বৈরী পরিবেশে ইসলামী জীবন
ব্যক্তিগতভাবে মানুষের ক্ষমতার তারতম্য এবং জীবনের রূঢ় বাস্তবতার বিভিন্ন স্তর থাকে। অন্তদৃêষ্টি ও ফিকহের জ্ঞানের পাশাপাশি অন্যের এই বাস্তবতার প্রতিও পরস্পর সহৃদয় অনুভূতি থাকা আবশ্যক। আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবার কাছ থেকে হজরত হামজাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব রাঃ মতো শাহাদতের শৌর্য প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। এটি এমন একটি মহৎ গুণ, গভীরতম নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় ছাড়া যার প্রকৃত মর্ম খুব কম লোকই অনুধাবন করতে পারে।
কেউ কেউ শান্তভাবে সত্যের পক্ষে কথা বলে তৃপ্তি বোধ করে; অন্যরা তাদের ধারণা অনুযায়ী বিরাজমান মারাত্মক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নীরব থাকাই নিরাপদ মনে করে। আবার অনেকে মনে করে আগা নয়, গোড়া থেকে সংস্কার কাজ চালাতে হবে। এ জন্য তারা ব্যক্তিবিশেষের প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তারা মনে করে, এসব লোকের দৃষ্টিভঙ্গি সংযত ও পরিশুদ্ধ করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু এটা বলা বাহুল্য, পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা নির্মূল করতে হলে সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির ভিত্তিতে একটি ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্বে সম্মিলিত সংগ্রাম ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবশ্য শরিয়ত এক মুনকার থেকে যেন আরেকটি বড় মুনকারের সৃষ্টি না হয় সে জন্য অনেক ক্ষেত্রে নীরবতাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল করীমে হজরত মূসা আঃ-এর ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়। মূসা আঃ সিনাই পর্বতে ওঠার আগে তার ভাই হজরত হারুন আঃকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যান। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরপরই ইসরাইলিরা সামেরিদের পরামর্শে একটি সোনার গো-মূর্তি বানিয়ে পূজা করতে শুরু করে। এই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে হারুন আঃ-এর বক্তব্য শুনতেও তারা অস্বীকার করে। কুরআন বলছেঃ
‘হারুন তাদেরকে আগেই বলেছিলেন, হে আমার স্বজাতি! তোমাদের এর দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। তোমাদের প্রভু দয়াময়; সুতরাং তোমরা আমাকে অনুসরণ করো এবং আমার আদেশ মেনে চলো। তারা বলেছিলঃ আমাদের কাছে মূসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজা থেকে কিছুতেই বিরত হবো না।’ (২০ঃ ৯০-৯১)
তাদের অনমনীয়তা দেখে হারুন আঃ নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। মূসা আঃ ফিরে এসে ক্রোধে ও দুঃখে অগ্নিশর্মা হয়ে হারুন আঃকে রূঢ়ভাবে তিরস্কার করলেন। কুরআনের বর্ণনা, ‘মূসা বললেন, ও হারুন! তুমি যখন দেখলে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তখন কিসে তোমাকে নিবৃত্ত করল আমার অনুসরণ করা থেকে? তবে কি তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে!’ (২০ঃ ৯২-৯৩)
হারুন আঃ জবাব দিলেন ‘হে আমার সহোদর! আমার দাড়ি ও চুল ধরে টেনো না; আমি আশঙ্কা করেছিলাম, তুমি বলবে, তুমি বনী ইসরাইলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ এবং তুমি আমার কথা পালনে যত্নবান হওনি।’ (২০ঃ ৯৪)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সামাজিক ঐক্য ও সম্প্রীতির স্বার্থে হারুন আঃ হজরত মূসা আঃ ফিরে না আসা পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করলেন। এ ঘটনার সাথে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর হাদিসের সাযুজ্য লক্ষণীয়। তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর অনুসারীরা সবেমাত্র পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে ইসলামে এসেছে, এটা বিবেচনা করেই তিনি পুরনো কাবাকে ধ্বংস করে নতুন করে কাবা নির্মাণ থেকে বিরত থেকেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর অন্যান্য আদেশ থেকেও এরূপ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন যদি অত্যাচারী-অনাচারী শাসককে হটিয়ে সৎ ব্যক্তির সরকার কায়েমের ক্ষমতা না থাকে তাহলে শাসকের অবিচার সহ্য করার কথা আছে। কেননা প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন বৃহত্তর ফেতনার সৃষ্টি না হয়, মুসলমানদের অযথা রক্তপাত বা সামাজিক স্থিতিশীলতা যেন বিনষ্ট না হয় অর্থাৎ বাস্তব ফল ছাড়া শুধু অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে এমন প্রতিবাদের চেয়ে নীরবতাই কাম্য। অন্যথায় পরিস্থিতি এমনও হতে পারে যে, কুফরির দিকেও মোড় নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন, ‘যতক্ষণ না তুমি প্রকাশ্য কুফরি প্রত্যক্ষ করো, যার পক্ষে তোমার কাছে আল্লাহর তরফ থেকে প্রমাণ আছে।’ (বুখারী, মুসলিম)
দু’টি দৃষ্টান্তই অনিশ্চিত সাফল্যের মুখে ঐক্য বজায় রাখার ওপর আলোকপাত করেছে। পক্ষান্তরে ইসলামী শিক্ষা পালনের ক্ষেত্রে যেসব ভাববাদী মুসলমান চরম পূর্ণতা দেখতে চায় অথবা যারা একেবারে বর্জন করতে চায় তাদের উভয়ের জন্য এ ঘটনাগুলো শিক্ষণীয়। এদের কাছে কোনো মধ্যপন্থা নেই। ভাববাদীরা মুনকার উচ্ছেদে শক্তি প্রয়োগকেই শেষ হাতিয়ার মনে করেন। তারা অন্য দু’টি পথ অর্থাৎ কথা ও হৃদয় দিয়ে প্রতিরোধের কথা বেমালুম ভুলে যান। মোট কথা, প্রতিটি উপায় প্রয়োগ নির্ভর করে ব্যক্তির ক্ষমতা ও পরিস্থিতির ওপর। আশ শরিয়াহ বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করার ওপর এত দূর গুরুত্ব দিয়েছে যে, নিরুপায় অবস্থায় হারামও হালাল হয়ে যায় এবং ওয়াজিব স্থগিত হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ এ বিষয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
‘আল্লাহতায়ালা কুরআনুল করীমে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, তিনি ক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত বোঝা মানুষের ওপর চাপাতে চান না।’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ কারো ওপর এমন কোনো কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা তার সাধ্যাতীত।’ (২ঃ ২৮৬)
‘আমরা কাউকেই তার সাধ্যাতীত ভার অর্পণ করি না, যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে তারাই জান্নাতবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।’ (৭ঃ ৪২)
‘কাউকেই তার সাধ্যাতীত কার্যভার দেয়া হয় না এবং আল্লাহ যাকে যে সামর্থø দিয়েছেন তদপেক্ষা গুরুতর বোঝা তিনি তার ওপর চাপান না।’ (৬৫ঃ ৭)
আল্লাহ মানুষকে যথাসাধ্য তার আদেশ পালন করতে বলেছেন। তিনি বলেনঃ‘তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করো।’ (৬৪ঃ ১৬)
ঈমানদাররাই তাঁর কাছে প্রার্থনা করেছেঃ‘হে প্রভু, আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যেমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন আমাদের ওপর তেমন দায়িত্ব অর্পণ করবেন না। হে প্রভু! এমন ভার আমাদের ওপর অর্পণ করবেন না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই।’ (২ঃ ২৮৬)
আল্লাহ তাদের প্রার্থনা কবুল করেছেন। এসব আয়াত প্রমাণ করছে যে, তিনি মানুষের ওপর এমন বোঝা চাপান না, যা সে বহন করতে পারবে না। এটা নিশ্চিত যে, জাহমিয়া, কাদিরিয়া ও মুতাজিলা দর্শনের সাথে এর কোনো সঙ্গতি নেই। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝে নিতে হবে, যদি কোনো শাসক, ইমাম, বুদ্ধিজীবী, ফকিহ অথবা মুফতি আল্লাহর খালেস ভয়ে তার সাধ্য অনুযায়ী যে ইজতিহাদ করবে তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহ তার কাছ থেকে এটাই চেয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, তাকে শাস্তি দেয়া হবে না। এর বিপরীত কাদিরিয়া ও মুতাজিলারা যে ধারণা পোষণ করে তা বাতিল।
কাফেরদের বেলায়ও একই বিষয় প্রযোজ্য। যারা কুফরির দেশে রাসূল সাঃ-এর দাওয়াত পেয়ে তাকে রাসূল বলে স্বীকার করলেন এবং তাঁর ওপর অবতীর্ণ ওহিকে বিশ্বাস করে যথাসাধ্য আনুগত্য করলেন যেমন নাজ্জাশী ও অন্যান্য, কিন্তু ইসলামের ভূখণ্ডে যেতে না পারার দরুন শরিয়তকে সামগ্রিকভাবে মানতে পারলেন না; কারণ তাদেরকে দেশত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়নি অথবা প্রকাশ্যে আমলের সুযোগ পাননি এবং তাদেরকে সমগ্র শরিয়াহ শিক্ষা দেয়ার মতো লোক ছিল না। এমন সব মানুষের জন্য আল্লাহ জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরূপ আরো উদাহরণ আছে। আল্লাহতায়ালা ফেরাউনের লোকদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী ছিল তাদের সম্পর্কে বলছেন, ‘এবং তোমাদের কাছে আগে ইউসুফ এসেছিলেন স্পষ্ট নিদর্শনসহকারে, কিন্তু তিনি যা নিয়ে এসেছিলেন তাতে তোমরা বারবার সন্দেহ পোষণ করতে। অবশেষে তিনি যখন ইন্তেকাল করলেন তখন তোমরা বলেছিলে তার পরে আল্লাহ আর কাউকে রাসূল করে পাঠাবেন না।’ (৪০ঃ ৩৪)
নাজ্জাশী খ্রিষ্টানদের রাজা ছিলেন; কিন্তু তিনি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে বললে তারা অস্বীকার করল। শুধু মুষ্টিমেয় লোক তাঁকে অনুসরণ করেছিল। তিনি যখন মারা গেলেন তখন তার জানাজা পড়ারও কেউ ছিল না। অবশ্য রাসূলুল্লাহ সাঃ মদিনায় তার জানাজা পড়েন এবং উপস্থিত সবাইকে বলেন, ‘আবিসিনিয়ায় তোমাদের মধ্যকার একজন সৎ কর্মশীল ভাই মারা গেছেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)
যদিও নাজ্জাশী ইসলামের অনেক শিক্ষা মানতে পারেননি, দেশত্যাগ করেননি, জিহাদে অংশ নেননি অথবা হজও করেননি। এটাও বর্ণিত আছে যে, তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, সিয়াম অথবা জাকাতের কর্তব্য পালন করতে পারেননি; কেননা তার ঈমানের কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে জনগণ তার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। আমরা জানি, তিনি আল কুরআনের বিধানও প্রয়োগ করেননি, যদিও আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে আহলে কিতাবরা চাইলে তাঁর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করার আদেশ দিয়েছিলেন। আবার আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে এই মর্মে সতর্কও করে দিয়েছেন, ‘আহলে কিতাবরা যেন তাকে ওহির অংশবিশেষ থেকেও বিচ্যুত করার জন্য প্রলুব্ধ করতে না পারে।’
কঠোর ন্যায়পরায়ণতার জন্য উমর ইবনে আবদুল আজিজ রাঃকে অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে। এ জন্য তাকে বিষ প্রয়োগও করা হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু নাজ্জাশী এবং তার মতো অন্যরা এখন জান্নাতে শান্তিতে আছেন, যদিও তারা শরিয়তকে পূর্ণরূপে পালন ও প্রয়োগ করার সুযোগ পাননি বরং তা-ই করেছেন, যা তাদের কাছে প্রযোজ্য মনে হয়েছে। (মাজমুয়া আল ফাতওয়া)
ড. ইউসুফ আল কারজাভী
ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন