শনিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

আল কুরআনের অনুবাদ বিভিন্ন ভাষায়


আল কুরআনের অনুবাদ বিভিন্ন ভাষায়


ইসলাম কোনো অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়। এর প্রকৃতি হচ্ছে প্রচারধর্মী। আবেদন বিশ্বজনীন। অতএব কুরআনের বাণীও গোটা বিশ্বমানবতার জন্য। আরবি একটি প্রাণবন্ত, গতিশীল, সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশীল ভাষা। এ ভাষাকেই বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ আল কুরআনের জন্য নির্বাচিত করেছেন যাতে অনাগত কালের মানুষ মূল আরবি ভাষা থেকেই কুরআনের পথনির্দেশ লাভ করতে পারে। সুতরাং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন নাজিল করে সংরক্ষণের নিশ্চয়তাও বিধান করেছেন।
আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক। (সূরা হিজরঃ আয়াত-৯)
কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হলেও তার আবেদন বিশ্বজনীন হওয়ার দরুন বিশ্বমানুষের কাছে কুরআনের বাণী পৌঁছে দেয়া মহানবী সাঃ-এর অন্যতম অবশ্যকর্তব্য ছিল। অতএব তিনি তাঁর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শাসনকর্তাদের নামে পত্রাদির মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত পাঠান। এ ব্যাপারে ভাষার বিভিন্নতা প্রতিবন্ধক হতে দেননি। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরবি না জানা মানুষের কাছে কুরআনের বাণী পৌঁছে দেয়ার তাগিদে অনারবি ভাষায় কুরআনের অনুবাদ বিশ্বনবীর আমলে আরম্ভ হয়ে আজো অব্যাহত আছে। তবে এ কথা মুসলমানরা ভালোভাবে জানেন, অনুবাদ কোনো অবস্থাতেই মূল কুরআনের বিকল্প হতে পারে না। কারণ কুরআন হচ্ছে হজরত জিব্রাইল আনীত ভাষা ও অর্থের সমন্বয়ে আল্লাহর বাণী। সুতরাং মূল আরবি ভাষায় কুরআন পাঠ করতে এবং কুরআনের মূল বাণী বুঝতে সক্ষম হওয়া পর্যন্ত কুরআনের অনুবাদের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়। এই অনুপ্রেরণা নিয়েই বিভিন্ন ভাষাভাষী মুসলিম মনীষী ও পণ্ডিতগণ কুরআন অনুবাদের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসেন। পক্ষান্তরে অমুসলিম পণ্ডিতরাও ধর্ম প্রচারের গরজে এই গ্রন্থ অনুবাদে এগিয়ে আসেন।
সাম্প্রতিক কালের এক জরিপে জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৭০টি প্রধান ভাষায় আল কুরআন অনূদিত হয়েছে। অমুসলিমদের ভাষাতেও পর্যাপ্ত অনুবাদ হয়েছে। নিØে কয়েকটি ভাষায় অনূদিত কুরআনের উল্লেখ করা হলো।
বাংলাঃ ইসলামী ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদের ক্ষেত্রে বাংলাও পিছিয়ে নেই। সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়, ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন নামের একজন অমুসলিম পণ্ডিতই বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন (১৮৮১-১৮৮৬)। কুরআনের প্রথম আংশিক অনুবাদ সম্পর্কেও মতভেদ আছে। কারো কারো মতে মীর্জাপুরের গোলাম আলী আকবর ১৮৬৪ সালে সর্বপ্রথম ৩০তম পারার বাংলা অনুবাদ করেছেন। আবার কারো কারো মতে মৌলভী আমীরুদ্দীন বিচ্ছুনিয়াকৃত অনুবাদই প্রথম। এক জরিপ অনুযায়ী বাংলা ভাষায় এ যাবত ৩৯টি পূর্ণাঙ্গ ও ৯৫টি আংশিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
উর্দুঃ শাহ রফীউদ্দীন কৃত কুরআনের তরজমা উর্দু ভাষায় কৃত প্রথম তরজমার মর্যাদা রাখে। এই অনুবাদ ঈসায়ী ১১৯০ সালে সম্পন্ন হয় এবং ১৮৪০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। প্রায় একই সময় শাহ আবদুল কাদির কৃত অনুবাদ ১২০৫ হিজরি মোতাবেক ১৭৯০ সালে সুসম্পন্ন হয়ে ১৮২৯ দিল্লি থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। উর্দু ভাষায় এ যাবৎ প্রায় তিন শতাধিক অনুবাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
তুর্কিঃ তুর্কি ভাষায় পবিত্র কুরআনের প্রথম অনুবাদ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে। প্রফেসর ‘জাকি ভালিদি তুগানের’ মতে তাফসিরে তাবারির ফার্সি অনুবাদকমণ্ডলীর মধ্যে কিছু তুর্কিভাষী পণ্ডিতও ছিলেন। তারা ফার্সি অনুবাদের সাথে সাথে তাফসিরের তুর্কি অনুবাদও করেছিলেন। তবে স্পষ্টভাবে জানা যায়, ৭৩৪ হিজরিতে পূর্ব তুর্কি ভাষায় কুরআন প্রথম অনূদিত হয়েছে। ছাপার অক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালে ‘তাফসির আল তিরিয়ান’ কায়রো থেকে। এ পর্যন্ত তুর্কি ভাষায় অনূদিত পূর্ণাঙ্গ তাফসির ও তরজমার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৭-এর মতো।
গুজরাটিঃ আবদুল কাদির বিন লোকমান কর্তৃক প্রথম গুজরাটি অনুবাদ সর্বপ্রথম ১৫৭৯ইং বোম্বাই থেকে প্রকাশিত হয়। এ ভাষায় এ যাবৎ প্রায় এক ডজন পূর্ণাঙ্গ ও দু’টি আংশিক অনুবাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
হিন্দিঃ পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের রাজা মেহরুকের অনুরোধক্রমে ২৭০ হিজরিতে কুরআন মজিদ প্রথম হিন্দি ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে এই অনুবাদ সূরা ইয়াসিন পর্যন্ত সমাপ্ত হতে পেরেছিল। আহমদ শাহ মসীহী কর্তৃক হিন্দি অনুবাদই সম্পূর্ণ কুরআনের অনুবাদ হিসেবে স্বীকৃত। এটি ১৯১৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে।
কাশ্মীরিঃ মুহাম্মদ ইয়াহিয়া শাহ কাশ্মীরি ভাষায় কুরআন মজিদ প্রথম অনুবাদ করেন। এটা একটা আংশিক অনুবাদ। এই অনুবাদ ১৮৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
সিন্ধিঃ একজন আরব পণ্ডিত কর্তৃক সিন্ধি ভাষায় কুরআন মজিদ প্রথম অনূদিত হয়েছিল বলে জানা যায়। জ্ঞাত তথ্য অনুসারে আখুন্দ আযিবুল্লাহ মটালাভি কর্তৃক অনূদিত সিন্ধি অনুবাদই প্রথম অনুবাদরূপে স্বীকৃত। এটি ১৮৭০ ইং গুজরাট থেকে প্রকাশিত হয়। সিন্ধি ভাষায় ছাপার অক্ষরে মুদ্রিত প্রথম অনুবাদ হচ্ছে মুহাম্মদ সিদ্দিক কর্তৃক অনুবাদ। এটি ১৮৬৭ ইং লাহোর থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
তামিলঃ মুস্তাফা আলিম হাজিয়্যার নুই তামিল ভাষায় কুরআন মজিদ প্রথম অনুবাদ করেছেন। এটা একটা আংশিক অনুবাদ হলেও কুরআনের প্রথম তামিল অনুবাদ হওয়ার মর্যাদা রাখে। এটি ১৮৩৭ সালে বোম্বাই থেকে প্রকাশিত হয়। হাবিব মুহাম্মদ আল কাহিরি কর্তৃক তামিল অনুবাদই এ ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। এটি ১৮৮৪ সালে বোম্বাই থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়।
পশতুঃ এ ভাষায় প্রথম কুরআন মজিদ অনুবাদ করেন মাওলানা মুরাদ আলি। এটা ১৯০৬ সালে লাহোর থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ১৮৬১ সালে ভুপাল থেকেও একখানা পশতু তরজমা প্রকাশিত হয় বলে জানা যায়।
পাঞ্জাবিঃ এ ভাষায় অনূদিত সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ কুরআন হচ্ছে হাফিজ মুবারকুল্লাহ কর্তৃক পাঞ্জাবি অনুবাদ। এটি প্রকাশিত হয় ইংরেজি ১৮৭০ সালে। এর আগে একটি আংশিক অনুবাদ লাহোর থেকে ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেন নুয়ান কুটি শাহ।
চৈনিকঃ বিংশ শতকের গোড়ার দিকে শায়থ লিউ চি কর্তৃক নির্বাচিত বিভিন্ন পারার অনুবাদের মাধ্যমে আধুনিক চীনা ভাষায় কুরআনের অনুবাদের সূচনা হয়। অতঃপর শেখ মাফু সু ২০ পারা পর্যন্ত সমাপ্ত করেন। মালিয়ান ইয়ান অনূদিত চীনা কুরআন ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে লি টিয হং কর্তৃক চীনা অনুবাদই এ ভাষায় প্রথম কুরআনের প্রকাশিত অনুবাদ।
জাপানিঃ জাপানে ইসলামের ইতিহাস যেমন অতি আধুনিক এ ভাষায় কুরআনের অনুবাদের ইতিহাসও অতি সাম্প্রতিক। ১৯২০ সালে কে আই স্যাকামুটু কর্তৃক অনুবাদের মাধ্যমে জাপানি ভাষায় কুরআনের অনুবাদের সূচনা হয়। বর্তমানে এ ভাষায় নয়খানা অনুবাদমূলক বলে জানা যায়।
কোরিয়ানঃ কোরিয়ান ভাষায় কুরআনের অনুবাদের ইতিহাস আরো সাম্প্রতিক। ইউয়াং সান কিম নামের এক পণ্ডিত কোরিয়ান ভাষায় পবিত্র কুরআন প্রথম অনুবাদ করার সৌভাগ্য লাভ করেন। এটি ১৯৭১ সালে রাজধানী সিউল থেকে প্রকাশিত হয়।
ইংরেজিঃ ইংরেজি অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা। সুতরাং মুসলিম অমুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বীরাই এ ভাষায় পবিত্র কুরআন অনুবাদ করেছেন। ১৫১৫ ইং কুরআন চয়নিকারূপে প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তবে আলেকজান্ডার রস কর্তৃক অনূদিত কুরআনই এ ভাষায় কৃত প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ।
ল্যাটিনঃ বরাটুস কেটে নেনসিস নামের এক পণ্ডিত ল্যাটিন ভাষায় প্রথম কুরআন অনুবাদ করেন। এটা ১১৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সমাপ্ত হয় এবং ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ ইং পর্যন্ত এ ভাষায় মোট পাঁচখানা সম্পূর্ণ ও ২৮ খানা আংশিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
স্প্যানিশঃ অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা স্প্যানিশ। ডি জসি গার্বার ডি রবলিস এ ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআন অনুবাদ করেন। তার অনূদিত কুরআন ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রিদ থেকে প্রকাশিত হয়।
ইতালিয়ানঃ ইতালিয়ান ভাষায় পবিত্র কুরআন প্রথম অনূদিত হয় ১৫৪৭ ইং। আঁন্দ্রে এবিভাবেনে ইতালিয়ান ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআন অনুবাদ করেন। ১৯৮০ পর্যন্ত এ ভাষায় মোট ৮০খানা সম্পূর্ণ ও চারখানা আংশিক অনুবাদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
উপসংহারঃ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা অব্যাহত গতিতে চলছে। তথ্যদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, এ ধারা আরো ব্যাপকরূপে পরিগ্রহ করবে।
জি এম এমদাদ

কোন মন্তব্য নেই: