সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০০৮

তবুও ভারত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র


তবুও ভারত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র


আলফাজ আনাম
তিনি একজন মন্ত্রী। ছোটখাটো কোনো দেশের নন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক এবং অন্তত সাংবিধানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক দেশ ভারতের মধ্যপ্রদেশের সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী। তার নাম অখণ্ড প্রতাপ সিং যাদব। সম্প্রতি তার দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা তার মৃত্যু কামনা করে পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে ১৩টি গাধাকে ভোজন করানো হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নেতাকর্মীরা ঘোষণা দিয়েছেন মন্ত্রীকে পেলে তার মুখে কালি লেপে, গায়ে কাদা ছুড়ে কাপড়-জামা ছেঁড়া হবে। বেচারা মন্ত্রী এখন অনেকটা আত্মগোপনে আছেন। মধ্যপ্রদেশ বিজেপি শাসিত রাজ্য। এ ঘোষণা দিয়েছে বিজেপি’র অঙ্গসংগঠন জাগরণ সমিতি। আর বজরং দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তাকে আর তার নিজের জন্মভিটায় ঢুকতে দেয়া হবে না। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তিনি যে আর দলের মনোনয়ন পাবেন না এটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু কেন এ মন্ত্রীর ওপর বিজেপি বজরং দল বা জাগরণ সমিতির ক্ষোভ? কারণ, একটি দাওয়াতে অংশ নেয়া। যেহেতু তিনি সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী, সে কারণে তার প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণে এক ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। আর এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে বিজেপি আর তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। আমাদের দেশের সংবাদপত্রে ভারতের খবর সব সময় গুরুত্বের সাথে আসে না। আর এমন খবর তো ছাপাই হয় না। কেন হয় না, তা নিয়ে পরে আলোচনা করব। তবে ভারত আমাদের শুধু প্রতিবেশী দেশ নয়, নানা কারণে ভারতের প্রতি আমাদের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। খবরটি ভারতের একটি সংবাদপত্র থেকে নেয়া। ভারতে প্রতি বছর বিভিন্ন প্রদেশে সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়, তাতে শত শত লোক মারা যায়। কিন্তু এ খবরের গুরুত্ব অন্যখানে। তা হলো ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সহনশীলতার মাত্রা কতখানি। তা উপলব্ধি করা যাচ্ছে এ খবর থেকে। সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দাওয়াতে অংশ নেয়ায় এ পরিণতি। তাহলে ভারতের সংখ্যালঘুরা কেমন আছে, তা সহজেই বোঝা যায়। আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, তার রাজ্যে মুসলমানরা পিছিয়ে আছে এবং দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। যদিও এরা এত দিন বলে আসছিলেন ধর্ম পরিচয়ে নয়, তারা নাকি মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে মুসলমানরা মানুষ নামের একটু ভিন্ন প্রজাতি এ কারণে তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে একটু বেশি পিছিয়ে পড়েছে। তার পরও ভারতের কোনো মিডিয়া বা সুশীলসমাজের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রচারণা দেখছি না যে নির্যাতিত কোনো মুসলমান দেশত্যাগ করে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ চলে গেছে। কী জানি বাংলাদেশের মিডিয়া বা সুশীলসমাজের মতো সে দেশের মিডিয়া বা সুশীলসমাজ হয়তো এতটা সংখ্যালঘু ফ্রেন্ডলি নয়। ভারতের কমপক্ষে তিনটি প্রদেশে এখন সংখ্যালঘুদের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চলছে, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ হইচই হচ্ছে। তবে যারা এই মুহূর্তে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারা মুসলমান নন। ধর্মীয় পরিচয়ে খ্রিষ্টান। এ কারণে হইচই বেশি হচ্ছে। অবশ্য এসব খবর আগের মতো ঢাকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে না। সম্প্রতি কর্নাটকের মেঙ্গুলুরে খ্রিষ্টানদের ওপর একের পর হামলার ঘটনায় সেখানে কারফিউ জারি করতে হয়েছিল। সেখানে চলতি মাসের ৭ ও ১৪ তারিখে প্রায় ১৬টি চার্চে হামলা চালানো হয়। সাধারণত দলিত হিন্দুরাই এসব অঞ্চলে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। আর এরাই সমাজের প্রভাবশালী হিন্দুদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। কর্নাটক রাজ্যে এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। ভারতীয় পত্রপত্রিকা বলছে, সেখানকার সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এখন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। শুধু কর্নাটক নয়, আমাদের কাছাকাছি ভারতের আরেক রাষ্ট্র উড়িষ্যায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অবস্থা আরো শোচনীয়। এক সময় বাংলা, বিহার আর উড়িষ্যা এক শাসকের অধীনে শাসিত হয়েছে। সিরাজ উদ্দৌলার পরিচয় আমরা জানি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব হিসেবে। এ নামগুলোর সাথে আমাদের কেমন যেন ভাবাবেগ কাজ করে। কিন্তু এসব রাষ্ট্র এখন ভারতের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এলাকা। উড়িষ্যাও বিজেপি শাসিত। সেখানে এখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। গত এক মাসে খ্রিষ্টানদের ওপর হামলায় মারা গেছে ৩৬ জন। আগস্ট মাসের শেষ দিকে হামলা হয়েছে ১৪টি চার্চে। এর মধ্যে খ্রিষ্টান মিশনারি পরিচালিত এক অনাথ আশ্রমে হামলার ঘটনায় আশ্রমের দায়িত্বে নিয়োজিত এক মহিলা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। এর আগে ’৯৯ সালে এই উড়িষ্যায় আট ও দশ বছরের দুই পুত্রকে নিয়ে এক অস্ট্রেলীয় নাগরিক গাড়িতে করে যাওয়ার সময় তার গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলে পিতা-পুত্রসহ তিনজন আগুনে পুড়ে মারা যান। এসব খবর পড়ার সময় মনে প্রশ্ন এসেছে, সিরাজ উদ্দৌলার সময় কি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এভাবে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল? ইতিহাসে তেমন কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। তখন ভারতের জনগোষ্ঠী এতটা শিক্ষার আলোয় আলোকিত ছিল না। কিন্তু এমন পৈশাচিক ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এখনকার সভ্য ভারতে এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে ২০০২ সালে হিন্দু উগ্রবাদীদের হামলায় প্রায় ১ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। এক মাসের এই দাঙ্গায় ২৫ জেলার ১৫১টি শহর আর ৯৯৩টি গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সে সময় অনেক মুসলমানকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদির এ হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল তখনকার গুজরাট সরকারের রাষ্ট্রীয় মদদে। পুলিশ প্রশাসন ছিল নির্বিকার। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্র ছিল হত্যাযজ্ঞের সাথে সরাসরি জড়িত। রাষ্ট্রীয় মদদে এখনো ভারতে প্রতিদিন এভাবে সংখ্যালঘু মুসলমান কিংবা অন্য ধর্মের নাগরিকরা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এখন তো মনমোহন সিং বুশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এক নম্বর সহযোগী। তারাও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। প্রায়ই আমরা আলকায়েদা তালেবানের মতো নানা সংগঠনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত মুসলমান নাগরিকদের হত্যার খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে পাচ্ছি। তারা কি প্রকৃত অর্থেই সন্ত্রাসী না নরেন্দ্র মোদির সহযোগী ভারতীয় ট্রিগারহ্যাপি নানা বাহিনীর টার্গেটের শিকার। আমরা জানি না। যদিও ভারতেরই মানবাধিকার সংগঠন সন্ত্রাস দমনের নামে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করছে। রাষ্ট্রীয় বা স্থানীয় প্রশাসনের মদদে ভারতের এসব সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড কোনো রাষ্ট্রের জন্য আদর্শ তো নয়ই, উদাহরণও হতে পারে না। আমরা গর্বিত ভারতের একেবারে প্রতিবেশী একটি দেশে সব ধর্মের মানুষ পরম শান্তিতে একে অপরের সাথে পারস্পরিক সুসম্পর্কের ভিত্তিতে বসবাস করছে। অহেতুক ভারতবিদ্বেষ নয়, ভারতের এসব সাম্প্রদায়িক পৈশাচিক কর্মকাণ্ড থেকে আমরা শিক্ষা নেবো, যাতে কখনো এ দেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। আগেই বলেছি, কোনো খারাপ উদাহরণ হতে পারে না। কিন্তু তুলনামূলক বিচারের জন্য এ আলোচনা। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী লেখক এবং ভারতের প্রতি নানা কারণে আনুগত্যবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশকে চিত্রিত করছে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে। বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের দেশত্যাগের নানা কল্পকাহিনী প্রচার করছে। প্রচার করছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের নানা খবর। এদের চোখে ভারত হচ্ছে বিশ্বের এক নম্বর অসাম্প্রদায়িক আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমরাও মনে করি ভারত বিশ্বের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম। ভারতে যেভাবে ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তাতে কি দেশটিকে অসাম্প্রদায়িক আধুনিক রাষ্ট্র বলা যায়? বলা যায় না। গণতন্ত্রের মূল বাণী হলো সহিষ্ণুতা। ভারতে সেই সহিষ্ণুতা কোথায়? ভারতের এ চিত্রের সাথে বাংলাদেশকে মেলালে এ দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কি আমরা কেবল অন্ধকার দেখি? না কোনো আলোর রেখা আছে? এ দেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজ বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নাম করে একটি অসাংবিধানিক অগণতান্ত্রিক জবাবদিহিতাবিহীন সরকার জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর হানাহানির কারণে নাকি এমন অগণতান্ত্রিক সরকার জরুরি ছিল। অথচ এদের আদর্শের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শুধু একটি প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মারা গেছে ১৭ জনের বেশি লোক। সেখানে শাসক দলের সাথে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের খুনাখুনিতে প্রতি মাসে দুয়েকজন লোক নিহত হচ্ছে। কিন্তু ভারত ব্যর্থ রাষ্ট্র হয় না বা পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার ব্যর্থ সরকার নয়। লালু প্রসাদ যাদব কিংবা রাবড়ী দেবীর মতো অশিক্ষিত বা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত রাজনীতিকরা বছরের পর বছর বিহার শাসন করলেও সেখানে সেনাসমর্থিত সরকার এমনকি কেন্দ্রের শাসন প্রয়োজন হয় না, ভারতের পার্লামেন্টে এমপি কেনাবেচার টাকা স্পিকারের সামনে প্রদর্শন করা হলেও সে দেশে গণতন্ত্র দুর্বল হয় না। কিংবা রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির জন্য জেলে পাঠানো হয় না। কিন্তু তার পরও ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে রাজনীতিবিদদের প্রতি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের আস্থার মধ্যে। ভারতে রাষ্ট্রঘাতী কোনো বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজ আমরা দেখি না কিংবা নিজের দেশকে কুৎসিতভাবে তুলে ধরার মতো জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবী ভারতে নেই। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা অনেক বেশি প্রতিভাবান। তাদের প্রতিভা এমনই যে খৈ খাওয়ার জন্য তারা ধানের গোলায় আগুন দিতে পারে। বাংলাদেশকে পশ্চাৎপদ একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য আমাদের বুদ্ধিজীবী যারা সম্প্রতি সুশীলে পরিণত হয়েছেন তাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত সুশীলসমাজ যদি ভারত থেকে শিক্ষা নিত, তাহলে বাংলাদেশের চিত্র হতো ভিন্ন রকম। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে অনেকখানি এগিয়ে যেত।

কোন মন্তব্য নেই: