীত করে নবুয়তি প্রদান করেন এবং ইসলামি জীবনধারা অনুযায়ী চলার নির্দেশ দেন। মানুষকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী চলার জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য পরস্পর ধারায় বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ্‌ তায়ালা অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। এই বিপুলসংখ্যক নবী ও রাসূলের সময়ে যারা তাদের কথায় ইমান এনে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করেছেন এবং করছেন তাদেরকে বলে ‘মুমিন’। আর যারা ইমান আনেনি এবং আল্লাহর বিধানের বিপরীতে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো জীবনযাপন করেছে ও করছে তাদের বলে ‘মুশরিক’ বা ‘কাফির’। প্রাচীন যুগে ওই সব কাফির আল্লাহর বিধান অমান্য করে নারীর প্রতি করেছে নির্মম অমানুষিক অত্যাচার ও জুলুম। তারা নারীকে মনে করত পুরুষের ভোগের উপকরণ। তাদেরকে বাজারে পণ্যদ্রব্যের মতো বেচাকেনা করত। ওই সব যুগে নারীর মানসম্মান রক্ষা করা হতো না। ছিল না তাদের ইজ্জত ও আবরু রক্ষা করার অধিকার। তাদের প্রতি জুলুম-অত্যাচার, হত্যা-ধর্ষণ ইত্যাদি ছিল নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। নারী জাতির প্রতি ওই সব অত্যাচার আবহমানকাল ধরে চলে আসছিল। অবশেষে সর্বযুগের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মোহাম্মাদ সাঃ-এর আবির্ভাবের পর আল্লাহ তায়ালা তাকে নবুয়াত দান করে মানুষের মঙ্গলের জন্য তার ওপর কুরআন বা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান নাজিল করেন। এই কুরআনই বর্তমান দুনিয়ার মানুষের মুক্তির সনদ। আল্লাহ-প্রেরিত মুক্তিসনদ অনুযায়ী চলার জন্য প্রিয় নবী মানবজাতির প্রতি বিভিন্ন সময়ে রেখেছেন আকুল আবেদন। তিনি শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, মজলুম নর-নারীকে জালেমের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে দান করেছেন নতুন জীবন। লাঞ্ছিতা, অপমানিতা অধিকারহীনা নারীসমাজকে অধিষ্ঠিত করেছেন সম্মানের আসনে। দান করেছেন তাদের পিতা-মাতা ও স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তির অধিকার। বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময় মোহরানার অধিকার দান করে নারীকে করেছেন সম্মানিত। তিনিই নারী জাতিকে স্বীয় মর্জি মোতাবেক বিয়ে করার অধিকার দান করেছেন। তিনি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে গরমিল দেখা দিলে তালাক লাভের অধিকার প্রদান করেন। তিনিই সর্বপ্রথম নারী জাতিকে বিদ্যাশিক্ষার প্রতি আহ্বান করেছেন। এক কথায় নারী জাতিকে একটি সম্মানিত জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করার সম্পূর্ণ সুযোগ দান করেছেন। প্রকৃতপক্ষে করুণাময় আল্লাহ তায়ালা নারী জাতিকে সৃষ্টি করেছেন মানবজাতির বংশ বৃদ্ধির জন্য। কোনো পুরুষের পক্ষে যেমন নারীর বিশেষ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়, তেমনি নারীর পক্ষেও পুরুষের কঠিন কার্যাবলি আনজাম দেয়া সম্ভব নয়। নারী জাতির প্রথম কর্মক্ষেত্র বিশেষ করে গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান, দুগ্ধদান, শিশু প্রতিপালন প্রতিটি স্তর নারীকে পূর্ণ মনোযোগের সাথে চালিয়ে যেতে হয়। মুসলমান নারীদের বিদ্যার্জন শেষে তাদের রূপ-যৌবন আবৃত করে, শালীনতা বজায় রেখে প্রয়োজনবোধে রুটি-রোজগার ও বাইরে চলাফেরা করতে আল্লাহর বিধানে কোনো নিষেধ নেই। ইসলাম পুরুষের মতো নারীর জন্যও শিক্ষালাভ ফরজ করেছে এবং শিক্ষার সাথে সাথে প্রশিক্ষণের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। নারীর প্রশিক্ষণের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক বিষয় হচ্ছে তার মধ্যে সততা, লজ্জা, নম্রতা, ইজ্জত ও পবিত্রতার অনুভূতি সৃষ্টি করা। এসব গুণকে তার অভ্যাসে পরিণত করা। একটি জাতির উন্নতি, অগ্রগতি, অবনতি নির্ভর করে তাদের সন্তানসন্ততির শিক্ষাদীক্ষার ওপর এবং এই শিক্ষা অধিকতর নির্ভর করে তাদের মায়েদের ওপর। মা যদি শিক্ষিত, নেক্‌কার, জ্ঞানী, চরিত্রবতী, বুদ্ধিমতী ও সচেতন হন তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের সন্তানরাও ওই সব গুণে গুণী হবে। একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে নারীসমাজের সুষ্ঠু শিক্ষার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিক্ষিত মেয়ে যে ঘরে প্রবেশ করবে সেটি আলোকিত হবে এবং তার ঘরে যে সন্তান জন্ম নেবে তারাও শিক্ষিত হবে। তাদের নৈতিক চরিত্র উত্তম হবে। একমাত্র ধর্মভীরু ও শিক্ষিতা মায়ের হাত বুলানো পরামর্শই পারে সন্তানকে মিথ্যা প্রবঞ্চনা, বেহায়াপনা, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, অবৈধ অর্থ উপার্জন, অন্যের হক হরণ ইত্যাদি থেকে বিরত রাখতে। এ জন্য কন্যাসন্তানকে প্রাথমিক অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে পৃথকভাবে ইসলামি রীতি অনুযায়ী শিক্ষিত করে তোলা একান্ত আবশ্যক। সুফি, দরবেশ, বুজুর্গ পীর, আওলিয়া, বুদ্ধিজীবী, সমাজহিতৈষী ব্যক্তিদের জীবনী পড়লেই দেখা যায় তারা তাদের মায়ের সম্পর্কে গর্ব করে বলেছেন, আমার মা নেক্‌কার ছিলেন, খোদাভক্ত বুজুর্গ ছিলেন বলেই আমি জীবনের উচ্চ সিঁড়িতে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছি। মোট কথা, গৃহজীবনে নারীর চরিত্রই অধিকতর প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। কাজেই মেয়েদের শিক্ষা যদি ভালো হয়, তবে পরিণামও ভালো হবে। এক কথায় আমাদের মেয়েদের বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা প্রদান করতে হবে এবং সাথে সাথে ইসলামি চরিত্র ও তার মূল্যবোধ জাগরিত করতে হবে এবং তখনই তা সম্ভব হবে যখন অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে তারা ইসলামি আমল-আখলাক ও শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে উঠবে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, গোটা উপমহাদেশে আগে মেয়েদের এমন কোনো পৃথক শিক্ষায়তন বা মহিলা মাদ্রাসা ছিল না যেখানে পৃথকভাবে মহিলারা দ্বীনি শিক্ষা নিয়ে ধর্মীয় উচ্চশিক্ষা দানে সহযোগিতা করতে পারেন। তা ছাড়া তাদেরকে কেবল কুরআন-হাদিস শিক্ষা দিলেই চলবে না, সাথে সাথে আধুনিক শিক্ষাসহ অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানও শিক্ষা দিতে হবে। যাতে করে তারা সব ধরনের সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম হন এবং জাতীয় জীবনে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণসহ প্রয়োজনবোধে শালীনতা বজায় রেখে রুটি-রোজগার করতে পারেন। দেশে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার জন্য যথেষ্ট স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যমান আছে। কিন্তু যে সমাজে মেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষা ক্ষেত্র নেই সেই সমাজে মেয়েদের জন্য সঠিক ও সুষ্ঠু শিক্ষা সম্ভব নয়। মেয়েদেরকে সুষ্ঠু শিক্ষা দিতে হলে পৃথক মাদ্রাসার মাধ্যমে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে এবং পৃথক মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সদাশয় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। অবশ্য ইদানীং আরব বিশ্বের পর ভারত-পাকিস্তানসহ মুসলিম অধ্যুষিত অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র মাদ্রাসা, দেশের বিরাট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র মহিলা মাদ্রাসাগুলো শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। অবশ্য প্রয়োজনের তুলনায় মহিলা মাদ্রাসা অনেক কম। দেশে শিক্ষিত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে প্রত্যেকটি জেলা-উপজেলায় স্বতন্ত্র মহিলা মাদ্রাসা গড়ে তোলা একান্ত দরকার। মহিলা মাদ্রাসাগুলো চলার জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

কোন মন্তব্য নেই: