ইসলাম প্রচারের ইতিবাচক উপায় তাবলিগ
রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে শিল্পনগরী টঙ্গীতে তুরাগ নদীর তীরে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে এ ধরনের একটি সম্মিলনীর ব্যবস্খাপনায় বাংলাদেশের বিরাট অবদান রাখতে পারা নি:সন্দেহে মর্যাদা ও গৌরবের বিষয়। প্রায় চার দশক ধরে প্রতি বছর একই স্খানে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে এ যাবৎ নির্বিঘেí সব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেসরকারি আয়োজনে ও স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সবকিছু পরিচালিত হলেও স্খানীয় ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারিভাবেও এতে যথেষ্ট সহায়তা করা হয় এবং হয়েছে।
তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম গত শতাব্দীতে শুরু হওয়া একটি নতুন ধারা। শাব্দিকভাবে তাবলিগ অর্থ প্রচার হলেও এতে মূল আবেদন থাকে মুসলমানদের শরিয়া পালনে উদ্বুদ্ধ করা। ঐতিহ্যগতভাবে বা বংশধারা অনুযায়ী মুসলিম হয়েও যারা ইসলামি অনুশাসন ও আচার পালনে উদাসীন, ইসলামের বিধিনিষেধ জানার ও অনুধাবনের আগ্রহ যাদের কম, তাদের উদ্দীপিত করতেই এই কার্যক্রমের অবতারণা। ইসলামি জীবনধারা পরিচালনায় অনাগ্রহী কিংবা অসচেতন ব্যক্তিদের সজাগ করার জন্য দিল্লির এক ক্ষণজন্মা আলেমে দীন ও ইসলামি মনীষী এই নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। নিতান্ত সীমিত পর্যায়ে স্খানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে শুরু হলেও ফলপ্রসূ ও কার্যকারিতার কারণে তার প্রসার ঘটেছে অভাবনীয় গতিতে। এরই ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাবলিগের ইজতেমা বা সম্মেলন হয় প্রতি বছর। তবে বাংলাদেশেরটি জনসমাগমের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় হয়। লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে তুরাগ পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা মুখরিত হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী উচ্চারণ করে করে মুমিন বান্দারা নতুন প্রেরণা লাভ করেন। তারপর রব ও রাসূলের নির্দেশিত জীবন নির্বাহের দীক্ষা নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যান।তাবলিগ নামের নতুন কর্মধারা চালু হওয়ার পেছনে রয়েছে উল্লেখযোগ্য কারণ। বিষয়বস্তু ও নীতিমালায় নতুনত্ব না থাকলেও কর্মপদ্ধতি বিন্যাসে রয়েছে ব্যতিক্রমী অনুষঙ্গ। প্রয়োজনের তাগিদে সময়ের চাহিদা সামনে রেখে মুসলমানদের মধ্যে দীনি চেতনা উজ্জীবনের কৌশল হিসেবে এমনটি করা হয়েছে। পৃথিবীতে ইসলাম এসেছে মানবজাতির কল্যাণের বারতা নিয়ে। আশরাফুল মাখলুকাত বনি আদম জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা যেন আবারো জান্নাতে যেতে পারে সেজন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশিকা ও উপদেশমালার আগমন শুরু হয়েছে প্রথম থেকেই। মানুষ তা অনুসরণের ফলে যেমন পরজীবনে স্খায়ী সুখের নিবাস জান্নাতে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করবে, তেমনি তার দুনিয়াবি জীবনও হবে সুখময়, স্বাচ্ছন্দ্যময়। প্রথম মানব হজরত আদম আলাইহিস সালামের মাধ্যমে শুরু হয়ে আল্লাহর বিধিনির্দেশ আগমনের ধারা অব্যাহত থাকে। মানবজাতির ইহ ও পরকালীন জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও সাফল্যের একমাত্র নিয়ামক মহান স্রষ্টার পাঠানো নির্দেশাবলি পালন এবং সেগুলো পরিপালনে আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রদর্শিত আদর্শের অনুসরণ। অসংখ্য নবী-রাসূলের মাধ্যমে আদম সন্তানদের উদ্দেশ্যে বিধান ও নিয়মাবলি প্রেরণের পর চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণ জীবনবিধান নাজিল করা হয়েছে শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। সৃষ্টি জগৎ যত দিন টিকে থাকবে, ইনসান নামের আদম জাতি যত দিন পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকবে, সবশেষ আসমানি গ্রন্থ আল কুরআনুল করীম তত দিন বহাল ও কার্যকর থাকবে মানুষের অপরিবর্তনীয় বিধানগ্রন্থ হিসেবে।
ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে কুরআন মজিদ নাজিল হয়েছিল। বিশ্বমানবতা তখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। অনাচার ও দুর্বৃত্তপনায় চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই চরম দুর্দশাগ্রস্ত মানবসমাজকে সত্য ও সুন্দর পথের দিশা দেয়ার মতো কোনো শক্তি বা ব্যবস্খাপনার অস্তিত্ব ছিল না পৃথিবীতে। তখন মরু আরবের মক্কা নগরীতে আগমন করেন কুরাইশ নেতা আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আবদুল্লাহর ঘরে মুহাম্মদ নামের এক শিশু। মহান রাব্বুল আলামিনের ফয়সালা ছিল তাঁকে শেষ নবীর আসনে অভিষিক্ত করা। চল্লিশ বছর বয়সের সময় তিনি প্রথম ওহী লাভ করেন। আর দায়িত্ব পান পথভোলা মানুষকে প্রকৃত কল্যাণ ও সাফল্যের পথ দেখানোর। আল্লাহর কিতাব কুরআন মজিদের আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে তিনি নিজ গোত্র ও সম্প্রদায়ের লোকদের আহµান জানাতে থাকেন সব ধরনের অন্যায় ও অপরাধমূলক কাজকর্ম থেকে। ফিরে আসতে তাঁর এই দাওয়াতি কার্যক্রম নির্বিঘí ছিল না। পদে পদে প্রতিকূলতা ও বাধা থাকলেও তিনি আপন মিশনে অবিচল ছিলেন। প্রবল বাধা ও নিপীড়নের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। দীর্ঘ তের বছরে তেমন অগ্রসর হলো না ইসলামের প্রচার। তারপর তিনি হিজরত করলেন ইয়াছরিব বা মদিনায়। এখান থেকে ইসলামের প্রসার ঘটল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে মানুষের বিশ্বাস ও আন্তরিকতার সংস্কার করলেন। তাদের আচরণ ও নৈতিকতায় উন্নততম আদর্শের নমুনা প্রদর্শন করলেন। এত দিন যাদের জীবনাচারে সৌন্দর্য ও সৌজন্যের ছোঁয়া পায়নি, তারাই এক-একজন হয়ে উঠলেন আদর্শ মানুষ। এ ধরনের মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি সমাজ ও পরিবেশে শৃঙ্খলা ও অনাবিলতা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। তারপর বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবেলায় মৌখিক আহµান ও সুবচনে যখন কোনো ফল পাওয়া গেল না, বরং আরো আক্রমণের শিকার হতে হলো, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমতি এলো সশস্ত্র প্রতিরোধের। আল্লাহর নবী ও তাঁর সহচররা বিচলিত হলেন না। সব ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করলেন। বিরোধী শক্তি একে একে নত হতে থাকে। আরব উপদ্বীপে ইসলামের সমাদর ও গ্রহণীয়তার বিস্তার ঘটল অতুলনীয় পর্যায়ে।মহানবী সা:-এর ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও ইসলামের অগ্রযাত্রায় কোনো ছন্দপতন হয়নি। মাত্র দুই দশকের মধ্যে সমকালীন প্রধান দুই সাম্রাজ্য পূর্ব রোম ও পারস্যের পতন ঘটে মুসলমানদের হাতে। তখনকার অর্ধ পৃথিবীতে ইসলামের পতাকা উড়তে থাকে শান্তির বাণী ও ব্যবস্খার প্রতীক হিসেবে। সমরশক্তিতে এত দুর্বার গতিতে মুসলমানদের বিজয়ী হওয়া সম্ভব ছিল না। বরং একটি অনন্য জীবন দর্শন, বিশ্বাস ও কর্মের অপূর্ব সমন্বয়, নৈতিকতার অনুপম নমুনা এবং মানবসাম্য ও মানব মর্যাদার নজিরবিহীন মানদণ্ড উপস্খাপন করেছিলেন মুসলিম জনগোষ্ঠী। এরই সামনে পরাজিত হতে হয় সমকালীন সব শক্তিকে। এজন্য শাসন ক্ষমতা লাভই মুসলমানদের আসল কাম্য ছিল না বলে
বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী এই উম্মাহর পতাকাতলে স্বেচ্ছায় আশ্রয় নেয়।
মুসলমানরা যেমন ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবনে আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলের সুন্নাহ পালনে নিষ্ঠাবান ছিলেন, তেমনি কর্মকুশলে ও প্রজ্ঞায়ও পরিচয় দিয়েছিলেন অনন্যতার। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও জীবনোপকরণ উদ্ভাবনে মুসলিম মনীষীরা আত্মনিয়োগ করেছেন। রেখেছেন সাফল্যের যুগান্তকারী নজির। চড়াই উৎরাই হলেও সার্বিকভাবে ইসলামের প্রসার হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর গৌরব অক্ষুণí থেকেছে। কিন্তু এক পর্যায়ে মুসলমানদের যাত্রার গতিতে ছেদ পড়ে। অন্যান্য জাতি এগিয়ে যেতে থাকে। আর পিছিয়ে পড়ে মুসলিম জাতি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও প্রশাসনিক অঙ্গন থেকে ইসলাম অনুসারীরা বাদ পড়তে থাকে। শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার, ব্যবসায় কোনো ক্ষেত্রেই ইসলামি শিক্ষা ও ব্যবস্খা অবশিষ্ট রইল না। মুসলমানদের ব্যক্তিগত জীবনেও ইসলাম পালনে অবহেলা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে যখন ইসলামের শিক্ষালাভ করাও দুরূহ হয়ে পড়ে, তখন সাধারণভাবে মুসলমানরা নিজেদের ধর্ম ও ধর্মীয় কর্তব্য সম্পর্কেই অজ্ঞ থেকে যায়। ভারত বর্ষের মুসলমানদের অবস্খা এমনই ছিল। সেই পরাধীন যুগে ইসলামের শিক্ষা বজায় রাখার জন্য যেমন ইসলামি মনীষীরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন, আর এজন্য বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তেমনি জনসাধারণের মধ্যে দীনি চেতনা বজায় রাখারও চেষ্টা চালিয়েছেন।
তাবলিগ সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে তোলা ও তাদের ধর্ম পালনে প্রাথমিকভাবে অভ্যস্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়। দিল্লির নেজামুদ্দীন মহল্লার এক মসজিদের নিকটবর্তী মেওয়াত নামের বস্তি থেকে এই অভিনব কর্মধারার সূচনা করেন মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে শুরু হয়ে বর্তমানে তা ব্যাপক প্রসারিত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ কার্যক্রম চালু আছে। সারাবিশ্বের অগণিত মানুষ এই ধারায় যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু তাবলিগি কার্যক্রমে প্রথম থেকেই সামগ্রিকতার দিকটি রাখা হয়নি। মুসলমানদের বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের ইবাদত, আল্লাহর স্মরণ, মুসলমানদের পারস্পরিক সহমর্মিতা, কর্তব্য পালনে আন্তরিকতা ও অকৃত্রিমতা ইত্যাদির প্রতি আহµান জানানোই তাবলিগের মূল বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়। আর আশা করা হয়, একজন মুসলমান যখন এ দিকগুলোতে অভ্যস্ত হবে, তখন সামগ্রিক জীবনে ইসলাম পালন ও অনুসরণের প্রেরণা লাভ করবে। তা ছাড়া ইসলাম শেখানোর চেয়ে শেখার প্রতি উৎসাহ প্রদানেই বেশি জোর দেয়া হয়। পাশাপাশি ইহ ও পরকালীন জীবনের সাফল্য ইসলাম পালনে নিহিত থাকার বিশ্বাস তার অন্তরে বদ্ধমূল করিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে। এভাবে ইতিবাচক পদ্ধতিতে স্বয়ং মুসলমানদের মধ্যেই ইসলামের প্রচার ও প্রসারের নাম তাবলিগ।
তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ কার্যধারাটির মর্যাদা ক্ষুণí করা হয় অতিরঞ্জনের মাধ্যমে। লোক সমাগমের ব্যাপকতা দেখে বিশ্ব ইজতেমাকে হজের সাথে তুলনা কিংবা দাওয়াতের সব ক্ষেত্রকে জিহাদের সাথে সমীকরণ কিংবা ইসলামের লালন, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার অন্য সব ক্ষেত্র থেকে তাবলিগকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ও এটাকে দীনের একমাত্র কাজ মনে করা কিংবা প্রাধান্য দেয়া একেবারেই অনুচিত। আবেগের বশে কিংবা পরিণাম চিন্তা না করে এ ধরনের মূল্যায়ন যারা করেন, তারা তাবলিগের পক্ষে নয়, বরং বিপক্ষে কাজ করে ফেলেন।
সার্বিকভাবে তাবলিগ একটি ইতিবাচক ধারা। তবে ইসলাম প্রচারের জন্য আরো ব্যাপক ও বহুমুখী পন্থা অবলম্বনের দাবি এখন আরো বেশি জোরালো। ইসলামের ইতিবাচক উপস্খাপন ও সৌন্দর্য বিশ্লেষণ যেমন প্রয়োজন, ইসলামি বিধি নির্দেশনায় যৌক্তিকতা ও কল্যাণের দিক যেমন তুলে ধরা প্রয়োজন, তেমনি অনৈসলামি বিধিব্যবস্খার অনিষ্টতাগুলোও ধরিয়ে দেয়া দরকার। তা ছাড়া ইসলামের বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার চালায়, তাদের জবাব দেয়ার জন্যও প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। স্খানীয় ও দেশীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েই পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন ইসলাম প্রচারের বহুমুখী কার্যক্রম। আর সেজন্য অবলম্বন করতে হবে আধুনিক সব উপকরণ ও প্রযুক্তি। তাহলেই মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ সাধিত হবে। জগদ্বাসীর কাছে মুসলমানরা আবার অনুকরণীয় জাতি হিসেবে আবির্ভূত হবে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন