বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮


অপরাধ দমনে ইসলামের ভূমিকা


কোন অপরাধীই অপরাধীরূপে জন্মগ্রহণ করে না। যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে নিষ্পাপ থাকে। তা’ছাড়া অপরাধী সেও সমাজের একজন। সে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে না। সে হয়ত বা আমাদের কারো আত্মীয় নয়তো বা প্রতিবেশী নয়তো বা সহকর্মী ইত্যাদি। আমরা যদি আত্মীয় হিসেবে তার প্রতি যে দায়িত্ব কর্তব্য ছিল তা পালন করতাম, আমরা যদি প্রতিবেশী হিসেবে তার প্রতি যে দায়িত্ব কর্তব্য ছিল-তা পালন করতাম, আমরা যদি সহকর্মী হিসেবে তার প্রতি যে দায়িত্ব ছিল তা পালন করতাম তাহলে সম্ভবতঃ কোন ব্যক্তিই অপরাধীরূপে চিহ্নিত হত না এবং কোন মানুষই অপরাধ করতে পারত না।

কোন মানুষই একদিনে বড় অপরাধী হয়ে ওঠে না। ছোট-খাট অপরাধ করতে করতে বড় অপরাধে পা বাড়ায়। কেউ কোন অন্যায় কাজ করে ফেললে আমরা সকলে মিলে যার যার সামর্থø অনুযায়ী কৌশলে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করি ( তাকে বুঝাই-অন্যায় বলে তিরস্কার করি) তবে তিনি হয়ত কোন এক সময় তার ভুল বুঝতে পারবেন। কেননা এক মনীষী বলেছেন- “আপন চোখ সবকিছু দেখতে পায়-নিজেকে দেখতে পায় না।”

আমরা অনেক সময় নিজের ত্রম্নটি নিজে দেখতে পাই না। কিন্তু পাশে যারা থাকেন তারা যদি আলস্নাহর হুকুমের প্রতি খেয়াল রেখে সময় সুযোগ বুঝে বলতে থাকেন তবে অবশ্যই আলস্নাহপাকের মদদে তিনি একদিন তার ভুল বুঝতে পারবেন এবং অনাকাঙিড়্গত পরিস্থিতি থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। কিন্তু বাস্তôবে আমরা ভাবি অমুক আমার আত্মীয়, বন্ধু লোক, সহকর্মী দলের লোক-তাকে কি করে বাঁচানো যায়, রেহাই দেয়া যায় সে উপায়, পথ খুঁজতে থাকি। ফলে অপরাধী আরও সাহস পেয়ে যায়, উৎসাহ পায়। তবে অপরাধী কেন অপরাধ করল অপরাধের কারণ তথা তার সুখ-দুঃখের কথাগুলো তথা তার বক্তব্য শোনা যায় এবং যাচাই করে বিশেস্নষণ করা যায়। হয়ত হতে পারে আমাদের কারও অবহেলা/নির্যাতন, যুলুমের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। সে যখন বঞ্চিত হয়, নির্যাতিত হয় তখন সে আত্মরড়্গার চেষ্টায় প্রতিবাদ করে, প্রতিরোধ তৈরি করে। এভাবেও সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। সন্ত্রাসী কোন দলের নয় কথাটি অত্যন্তô সঠিক। সন্ত্রাস বেড়ে চলছে এবং এর প্রতিরোধে সমাজের অনেক কিছু করণীয় আছে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সহকর্মীকে ঘিরে ৮০% ভাগ অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে।

আমাদের সন্তôানদের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিড়্গায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিড়্গিত/সচেতন ব্যক্তিদেরকে প্রথমতঃ ইসলামের শিড়্গা তথা আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। ইসলামের আদর্শ মেনে চলার মধ্যে আছে অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা তথা শান্তিô। তাই ইসলামের শিড়্গা/ আদর্শ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা দরকার। ইসলামের আদর্শ-ইসলামের শিড়্গা নামক প্রবন্ধে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

আমরা যারা সচেতন হিসেবে পরিচিত অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যাদেরকে সচেতন হিসেবে (১০%-২০%) ভাবেন তারা যদি ইসলামের শিড়্গা/ আদর্শ মেনে চলতে সচেষ্ট হতাম তবেই সমাজের মঙ্গল হত এবং অপরাধ কমে যেত। কেননা সচেতন জনগণ সকল অবস্থায় সমাজের সম্পদ। সাধারণ মানুষ এদের আচার ব্যবহার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়। এক কথায় আলস্নাহর দ্বীন বাস্তôবায়নই মুখ্য উদ্দেশ্য। মনীষী বলেছেন-“মুখের ভাল ভাল কথায় ভাল কাজ হয় না। ভাল চিন্তôা থেকেই ভাল কাজের সূচনা হয়। ভাল চিন্তôা মানুষের অন্তôরেই জন্মে।” ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) বলেন- “মানুষের অন্তôর হচ্ছে মনিব। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হচ্ছে তার চাকর। অপরাধ প্রবণতা মূলত অন্তôরেই জন্মে।”

মূলতঃ চারটি কারণে অপরাধ প্রবণতা জন্মেঃ-

১। অন্তôরে খোদাভীতির অভাবে, ২। পরস্পরের প্রতি যে দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে তা পালন না করা, ৩। অশস্নীলতা, বেহায়াপনা, নগ্নতা যা অপরাধ তৈরিতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। (প্রত্যন্তô অঞ্চলেও ভি·সি·পি চলে যা ভয়াবহ), ৪। প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকলে।

আইন-শৃঙ্খলাকে একটি ফলজ বৃড়্গের সাথে তুলনা করা যায়। ধরি একটি টম্যাটো গাছ যা থেকে আমরা টমেটো ফল আশা করি। টমেটো ফল পেতে গাছেল শিকড় যাতে পাকায় না কাটে সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে অন্য দিকে প্রয়োজনীয় সেচ এবং সার, ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু শিকড় পোকায় কাটলে সেচ দিয়ে কি টমেটো পাওয়া যাবে? একদিন হয়তো টমেটো গাছটিই মরে যাবে। শিকড়কে পরস্পরের প্রতি যথাযথ আচরণ, অশস্নীলতা বর্জন, খোদাভীতি অর্জনের সঙ্গে তুলনা করা যায় এবং প্রয়োজনীয় সেচ ও সার ওষুধ প্রয়োগের সঙ্গে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

শুধু প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ দ্বারা অপরাধ কমানো সম্ভব নয় এবং আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ও সম্ভব নয়। কেননা অপরাধের নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং সচেতন মানুষদের মধ্যেই অপরাধীকে ছায়া দিতে ব্যস্তô। সমাজে শান্তিô-শৃঙ্খলা আনয়ন করতে হলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের সুমহান আদর্শ বাস্তôবায়ন করতে হবে। ইসলামের মৌলিক দিকই হচ্ছে ইসলামের শিড়্গা তথা আদর্শের আলোকে মানব জীবনকে আলোকিত করা।

কেননা হুজুরপাক (সাঃ) ঘোষণা করেন, “উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী পূর্ণতা দানের জন্য আমি নবীরূপে প্রেরিত হয়েছি।” নবীদের কাজই হল উত্তম চরিত্র শিড়্গা দেয়া। তৎকালীন আরবের অসভ্য, বর্বর লোকগুলো হুজুরপাক (সাঃ)এৈর সান্নিধ্যে এসে সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।

পাক-ভারত উপমহাদেশে যারা ইসলামের আদর্শ কায়েম করে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মুসলিম মনীষী ছিলেন বাগেরহাটের হযরত খানজাহান আলী (রহঃ)। তিনি পারস্য দেশীয় একজন মুসলমান ছিলেন। প্রায় ছয়শত বৎসর পূর্বে মুহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে ইসলাম প্রচারে ভারতবর্ষে আগমন করেছিলেন একজন সুবেদার হিসেবে। তিনি এদেশে সুবেদার হয়ে এসে থাকলে ও ইসলাম প্রচার করা এবং ইসলাম এদেশে কায়েম করাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। যখন তিনি এলেন তখন দেখলেন এটি সম্পূর্ণ মুসলিম বিবর্জিত বৌদ্ধ, বাগ্মি, পৌধ অধ্যুষিত এলাকা। ধর্ম প্রচারের খাতিরে এদেশে এসে বিধর্মীদের সাথে (আত্মরড়্গামূলক) সশস্ত্র জিহাদ করতে হয়েছে। আবার তাকে নবী করিম (সাঃ) এর পর খলিফাদের মত বাদশাগিরিও করতে হয়েছে ইসলামকে জিন্দা রাখার খাতিরে। মানব কল্যাণের জন্য ও এই শান্তিôর ধর্মে মানবকে দীড়্গিত করার জন্য জোর করে জবরদস্তিô করে নয়- ইসলামকে নিজের জীবনে আচরণে প্রতিফলিত করে মানুষকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করে। তার জীবনী থেকে লড়্গ্য করা যায় নিম্নবর্ণিত চারটি ধাপে ইসলামের আদর্শ বাস্তôবায়ন করতে হবে-

ব্যক্তি পর্যায়েঃ সত্যবাদিতা, বিনয়, নম্রতা, অল্পে তুষ্টি, দায়িত্ব কর্তব্যবোধ, ধৈর্যসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ, ত্যাগ, উদারতা। ব্যক্তিই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। কাউকে শ্রদ্ধা করা, অল্পে তুষ্টি, দায়িত্বের প্রতি আন্তôরিক হওয়া, কারো প্রতি সহানুভূতি দেখানো, কারো ও উপকার করা- এগুলো নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপারÌৈজার করে, আইন প্রয়োগ করে এগুলো নিশ্চিত করা প্রায়ই অসম্ভব।

পারিবারিক পর্যায়েঃ নিজের জীবনে শুধু বাস্তôবায়ন করলে চলবে না। পরিবারের সকল সদস্যকে ইসলামের আদর্শে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে এবং অভ্যস্তô করে তুলতে হবে। কুরআন পাক এবং সুন্নাহও তাই নির্দেশ করে।

সামাজিক পর্যায়েঃ সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণকে শিড়্গা তথা আদর্শ সামাজিকভাবে বাস্তôবায়নে এগিয়ে আসতে হবে এবং এ ব্যাপারে একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। অর্থাৎ সমাজের সকলে যাতে ইসলামের আদর্শ মেনে চলে সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আলস্নাহপাকের হুকুমও তাই।

রাষ্ট্রীয় ও আন্তôর্জাতিক পর্যায়েঃ মানুষ যাতে ইসলামের শিড়্গা/আদর্শ মেনে চলে সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এভাবে পৃথিবীর মানুষ যাতে ইসলামের দাওয়াত পায় সেজন্য সাধ্যমত প্রচেষ্টা করা।

মানব সভ্যতা আজ ভাগ্য বিপর্যয়ের শিকার। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় জর্জরিত এবং উদভ্রান্তô। শূন্যতা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই তার ভাগ্যে জুটছে না। আর এই অসহনীয় বাস্তôবতা থেকে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয় লাভের জন্য আফিম, হেরোইন ও যাবতীয় নেশাকর দ্রব্য সেবন করে সামান্য সময়ের জন্য হলেও শান্তিô চায়। বস্তুগত প্রাচুর্য, পর্যাপ্ত উৎপাদন, উচ্ছল ও বিলাসী জীবন-যাপন যত্নে ও শোচনীয় দুর্দশায় আজ পতিত। বরঞ্চ বস্তুগত সুখ-সমৃদ্ধি সভ্যতার উপকরণের উপচে-পড়া প্রাচুর্য ও সুযোগ-সুবিধার ব্যাপকতা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে-শূন্যতা, উদ্বেগ ও উদভ্রান্তিô ততই প্রকটতর হচ্ছে।

বর্তমান ঝঞ্ঝা বিড়্গুব্ধ পৃথিবীতে একমাত্র ইসলামই পারে শান্তিôর পরিবেশ তৈরি করতে। ইসলামের শিড়্গা/আদর্শ আমাদের অধিকাংশের আচরণে অনুপস্থিত। জর্জ বানার্ড’শ বলেছেন-“ইসলামেই সকল যুগের সকল মানুষের ধর্ম।” অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম হচ্ছে সার্বজনীন ধর্ম। ইসলামের আদর্শ মেনে চলার মধ্যেই শান্তিô নিহিত রয়েছে। আজকের সময়ে বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ নসিহত, সেমিনার, আলোচনা সভা যত বেশি বেশি হয়ে থাকে বিগত দিনে কিন্তু এত আলোচনা সভা হত না। তবু অপরাধ প্রবণতা যেন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যখন আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য থেকে দূরে সরে যাব তখন আলস্নাহপাকের রহমত আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। তাই আলস্নাহপাক ঘোষণা করেন- ‘যা কিছু মঙ্গল আলস্নাহর তরফ থেকেই -যা কিছু অমঙ্গল তা মানুষের হাতের কামাই।” (সূরা নিসা-৭১)
মোঃ আজিজুর রহমান

মহান আলস্নাহ তায়ালার গুণাবলী


মহান আলস্নাহ তায়ালার গুণাবলী


মহান আলস্নাহ রাব্বুল আলামীনের মহৎ গুণাবলীর সম্যক জ্ঞান ও স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য এবং অপরিহার্য। কেননা, যারা মহান আলস্নাহতাআলার মহা মহিমান্বিত মহাজ্ঞান, মহাশক্তিধরের মহাশক্তির এবং অসীম ড়্গমতা সম্পর্কে অজ্ঞ, তারা কীভাবে আরশ-কুর্সীর অধিকারী, মহাবিশ্বের ও সৌরজগতের নিয়ন্ত্রণকারী এবং অসীম দয়ার অধিকারীর সকল গুণের মূল্যায়নে ও তাঁর আদেশ-নির্দেশ মানতে বাধ্য হবে। মহান আলস্নাহ তো তাঁর গুণাবলী অর্জনের জন্য মানুষকে নির্দেশও দান করেছেন যে, তোমরা বল, আলস্নাহর গুণই উত্তম। মহান আলস্নাহতাআলাই আমাদের ইসলাম ধর্ম দান করেছেন, তাই তা সর্বোত্তম ধর্ম। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে ৈছিবগাতালস্নাহি, ওয়া মান আহ্‌সানু মিনালস্নাহি, ছিবগাতাও ওয়া নাহ্‌নু লাহূ আবিদূন” অর্থাৎ আমরা আলস্নাহর রং (দ্বীন ইসলাম) গ্রহণ করেছি- (তাঁর গুণে গুণাণ্বিত হওয়ার জন্য)। আলস্নাহর রং-এর চাইতে (তাঁর গুণাবলীর চাইতে) উত্তম রং (গুণাবলী) আর কার হতে পারে? আমরা (মুসলমানরা) তাঁরই ইবাদত করি (এবং তাঁর গুণে গুণাণ্বিত হতে চাই)।

সমগ্র মানবজাতিকেই আলস্নাহতাআলার গুণে গুণাণ্বিত হওয়া উচিত। যেহেতু তিনি মানুষকে তাঁর (আলস্নাহর) প্রতিনিধিত্ব দান করেছেন। মহান আলস্নাহ ন্যায়-বিচারক, ন্যায়-বিচার হওয়া, তিনি (আলস্নাহ) অতিশয় দানশীল, দানশীল হওয়া, তিনি পরোপকার পছন্দ করেন, পরোপকারী হওয়া, আলস্নাহ সহনশীল, সহনশীল হওয়া, তিনি জুলুম করেন না, জুলুমকারী না হওয়া এবং মহান আলস্নাহতাআলা সকল বিচারকের সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক, তাই সুশাসক ও ন্যায় বিচারক হওয়াই সকল মানুষেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য।

মহান আলস্নাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর মহাশক্তি, দয়া ও করম্নণার কথা সূরা আর রাহ্‌মানের প্রশ্নের মাধ্যমে জ্বীন ও মানবজাতিকে শিড়্গা দিচ্ছেন।

মহান আলস্নাহ্‌তা’আলার অমীয় বাণীসমূহে হচ্ছে যে, করম্নণাময় আলস্নাহ্‌, শিড়্গা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা। সূর্য ও চন্দ্র হিসাবমত চলে, এবং তৃণলতা ও বৃড়্গরাজি সেজদারত আছে অর্থাৎ আলস্নাহর বাধ্যগত আছে। তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদণ্ড, যাতে তোমরা সীমা লংঘন না কর তুলাদণ্ডে অর্থাৎ এর দ্বারা ন্যায় বিচার কায়েম করবে। তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম কর এবং ওজনে কম দিয়ো না অর্থাৎ আলস্নাহ্‌তাআলা দাঁড়িপালস্না স্থাপন করেছেন, যাতে তোমরা ওজনে কম-বেশী করে জুলুম ও অত্যাচারে লিপ্ত না হও। তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্ট জীবের জন্য। এতে আছে ফলমূল এবং বহিরাবরণ ৈবিশিষ্ট খেজুর বৃড়্গ। আর আছে খোসাবিশিষ্ট শস্য ও সুগন্ধি ফুল।

অতএব, তোমরা উভয়ে (জ্বীন ও ইনসান) তোমাদের পালন কর্তার কোন্‌ কোন্‌ অনুগ্রহকে (অবদানকে) অস্বীকার করবে? তিনি (আলস্নাহতাআলা) মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে এবং জ্বীনকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিশিখা থেকে। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্‌ কোন্‌ অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? তিনি দুই উদয়াচল ও দুই অস্তôাচলের (চন্দ্র ও সূর্যের) মালিক। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্‌ কোন্‌ অবদানকে অস্বীকার করবে? তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন (যেমন বাংলাদেশের পদ্মা ও মেঘনা, মেঘনার পানি ঘোলা এবং পদ্মার পানি খুবই স্বচ্ছ ও পরিষ্কার)।

উভয়ের (দুই দরিয়ার) মাঝখানে রয়েছে এক অন্তôরাল, যারা অতিক্রম করে না। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্‌ কোন্‌ অবদানকে অস্বীকার করবে?

উভয় দরিয়া (স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানির ও ঘোলা পানির দরিয়া থেকে) থেকে উৎপন্ন হয় মোতি ও প্রবাল অর্থাৎ মণিমুক্তা ও পান্না-জহরত। অতএব, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কোন্‌ কোন্‌ অবদানকে অস্বীকার করবে?

দরিয়ায় বিচরণশীল পর্বত সাদৃশ্য জাহাজসমূহ তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্‌ কোন্‌ অবদানকে অস্বীকার করবে? ভূ-পৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা (ছাড়া) ব্যতীত। অতএব তোমরা উভয়ে (জ্বীন ও ইনসান) তোমাদের পালনকর্তার কোন্‌ কোন্‌ অবদানকে অস্বীকার করবে? (সূরা-আর-রহমান-১-২৮)।

মহান আলস্নাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর মহাশক্তির কথা প্রিয় নবী (সাঃ) এর মাধ্যমে ইসলামের শুরম্নতে শক্তিধর কোরাইশ বংশের বড় বড় নেতা ও পৌত্তলিক মুশরিকদের হুঁশিয়ার করে বলেন, যে, হে নবী (সাঃ) আপনি বলুন, তোমরা কি তাঁকে (আলস্নাহকে) অস্বীকার করবেই যিনি দু’দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তাঁর সমকড়্গ দাঁড় করাতে চাও? তিনি তো বিশ্ব জগতের প্রতিপালক। তিনি ভূ-পৃষ্ঠে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং পৃথিবীতে রেখেছেন কল্যাণ এবং চারদিনের মধ্যে এতে ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের, সমানভাবে সকলের জন্য যারা এর অনুসন্ধান করে। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। অনন্তôর তিনি (আলস্নাহতা’আলা) ওকে (আকাশকে) ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আমার আদেশ পালনের জন্য ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় প্রস্তুত হও।’ ওরা (আকাশেও পৃথিবী) বলল, ‘আমরা তো অনুগত হয়ে থাকতে প্রস্তুত আছি।’ অতঃপর তিনি আকাশমন্ডলীকে দু’দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশের নিকট তাঁর আদেশ প্রেরণ করলেন এবং আমি নিকটবর্তী আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুশোভিত ও সংরড়্গিত করেছি। এসবই পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ মহান আলস্নাহ কর্তৃক সুবিন্যস্তô।” (সূরাঃ হ্বা-মীম সিজদাহ্‌-৯-১২)।

মহান আলস্নাহতা’আলা তাঁর মহা বিজ্ঞানী শক্তি, অপার মহিমা ও করম্নণার যে নিদর্শন, তিন তাঁর অতিশয় প্রিয় বান্দা ও রাসূল, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তôফা সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া সালস্নামের মাধ্যমে দেখিয়েছেন। তা বিশ্বের মানুষের নিকট এখন পর্যন্তô রহস্যময় ও অচিন্তô্যনীয় ঘটনা, যদিও তা বর্তমানে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় এর সততা প্রমাণের দ্বার খুলে গিয়েছে। আর সেই মহামহিমায় ঘটনা হল যে, মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর মে’রাজ বা ঊর্ধ্বাকাশে গমন এবং মহান আলস্নাহতা’আলার সাথে কর্থাবার্তা, তাঁর কুদরতি মোয়ামেলার অনেক কিছু দর্শন ও উম্মতে মুহাম্মদীর প্রতি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত উপহার।

এই মহা পবিত্র ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল মহানবী (সাঃ)এৈর হিজরতের পূর্বে রজব মাসের ২৭ দিবাগত রাতে। এ সম্পর্কে মহান আলস্নাহতা’আলা বলেন, “পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে (কা’বা শরীফ) মসজিদে আকসা পর্যন্তô (বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্তô) যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছিযৈাতে আমি তাঁকে (নবী করিম সাঃকে) কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি শ্রবণকারী ও দর্শনশীলা”। সূরা বনী ইসরাঈল-০১ আয়াত)।

মহান আলস্নাহতা’আলার মহা শক্তি ও কুদরতের আরো পরিচয় এই যে, সকল আরব গোত্র ও কোরাইশ নেতাগণের অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই ঘটনার সততা প্রকাশ পেয়েছিল, তাদের নেতা আবু সুফিয়ানের মুখের ভাষায়।
মওলানা মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ইবনে ইউসুফ

ষোড়শ শতকের আরমানিয়ান গির্জা


ষোড়শ শতকের আরমানিয়ান গির্জা



পারস্যের সাফাভি শাসকরা ষোল শতকে পশ্চিমের পাহাড়ি দেশ আরমানিয়া দখলের প্রেড়্গাপটে আরমানিয়ানরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরম্ন করে। মোগলদের সমসাময়িক সময়ে ঢাকায় আরমানিয়ানদের আগমন ঘটে। ভাগ্য বদলের লড়্গ্যে ঢাকায় আসা আরমানিয়ানরা অল্পদিনের মধ্যেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

এখানে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য দ্রম্নত বিস্তôারের মাধ্যমে তারা শহরের গুরম্নত্বপূর্ণ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। আঠারো শতকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা ব্যবসা ছিল লবণ। এই লবণ উৎপাদন এবং বিতরণের জন্য কোম্পানির ঠিকাদারদের অধিকাংশ ছিল আরমানিয়ান। ব্যাবসায়িকে সাফল্যের কারণে আরমানিয়ান পরিবার আঠারো শতকে ঢাকয় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরম্ন করে। ঢাকা শহরের যে স্থানটিতে তারা শ্রেণীবদ্ধভাবে বসত শুরম্ন করে সে স্থানটি আরমানিটোলা নামে পরিচিত। আরমানিটোলা ছাড়াও ঢাকার অনেকাংশে আরমানিয়ানরা ছড়িয়ে পড়েছিল। সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুরের মতে, সব আরমানিয়ানই এক জায়গায় বাস করতো না, কেউ কেউ বাস করতো মৌলভীবাজার নলগোলায়। আরমানিয়ান স্টিফেন থাকতেন আনন্দরায় স্ট্রিটে, তাজমহল সিনেমা হলের স্থলে ছিল পটিয়াটির বাড়ি, কাচাতুরের বাড়ি ছিলো বাবু বাজার পুলের উত্তর পশ্চিমে আর কাজী আলাউদ্দিন রোডের মোড়ে ছিল বাগান বাড়ি, আরমানিয়ান নাগরিক প্রথম দিকে সদরঘাটে থাকলেও পরবর্তীকালে চলে যান মতিঝিলের দিলকুশা এলাকায়।

ইউরোপিয়ানদের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ঢাকার প্রথম যে আরমানিয়ানের নাম জানা যায় তিনি হচ্ছেন কোজা ফানুস কলন্দর, কলন্দর তার সম্প্রদায়ের বণিকদের মালামাল ইংরেজদের জাহাজের বহন করার জন্য ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে-১৬৮৮ সালে একটি চুক্তি করেন। এ চুক্তির সুবাদে ঢাকায় আরমানিয়ানদের অবস্থা সুদৃঢ় হতে শুরম্ন করে। সামাজিক প্রতিপত্তির পাশাপাশি তারা সমাজসেবামূলক কর্মকান্ড শুরম্ন করে।

ঊনিশ শতকে ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী আরমানিয়ানদের মধ্যে ছিলেন পোগজ, আরাতুন, পানিয়াটি, কোজা মাইকেল, মানুক,হার্নি ও সার্কিস প্রমুখ। এরা মূলত ছিলেন জমিদার এবং ব্যবসায়ী। ধারণা করা হয় প্রভাব ও সামাজিক আধিপত্য বিস্তôারের জন্য ঢাকায় বসবাসরত আরমানিয়ানরা পরবর্তী সময়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে জমিদারি কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েন।

ঢাকার আরমানিয়ানরা ছিল বেশ গুরম্নত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নাগরিক। তাদের প্রতি প্রশাসনের সব সময়ই সু-নজর ছিল। তাদের সুবিধার জন্য প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের পদড়্গেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো আরমানিটোলার ঝিলে জমে থাকা পানি নিঃসরণের জন্য খাল খনন। জানা যায় ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেট ডস ১৯১৬ সালে ৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ধোলাই খাল থেকে আরমানিটোলা পর্যন্তô ৭২৩ ফিট দীর্ঘ, ১৮ ফিট প্রস্থ ও ১৬ফিট গভীর একটি সংযোগ খাল খনন কাজ করান। কননকৃত খালের উপর সে সময় একটি পুলও নির্মাণ করা হয়।

পুরনো ঢাকার আরমানিটোলায় ১৭৮১ সালে বসবাসকারী আর্মেনিয়ানদের উদ্যোগে “চার্চ অফ হলি রিজারেকশন” নামে একটি গির্জা নির্মাণ করে। গির্জাটির মিনার চারটি স্তôরে বিভক্ত এবং কয়েক’শ ফুট উঁচু। চারটি দরজা বিশিষ্ট গির্জাটিতে ৭২টি জানালা রয়েছে। গ্রিক স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত গির্জাটির প্রবেশ পথটি বিশাল এবং কারম্নকার্যময়। প্রতি শুক্রবার গির্জায় উপাসনা হয়।

ঢাকায় অবিকৃত অবস্থায় টিকে থাকা এই উপাসনালয়টি আরমানিয়ানদের একমাত্র স্থাপনা। এ গির্জার প্রাঙ্গণে আরমানিয়ানদের ব্যক্তিগত কবরস্থানে অষ্টাদশ শতকের বেশ কিছু পুরনো সমাধিগুলোতে বিভিন্ন ভাষা ও বৈচিত্র্যের সব এফিটাপ। বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকায় প্রভাবশালী আরমানিয়ান নাগরিকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আরাতুন। আরাতুন ছিলেন ঢাকা জার্নাল স্কুলের অধ্যড়্গ। তিনি ঢাকাবাসীর কাছে অধিক পরিচিত ছিলেন সৌখিন আরাতুন নামে। আরাতুন ভালবাসতেন ঘুড়ি ও পায়রা ওড়াতে। মোরগের লড়াই ও তার খুব পছন্দ ছিল। শ্যামবাজারে ‘রূপলাল হাউস’ নামে পরিচিত বাড়িটি আদিতে ছিল আরাতুনের। বর্তমানে শাহবাগ এলাকার বাংলা একাডেমির পার্শ্ববর্তী আণবিক শক্তি কমিশন ভবনের স্থলে ছিল তার বাগানবাড়ি। দড়্গিণ শাহবাজপুর (ভোলা) ও ময়মনসিংহের হোসেন শাহী পরগনায় ছিল আরাতুনের বিশাল জমিদারি। তার মৃত্যুর পরে জমিদারি ভাগ হয়ে যায় তার দুই কন্যার মাঝে। অল্পদিনের মধ্যেই তারা জমিদারি বিক্রি করে পাড়ি জমান কলকাতায়।

আরমানিয়ান নাগরিক নিকি পোগজও ঢাকাবাসীর কাছে ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কোতোয়ালি থানাসংলগ্ন ওয়াইজ ঘাটের বাফা’র (বুলবুল ললিতকলা একাডেমি) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভবনটি এক সময় ছিল নিকি পোগজের বাড়ি। তখন এ বাড়িটি পরিচিত ছিল ‘নিকি সাহেবের কুঠি’ নামে। পরে তিনি ঢাকার আরমানিয়ান অধ্যুষিত এলাকা আরমানিটোলায় একটি কুঠি নির্মাণ করে সেখানে চলে যান।
ঢাকার প্রথম ইউরোপিয়ান জিনিসপত্র বিক্রির দোকানটি খোলেন আরমানিয়ান নাগরিক জি এম সিরকোর। ১০৫৭ সালে শাঁখারিবাজারে প্রতিষ্ঠিত তার দোকানটির নাম ছিল ‘ সিরকোর অ্যান্ড সন্স’। এ দোকানে বিক্রীত জিনিসের মধ্যে অন্যতম ছিল চা। সম্ভবত তিনিই ঢাকায় প্রথম ঘোড়াগাড়ি প্রবর্তন করেন। তার প্রবর্তিত ঘোড়াগাড়ি ঢাকায় পরিচিতি পায় ঠিকাগাড়ি নামে। অল্পদিনের মধ্যেই তার ঠিকাগাড়ি ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে।
এছাড়া আরমানিয়ান জে জি এন পোগজ ছিলেন ঢাকা ব্যাংকের একজন পরিচালক। আর মাইকেল সার্কিস ছিলেন ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য। ঢাকার আমানিটোলায় তাদের গির্জা নির্মাণেও তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ঢাকার বিশিষ্ট আরমানিয়ান নাগরিকদের মধ্যে কমিশন এজেন্সিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন জে লুকাস, এ এম ডেভিড, এ থমাস, জে মিনাস, মার্গার ডেভিড, এম হাইকাজোনি, এ এস ম্যাকর্টিচ, পি আরথন, যোসেফ ল্যাজারাস, আব্রাহাম লুকাস, টিগ্রন নাহাপিত, ম্যাকর্টিচ আব্রাহাম, ছাদিউস নাহাপিত প্রমুখ।
আরমানিয়ান নাগরিক মার্গার ডেভিড ঢাকাবাসীর কাছে পরিচিত ছিল ‘মার্চেন্ট প্রিন্স অফ ইস্টার্ণ বেঙ্গল’ নামে। ১৮৬০-৭০ সালের মধ্যে আব্রাহাম পোগজ, মাইকেল সার্কিস, মার্গার ডেভিড, এম ক্যাচাটুর, এ টমাস ওপি আরাতুন পাট ব্যবসায় অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন। ১৮৩০ সালে ঢাকায় আরমানিয়ানদের সংখ্যা ছিল ১২৬ জন। হেনরি ওয়ালটার্সের তথ্য মতে, ১৮৩২ সালে ঢাকায় আরমানিয়ানদের মোট বাড়ির সংখ্যা ছিল ৪২টি। মোট আরমানিয়ান নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১২৬ জন। ১৮৫৭ সালে ঢাকায় সিপাহী বিদ্রোহ চলার সময়ে আগস্ট মাসে ঢাকা থেকে বহু আরমানিয়ান কলকাতায় পালিয়ে যান।
এক সময়কার ঢাকার প্রভাবশালী আরমানিয়ান সম্প্রদায়ের কথা আজ অনেকেরই অজানা। কালের পালাবদলে রাজধানী ঢাকায় কিছু আরমানিয়ান থাকলেও এখানো তাদের আরমানিটোলা আরমানিয়ান গির্জা, রূপলাল হাউস, নিকি সাহেবের কুঠি, পোগোজ স্কুল ভবন টিকে আছে। বহু ঘটনার সাড়্গী এসব অট্টালিকার যথাযথ সংরড়্গণ জরম্নরি।
মিলন সব্যসাচী

পবিত্র বাণী


পবিত্র বাণী



১। যারা কুফরী করে কিয়ামতের দিন শাস্তিô থেকে মুক্তির জন্য পণস্বরূপ পৃথিবীতে যা কিছু আছে, যদি তাদের তা সবই থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরো থাকে তবুও তাদের নিকট থেকে তা গৃহীত হবে না। তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তôুদ শাস্তিô। (সূরা-মায়িদা-৩৬)

২। যারা সীমা লংঘন করে (শিরক বা কুফরী) করে, যদি তাদের থাকে, পৃথিবীতে যা-আছে তা সম্পূর্ণ এবং এর সমপরিমাণ সম্পদ ও দিতে হয়, তা হলে কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তিô হতে মুক্তিপণ স্বরূপ সবকিছু তারা দিতে সম্মত হবে। (সুরা যুমার-৪৭)

৩। প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কিয়ামতের দিন তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেয়া হবে। যাকে অগ্নি হতে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হবে সে-ই হবে সফলকাম। পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়। (সূরা আলে ইমরান-১৮৫)

৪। হযরত আবদুলস্নাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুলাহ (সঃ) বলেন, মানুষ দুনিয়াতে ভিড়্গার কারণে এমন অবস্থা হবে যে, কিয়ামতের দিন তাদের চেহরায় একটুও মাংস থাকবে না। (বুখারী, মুসলিম)

৫। হযরত আবদুলস্নাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুলস্নাহ (সঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রীতিমত নামায আদায় করেনি, নামায তার জন্য নূর হবে না এবং তার দলীল ও মুক্তির উছিলা হবে না। কিয়ামতের দিন তার হাশর ফিরআউন, কারূণ, হামান এবং উবাই ইবনে খলফের সাথে হবে। (আহমদ ও দারেমী)

৬। নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসূল (সঃ)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যারা আলস্নাহ ও আখিরাতের দিনের প্রত্যাশী এবং যারা খুব বেশি বেশি আলস্নাহকে স্বরণ করে। (সুরা আহযাব-২১)

৭। হে নবী! আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের এবং মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, (তারা বাইরে গেলে) যেন তাদের চাদরের এক অংশ নিজেরদের বড়্গের উপর ঝুলিয়ে দেয়, এটাই অধিক বেশি সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি যাতে তাদেরকে চিনে নেয়া যায় এবং তাদেরকে কষ্ট দেয়া না হয়। আলস্নাহ অতীব ড়্গমাশীল ও দয়াবান। (সুরা আহযাব-৫৯)
সংকলনঃ আবু নেসার শাহ

আলস্নাহ ও তাঁর রাসূলে করিম (সা·) এর সন্তুষ্টি অর্জন


আলস্নাহ ও তাঁর রাসূলে করিম (সা·) এর সন্তুষ্টি অর্জন



তরীকা আবরী শব্দ, এর অর্থ পথ-পন্থা, রাস্তা উপায়-পদ্ধতি বা রীতি-আদর্শ। সোজা কথায় যে আদর্শকে অনুসরণ করে মহান আলস্নাহপাক ও রাসূলে করিম (সা·)-এর সন্তুষ্টি অর্জিত হয় সেই পথ বা পন্থা-পদ্ধতিকে তরীকা বলে। মহান আলস্নাহপাক পবিত্র কোরআনুল করিমে সূরা তওবার ১১৯ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছে।

“কূ-নূ মা’ আচ সা-দিকীন”

অর্থঃ তোমরা সাদিক(সত্যবাদী ) লোকের সঙ্গী হও।

সকল হক্কানী তাফসীরে সাদেকীন দ্বারা পীর-মাশায়েখগণকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। তাই পীর-অলী-আলস্নাহগণের সান্নিরধ্য লাভ করার কথা আলস্নাহ তা’য়ালা কুরআন পাকেই বলেছেন এবং পীর, অলী, আলস্নাহগণের তরীকা গ্রহণ করা অবশ্য কর্তব্য। মহান আলস্নাহ পাক কুরআনের অন্যত্র বলেছেনঃ

‘ইত্তাবি’ ছাবীলা মান আনা- বা ইলাইয়া”

অর্থঃ আমার দিকে যে ব্যক্তি রম্নজু হয়েছে, তার পুর্নাঙ্গ অনুসরণ কর। (সুরা লোকমান, আয়াত১ৈ৫)।

আলস্নাহ পাক কুরআনের অন্যত্র বলেছেন

“ইয়া আয়্যু হালস্নাযীনা আ-মানুত্তাকুলস্নাহা আবতাগু ইলাইহিল অসীলাহ।”

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আলস্নাহ তায়ালাকে ভয় কর এবং তাহাকে পাওয়ার জন্য অসীলা (মাধ্যম) তালাশ কর।(সুরা মায়িদা, আয়াত-৩৫)।

বিভিন্ন তাফসীরে উলেস্নখ রয়েছে এই অসীলা হলো কামেল অলীআলস্নাহগণ। কামেল অলী আলস্নাহগণের পথই প্রকৃত সত্যের পথ আলস্নাহ তা’য়ালা যাহাদের মঙ্গল কামনা করেন তাহাদেরকে এই সত্য পথ দেখানোর জন্য কামেল পীরের সন্ধান মিলাইয়া দেন। তাই আলস্নাহ তা’য়ালা বলেনঃ “অ মাই ইউদলিল পালান তাজিদা লাহু অলিয়্যাম পুরশিদা” অর্থঃ যাহারা পথভ্রষ্ট, তাহারা কামেল মুর্শিদের সন্ধান পাবে না (সূরা কাহাফ আয়াত-১৭)। অর্থাৎ কামেল পীর ধরা তাদের নসীব হবে না। পীর ধরা, মুরীদ হওয়া, বাইয়াত হওয়া তরীকা গ্রহণ করা এসব কিছুরই একই অর্থ এবং এর উদ্দেশ্য হলো খোদা প্রাপ্তির পথ হাছিল করা। কুরআন শরীফে সূরা ফাতাহ এর ১০নং আয়াতে বাইয়াতের কথা উলেস্নখ আছে- । ইন্নাললস্নাযীনা ইয়ুবায়িউনাকা ইন্নামা ইয়ুবায়িউৗৗলস্নাহা ইয়াদুলস্নাহি ফাউকা আইদীহিম”

অর্থঃ হে নবী, যারা আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করল, তারা মূলত আমার হাতেই বাইয়াত গ্রহণ করল। আমার হাত তাহাদের হাতের উপর রহিয়াছে।

এই আয়াতের হুকুম কিয়ামত দিবস পর্যন্তô বহাল থাকবে। সেড়্গেত্রে এখনতো নবী রাসূল এর যুগ নয় দুনিয়াতে আর কোনো নবী রাসূল আসবেন না। এখন হল নায়েবে রাসূলের যুগ তথা বেলায়েতের যুগ। যাহারা আলস্নাহ ও তাঁর রাসূলের পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন তাহারাই হলেন এই বেলায়েতের অধিকারী। যুগের মানুষকে তাহাদের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করা অর্থাৎ মুরীদ হওয়া একান্তô কর্তব্য ও জরম্নরি।

হাদীস শরীফে উলেস্নখ আছেঃ

“তালাবুল ইলমি ফারীদাতুন আ’লা কুলিস্ন মুসলিমিউ অ মুসলিমাতিন” অর্থঃ ইলম শিড়্গা করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরয। এই ইলম আবার দুই প্রকারঃ ইলমে শরীয়ত ও ইলমে মা’রিফাত। খোদা প্রাপ্তির পথে উভয় ইলমই অতীব জরম্নরি। এই উভয় বিদ্যা অর্জন করতে হইলে যাদের কাছে এই উভয় বিদ্যা আছে তাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হবে। এই শিষ্যত্ব গ্রহণ করাকেই তরীকা গ্রহণ করা বা মুরীদ হওয়া বলে।

ইমাম আজম আবু হানীফা (রা·) বলেনঃ “লাউলা-ছিনতা-নে হালাকা নু’মানু”।

অর্থ আমি নু’মান যদি (আমার মোর্শেদ ইমাম বাকের (র·)-এর) দুই বছর খেদমত না করিতাম তাহা হইলে ধ্বংস হইয়া যাইতাম।

তিনি আরো বলেনঃ

“ইলমে শরীয়ত বাহিরের দিককে পরিশুদ্ধ করে। আর ইলমে তাসাউফ ভিতরের দিককে পবিত্র করে”

যে ব্যক্তি ফিকাহ ও তাসাউফ আমল করল সে ব্যক্তি জাহেরী এবং বাতেনী উভয়দিক পরিশুদ্ধ হয়ে কামেল মু’মিনের দরজা লাভ করল। ইলমে মা’রিফাত আলস্নাহতা’য়ালার দেওয়া বিশেষ দান। এই ইলমে মা’রিফাত শিড়্গা করার জন্য হযরত মুসা (আ·) হযরত খিযির (আ·)-এর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন।

বুখারী শরীফে অনেক জায়গায় হযরত মুসা (আ·) যে খিযির (আ·)-এ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তার প্রমাণ আছে। আলস্নামা জালালউদ্দীন রম্নমী (র·) বড় আলেম হওয়ার পরও তিনি হযরত শামছে তাবরিযী (র·)-এর কাছে তরীকা গ্রহণ করেছিলেন।

তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবী শরীফে উলেস্নখ করেন

“খোদ বাখোদ কামেল না শোদ মাওলায়ে রম্নম

তা গোলামে শামছে তামছে তাবরিযী না শোদ”

অর্থঃ আমি নিজে নিজে মাওলানা রম্নমী হইতে পারি নাই, যতড়্গণ পর্যন্তô না আমি শামছে তাবরিযী (র·)-এর গোলাম হয়েছি।

আলস্নামা রম্নমী (র·) বলেন-ঃ

“দর হাকীকত গাশতায়ী দূর আয খোদা

গর শুভি দূর আয ছোহবতে আওলিয়া”

অর্থঃ সত্যিকারে ঐ ব্যক্তিই আলস্নাহরতা’য়ালার নিকট হইতে দূরে আছে, যে ব্যক্তি অলী আলস্নাহগণের নিকট হইতে দূরে থাকে।

আলস্নামা রম্নমী (র·) আরো বলেনঃ

“আগারখাহী হাম নাশিনী বা খোদা

গো নাশিনাদ দর হুযুরে আওলিয়া”

অর্থঃ তোমরা যদি আলস্নাহর দরবারে বসতে চাও তবে অলী আলস্নাহগণের সামনে বস।

কুতুববাগ পাক দরবার শরীফে মহান আলস্নাহপাকও রাসূলে করিম (সা·)-এর আদর্শ অনুসরণের লড়্গ্যে প্রতিদিন অনুসারীগণ উপস্থিত হন। এইসব অনুসারীকে নিয়মিত অজীফাসমূহ পালন করতে হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের প্রাক্কালে অজীফাসমূহ পালন করতে হয়। ফজর নামাজের সময় ফাতেহা শরীফ ও খতম শরীফ অবশ্যই পাঠ করতে হয়। এছাড়াও রয়েছে দরম্নদ শরীফ ও নির্ধারিত মুনাজাত। কুতুববাগ পাক দরবার শরীফের অনুসারীদের যথাযথভাবে আদব-কায়দা পালন করতে হয়। এগুলো হলোঃ মুর্শিদের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা, নির্দেশ পালন, হুকুমের প্রতি বিশ্বাস, দরবারে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা, বার্ষিক অনুষ্ঠানে শরীক হওয়া এবং অনুমতি ছাড়া মুর্শিদের সঙ্গ না ছাড়া।
আল হাজ্ব মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান

ইসলামী শরিয়তে পর্দা


ইসলামী শরিয়তে পর্দা


পর্দা শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘হিজাব’। এর শাব্দিক অর্থ প্রতিহত করা, বাধা দান করা, গোপন করা, আড়াল করা, ঢেকে রাখা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের আপাদমস্তক গায়ের মাহরাম পুরুষ থেকে ঢেকে রাখাকে ‘হিজাব’ বা পর্দা বলে।
ইসলামী শরিয়তে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দা ফরজ করা হয়েছে। পর্দাব্যবস্থা আল্লাহর এমন এক উত্তম বিধান যা পুরুষকে পাশবিক উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে হিফাজত করে এবং মানবিক মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করে।
পর্দার বিধান ঘোষণা করে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন­ ‘হে নবী! মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। এটি তাদের জন্য পূত-পবিত্র পদ্ধতি। তারা যা কিছু করে, আল্লাহ তা জানেন। আর মুমিন মহিলাদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। আর তারা যেন স্বীয় সাজসৌন্দর্য না দেখায়, তবে যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় ... তা ছাড়া তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে। এবং তারা কারো সামনে তাদের সাজসৌন্দর্য প্রকাশ করবে না এই মাহরাম আত্মীয়গণ ব্যতীত যথা­ স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, ভ্রাতা ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত, বাঁদী, নারীর প্রতি স্পৃহাহীন সেবক, ওই সব বালক যারা নারীর গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়নি। তারা যেন পথচলার সময় এমন পদধ্বনি না করে যাতে তাদের অপ্রকাশিত সৌন্দর্য পদধ্বনিতে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরাঃ নূর, আয়াত- ৩১)।
পর্দা দু’ভাগে বিভক্তঃ (১) চোখের পর্দা, (২) দেহের পর্দা।
চোখের পর্দা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ফরজ। আর দেহের পর্দা বিশেষভাবে নারীর জন্য ফরজ। আর নারীদের পর্দা যাতে লঙ্ঘিত না হয় সেভাবে পুরুষদের চলে নারীদের পর্দা বজায় রাখতে সহায়তা করা পুরুষদের জন্য ফরজ। অপর দিকে ফরজ সতর আবৃত রাখার হুকুম পালন নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ফরজ।
সর্বোত্তম পর্দা হিসেবে মহিলাদেরকে সর্বদা ঘরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। এ জন্য একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মহিলাদের বাইরে বের হওয়া নিষেধ। (মুসলিম শরিফ) এ সম্পর্কে মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘(হে নারীগণ!) তোমরা আপন গৃহে অবস্থান করো এবং জাহেলিয়াতের যুগের মতো সাজসজ্জা সহকারে অবাধে চলাফেরা করো না।’ (সূরা আহজাবঃ আয়াত-৩৩) মহানবী সাঃ পর্দা সম্পর্কে সতর্ক করে এরশাদ করেন, খবরদার! তোমরা মেয়েদের মধ্যে অবাধে যাতায়াত করো না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর যখন তাদের (নবীর স্ত্রীদের) কাছে তোমরা কিছু চাইবে, তখন (তারা) তোমাদের দৃষ্টির অন্তরালে হিজাব বা পর্দার ভেতরে অবস্থান করবে, আর তোমরা তাদের কাছে পর্দার বাইরে থেকে চাইবে। তোমাদের এ কাজ তোমাদের অন্তর ও তাদের অন্তরকে কুচিন্তার আবরণ থেকে উত্তমভাবে পাক-পবিত্র রাখার উপায় হবে।’ (সূরা আহজাবঃ আয়াত-৫৩)।
পর্দা সম্ব েআল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন, হে মোমিনগণ, যতক্ষণ তোমরা অনুমতি না পাও এবং গৃহের মালিকের কাছ থেকে সালামের জবাব না পাও, ততক্ষণ নিজ গৃহ ছাড়া অপরের গৃহে প্রবেশ করিও না।’ (সূরা নূরঃ আয়াত-২৭)।
হাদিসে আছে, মহিলারা যখন বাইরে যায়, শয়তান তখন তাদের পিছু নেয়। শয়তান ওই মহিলার রূপের ভেতর আকর্ষণ সৃষ্টি করে পুরুষের চোখে তুলে ধরে, আর তখনই উভয়ের জিনার গুনাহ হয়। নবীজি সাঃও এ ব্যাপারে বলেছেন, নারীরা পর্দার আড়ালে থাকার জিনিস। (তিরমিজি)।
তাই যখনই কোনো পর্দাহীন নারীর প্রতি কোনো পুরুষের দৃষ্টিপাত হয়, তখন তার মনে চাঞ্চল্য উপস্থিত হয়। আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। তখন তাকে পাওয়ার জন্য নানা ছল-চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।
বেপর্দা নারীগণের নির্লজ্জ আচরণকে কেন্দ্র করে শয়তান তার অনুসারীদের দ্বারা অশ্লীল, অশালীন ও জঘন্যতম পাপের কাজ করিয়ে নেয়। তোমরা (নারীগণ) নিজগৃহে অবস্থান করো। বর্বর যুগের সৌন্দর্য প্রদানের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন করিও না। (সূরা আহজাবঃ আয়াত-২৩)।
নবী করিম সাঃ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর কাছে পর পুরুষের যাতায়াতকে আপত্তিজনক মনে না করে তাকে শরিয়তের ভাষায় ‘দাইউস’ বলা হয়। আর ‘দাইউস’ কখনো বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং দাইউসকে ৫০০ বছরের দূরত্ব থেকে দোজখে ফেলে দেয়া হবে। দাইউসের জন্য বেহেশত হারাম। (আল হাদিস)
যে স্ত্রী কিংবা পুরুষ একে অন্যের প্রতি ইচ্ছাপূর্বক খারাপ দৃষ্টিতে তাকাবে তার চোখে গরম সিসা ঢেলে দেয়া হবে। (আল হাদিস)
নারীদের সৌন্দর্য গোপন রাখার বস্তু। সৌন্দর্য বলতে নারীদের পুরো শরীর বোঝায়। বেগানা নারী-পুরুষের নির্জনে ওঠাবসা ও চলাফেরা হারাম। কারণ, শয়তান তখন তাদের সঙ্গী হয়। (আল হাদিস, তিরমিজি)
মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে এভাবে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে, নারী চাদর, বোরকা বা দোপাট্টা দ্বারা তাদের বক্ষস্থল ঢেকে রাখে তার একাংশ দিয়ে যেন মাথাও ঢেকে রাখে। এ ছাড়া মাহরাম পুরুষ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের কাছে নারীদের আবরণ উন্মুক্ত রাখতে কড়াকড়িভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীলোক যেন তাদের স্বাভাবিক সজ্জার ওপর একটা বাড়তি কাপড় ব্যবহার করে। এর দ্বারাই তারা মাথাসহ শরীরের ঊর্ধ্বাংশ আবৃত করে রাখবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন, ‘হে নবী! আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ এবং মুমিন স্ত্রীগণকে বলে দিন যে তারা যেন চাদরের কিছু অংশ নিজেদের মুখের ওপর টেনে দেয়, এতে তাদের চেনা সহজতর হবে ফলে তাদের কেউ উত্ত্যক্ত করবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সূরা আহজাবঃ আয়াত-৫১)
নারীদের পথ চলার সময়ও হাদিসে কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে বলা হয়েছে। যেমন­ সুগ িব্যবহার করে বের হবে না, শব্দ করে এমন অলঙ্কার পরিধান করে বের হবে না, পথের কিনারা দিয়ে পথ চলবে এবং পুরুষদের ভিড়ে প্রবেশ করবে না ইত্যাদি। ইমাম জাসসাস বলেন, সুশোভিত রঙিন কারুকার্যখচিত বোরকা পরিধান করে বের হওয়াও নিষিদ্ধ।
মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, ‘হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো তবে পুরুষদের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে।’ উম্মাহাতুল মুমিনীনগণের কেউ যদি পরপুরুষের সাথে কথাবার্তা বলতেন, তবে মুখে হাত রেখে বলতেন, যাতে কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে যায়। (সূরা আহজাবঃ আয়াত-৩২)
রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, ‘আল্লাহর অভিশাপ ওইসব নারীর ওপর যারা কাপড় পরিধান করেও উলঙ্গ থাকে।’ একবার হাফসা বিনতে আবদুর রহমান একটি সূক্ষ্ম দোপাট্টা পরিধান করে হজরত আয়েশা রাঃ-এর গৃহে হাজির হলেন। তখন উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা রাঃ তা ছিঁড়ে ফেলে একটা মোটা চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে দিলেন।’ (ইমাম মালিক, মুয়াত্তা)।
হজরত ওমর ফারুক রাঃ বলেছেন, ‘নারীদের এমন আঁটসাঁট পোশাক পরিধান করতে দিও না যাতে শরীরের গঠন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।’হজরত উম্মে সালমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি এবং মায়মুনা রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর কাছে থাকাকালীন হঠাৎ অ সাহাবী আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উম্মে মাকতুম তথায় আগমন করলেন। তিনি আমাদের বললেনঃ ইহার কাছে পর্দা করো। এই ঘটনার সময়কাল ছিল পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর।
উম্মে সালমা আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাঃ, সে তো অ সে আমাদের দেখতে পাবে না এবং আমাদের চেনেও না। রাসূলুল্লাহ সাঃ বললেন, তোমরা তো অ নও, তোমরা তাকে দেখছ। (আবু দাউদ, তিরমিজি) হঠাৎ গায়ের মাহরামের প্রতি দৃষ্টি পড়ে গেলে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে হবে। তা না হলে দ্বিতীয় দৃষ্টিপাতে জিনা হয়ে যাবে। (মুসলিম শরিফ)।
হজরত আলী রাঃ থেকে বর্ণিত রাসুল সা. বলেন, ‘হে আলী! প্রথম দৃষ্টির পর দ্বিতীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করো না। প্রথমটি ক্ষমার যোগ্য কিন্তু দ্বিতীয়টি নয়।’ এই হাদিসটির তাৎপর্য এই যে, পুরুষ লোকের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও গুনাহ। বিশেষ উদ্দেশ্যে একাধিকবার দৃষ্টিপাত করা গুনাহ। ‘প্রত্যেকটি নজরই (খারাপ নিয়তের সহিত) জিনা।’ দৃষ্টির ক্ষেত্রেও পর্দা করা জরুরি।
মহানবী সাঃ বলেছেন, ‘যদি কেউ এমন কোনো নারীর ‘হস্ত’ স্পর্শ করে যার সাথে তার কোনো বৈধ সম্পর্ক নেই তাহলে পরকালে তার হাতের ওপরে জ্বলন্ত অগ্নি রাখা হবে।’ প্রিয় নবী সাঃ আরো বলেছেন, ‘যদি কেউ তোমার বিনা অনুমতিতে তোমার গৃহে উপস্থিত হয়, তারপর তুমি তার ওপর কঙ্কর নিক্ষেপ করে তার চক্ষু কানা করে দাও, তাতে কোনো গোনাহ হবে না। (মুসলিম)
মেয়েদের গৃহে বা অবস্থানস্থলে প্রবেশের সময় অনুমতিসাপেক্ষে প্রবেশ করার জন্য ইসলামে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, নিজ পুত্রসন্তান সাবালক হলেও তাকে অনুমতি নিয়েই মাতার ঘরে প্রবেশ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ্‌পাক বলেছেন, ‘যখন তোমাদের পুত্ররা সাবালক হবে তখন অনুমতি সহকারে ঘরে প্রবেশ করবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীরা প্রবেশ করত। (সূরা নূরঃ আয়াত-৫৯)।
তা ছাড়া যে গৃহে স্বামী অনুপস্থিত থাকে সে গৃহে গমন করাও অনুচিত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, ‘স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোনো নারীর কাছেও যেও না। কারণ, শয়তান তোমাদের যেকোনো একজনের মধ্যে রক্তের মতো প্রবাহিত হয়।’ (তিরমিজি)।
মহানবী সাঃ পর্দা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, সাবধান! নিভৃতে নারীদের কাছে গমন করো না। একক সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলুল্লাহ সাঃ! ‘দেবর’ সম্ব েকী হুকুম? উত্তরে নবীজি সাঃ বললেন, ‘দেবর তো মৃত্যুর সমতুল্য।’ (বোখারী ও মুসলিম শরিফ)
যদি কোনো ব্যক্তি এমন নারীর বিছানায় শয়ন করে, যার স্বামী অন্যত্র গেছে এবং সে তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে মনোস্কার্য পূর্ণ করতে ইচ্ছা করে, তবে কিয়ামতের দিন ওই নারী-পুরুষের জন্য একটি করে ‘কালো বিষধর সাপ’ নিযুক্ত করা হবে। সাপটি তাকে পুনঃপুন দংশন করতে থাকবে।’ (তাবরানি)
নারীর মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সমস্ত শরীর বেগানা পুরুষের নজর থেকে ঢেকে রাখা ফরজ এবং বেগানা পুরুষের পক্ষে সেদিকে নজর করা হারাম।
আসলে পর্দা হচ্ছে আবরণ, যে আবরণ দিয়ে দেহ ও মনকে আচ্ছাদিত করা হয়। বাহ্যিক পর্দা দ্বারা দেহকে আবৃত করতে হয় এবং তাকওয়া বা আল্লাহ্‌ ভীতির দ্বারা মনকে কন্ট্রোলে ও হিফাজতে রাখতে হয়। এই উভয় প্রকার পদ্ধতি অবলম্বনের দ্বারাই সম্ভব হতে পারে পরিপূর্ণ পর্দা রক্ষা করা। তাই শুধু দেহকে আচ্ছাদিত করে মনকে লাগামহীন ছেড়ে দিলে, পর্দা বজায় থাকবে না। দুটোই প্রয়োজন। অথচ জাহান্নামে তিন বক্তির জন্য নাম রেজিস্ট্রি করা হয়। তা হলো­ (১) যে বাবা তার সাবালিকা মেয়েকে পর্দায় রাখে না, (২) যে স্বামী তার স্ত্রীকে পর্দার ব্যাপারে কড়াকড়ি হুকুম দেয় না এবং (৩) যে মহিলা পাতলা কাপড় পরে সেজেগুজে বেপর্দায় চলে। ‘সাজসজ্জার স্থানগুলো প্রকাশ না করা মহিলাদের ওপর ওয়াজেব।’ (মারেফুল কুরআন)
এ কারণেই আমাদের পেয়ারা নবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের মুখ ও লজ্জাস্থানকে হেফাজত করো। আমি তোমাদের বেহেশতের জামিনদার হবো।’ নারীদের ইজ্জতের মূল্য দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ্‌পাক এরশাদ করেন, ‘যারা সতী নারীদের প্রতি অপবাদ রটনা করে বা ছড়ায় এবং চারজন সাক্ষী হাজির না করে তাদেরকে ৮০টি দোররা লাগাও এবং কখনো তাদের সাক্ষী গ্রহণ করো না, এরা তো সত্যত্যাগী।’ (সূরা নূরঃ আয়াত-৪), তাদের সম্ব েআরো বলা হয়, ‘যারা সতী সরলমনা ও ঈমানদার নারীদের অপবাদ দেয় তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।’ (সূরা আন-নূরঃ আয়াত-২৩)
নারী এক ভিন্ন সত্তা, অস্তিত্ব, মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। তার নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতাবোধ ব্যক্তিত্বকে আকর্ষণীয় করে। একজন মুসলিম নারীর আইডেনটিটি তার শালীনতা, পর্দা। পর্দাই তার পরিচয় বহন করে। নারীর মর্যাদা তার পর্দায়। পর্দা নারীর শৃঙ্খল নয়। পর্দা বরং নারীর রক্ষাকবচ। উচ্ছৃঙ্খল বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় একমাত্র এই পর্দা। যে সমাজে পর্দা নেই সেই সমাজের নারীরাই বেশি নির্যাতনের শিকার।
মাসুদা বেগম

ইসলামে নেতৃত্ব নির্বাচনের গুরুত্ব


ইসলামে নেতৃত্ব নির্বাচনের গুরুত্ব


হে নবী! নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি পূর্ণ কুরআন পরম সত্যতার সাথে এ জন্যই নাজিল করেছি যে, তুমি সে অনুযায়ী মানুষের ওপর আল্লাহর দেখানো পন্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এবং বিচার-ইনসাফ কায়েম করবে কুরআন অনুযায়ী, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায় না তুমি এসব খিয়ানতকারীকে সাহায্যকারী এবং পক্ষাবলম্বনকারী হয়ে যেয়ো না (সূরা নিসাঃ ১০৫ আয়াত)। আমাদের সামনে আর কিছু দিন পরই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে এখন নির্বাচনী হাওয়া প্রচন্ড গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। কে কাকে ভোট দেবে, এই নিয়ে নানা চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত সম্মানিত ভোটাররা। অনেকে এমন আছেন যাদের নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসত নেই। দিনমুজুর যারা, তাদের কাছে সব কিছুই যেন একটা উল্লম্ফন মনে হয়। তার পরও ভোটের দিন সকালবেলা যেকোনো একজন প্রার্থীকে তিনি ভোট দেবেনই।


অন্যবারের চেয়ে এবার ভোটারদের মাঝে যেন একটি নতুন সাড়া। কারণ দেশ দু’বছরের জরুরি অবস্থা থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পেরেছে। দেশে যে নির্বাচন না হওয়ার একটা সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল সেটা এখন আর নেই। তাই ভোট সবাই দেবে। সবাই ভোট দিন সেটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু আপনি কাকে ভোট দিচ্ছেন সে বিষয়টি কি ভেবে দেখেছেন? কারণ আপনি মুসলমান হলে অবশ্যই আপনার মধ্যে পরকালে আল্লাহর কাছে সব কাজের জবাবদিহিতার ব্যাপারে ভাবতে হবে। আপনি অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবেন। আর কবরে তিনটি প্রশ্ন করা হবে­ আপনার রব কে ছিল? আপনার নবী কে ছিল? আপনার দীন বা ধর্ম কী ছিল? এসব প্রশ্নের জবাব তারা দিতে পারবেন যারা রবের হুকুমমতো দুনিয়ায় চলেছেন। নবীর আদর্শ মোতাবেক জীবনযাপন করেছেন। ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ এমন কোনো কাজ করেননি। তা না হলে ওই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। তখন কবরের কঠিন শাস্তি শুরু হয়ে যাবে যখন হাশরের ময়দানে উঠবেন। তখন পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে, যার জবাব না দিতে পারলে একটি পা পর্যন্ত নড়তে দেয়া হবে না। তা হলো­ তোমার গোটা জীবন তুমি কার পথে অতিবাহিত করেছ? বিশেষ করে জিজ্ঞাসা করা হবে­ তোমার যৌবনকালকে তুমি কার পথে কাটিয়েছ? তারপর বলা হবে­ তুমি কোন পথে অর্থ উপার্জন করেছিলে, আর তা কার পথে খরচ করেছিলে? তুমি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলে সে অনুযায়ী তুমি চলেছিলে কিনা? এই প্রশ্নগুলোর জবাব না দিতে পারলে আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা ওই লোকটির কপালের সামনের চুল ধরবে আর পা ধরে সাথে সাথে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
ইসলামের দাবি হলো­ নেতৃত্ব নির্বাচন করা, এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কেননা আপনার সামান্য একটি সিল বা রায় দেয়া নিয়ে একজন লোক বিশাল ক্ষমতাধর হবেন আর যা না করার তা-ই করবেন। এ ব্যাপারে আপনি কি ভাবছেন নিজে মোটেই দায়ী হবেন না? অবশ্যই হবেন। কারণ ভোট বা সমর্থন হলো একটি পবিত্র আমানত। এর অপব্যবহার যদি হয় তাহলে ভোটদাতা অবশ্যই দায়ী হবেন।
কুরআন অনুযায়ী আমরা সবাই এই পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালার প্রতিনিধি। যিনি যার প্রতিনিধি হন তিনি তার অ্যাসাইনমেন্ট অনুযায়ী কাজ করেন। নিজের থেকে কিছুই করার এখতিয়ার রাখেন না।
যদি তা না করেন তাহলে তিনি তার প্রতিনিধি থাকতে পারেন না। মূলত আমাদের সৃষ্টি করেছেন আল্লাহতায়ালা। তিনি আমাদের পালনেওয়ালা। তিনি আমাদের মাথার ওপর বিশাল আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং পায়ের নিচে বিস্তীর্ণ জমি সৃষ্টি করেছেন। জমি যার এখানে আইন চলবে একমাত্র তাঁরই। তাঁর আইন ছাড়া অন্য কারো আইন চলতে পারে না। মহানবী সাঃ-কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর নবী হজরত মুহাম্মদ সঃ-কে হেদায়েত ও সত্য দীন সহকারে পৃথিবীতে এ জন্যই পাঠিয়েছেন যে, যাতে করে তিনি পৃথিবীর সব মতাদর্শের ওপর ইসলামকে বিজয়ী করতে পারেন। মহানবী সাঃ আল্লাহর এই নির্দেশ পুঙ্খানুপঙ্খ পালন করেছিলেন। যার কারণে তার ইন্তেকালের সময় আরব ভূখণ্ডে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে তাঁর সাহাবি ও দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের সময় অর্ধেক দুনিয়ায় ইসলামের আলো প্রজ্বলিত হয়েছিল।

একেবারে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে মরক্কোর রাবাত পর্যন্ত মুসলমানদের করতলগত হয়েছিল। সুতরাং রাসূল সাঃ-এর আদর্শমতো না চললে সে মুসলমান থাকতে পারে না। কুরআনে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে­ তারা মুমিন নয়, যারা তাদের পারস্পরিক ব্যাপারে রাসূল সাঃ-কে ফায়সালাকারী না মানবে। এমতাবস্থায় যদি আমরা রাসূল সাঃ-কে ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করি, তাকে নেতা মানি তাহলে আজো তাঁর নির্দেশমতো নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। রাসূল সাঃ যাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা হলেন তাঁর নিকটতম সাহাবি বা চার খলিফা। তাদের ৩০ বছরের খেলাফতকালে ইসলামের সোনালি সমাজ সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, লুটতরাজ, জেনা-ব্যভিচার ব হয়ে একটি নিরাপদ নগরীতে পরিণত হয়েছিল মক্কা-মদিনা ও গোটা আরব ভূখণ্ড। আজো যদি কুরআনের আলোকে সুখী সমাজ নির্মিত হয় তাহলে প্রত্যেক মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পেয়ে ধন্য হবে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য আল কুরআনের অনুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। যিনি সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও চরিত্রবান তাকেই মনোনীত করতে হবে। পক্ষান্তরে অসৎ, অত্যাচারী, সন্ত্রাসী, কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিপরায়ণ ও ইসলামবিরোধী কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেয়া হতে বিরত থাকাই ঈমানি দায়িত্ব।
মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী

শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০০৮

ইসলামে সন্ত্রাসের স্থান নেই

ইসলামে সন্ত্রাসের স্থান নেই

ভারতের মুম্বাইয়ে যে জঘন্য সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, তাতে মুসলমান এবং মানুষ হিসেবে আমি লজ্জিত ও আতংকিত। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সূরা কাসাস, ২৮:৭৭)।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ আগে পাঠানো কিতাবের আদেশের কথা মুসলমানদের মনে করিয়ে দিয়েছেনঃ ‘কেউ কাউকে প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ কিংবা দুনিয়ায় ফ্যাসাদ সৃষ্টি করার কারণ ছাড়া হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল, আর যে কেউ কারও জীবন রক্ষা করল, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করলঃ।’ (সূরা মায়িদা; ৫:৩২)।
কোন মুসলমানই নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শিশু, নিরপরাধ নারী-পুরুষঃ তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন, তাদের মেরে ফেলতে পারে না। হ্যাঁ, যুদ্ধের ময়দানে সশস্ত্র শত্রুকে খুন করা জায়েজ, কিন্তু অন্য সময় একজন অমুসলিমের জানমাল মুসলমানদের হাতে নিরাপদ থাকবে।’
অনেক মুসলমান কোরআনে যুদ্ধের আয়াতগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করেন ও ভাবেন, আল্লাহ সব সময়, যেখানেই সম্ভব অমুসলমানদের খুন করতে বলেছেন। এটা ঠিক নয়। হজরত মুহাম্মদ (সা·) একবার এক ইহুদির পক্ষে ও মুসলমানের বিপক্ষে ফায়সালা দিয়েছিলেন। তিনি পবিত্রতম মসজিদ কাবাকে মূর্তি থেকে মুক্ত করেন, কিন্তু কোনদিনই কোন মন্দিরে বা গির্জায় গিয়ে কোন মূর্তি ভাঙেননি বা কোন মুসলমানকে এমনটি করতে আদেশ দেননি। এমনকি, অমুসলিমদের উপাস্যকে গালি দেয়াও কোরআনে নিষেধ। (সূরা আনআম, আয়াত-১৮৮)।
নিরপরাধ নারী, শিশু, বেসামরিক পুরুষদের খুন করার তো প্রশ্নই আসে না, কোন অবিচারও তাদের ওপর করা যাবে না, এটাই ইসলামের শিক্ষা- ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ। তোমরা অবিচল থাকবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে; এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদের কখনও প্ররোচিত না করে ন্যায়বিচার বর্জন করতে। ন্যায়বিচার করবে। ন্যায়বিচার করাই তাকওয়ার নিকটতম। আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন যা তোমরা করো।’ (সূরা মায়িদা, ৫:৮)।
যুদ্ধের ময়দানেও বাড়াবাড়ি করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন- আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তবে সীমা লংঘন করো না। আল্লাহ সীমা লংঘনকারীদের ভালোবাসেন না।
(সূরা বাকারা; আয়াত-১৯০)।
এটা ঠিক যে, ভারত, ইসরাইলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চলছে; কিন্তু তার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বেসামরিক মানুষ খুন করা যাবে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম, এটা শুধু মুখে দাবি করলে হবে না; কাজে প্রমাণ করার দায়িত্বও মুসলমানদেরই নিতে হবে।
জাবীন হামিদ

আমাদের ধর্মে আমাদের বিজয়

আমাদের ধর্মে আমাদের বিজয়


পৃথিবীতে এমন কোন জাতি নেই যাদের কোন বিজয় দিবস নেই, সুখ-শান্তির জাতীয় দিন নেই। মানব জাতির প্রতি এ বিজয় রাব্বুল আলামিনের বিশেষ দান ও করুণা। অন্যায়-অবিচার, অশান্তি ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তিলাভের দিনকেই বলা হয় বিজয় দিবস বা নাজাত দিবস।
ষোল ডিসেম্বর এমনি একটি বিশেষ দিবস, যা আমাদের জাতির জন্য মহা দিবস, মহা বিজয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল এ জাতির এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। এমন কোন মানুষ ও এমন কোন ঘর আমাদের ছিল না, যা এ যুদ্ধে শত্রুদের অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের শিকার হয়নি। পাকহানাদার বাহিনীর এ সীমাহীন গণঅত্যাচার যেন ফেরাউনের অত্যাচার-উৎপীড়নকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আল কোরআনের ভাষায় বনি ইসরাইলের ওপর নিপতিত ফেরাউনের অত্যাচার-উৎপীড়ন ও জোর-জুলুম ছিল ‘বালাউন আজিম’ বা মহাবিপর্যয়। আমাদের জন্যও একাত্তরের নয় মাস ছিল বালাউন আজিম। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মনিবেদিত লড়াই ও জনগণের সর্বান্তকরণ ত্যাগ-তিতিক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে দান করলেন সাহায্য ও বিজয়। যাদের চোখ আছে, মন আছে, আছে অন্তর্দৃষ্টি ও আধ্যাত্মিক নজর, তারাই কেবল বুঝতে পারেন ষোল ডিসেম্বরের বিজয় শুধু আল্লাহপাকেরই খাস রহমত, বিশেষ করুণা ও বিজয়।
একাত্তরের ষোল ডিসেম্বর যারা ঢাকায় ছিলেন তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন কিভাবে জনতার ঢল নেমেছিল ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ও রেসকোর্স ময়দানে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা যেন চাঙ্গা হয়ে ওঠে ঢাকাবাসীর বিজয় উল্লাসে। সেদিন ঈমানদার, আল্লাহওয়ালা মানুষের অন্তরে যেন আল কোরআনের বাণী নতুন করে ইলহাম হতে লাগল- ‘ইযা জা আ নাসরুল্লাহ ওয়াল ফাত্‌হ্‌ ওয়ারাইতান্নাসাই ইয়াদখুলুনা ফি দিনিল্লাহি আফওয়াজা!’ যখন নেমে এলো আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং দেখতে পেল মানুষ ফৌজে ফৌজে প্রবেশ করছে আল্লাহর দিনে। বিজয় উল্লাস ও আনন্দ উল্লাসও আল্লাহর দিন বা ফিতরাত তথা স্বভাব। আল্লাহর স্বভাব গণমানুষের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে উপচেপড়া জোয়ারের মতো, বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো। ষোল ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স পরবর্তী সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাই ঘটেছিল। অন্যায়, অবিচার, জুলুম, অত্যাচার, ব্যভিচার, গণহত্যা, পোড়ামাটিনীতি প্রভৃতি ফেরাউন-হিটলারি অপরাধযজ্ঞের পর অর্জিত বিজয়ে মানুষের মুখে যে হাসি ফুটেছিল তা ছিল আল্লাহর হাসি, আল্লাহরই খুশি ও রেজামন্দি।
আজ সাঁয়ত্রিশ বছর পর যখন একাত্তরের বিজয় দিবস নিয়ে ভাবি তখন চিন্তাগ্রস্ত হই, উৎকণ্ঠিত হই ও শংকিত হই। বিজয়ের যে হাসি, খুশি ও আনন্দ সেদিন আসমান থেকে নেমে এসেছিল মাটির ধরায়, তা বেশি দিন টেকেনি। কেন?
ভাবনার বিষয়, গবেষণার বিষয় নিশ্চয়ই। তবে কঠিন কোন থিসিসের ব্যাপার নয়। এ ভাবনা ও গবেষণার উপাত্ত রয়েছে আল কোরআনের ভেতরই, যা আমরা খোঁজ করিনি, তালাশ চালাইনি। সূরায়ে নাসরের ভেতরই বাকি অংশের প্রতি আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়নি। বিশেষত আমাদের বিজয় অর্জনকারী নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপকরা সেদিকে তাকাননি। সেখানেই ছিল টেকসই বিজয়ের বাণী ও চাবিকাঠি। বলা হয়েছিল, ‘ফাসাব্বিহ বিহামদিহি রাব্বিকা ওয়াস্তাগফিরহু। ইন্নাহু কানা তাওয়াবা।’ আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং জনসমর্থন পাওয়ার পর তা টেকসই করার শর্ত দেয়া হয় যে, রবের গুণগান, প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো, তাঁর কাছে ভুলত্রুটির জন্য অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনা করো।
তিনি অত্যন্ত দয়াবান, ক্ষমাশীল ও করুণাময়। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, আমরা এক সাগর রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করলাম, আগুনের পাহাড় ডিঙিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম এবং অবশেষে বিজয় অর্জন করলাম, কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। আল্লাহর রহমতের চাদর ও সামিয়ানা আমাদের মাথার ওপর থেকে সরে গেল আমাদেরই কারণে, আমাদেরই খোদাবিমুখতার জন্য। বনি ইসরাইল যেমন নাজাত লাভ করেও সামেরির কুমন্ত্রণায় বিপথগামী হল, আল্লাহকে ভুলে গিয়ে শয়তানের পথ ধরল, তেমনি আমরাও আল্লাহকে ভুলে গেলাম, শয়তান ও শয়তানি শত্রুদের আশ্রয়-প্রশ্রয় নিলাম। ফলে যা হওয়ার গত সাঁয়ত্রিশ বছরে তাই হল। বুশ পরিবার ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সরকার আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুশমন ছিল, তারাই হল আমাদের দোস্ত। ব্যস স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয় দিবসের সব ফল-ফসল ওরাই বস্তায় ভরে নিয়ে গেল, ভাগ-বাটোয়ারা করল আমাদের তেল, গ্যাস, কয়লার ময়দান ও ব্লক, পকেটস্থ করল আমাদের জাতীয় ভাগ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতি। আমাদের নেতারা, আমলারা, ব্যবসায়ীরা এবং সমাজপতিরা শয়তানি বিশ্ব শত্রুর খপ্পরে পড়ে তাদের দয়ালু দাতা, মনিব ও ইলাহ হিসেবে মেনে নিল।
ষোল ডিসেম্বরের মহান বিজয় দিবসের মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাই আজ কামনা করি আমাদের সম্বিৎ ও চেতনা। রাব্বুশ শুহাদা ও মুজাহিদিন আমাদের পথ দেখান সিরাতুল মুস্তাকিমে চির নাজাতের দিকে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০০৮

আল কুরআন এবং আমরা


আল কুরআন এবং আমরা



এটা সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুত্তাকিদের জন্য পূর্ণাঙ্গ হিদায়াত।­ (সূরা বাকারা) মানবজাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ আসমানি কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব হলো আল কুরআন। আমাদের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার একমাত্র দিক নির্দেশকই হলো কুরআন।
কুরআন মাজিদ আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি পড়ে থাকি। রমজান মাসে দেখা যায়, কুরআন পাঠ ও খতম নিয়ে প্রতিযোগিতা পর্যন্ত শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কুরআন গতানুগতিকভাবে পাঠ কিংবা খতমের জন্য নয়। হ্যাঁ, কুরআন পাঠে অনেক নেকি পাওয়া যায় সত্যি। কিন্তু আল্লাহপাক যে উদ্দেশ্যে কুরআন মাজিদ নাজিল করেছেন তা সফল হয় না। কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহকে চেনা, তাঁর পথকে চেনা, তিনি যে বিধান জারি করেছেন তা পালন করা। অথচ বড়ই অনুতাপের বিষয় যে, কুরআন আমরা সেভাবে হিফাজত করি না।
বর্তমান বিশ্বে চতুর্দিকে চলছে হানাহানি, মারামারি, খুন, হত্যা, চুরি, সন্ত্রাস, আত্মসাৎ, প্রতারণা, ধর্ষণ, মাদক প্রকোপ, মরণব্যাধি এইডস, নানা রকমের অনাচার, অবিচার। আজকে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক শীর্ষে অবস্থান করছি ঠিকই, কিন্তু কোথাও কোনো শান্তি পাচ্ছি না। এর একমাত্র কারণই হলো আমরা মুসলমানরা কুরআন থেকে অনেক পেছনে। কুরআন থেকে অনেক দূরে। এ যুগের মুসলমানরা কুরআন পড়ে না, আর যারা পড়েন তারাও এর হুকুম আহকাম মেনে চলেন না। অথচ কুরআনই একমাত্র সংবিধান যেটি সমগ্র বিশ্বে এনে দিতে পারে শান্তি তেমনি আমাদের দেবে পরকালীন মুক্তি। রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন­
‘যে ব্যক্তি কুরআন পাক অধ্যয়ন করবে (অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ জ্ঞান লাভ করবে) অর্থাৎ, তদানুযায়ী আমল করবে এবং জীবন গঠন করবে­ তার হালালকে হালাল জানবে, হারামকে হারাম জানবে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন এবং তার পরিবার পরিজনদের ভেতর থেকে এমন দশ জনকে (জান্নাতের জন্য) সুপারিশ করার ক্ষমতা দান করবেন যাদের প্রত্যেকের জন্যই জাহান্নাম নির্ধারিত হয়েছিল।’
উপরিউক্ত হাদিসের আলোকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, কুরআন পড়া, বোঝা ও বুঝে প্রাত্যাহিক জীবনে আমল করাটা কত জরুরি। কিন্তু আমরা অধিকাংশই এটা উপলব্ধি করি না। আমাদের মধ্যে যারা কুরআন পড়ে তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। কুরআন থেকে আমরা অনেক দূরে। আর এ জন্য আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন­ ‘সেই মুসলমান সম্মানিত হয়েছে যে পবিত্র কুরআনের অনুসরণ করেছে। আর তোমরা লাঞ্ছিত ও অধঃপতিত হয়েছো পবিত্র কুরআনকে বর্জন করে।’
সুতরাং পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, কুরআনকে কেবল গতানুগতিকভাবে তিলওয়াত নয়, বরং এর অর্থ ও ব্যাখ্যা বোঝা, এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আমাদের জন্য ফরজ এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা দরকার নতুবা কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহর কাছে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে।
হাফসা ফারুকী প্রতীতি

সন্তানের ব্যাপারে মা-বাবার জবাবদিহিতা


সন্তানের ব্যাপারে মা-বাবার জবাবদিহিতা



আল্লাহতায়ালা মানুষকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। এমনি একটি নেয়ামত হলো সন্তান-সন্তুতি। এ সন্তান যখন দুনিয়াতে আসে তখন সে ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতা নিয়েই আসে। এটাকে আরবিতে ফিতরাত বলা হয়। কিন্তু পরে সে মা-বাবার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নানা রকম মত ও পথ গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাঃ বলেছেন, ‘প্রতিটি শিশুই ফিতরাত তথা ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতাসহ জন্মগ্রহণ করে। তার পর তার মা-বাবা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান অথবা অগ্নিপূজক বানায়। (বুখারি ও মুসলিম)
সহজেই অনুমেয় যে, সুন্দর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার যোগ্যতা প্রতিটি শিশুর মধ্যেই বিদ্যমান আছে। যদি শিশুর মা-বাবা এ ব্যাপারে যত্নবান হয় এবং পরিবেশ যদি সুন্দর চরিত্র গঠনে অনুকূলে থাকে তাহলে শিশুর মধ্যে অনুপম চরিত্রের বিকাশ ঘটে। আর যদি মা-বাবা এ বিষয়ে যত্নবান না হয় কিংবা পরিবেশ যদি চরিত্র গঠনের অনুকূলে না থাকে তবে শিশুর চরিত্র বিনষ্ট হয়ে যায়। কাজেই বুঝা যাচ্ছে সন্তানকে সচ্চরিত্রবান করা কিংবা অকার পথে ঠেলে দেয়ার একমাত্র রূপকার তার মা-বাবা । পবিত্র ধর্ম ইসলাম মা-বাবাকে সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশে দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ প্রদান করেছে এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিধৃত করেছেন।

সন্তানের প্রতি মা-বাবার প্রাথমিক পর্যায়ের কয়েকটি দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে­ যা যথাযথভাবে দায়িত্বশীলতার সাথে পালনের মাধ্যমেই সন্তানকে সৎ, চরিত্রবান এবং একজন পূর্ণাঙ্গ আদর্শ মানুষের মূর্ত প্রতীক বানানো সম্ভব। মহানবী সাঃ সন্তানের প্রতি মা-বাবার দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলতে গিয়ে ঘোষণা করেন, ‘মা-বাবার প্রতি সন্তানের হক হচ্ছে ­ প্রথমত, তিনটি। ১. জন্মের পর পরই তার জন্য একটি সুন্দর নাম রাখা, ২. জ্ঞান বৃদ্ধি হলে তাকে কুরআন তথা দীন শিক্ষা দেয়া, ৩. আর সে যখন বালিগ হবে তখন তার বিয়ের ব্যবস্থা করা।’ বস্তুত সন্তানের ভালো নাম না রাখা, কুরআন ও দীন শিক্ষা দান না করা এবং বালিগ হওয়ার পর তার বিয়ের ব্যবস্থা না করা মা-বাবার জন্য অপরাধের শামিল। এ সব কাজ না করলে মা-বাবার পারিবারিক দায়িত্ব পালিত হতে পারে না এবং ভবিষ্যৎ সমাজ ও ইসলামি আদর্শ মোতাবেক গড়ে উঠতে পারে না। এ কারণেই ইসলাম উপরিউক্ত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ করে শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি জোর তাগিদ প্রদান করেছে। ইসলামে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর জ্ঞানার্জন ফরজ। এ ফরজ কোনো বিশেষ শ্রেণী, দল বা জাতির জন্য নয়। বরং এ হচ্ছে এমন একটি সর্বজনীন অধিকার যা প্রতিটি মানুষকে শামিল করে। এ ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের শিক্ষা দাও।’ ইসলাম সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি কতটা যত্নশীল তা বুঝা যায় বদরের যুদ্ধে বন্দী মুক্তির ঘটনায়। এ যুদ্ধে কিছুসংখ্যক বন্দী এ শর্তে মুক্তি পায় যে তারা দশজন করে মুসলিম সন্তানকে লেখাপড়া শেখাবে।
ইসলাম সন্তানদের আদব-কায়দা, শিক্ষা-দীক্ষা ও সচ্চরিত্রবান করার ব্যাপারে মা-বাবাকে এ রকম তাগিদ দেয়া সত্ত্ব্বেও আমাদের সমাজের চিত্র অনেকটা ব্যতিক্রম। আমাদের সমাজের তথাকথিত এলিট শ্রেণীর লোকদের কাছে এখন ধর্মীয় শিক্ষার চেয়ে পাশ্চাত্য ধারণার রুচিহীন সেকুলার শিক্ষা খুবই সমাদৃত। ফলে আমাদের তরুণ-তরুণীদের নৈতিকতার চরম অবক্ষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। গত ২৭ জুলাই ’০৮ একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিক পত্রিকায় অভিজাত এলাকায় নাইট পার্টির নামে যা হচ্ছে­ শিরোনামে নগ্ন ছবি সংবলিত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সে ছবিটি দেখলে নিজেকে বিশ্বাস করানো কঠিন যে এটা কোনো মুসলিম দেশের মুসলমান সন্তানদের কীর্তিকাণ্ড! ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রাজধানীর অভিজাত পাড়ার কিছু হোটেল রেস্তোরাঁয় নাইট পার্টি আবারো জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতি রাতেই তারা আয়োজন করছে ড্যান্স ও ড্রিংকস পার্টি। প্রাপ্ত বয়স্কদের পাশাপাশি অল্প বয়সী অনেক কিশোর-কিশোরীকেও দেখা যায় এ সব পার্টিতে।

রাতভর উন্মাতাল নাচগান শেষে নেশায় বুঁদে হয়ে শেষ রাতে ঘরে ফিরে যায় তারা। এ ধরনের নাইট পার্টিতে অপ্রীতিকর ঘটনাও অহরহ ঘটার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এ প্রতিবেদন পড়ে বারবার মনের মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি মারছে যে, উঠতি বয়সী সন্তানকে নাইট ক্লাবে পাঠিয়ে মা-বাবা আরামে ঘুমাচ্ছেন­ তারা কেমন মা-বাবা? তাদের মধ্যে কী সন্তানের ব্যাপারে একটুও দায়িত্বানুভূতি নেই? তারা কেন বা কোন স্বার্থে ‘লিভ টুগেদার’কে বর্তমান সমাজের বা যুগের চাহিদা বলে নিজেদের সন্তানদেরকে অকার জগতে ঠেলে দিচ্ছে? তাদের মধ্যে কী পরকালীন কোনো ভয়-ভীতি নেই? তাদের বুঝা উচিত, আল্লাহতায়ালা তাদের যে সন্তান দিয়েছেন সে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করার দায়িত্বও তাদের দিয়েছেন। তারা সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাদের আসামি হিসেবে আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মহানবী সাঃ মা-বাবাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই রাখাল (দায়িত্বশীল), তোমাদের প্রত্যেককেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞসা করা হবে। (বুখারি) আর আল্লাহতায়ালা তো আরো সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ‘তোমরা নিজে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচ এবং তোমাদের আহল তথা পরিবারকেও বাঁচাও। সুতরাং সন্তানকে সৎ ও সচ্চরিত্রবান করার ক্ষেত্রে মা-বাবাকে কখনোই গাফলতি করা সমীচিন নয়। মা-বাবার উচিত তাদের সন্তানদের হজরত লোকমান আঃ-এর মতো নসিহত করা। তাদের চরিত্রবান করে গড়ে তোলার জন্য এক দিকে মা-বাবা যেমনিভাবে সচেষ্ট থাকবেন অপর দিকে আল্লাহর দরবারে দোয়া করবেন। কেননা আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া মানুষের চেষ্টা কখনো ফলপ্রসূ হতে পারে না। কুরআন মজিদে মা-বাবাকে তাদের সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার উপদেশ এবং শিক্ষা দেয়া হয়েছে। সূরা ফুরকানে আল্লাহর নেক বান্দাদের অন্যান্য গুণের সাথে এ গুণটির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহর নেক বান্দাহ তারাই যারা সব সময় এই বলে দোয়া করে হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি দান কর যারা আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর হবে। (২৫ঃ৭৪) আর সুসন্তান রেখে যাওয়ার ফায়দা সম্পর্কে মহানবী সাঃ বলেছেন, মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার আমলের দরজা ব হয়ে যায়। তবে তিনটি কাজ ব্যতীত অর্থাৎ তিনটি কাজের ফল সে মৃত্যুর পরও ভোগ করতে পারে। এক. সাদকায়ে জারিয়া, দুই. এমন এলম­ যা মানুষের উপকারে আসে, তিন. নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করবে। (আল আদাবুল মুফরাদ, পৃ. ৪৯।


লেখকঃ প্রবকার, গবেষক

ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে আত্মকর্মসংস্থান


ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে আত্মকর্মসংস্থান



পরনির্ভরশীল, অকর্মা, অলস কুড়ে বাদাইম্যা লোকের স্থান ইসলামে নেই। ইসলাম সব সময়ই এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছে। কোনো নবী-রাসূল পরনির্ভরশীল ছিলেন না। সবাই পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। মূলত আত্মকর্মসংস্থানহীন লোকের মাধ্যমে সমাজে, দেশে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও অনৈতিক কাজ হয়ে থাকে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আখড়া। যেহেতু একজন লোককে বাঁচার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, অন্ন, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির প্রয়োজন হয় তাই অকর্মা লোকরা অর্থের সংস্থানের জন্য সমাজে অনৈতিক কাজ করে থাকে। বক্ষ্যমাণ শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনার প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।
কর্মক্ষম ব্যক্তির বসে থাকা ঠিক নয়ঃ এক দিকে দেশের জনগণের আত্মকর্মসংস্থান করে দেয়ার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আত্মকর্মসংস্থান করে নেয়াও নৈতিক দায়িত্ব। আমরা বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখতে পাবো লাখো লাখো কর্মক্ষম বেকার যুবক বসে আছে। অথচ তাদের চাহিদা কিন্তু থেমে নেই। চাহিদা পূরণের জন্য তারা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি-রাহাজানি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি তাদের নিত্যদিনের কার্যসূচিতে পরিণত হয়েছে। যেহেতু তাদের পরিশ্রমলব্ধ টাকা নয় তাই টাকাগুলোও ব্যবহার হচ্ছে অনৈতিক কাজে।

মদ, জুয়া, হাউজি, নারীবাজি ইত্যাদিসহ সব অসামাজিক কাজে তারা ব্যবহার করছে কালো টাকা। এসব শিক্ষিত বেকার যুবক সাময়িকভাবে ডিগ্রি অর্জনের অহঙ্কার ত্যাগ করে যদি নিজেরা আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নেয়ার চেষ্টা করত, বসে না থেকে ব্যবসা বা কৃষি যেকোনো কাজে যদি আত্মনিয়োগ করত, তাহলে দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেও সচ্ছল হতো। অবশ্য এর পেছনে আমাদের দেশের একটি ভুল ধারণা কাজ করে থাকে তা হলোঃ শিক্ষিত যুবকদের চাকরি ছাড়া অন্য কাজ করা বেমানান। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি আলোচনা করলে আমরা প্রথমেই দেখতে পাবো কর্মক্ষম ব্যক্তি নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকা হারাম। কোনো মুসলমান কাজ করার শক্তি আছে এবং বাজারে শ্রমের মূল্য আছে, এমতাবস্থায় ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন হওয়ার বা আল্লাহর ওপর নির্ভরতার নাম করে রিজিক উপার্জন থেকে বিরত বা বেপরোয়া হয়ে থাকবে তা কিছুতেই হতে পারে না।
অনুরূপভাবে লোকজনের দান-খয়রাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বসে থাকা বা জীবিকা উপার্জনের উপায়-উপকরণ হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও তা ব্যবহার করে উপার্জনে আত্মনিয়োগ না করা এ পন্থায় নিজের ও নিজ আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজন পূরণ করতে চেষ্টা না করা কোনোক্রমেই জায়েজ হতে পারে না। এ ব্যাপারে রাসূল সাঃ বলেছেন­ দান-খয়রাত গ্রহণ করা কোনো ধনী লোকদের জন্য জায়েজ নয়, শক্তিমান ও সুস্থ ব্যক্তির জন্যও জায়েজ নয়। (তিরমিযী)। মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হয়, তখন জামিনে ছড়িয়ে পড়ো আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহ (জীবিকা) থেকে অন্বেষণ করো। (জুমআঃ ১০)। উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে অকর্মা হয়ে বসে থাকা ইসলামে জায়েজ নেই।
ভিক্ষাবৃত্তি ইসলামে জায়েজ নেইঃ ওপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম। রাসূল সাঃ বলেছেন, মহান আল্লাহর কাছে হালাল কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বা রাগের উদ্রেক সৃষ্টিকারী কাজ হলো স্ত্রীকে তালাক দেয়া, ভিক্ষাবৃত্তি করা। (আল হাদিস)। সামাজিক জীবনে আমরা দেখতে পাই যারা ভিক্ষাবৃত্তি করে তারা অসম্মানজনক, অবহেলিত ও তুচ্ছ জীবনযাপন করে। কোনো মুসলমান অপর কারো কাছে হাত প্রসারিত করলে তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিলীন হয়ে যাবে এবং স্বীয় মনুষ্যত্বের মানমর্যাদা অকারণে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নবী করীম সাঃ এ ব্যাপারে কঠিন ও কঠোর বাণী উচ্চরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে ভিক্ষা চায়, সে নিজ হস্তে অঙ্গার একত্রিত করার মতো ভয়াবহ কাজ করে। (বায়হাকী ইবনে খুজাইমা)। রাসূল সাঃ আরো বলেন- ‘যে লোক ধনী হওয়ার উদ্দেশ্যে লোকদের কাছে ভিক্ষা চাইবে সে নিজের চেহারাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য ক্ষতযুক্ত করে দিল। সে জাহান্নামের গরম পাথর ভক্ষণ করতে বাধ্য হবে। এখানে যার ইচ্ছা নিজের জন্য এ সব জিনিস বেশি পরিমাণে সংগ্রহ করুক আর যার ইচ্ছা কম করুক।’ রাসূল সাঃ আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ভিক্ষা করার কাজে নিজেকে অভ্যস্ত বানায় সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে এমন অবস্থায় যে, তার মুখমণ্ডল এক টুকরা গোশতও থাকবে না।’ (বুখারি মুসলিম) উল্লিখিত হাদিসগুলো থেকে আমরা জানতে পারলাম ভিক্ষাবৃত্তির ভয়াবহ পরিণাম। সুতরাং আত্মনির্ভরশীল না হয়ে পরনির্ভরশীল হওয়া বা পরগাছা হওয়া ইসলাম আদৌ সমর্থন করে না।
আত্মকর্মসংস্থানের ব্যাপারে নবী-রাসূল সাঃদের জীবনী থেকে দৃষ্টান্তঃ আল কুরআন, আল হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই, কোনো নবী-রাসূল অলস বা নিষ্কর্মা ছিলেন না। হাদিসে এসেছে রাসূল সাঃ বলেছেন, হজরত দাউদ আঃ নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। (বুখারি)
অন্য হাদিসে আছে­ হজরত জাকারিয়া আঃ ছিলেন একজন ছুতার বা কাঠমিস্ত্রি। মুস্তাদরাকে হাকেমে হজরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত আছে যে, হজরত আদম আঃ কৃষি কাজ করতেন, হজরত নূহ আঃ কাঠমিস্ত্রি ছিলেন, হজরত ইদ্রিস আঃ কাপড় সেলাই করতেন, হজরত মূসা আঃ রাখালের কাজ করতেন। অন্য একটি হাদিসে এসেছে­ রাসূল সাঃ বলেছেন, এমন কোনো নবী-রাসূল ছিলেন না যিনি বকরি বা ছাগল চরাননি। তা ছাড়া রাসূল সাঃ নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাসূল সাঃ ইহুদির কূপ থেকে খাদ্যের বিনিময়ে পানি তুলে দিয়েছেন। ব্যবসা পরিচালনা করেছেন­ ছাগল চরিয়েছেন। বিভিন্ন মানুষকে কামলা দিয়েছেন। সুতরাং কাজ না করে বসে থাকার কোনো অবকাশ অন্য ধর্মে থাকলেও ইসলামে নেই। নবী-রাসূলগণ ইচ্ছা করলে বর্তমান পীর মুরিদী ব্যবসার চেয়ে আরো আলিশানভাবে থাকতে পারতেন। রাজকীয় হালতে চলতে পারতেন। কিন্তু ইসলাম এগুলো সাপোর্ট করে না। যেখানে নবী-রাসূল আঃ কামার, ছুতার কৃষকের কাজ করতেন, রাখালের কাজ করতেন, কামলা দিতেন, সেখানে আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিরা কেন এসব কাজ করতে লজ্জাবোধ করি। নবী-রাসূল সাঃ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতেন সেখানে কেন আমরা অপরের গলগ্রহ বা অকর্মা, নিষ্কার্মা পরজীবি হয়ে জীবনযাপন করব? কোনো বিবেকবান মানুষ অকর্মা হয়ে বসে থাকতে পারে না। পরগাছা, পরজীবীরা সমাজে অসম্মানিত, লাঞ্ছিত, ধিকৃত, অবহেলিত, অপাঙক্তেয়। সুস্থ, সবল শিক্ষিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো লোক পরজীবী বা পরগাছা হয়ে জীবনযাপন করতে পারে না।
জীবিকা উপার্জনে উৎসাহ প্রদানঃ বাবুই পাখি চড়ুই পাখির কাহিনী অর্থাৎ নিজে বাসা নির্মাণ এবং পরের ঘরে থাকার মধ্যে পার্থক্য কী? কবি পরোক্ষভাবে আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। আসলে আত্মতৃপ্তি বলে একটি কথা আছে। নিজ হাতে উপার্জন এবং অপরের ঘরে বসে খাওয়ার মাধ্য পার্থক্য কী মানবীয় জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। রাসূল সাঃ ইশরাদ করেছেন,‘নিজ হাতে উপার্জনকারী ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বান্দা। অপর একটি হাদিসে রাসূল সাঃ বলেছেন, ওই ব্যক্তিই উত্তম যে নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে।’ জনৈক সাহাবি রাসূল সাঃ-এর কাছে ভিক্ষা চাইতে এলে রাসূল সাঃ তাকে ভিক্ষা না দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের উপায় বাতলিয়ে দেন। সাহাবায়ে কেরাম রাঃ ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। সবাই নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কেউ কারো গলগ্রহ হয়ে থাকেননি।
শেষ কথাঃ উরোল্লিখিত আলোচনা থেকে আমাদের কাছে এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হলো যে, নবী-রাসূর সাঃ সবাই ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। সবাই নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কাজ যত ক্ষুদ্র হোক না কেন তারা তা করতেন। কোনো কাজকে অবহেলা করতেন না। বৈধ যেকোনো কাজ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। ভিক্ষাবৃত্তি বা পরজীবী হিসেবে জীবনযাপনকে শুধু নিরুৎসাহিতই করেননি বরং ঘৃণা করেছেন। আমাদের উচিত নবী-রাসূল সাঃ এর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়া, নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহ করা। আল্লাহ আমাদের এ আলোচনা থেকে শিক্ষা নেয়ার তাওফিক দিন।


লেখকঃ এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

হজের পরবর্তী ভাবনা



হজের পরবর্তী ভাবনা



মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত, আল্লাহ ও রাসূল সাঃ-এর প্রিয় ও খাস মেহমান সম্মানিত হাজীদের হজ শেষে দেশে আগমনকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা, মুবারকবাদ ও স্বাগতম। রাসূল সাঃ বলেন, ‘হজ সমাপনকারী সদ্যজাত ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ।’ রাসূল সাঃ আরো বলেন, ‘হজের বিনিময় একমাত্র জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়।’ (আল-হাদিস)
পবিত্র হজ পালনকারী আল্লাহর খাস মেহমান ও প্রিয় বান্দারা দেশে আগমন করার সাথে সাথেই শুরু হবে তাদের আত্মজিজ্ঞাসা এবং আত্মসমালোচনা ও শুষ্ক মরুপ্রান্তরে যখন আল্লাহর রহমতের বারিধারা মুষলধারে বর্ষিত হয় তখন ধরণীর ধুলার ধারাসহ সব ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে মুছে মরুভূমি যেমন হয় পূত-পবিত্র তেমনি হয় তার বুকের তরুলতা, গাছ-গাছালি তরু তাজা, ফুলে ফলে হয় সুশোভিত, ঠিক তেমনভাবেই হজ সমাপনান্তে প্রত্যেক হাজী সর্বপ্রকার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে তাদের অন্তর, মন আত্মা ও দেহ বিবেক বুদ্ধি হয় পূত-পবিত্র এবং আল্লাহর গুণে গুণান্বিত। প্রত্যেক হাজীকে নবজীবন ধারণ করে আলোকময় সমাজ গড়ার চেষ্টা করতে হবে। আর এ চেষ্টা করাটাই হবে হজের সার্থকতা।
হাজীরা হজের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর যে যেভাবে মক্কা শরিফ গমন করেন সে সেই অবস্থায়ই আল্লাহর গৃহ কাবা শরিফ দেখা মাত্রই এবং আল্লাহর গৃহ তাওয়াফকালীন সময়ে আবেগাপ্লুত হয়ে মনের গভীর থেকে আল্লাহর কাছে প্রেম নিবেদনের সময় বলতে থাকেন লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নেয়মাতালাকাল মুলক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। অর্থ ‘হে প্রভু! দয়াময় খোদা! আমি তোমার দরবারে হাজির, তোমার কোনো শরিক বা অংশীদার নেই, আমি তোমার দরবারে হাজির হতে পেরে তোমার সব নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।’ প্রত্যেক হাজী কাবাগৃহের সামনে এবং বিশাল আরাফাতের ময়দানে এ কথাগুলো বারংবার মনের আবেগে উচ্চারণ করে থাকেন।
প্রত্যেক হাজী হজ পালন করার সময় বারংবার যেভাবে তালবিয়া পাঠের মধ্যে সে নিজেকে আল্লাহর সমীপে উৎসর্গ করে থাকেন, ঠিক তেমনভাবে হজ শেষে দেশে ফিরে তার প্রতিটি মুহূর্ত ও কর্মক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করা এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা একান্ত কর্তব্য। হজ পালনকারী ব্যক্তি হজের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য। আমাদের প্রিয় নবী উম্মতের কাণ্ডারি রহমতের ভাণ্ডার, হজরত মুহাম্মদ সাঃ যেভাবে তার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক জীবন অতিবাহিত করেছেন সেভাবেই প্রত্যেক হাজীকে তাদের নতুন জীবন শুরু করতে হবে। নতুবা হজ পালনকারী হাজীদের আসল উদ্দেশ্য সফল হবে না। আর হজেরও যথাযথ মূল্যায়ন হবে না।
প্রত্যেক হজ পালনকারী আল্লাহর মেহমান। হাজীরা মুসলিম মিল্লাতের জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিমসহ (আঃ) ইসমাঈল (আঃ) এবং আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ সাঃ সুন্নাত তরিকা অনুসারে মিনাপ্রান্তরে শয়তানের উদ্দেশে তিনটি জামরাতে তিন দিনে ৭ ী ৭-৪৯টি পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন। মূলত সেগুলো কিন্তু শয়তান নয়, তা ছিল শয়তানের প্রতীক মাত্র। আর সেখানে পাথর নিক্ষেপ করাও একটি প্রতীকী স্মৃতি চিহ্ন কাজ মাত্র। মানুষকে সৎ পথ থেকে দূরে সরানোর লক্ষ্যে শয়তান হাজীদের পদে পদে ধোঁকা দেবে তাই শয়তানকে উপেক্ষা করে সৎ পথে থাকার জন্য দৃঢ় চেষ্টা ও আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োজিত থাকতে হবে।
প্রত্যেক হাজী হজের নীতি অনুসরণে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে সর্বপ্রকার পাপাচার-কামাচার ভোগ-বিলাস, হিংসা, অহঙ্কার, ক্ষোভ, সুদ, ঘুষ, জুয়া, মদপান, ধূমপান, দাড়ি কামানো গিবত, শেকায়াত, অপচয় খেল-তামাশাসহ মিথ্যা কথা ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিহার করতে হবে। সর্বপ্রকার পাপকাজ থেকে বিরত থেকে শয়তানের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা ধিক্কার, উপেক্ষাই হবে মিনার ময়দানে শয়তানের উদ্দেশে পাথর নিক্ষেপ করার বাস্তব নমুনা হাজীরা মিনার ময়দানের পাথর নিক্ষেপের পর আল্লাহর প্রেমে পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন, মনে রাখতে হবে এই পশুটি কোরবানি করাও একটি প্রতীকী বা স্মৃতি চিহ্ন আমল বা কাজ। আল্লাহ হজরত ইব্রাহিমকে (আঃ) স্বপ্নের মাধ্যমে আদিষ্টিত করেছেন তার প্রিয় বস্তুটি কোরবানি করার জন্য। হজরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর প্রেম-প্রীতি ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে প্রায় ৯৯ বছর বয়সে প্রাপ্ত একমাত্র সন্তান ইসমাঈলকে (আঃ) আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি করার জন্য চরমভাবে আত্মত্যাগের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। ইব্রাহিম (আঃ) সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর উদ্দেশে আত্মত্যাগের মহান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খলিল উপাধি লাভ করেন। যার ফলে মহান আল্লাহতায়ালা তার কাজে খুশি হয়ে তার একমাত্র সন্তানের পরিবর্তে একটি পশু কোরবানির জন্য ছুরির নিচে হাজির করে দেন। এ ঘটনাটি আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয় হয়েছে বিধায় আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রেম নিবেদনের স্মৃতিটুকু ধরে রাখার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত সব সামর্থøবান মুসলমানের ওপর কোরবানি ওয়াজিব করেছেন।
পশু কোরবানি করা প্রতীকী বা স্মৃতি চিহ্ন আমল। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব সকল! জেনে রেখো কোরবানির গোশত ও রক্ত কিছুই আমার কাছে পৌঁছে না। কেবলমাত্র পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া, আমি দেখতে চাই তোমরা কে কতটুকু আমাকে ভালোবাস এবং ভয় করো।’
আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী খরচ করাই কোরবানির প্রধান লক্ষ্য, উদ্দেশ্য। তাই আল্লাহপাক বলেন, ‘হে আমার বান্দা সকল! তোমরা বলো, নিশ্চয় আমার সালাত বা নামাজ, আমার কোরবানি বা আত্মত্যাগ, আমার হায়াত বা জীবন, আমার মরণ সব কিছুই বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করলাম। তাই প্রত্যেক হাজীর উচিত হজ থেকে ফিরে এসে হজের সব বিধিবিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য চেষ্টা করা।



মাওলানা আবুল হোসাইন পাটওয়ারী

কুরআন-হাদিস চর্চায় প্রযুক্তি


কুরআন-হাদিস চর্চায় প্রযুক্তি



কম্পিউটার শিক্ষা শুধু বিজ্ঞান গবেষক বা বিজ্ঞান নিয়ে পড়া-লেখা করেন তাদের জন্য প্রয়োজনীয়। অন্যদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইসলামি শিক্ষার ছাত্র বা গবেষকদের এর প্রয়োজনীয়তা কম বা তা থাকলেও শুধু কম্পোজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এ ধরনের একটা ধারণা উভয় প্রকার লোকদের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু আসলে কি তাই? না, বরং কুরআন-হাদিস তথা ইসলাম চর্চায় প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। প্রযুক্তির বদৌলতে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি প্রাপ্তি যেমন সহজ ও স্থায়ী হয়েছে তেমনি যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তথ্য অনুসানও হয়েছে সহজ। পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত বের করা, একটি নির্দিষ্ট শব্দ পবিত্র কুরআনে কতবার এসেছে ও কোন কোন সূরায় বর্ণিত হয়েছে এবং শত শত গ্রন্থের মধ্য থেকে একটি হাদিস অনুসান করা এখন কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। তাই বর্তমানে কুরআন, হাদিস বা ইসলাম নিয়ে গবেষণার জন্য কম্পিউটার জানা অতীব প্রয়োজন।

তবে সব কম্পিউটারেই যে এ প্রোগ্রামগুলো ডিফল্ড হিসেবে থাকে তা কিন্তু নয়, বরং কম্পিউটারে এসব প্রোগ্রামগুলো ইনস্টল করে নিতে হয়ে। তাই ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতরা যদি কম্পিউটার শিক্ষায় আরো একটু এগিয়ে আসেন তবে ইসলাম নিয়ে গবেষণা আরো সহজ হবে এবং মানুষের কাছে ইসলাম আরো সুন্দর ও যুগোপযোগী হিসেবে উপস্থাপিত হবে। এ জন্য কম্পিউটার শিক্ষাকে শুধু কম্পোজ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ইনস্টল করা, উইন্ডোজের ছোট ছোট সমস্যাগুলো সমাধান করা, ইন্টারনেটে তথ্য অনুসান করতে পারা, ইন্টারনেট থেকে ফাইল ডাউনলোড করা ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা রাখতে হবে।
উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থাঃ প্রযুক্তির বদৌলতে আজ বিভিন্ন গ্রন্থাদি সংরক্ষণ অনেক সহজ হয়েছে এবং স্থায়িত্ব পেয়েছে। সিডি, ডিভিডি, হার্ডডিস্ক, সার্ভার ইত্যাদির মাধ্যমে ছোট একটি ব্রিফকেসে বড় একটি লাইব্রেরি যেমন রাখা সম্ভব, তেমনি সম্ভব দ্রুত তা থেকে একটি বই খোঁজা। কম্প্যাক্ট ডিস্কের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো সিডি এবং এ নামেই এটি অধিক পরিচিত। বর্তমানে যেসব নরমাল সিডি পাওয়া যায় সেগুলোর ধারণক্ষমতা ৭০০-৮০০ মেগাবাইট, যার বাজার মূল্য ১৫-২৫ টাকা। এ ধরনের একটি ডিস্কে কমপক্ষে আড়াই লাখ পৃষ্ঠার সমপরিমাণ বই সংরক্ষণ করা যায়। আর ভালো মানের একটি ডিস্কের মূল্য ১০০০-১৫০০ টাকা। যার কিনা ১০০ বছরের গ্যারান্টি দেয়া হয়ে থাকে। আর ডিভিডি’র ধারণক্ষমতা ১ গেগাবাইট (১ গেগাবাইট= ১০২৪ মেগাবাইট)। তাই সিডি/ডিভিডিতে সংরক্ষণের কারণে যেমন অনেক জায়গার প্রয়োজন হয় না তেমনি বইগুলোর পৃষ্ঠা কয়েক বছর পরেই লাল হয়েও যায় না। অতএব বুখারি, মুসলিমসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি সিডিতে সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। ইতোমধ্যে তা অবশ্য শুরুও হয়ে গেছে। এতে যেমন বইটির স্থায়িত্ব বাড়বে তেমনি অধ্যয়ন করাও সহজ হবে। কেননা কয়েক শত পৃষ্ঠার একটি বইয়ের ভেতরের যেকোনো পৃষ্ঠায় বা অনুচ্ছেদে যেতে কোনো পৃষ্ঠাও উল্লাটে হবে না আবার অনেক দিন ধরে না পড়ার কারণে বইটির ধূলাও ঝাড়তে হবে না।
গবেষণা সহায়ক প্রোগ্রামঃ লেখা-লেখির জন্য ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় সফটওয়্যার হলো এমএস ওয়ার্ড। কম্পিউটারে ব্যবহৃত সব সফটওয়্যারই হলো এক-একটি প্রোগ্রাম। অনুরূপভাবে কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি গদ্য-পদ্য ইত্যাদি বিষয়েও বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রামার তৈরি হয়েছে। পবিত্র কুরআনের শব্দ বা আয়াত অনুসান, সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসির ইত্যাদি নিয়ে যেসব সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘আল-মুসহাফ আর-রাকমি’। এর মাধ্যমে মুহূর্তেই বের করা যাবে আয়াতটি কোন সূরার বা এ শব্দটি কুরআনে কতবার এসেছে। এ ছাড়াও যেকোনো আয়াতের ওপর ক্লিক করলেই পাওয়া যাবে সেই আয়াতের একাধিক গ্রন্থের তাফসির। সুতরাং কোনো আয়াত বের করে সেই আয়াতটি আবার তাফসির গ্রন্থের কোন খণ্ডে আছে তা বের করতে অনেক সময় ব্যয় হলেও মাত্র কয়েক মিনিটেই আমরা কাঙ্ক্ষিত আয়াতটি বের করে তার তাফসির পড়তে পারি এক জায়গায় বসে আঙুলের একটি মাত্র চাপে।

আবার অনেক প্রোগ্রাম তৈরি হয়েছে পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াতকে প্রাধান্য দিয়ে, যাতে মাখরাজসহ প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ রাখা হয়েছে। শ্রোতরা এ প্রোগ্রামের সাহায্যে পূর্ণাঙ্গ কুরআনের তেলাওয়াত শোনাসহ শুদ্ধ করে তেলাওয়াত শিখতেও পারবে। এ রকম আরো একটি প্রোগ্রামের নাম আলিম সফট। এতে পুরো কুরআনের তেলাওয়াত শোনা ও পাঠ করাসহ ইংরেজি অনুবাদ পড়া যাবে এবং বিষয়ভিত্তিক আয়াতও খুঁজে বের করা যাবে। এহেন অনেক প্রোগ্রাম আছে যেগুলোর সাহায্যে কুরআন বুঝা ও গবেষণা করা অনেক সহজ হয়েছে সব ভাষাভাষী লোকদের জন্য।
হাদিস নিয়েও এ রকম অনেক প্রোগ্রাম তৈরি হয়েছে। এগুলোতে শুধু হাদিস গ্রন্থই নয়, বরং এর ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোও স্থান পেয়েছে। তাই সঠিক হাদিসটি চিহ্নিত করা ও মেনে চলা এবং কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে হাদিসে নববীর দলিল পেশ করা আজ অত্যন্ত সহজ। একটিমাত্র শব্দ দিয়ে হাজার-হাজার হাদিসের গ্রন্থ থেকে মিনিটেই একটি হাদিস খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এ ধরনের একটি প্রোগ্রামের নাম হলো ‘মাকতাবাতু আলফিয়াতুস সুন্নাহ আন নাবুবিয়্যাহ’। এতে হাজারের অধিক বই সংরক্ষিত আছে। ধরা যাক, আপনি একটি হাদিস খুঁজছেন। কিন্তু এর আংশিক স্মরণ হচ্ছে অথবা হাদিসটি কোন গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে তা জানা দরকার, এমতাবস্থায় আপনার পক্ষে সব হাদিসের গ্রন্থ পড়ে হাদিসটি খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আপনাকে কোনো হাদিস বিশারদের স্মরণাপন্ন হতে হবে। তবে তার কাছ থেকেও তাৎক্ষণিক উত্তর পাওয়া সব সময় সম্ভব নাও হতে পারে। অথচ আপনি শুধু সেই হাদিসের একটিমাত্র শব্দ লিখে সার্চ দিলেই মুহূর্তেই জানতে পারবেন হাদিসটি কোন গ্রন্থে আছে বা আদৌ হাদিসটি আছে কি না। আর আপনি জোরালোভাবেই হাদিসটির বিশুদ্ধতা বা জাল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন। কেননা মানুষের অনুসানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও কম্পিউটার কখনো ভুল করে না যদি তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা হয়। সুতরাং কুরআন-হাদিসের চর্চায় এহেন সফটওয়্যার যেমন তথ্য অনুসানে সময় বাঁচাবে তেমনি গবেষকের আগ্রহ বাড়াবে এবং গবেষণাকে সমৃদ্ধ করবে।
ইন্টারনেটঃ তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির অন্যতম সুফল হলো ইন্টারনেট। কোথায় কোন গবেষণা হচ্ছে, কত দূর এগিয়েছে তার সর্বশেষ খবর মুহূর্তেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি ইন্টারনেটের মাধ্যমে। সুতরাং ইসলাম নিয়ে যে প্রান্তেই কাজ হোক আর যতটুকুই হোক না কেন তা সাথে সাথেই জানতে পারছে সব প্রান্তের লোকেরা। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে মুহূর্তেই বের হয়ে আসবে কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের ফলাফল। ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত হলো এসসবলপ, ণথভসস, অলয়থঠমঢ়য়থ, গঢ়ষ ইত্যাদি। ইদানীং ঈৎমল নামক আরো একটি সাইট আত্মপ্রকাশ করেছে। আরবি বই/বিষয় অনুসান করতে আরবিতে সার্চ করাই বেশি ফলপ্রসূ। এ ক্ষেত্রে উইন্ডোজটি অ্যারাবিক এনাবল করে নিতে হবে।
এ ছাড়াও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তাফসির ও হাদিস মূল আরবি গ্রন্থগুলো এবং হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলো সর্বত্র পাওয়া যায় না। তাই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত অনেক গ্রন্থের মূল টেক্স না পাওয়ায় ফটোকপি করে তা পড়ানো ও পড়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকবার ফটোস্ট্যাট করার কারণে লেখাও অস্পষ্ট হয়ে থাকে। এতে পাঠকও বইটি পড়তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অথচ এ ধরনের অনেক বই বিনা মূল্যে ইন্টারনেট থেকে ফ্রি পড়া যায় এবং ডাউনলোড করা যায়। এমনই একটি সমৃদ্ধ চমৎকার সাইট হলো আল-মেশকাত, এতে পাওয়া যাবে কুরআন, উলুমুল কুরআন, হাদিস, উসুলে হাদিস, হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলো, ইসলামি সাহিত্য, আরবি সাহিত্য, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থাবলি। এ ছাড়াও এখানে বিভিন্ন পত্রিকা ও যুগোপযোগী প্রবগুলো পড়া এবং বিভিন্ন বিষয়ের মাসআলা জানা যাবে। এ রকম আরো কয়েকটি সাইট হলো ইসলামওয়েব, ইসলাম ওয়ানলাইন, সাঈদনেট, আল-মাকতাবা, ইসলামিক বুক স্টোর, খাইমা, ইসলামওয়ে ইত্যাদি। ইদানীং বাংলা ভাষায় রচিত বা অনুবাদকৃত বই নিয়েও কিছু কিছু সাইট বের হয়েছে। যেমন­ ইসলাম হাউস, বাংলাকিতাব ইত্যাদি। এ সাইটগুলো থেকে বাংলা ইসলামি বইগুলো ফ্রি ডাউনলোড করে যাবে। ইসলাম হাউস সাইটটিতে আরবি, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি, কুর্দি, হিন্দি, বাংলা, ফরাসি, জার্মানিসহ ২৫টি ভাষার বই পাওয়া যাবে।
সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা আলেমদের ফতুয়া, বক্তৃতা, বিভিন্ন সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এ ধরনের ওয়েবসাইটের সংখ্যাও অনেক। যেমন সৌদি আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতি শাইখ আবদুল আজিজ বিন বাজ, শাইখ ওসাইমিন প্রভৃতি ব্যক্তির বক্তৃতা, ফতুয়া, মাসায়েল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সাইট রয়েছে। যেগুলো থেকে গবেষকরা যেকোনো মুহূর্তে তাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি সংগ্রহ করতে পারবেন। আর এ বিষয়গুলো একাধিক ভাষায় পড়ারও ব্যবস্থা আছে। ইদানীং বাংলা ভাষায়ও কিছু কিছু সাইট আত্ম প্রকাশ করেছে।
এই একবিংশ শতাব্দী তথ্য-প্রযুক্তির শতাব্দী। যাকে বলা হচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ। তাই মানুষ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই থাকুক না কেন পৃথিবী তার হাতের মুঠোয়। আর তাই প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে ইসলামকে আরো সুন্দর করে সবার কাছে উপস্থাপন করতে হবে, আবারো প্রমাণ করতে হবে ইসলাম-ই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ট ধর্ম, যার প্রকৃত অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।


লেখকঃ অফিসার, শরীয়াহ্‌ কাউন্সিল, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড

রবিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

পবিত্র হজ বিশ্বমানবতার কল্যাণ ও শান্তি বয়ে আনুক


পবিত্র হজ বিশ্বমানবতার কল্যাণ ও শান্তি বয়ে আনুক



আজ পবিত্র হজ পালিত হচ্ছে। মক্কা নগরীর অদূরে আরাফাত ময়দানে সব হাজী একত্র হয়েছেন। সেখানে তারা সারাদিন অবস্থান করবেন। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজের তিনটি রুকনের একটি। সৌদি আরবের স্থানীয় হিসাব অনুযায়ী জিলহজ মাসের ৯ তারিখে আরাফাতের উকুফ বা অবস্থান পালিত হয়। যদিও জিলহজের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত হজের রুকন ও ওয়াজিবগুলো পালন করতে হয়। কিন্তু ৯ তারিখে আরাফাত ময়দানের অবস্থান সবচেয়ে দৃশ্যমান অংশ হওয়ায় সাধারণভাবে এ দিনটি হজের দিন হিসেবে পরিচিত।

হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। কালেমায়ে তাইয়েবা, সালাত, সিয়াম ও জাকাতের মতোই হজের গুরুত্ব। তবে তা আর্থিক সঙ্গতি ও মক্কা নগরী পর্যন্ত পৌঁছানোর উপায় সুলভ হওয়ার শর্তে মুসলমানদের ওপর ফরজ। দীর্ঘপথের সফর ও উল্লেখযোগ্য অঙ্কের অর্থব্যয় জড়িত থাকায় ইসলামের এই বুনিয়াদি ইবাদত পালনে সক্ষম হয় সীমিতসংখ্যক মুসলমান। জীবনে মাত্র একবার হজ করা ফরজ। তাই প্রত্যেক মুসলমানের কামনা থাকে এই বিশেষ ইবাদতটির সামর্থø অর্জনের। হজ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি অনুরাগ ও আনুগত্য প্রকাশের চরম পর্যায়। আত্মীয়-পরিজন ও আবাসভূমি ছেড়ে মহান প্রভুর প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি ও ভালোবাসা প্রকাশের জন্য মুমিন বান্দারা ছুটে যান মক্কা নগরীতে। তারা যখন লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক লাব্বাইক ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক লা শারিকা লাকা­ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির, আমি হাজির, নিশ্চয়ই প্রশংসা, অনুগ্রহ ও রাজত্ব তোমার, তোমার কোনো শরিক নেই’­ ধ্বনিতে চার দিক মুখরিত করে তোলেন, তখন তাতে যোগ দেয় প্রকৃতির সব কিছু।

বায়তুল্লাহ প্রদক্ষিণ, সাফা-মারওয়ার মাঝখানে দৌড় ও আরাফাত ময়দানে উপস্থিতি, শয়তানের উদ্দেশে কঙ্কর নিক্ষেপ ও কোরবানির মাধ্যমে অতিবাহিত হয়ে যায় কয়েকটি দিন। আর সমগ্র পৃথিবী থেকে আসা মুসলমানরা একই পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই ধ্বনি উচ্চারণ করে নিজেদের ঐক্য ও সংহতির ঘোষণা দেন। একই আদম-হাওয়ার সন্তানরা যেন পারিবারিক মেলবন গড়ে তোলেন এ উপলক্ষে। বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চলের ভেদরেখা মুছে যায় তখন। আজকের তারিখেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছিলেন সেই বিখ্যাত ভাষণ, যা মানবাধিকারের সবচেয়ে সুস্পষ্ট দলিল। আরব-অনারব ও সাদা-কালোর ভিত্তিতে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণীত হবে না, খোদাভীতিই হবে মর্যাদার মানদণ্ড, সব মানুষ আদম আঃ-এর সন্তান, আর তিনি ছিলেন মাটির তৈরি­ বিশ্বমানবতার ঐক্যের এই চূড়ান্ত সূত্র তিনি উচ্চারণ করেছিলেন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে। আজ সারা বিশ্বের মানুষ যখন সমস্যা ও জটিলতার আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে, বিভেদ ও অনৈক্যের শিকার হয়ে অশান্তি ও দুর্দশা পোহাচ্ছে, বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ যখন অভ্যন্তরীণ গোলযোগ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বাইরের দুশমনদের চক্রান্ত প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন আল্লাহর রাসূলের বিদায় হজের ভাষণ তাদের জন্য হতে পারে পরম পথনির্দেশ।

সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ এখন আরাফাত ও মিনায় অবস্থান করছেন হজের উদ্দেশে। আমাদের দেশ থেকেও প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ গিয়েছেন হজ করতে। আল্লাহ সবাইকে সুস্থ রাখুন, মাকবুল হজ আদায়ের তাওফিক দিন, তারা নিরাপদে দেশে ফিরে আসুন এই কামনা করি। হজ আমাদের মধ্যে বয়ে আনুক সাম্য ও মৈত্রীর বারতা। জাতীয় জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসুক, মুসলিম উম্মাহর গৌরব ও মর্যাদা আবার প্রতিষ্ঠিত হোক একই সূত্রে গ্রথিত হওয়ার মাধ্যমে।

শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০০৮

হজ্বের দোয়া ও নিয়ম-কানুন

হজ্বের দোয়া ও নিয়ম-কানুন


ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদের মধ্যে হজ্ব একটি অন্যতম স্তম্ভ। প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তির জন্য আলস্নাহতায়ালা হজ্বের নির্দেশ দিয়েছেন। সড়্গম ব্যক্তি যাদের উপর হজ্ব ফরজ হয়েছে তারা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে হজ্ব অস্বীকার করে তাহলে মুসলমান থাকতে পারে না। টিকিয়ে রাখতে হলে প্রত্যেক ধনবান মুসলমানকে অবশ্যই হজ্ব করতে হবে। হজ্বের মাধ্যমে নিষ্পাপ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এবং কবুল হজ্বের সওয়াব কেবলমাত্র আলস্নাহর জান্নাত। এত বড় পুরম্নস্কার যে হজ্বের মধ্যে নিহিত, সেই হজ্বের সকল কাজগুলো আমাদের জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। আলস্নাহতায়ালা কুরআনে বলেছেন, “স্মরণ করুন সেই সময়ের কথা যখন ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাইল কাবাঘর নির্মাণ শেষ করলেন। তখন তারা পিতা পুত্র উভয়েই আমার কাছে হাত তুললেন এবং বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক আমাদের পড়্গ থেকে এই সামান্য খেদমতটুকু কবুল করম্নন।
আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী।” কাবাঘর নির্মিত হয়েছিল হযরত আদম (আঃ)-এর পৃথিবীতে আগামনের সময় ফেরেশতাদের দ্বারা। তার পর হযরত নূহ (আঃ)-এর মহা পস্নাবনের সময় প্রায় এই ঘরের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়েছিল। তখন হযরত নূহ (আঃ) এটা সংস্কার করেছিলেন এর পরও কয়েকবার সংস্কার হয়েছে। তার পর হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর জামানা চলে এসেছে। তিনি একটি বড় পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে এই ঘরের দেয়াল গেঁথে ছিলেন। আর ইসমাইল (আঃ) তখন কিশোর। অনেক দূর-দূরান্ত হতে কুড়িয়ে কুড়িয়ে পাথর নিয়ে পিতার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এই সময় দীর্ঘ সময় ঐ বড় পাথরটির উপর দাঁড়িয়ে দেয়াল গেঁথেছিলেন বলে ঐ পাথরটিতে ইব্রাহিম (আঃ)-এর পায়ের ছাপ পড়ে গিয়েছিল। সেই পাথরটি এখন মাকামে ইব্রাহিমে রাখা আছে। ইব্রাহিম (আঃ) কর্তৃক এই ঘর নির্মাণ শেষে আরো কয়েকটি দোয়া পড়েছিলেন। যেমন ইব্রাহিম (আঃ) বললেন, “হে আমাদের প্রতিপালক আমাদের পিতা, পুত্র উভয়কে আপনি মুসলমান বানান। আমার বংশধরদের কেউও। আসার আমাদেরকে হজ্বের রীতি-নীতি শিড়্গা দিন। নিশ্চয় আপনি তওবা গ্রহণকারী এবং পরম দয়ালু।” ইব্রাহিম (আঃ) নিজে এবং তাঁর পুত্র ইসমাইলকে মুসলমান হওয়ার জন্য আলস্নাহর কাছে প্রার্থনা করায় আলস্নাহ বললেন, “হে ইব্রাহিম আত্মসমার্পন কর! অর্থাৎ মুসলমান হও! ইব্রাহিম (আঃ) বলেছিলেন, “আমি আত্মসমর্পন করলাম অর্থাৎ মুসলমান হয়ে গেলাম। আসমান জমিন সব কিছুর মালিক আলস্নাহতায়ালার নিকট। এবার ইব্রাহিম (আঃ) দোয়া করলেন হে আলস্নাহ আমার বংশধরদেরকে এই ঘর রড়্গণা-বেড়্গণ করার যোগ্যতা দান করম্নন।
আর তাদেরকে ফল-ফলারী দ্বারা রেজেকের ব্যবস্থা। করম্নন। জানি পরবর্তীতে আলস্নাহতায়ালা এই কাবাঘরের রড়্গণা-বেড়্গণকারী হিসেবে তাঁর সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ) কে আলস্নাহতায়ালা কুবল করেছিলেন। ঘটনার প্রেড়্গাপটটি ছিল এমন আলস্নাহ বললেন, হে ইব্রাহিম তোমার স্ত্রী ও শিশু পুত্রকে মরম্নভূমিতে রেখে এসো। ইব্রাহিম (আঃ) তাই করলেন। এর পর স্ত্রী হাজেরা শিশু পুত্রকে নিয়ে চিন্তায় পড়লেন। এক টুকরো রম্নটি ও সামান্য কিছু পানি। এটাতো এড়্গুণি শেষ হয়ে যাবে। চারিদিকে একবার তাকালেন। যতদূর দু’চোখ যায় ধু-ধু মরভূমি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। রুটি পানি শেষ হলো। মা হাজেরা নিকটবর্তী পাহাড়ের দিকে একবার তাকালেন। দেখলেন সাফা পাহাড় দিয়ে ঝর ঝর করে ঝর্নাধারা নামছে, অনেক আশা নিয়ে সাফা পাহাড়ে গেলেন। সেখানে যেয়ে কিছুই পেলেন না। কেবলই মরীচিকা। সেখান থেকেই মারওয়া পাহাড়ের দিকে তাকালেন। দেখলেন যে, মারওয়া পাহাড় দিয়ে ঝর্নাধারা নামছে। মারওয়া পাহাড়ে এক দৌঁড়ে চলে এলেন। সেখানেও কিছুই পেলেন না।
কেবলই মরীচিকা ছাড়া। এভাবে সাতবার সাফা পাহাড়ে ঝর্ণা ভেবে দৌঁড় দিয়ে ছিলেন। সাফা পাহাড় হতে মারওয়া পাহাড়ে ঝর্না ভেবে সাতবার দৌঁড় দিয়েছিলেন। উপর হতে হয়ত আলস্নাহ রাব্বুল আলামীন এই দৃশ্য দেখছিলেন এবং শিশু পুত্রকে বাঁচানোর যে অদম্য প্রচেষ্টা এটা আল্লাহতায়লা পছন্দ করে নিয়ে মা হাজেরার এই দৌঁড়ানোকে হজ্বের কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। সাথে সাথে শিশু পুত্র ইসমাইল (আঃ)-এর পায়ের গোড়ালীর আঘাতে সেখানে এমন একটি পানির উৎস সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যা কেয়ামত পর্যন্ত কখনোই শেষ হবার নয়। যার নাম যম্‌যম্‌। যম্‌যম্‌ শব্দটি হিব্রু ভাষার একটি শব্দ। অর্থ হলো থেমে যাও। মা হাজেরা যখন দেখলেন যে, পানি চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তখন পাথর দিয়ে বাঁধ দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন, যম্‌যম্‌-থাম থাম। এই পানি আলস্নাহর একান্তô অনুগ্রহের ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। কেননা এই পানি না হলে মা হাজেরা ও শিশু পুত্র ইসমাইল (আঃ)-এর বেঁচে থাকার কোন উপায় ছিল না। এটাতো কেবল পানি অন্যান্য খাবার তো নেই। যে কারণে আলস্নাহতায়ালা এই পানির মধ্যে খাবারের সব উপাদান দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। দুনিয়ার সব পানি খেতে হয় বসে। আর এই পানি খেতে হয় দাঁড়িয়ে। রাসুল (সঃ) এই পানি দাঁড়িয়ে খেতেন আর একটি দোয়া পড়তেন। “আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়া, অরিযকাও অছিয়া অশিফা আমমিন কুলেস্ন দাঈন”। অর্থাৎ “হে আল্লাহ। এই পানির মাধ্যমে আপনি আমাকে দান করিুন উপকারী জ্ঞান, প্রশস্ত রিযিক ও সকল বিমারী রোগ হতে আমাকে রড়্গা করুন।” এই পানি পান করার সময় যারা এই দোয়া পাঠ করবে এবং যে নিয়তে পাঠ করবে আলস্নাহতায়ালা তাঁর সেই নেক ইচ্ছা মঞ্জুর করবেন।
বাস্তবতার আলোকে দেখেছি অনেক হাজী সাহেব দেশ থেকে হজ্ব করতে যাওয়ার সময় ব্যাগ ভর্তি করে ওষুধ নিয়ে যান অসুস্থতার কারণে। কিন্তু যেই না যম্‌যমের পানি পান করা শুরম্ন করলেন সঙ্গে সঙ্গে সব রোগ হতে সুস্থতা লাভ করলেন ওষুধগুলো যেভাবে ব্যাগে ভরে নিয়ে গিয়েছিলেন আবার সেভাবেই ফেরত নিয়ে আসলেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আরো দোয়া করেছিলেন। “হে আমাদের প্রভু পরওয়ারদেগার আমার বংশধরদের মধ্যে এমন একজন নবী পাঠান যিনি আপনার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে শোনাবে। তাদের কে কিতাব ও হিকমাত বা জ্ঞান-বিজ্ঞান শিড়্গা দেবেন। এবং তাদেরকে পূতঃ পবিত্র করে তুলবেন। আপনি মহা পরাক্রমশালী এবং হেকমত ওয়ালা। আমরা উপরের আলোচনা হতে জেনেছি কাবাঘরের সন্নিকটে যম্‌যম্‌ কূপের পাশেই মা হাজেরা এবং ইসমাইল (আঃ)-এর বসতি ছিল। তাছাড়া আর কোন বসতি সেখানে ছিল না। বলা হয়েছে ৈ“গয়রা জি যারইন ইন্দা বায়তিকাল মুহাররম” কোন বাড়ী-ঘর নেই; ধু-ধু মরম্নভূমি ছাড়া আর কিছু নেই।
এই কাবা ঘরের নিকটে সর্বপ্রথম বসতি হলো মা হাজেরা এবং হযরত ইসমাইল (আঃ)। তাঁর পর ইসমাইল (আঃ) থেকেই মক্কার বসতি গড়ে উঠেছিল। সে কারণে মক্কার মানুষদেরকে ইসমাইলী আরবও বলা হয়। আর মুহাম্মদ (সঃ)-এর জন্ম মক্কার কুরাইশ বংশে। সে হিসেবে তিনিও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর বংশধর। ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর বংশে যে নবীর জন্য প্রার্থনা করেছিলেন তিনি হলেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। আলস্নাহতায়ালা হযরত ইবাহিম (আঃ)-এর দোয়া শেষ হলে আদেশ করলেন, “হে ইব্রাহিম মানুষদেরকে হজ্বের জন্য আহবান কর। মানুষেরা পায়ে হেঁটে আসবে। সওয়ারিতে আরোহণ করে করে আসবে।” আরো বললেন, হে ইব্রাহিম ও ইসমাইল! তোমরা উভয়ে আমার এই ঘর কাবা শরীফকে ইতেকাফকারী, তওয়াফকারী, রম্নকুকারী ও সিজদাকারীদের জন্য পুতঃ পবিত্র রাখবে।” সুতরাং ইব্রাহিম (আঃ)-এর সময় হতেই হজ্বের এই প্রচলন পরবর্তীতে সকল নবী এবং তাদের উম্মতদের মাধ্যমে এটি সংঘটিত হয়ে আসছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন রাসুল (সঃ) একটি ভাষণ দিলেন, সেখানে তিনি বললেন, আলস্নাহ যাদের উপর হজ্ব ফরজ করে দিয়েছেন তাদের তা আদায় করা উচিৎ (মুসলিম)। আমাদের বাংলাদেশের বেশির ভাগ মুসলমানদের অভ্যাস হলো বৃদ্ধ বয়সে হজ্ব করতে যাওয়া। অনেকে আশংকা করেন যুবক বয়সে হজ্ব করতে গেলে ফিরে এসে হয়ত হজ্বের মর্যাদা রড়্গা করতে পারবে না। এটা সঠিক নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন তারা যুবক বয়সেই হজ্ব করতে যাচ্ছেন। কেননা হজ্ব অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কাজ। এটা দৈহিক সড়্গমতা থাকতে থাকতেই না করলে বৃদ্ধ বয়েসে পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করা সম্ভব নয়। আমি নিজে শুনেছি অনেক বৃদ্ধ হাজী হজ্ব করে দেশে এসে আফসোস করে বলেন, যদি আরো আগে যেতে পারতাম! কেননা অনেক কাজই সঠিকভাবে আদায় করতে পারেননি। নিজের মনে তখন খারাপ লাগে। তাই যখনই হজ্ব ফরজ হয় তখনই তা আদায় করা উচিৎ।
বিলম্ব করা উচিৎ নয়। কারণ কার কখন হায়াত শেষ হয়ে যায় তাতো বলা যায় না। এমন যদি হয় কারো হজ্ব ফরজ হলো। আর তিনি ইচ্ছা করে বিলম্বে হজ্ব করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। এর মধ্যে হজ্ব করার পূর্বেই তার হায়াত শেষ হয়ে গেল অর্থাৎ মৃত্যু এসে গেল। সে অবস্থার উলেস্নখ করে রাসুল (সঃ) আফসোস করে বলেছেন, কেউ যদি হজ্ব না করে ইহুদী কিংবা নাছারা হয়ে মারা যায় তাহলে আমার পড়্গ থেকে তার জন্য কোন সুপারিশ নেই। একবার একদল মহিলা রাসুল (সঃ)-এর কাছে এসে জিহাদের অনুমতি চাইলে, রসুল (সঃ) তাদের বললেন, মেয়েদের জন্য হজ্বই হলো জিহাদ। মেয়েরা যদি হজ্ব করে তাহলে হজ্বের সোয়াব তাঁরাও পাবে। বিদায় হজ্বের সময় খাস্‌আম গোত্রের এক মহিলা তাঁর পিতার অসুস্থার কথা জানালে রসুল (সঃ) ঐ মহিলাকে তা আদায় করার জন্য বললেন। হযরত আবু রাজিন উকাইলী (রাঃ) বলেন, আমার পিতা অড়্গম, অসুস্থ রসুল (সঃ) বললেন, তোমার পিতার পড়্গ হতে তুমি তা আদায় করে দাও। পরিশেষে এটুকু বলেই শেষ করতে চাই হজ্ব আমাদের মিলস্নাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) থেকে মহানবী (সঃ) পর্যন্ত সকল নবী ও তার উম্মতদের উপর ফরজ ছিল। কেয়ামত পর্যন্ত এই ফরজ বলবত থাকবে। তাই আমাদের সামর্থবান সকলকে আল্লাহতায়ালা সঠিক সময়ে হজ্ব সম্পন্ন করার তাওফিক দান করুন।

মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী