মঙ্গলবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

ইসলামে শুক্রবার একটি সেরা দিন


ইসলামে শুক্রবার একটি সেরা দিন



সাপ্তাহিক ছুটির দিন পরিবর্তনের বিষয়টি এখন দেশব্যাপী বিভিন্ন মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের একটি বৃহৎ অংশ শুক্র ও শনিবারের পরিবর্তে সরকারি ছুটি রোববার করার পক্ষে। অপর দিকে দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী ও ধর্মীয় মতাবলম্বী নেতৃবৃন্দ সরকারি ছুটি শুক্রবার রাখার দাবি করে আসছেন শুরু থেকেই। এ নিয়ে একধরনের দ্বিধাবিভক্তি পুরো জাতির মধ্যে।
ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ওআইসি’র ফোরামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইসলামি দেশগুলো রেড ক্রসের পরিবর্তে রেড ক্রিসেন্ট করা হয়েছে। সৌদি আরব, মিসর, ইরাক, ইরান, কুয়েত, আরব আমিরাত, কাতারসহ ওআইসি’র ৫০টির বেশি সদস্য দেশ এখনো শুক্রবার ছুটি ভোগ করে আসছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মালদ্বীপও এ রীতি অনুসরণ করছে। শুধু মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান এ ক’টি দেশে শুক্রবারের পরিবর্তে অন্য দিন ছুটি পালন করছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোববারের পরিবর্তে সরকারি ছুটি শুক্রবার করার সময় দেশে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। অথচ সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সরকারি ছুটির দিন পরিবর্তন করে আশির দশকের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে জনগণের মাঝে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে এমন সিদ্ধান্ত জনরোষের সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিনের পরিবর্তে এক দিন করা বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত। কিন্তু শুক্রবারের পরিবর্তে রোববার ছুটির দাবির কোনো যুক্তিসম্মত ভিত্তি নেই। কারণ পশ্চিমাদের সাথে তাল মিলিয়ে যারা রোববার ছুটি দাবি করছেন তাদের কাছে শুক্রবারের ভালো বা মন্দ বিষয়ে তেমন কোনো সমীক্ষা নেই। তা ছাড়া শুক্রবার ছুটির কারণে আমদানি-রফতানির কোনো ক্ষতি হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও তাদের কাছে নেই। দ্বিতীয় হলো, বিশ্বের যেসব দেশে রোববার ও শনিবারকে ছুটির দিন হিসেবে বেছে নিয়েছে তার ভিত্তি যদি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক হয়, তাহলে একই কারণে বাংলাদেশের মতো বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ মুসলিম দেশের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার হলে সমস্যা কোথায়? উপরন্তু যুক্তিসম্মত। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মুসলিম দেশের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার থাকায় তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যে যদি অসুবিধা না হয়, তাহলে আমাদের অসুবিধার কথা কী করে যুক্তিগ্রাহ্য হয়।
দুই যুগ ধরে এ দেশের মানুষ সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার ভোগ করে আসছেন। তাতে ব্যবসায়-বাণিজ্যের এমন কোনো ক্ষতি হয়নি যা দেশের অর্থনৈতিক দিককে ভরাডুবি করেছে। আবার যে সময় রোববার সাপ্তাহিক ছুটি ছিল তখন ব্যবসায়-বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য কোনো লাভও হয়নি। তা ছাড়া বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক দুর্নীতি। শুক্রবারের ছুটির কারণে নয়। সুতরাং এমন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে সাপ্তাহিক ছুটি রোববার করার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়-বাণিজ্যের এমন নাজেহাল বা খারাপ অবস্থার জন্য শুক্রবারের ছুটি দায়ী নয়। বরং দেশের অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পেছনে ফেলে রেখেছে। যদি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা হয়, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়, সব দিকের দুর্নীতি বন্ধ করা হয়, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অবসান ঘটানো হয় তবেই দেশের শিল্পের বিকাশ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতি স্বাভাবিকভাবেই ঘটবে। অর্থনৈতিক দুরবস্থার অবসান হবে।
সুশীলসমাজের কেউ কেউ সূরা জুমার ১০ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, নামাজের পরই জীবিকা অন্বেষণে বেরিয়ে যেতে হবে। শুক্রবার ছুটি থাকলে এই রুজি অন্বেষণে বাধা হচ্ছে। এ কারণে কুরআনের স্পিরিট রক্ষা হচ্ছে না বলেও তারা মন্তব্য করেছেন। তাদের এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমত বলতে হচ্ছে, যাদের কাছে নামাজ পড়া-না পড়া সমান এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে হারাম-হালাল বাছাইয়ের কোনো পার্থক্য নেই, তাদের পক্ষে এমন যৌক্তিকতার কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, বলতে হচ্ছে কুরআনুল হাকিমে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হচ্ছে­ মানুষকে নামাজের প্রতি উৎসাহী করা। যাতে করে তারা ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করে এবং সময়মতো নামাজের জন্য মসজিদে গমন করে।
ইসলাম ও মুসলিম কালচারের একটি বিশেষ পরিচিতি হলো­ শুক্রবারকে ইবাদত-বন্দেগি, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাঃ-এর স্মরণে ব্যয় করা। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, ইহুদিদের জন্য উপাসনার বিশেষ দিন শনিবার আর খ্র্রিষ্টানদের উপাসনার বিশেষ দিন রোববার। এই উভয় সম্প্রদায় তাদের উপাসনার দিনকে সাপ্তাহিক ছুটি হিসেবে পালন করে যাতে তারা বাধাহীন ও পরিপূর্ণভাবে উপাসনা করতে পারে। কাজেই মুসলমানদের জন্য শুক্রবার সেই বিশেষ ইবাদতের দিন। এই দিনকে সাপ্তাহিক ছুটি হিসেবে পালন করার মধ্যে ইসলামি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। এ ছাড়া মুসলমানদের সাপ্তাহিক ছুটি হিসেবে শুক্রবারের এত বেশি অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ছুটির দিবসে নেই।
এই শুক্রবার অন্যান্য দিন থেকে অনেক মর্যাদাশীল এবং মাহাত্ম্যময় একটি দিন। রাসূল সাঃ-এর কাছে এ দিনটির অনেক মর্যাদা ছিল। তিনি এই দিনটিকে সাপ্তাহিক ছুটি হিসেবে নয়, বরং সম্মিলিত ইবাদতের দিন হিসেবে পালন করতেন। এমনকি খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়েও শুক্রবার ছিল সম্মিলিত ইবাদতের দিবস। আবু হুরায়রা রাঃ বর্ণিত রাসূল সাঃ বলেন, ‘মুসলিম উম্মাহ হিসেবে আমাদের দুনিয়ায় আগমন পরবর্তী যুগের লোক হিসেবে আর কেয়ামতের দিন আমরা হব অগ্রগামী। তবে এটা মনে রেখো, ইহুদি ও নাসারাদের কিতাব দেয়া হয়েছে আমাদের আগে। আর আমাদের কিতাব (কুরআন) দেয়া হয়েছে তাদের পরে। আল্লাহতায়ালা সম্মিলিতভাবে ইবাদতের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আর তা হলো শুক্রবার। কিন্তু বিভিন্ন সম্প্রদায় এর মধ্যে মতভেদ করলে আল্লাহ আমাদের শুক্রবার দিবসের প্রতি হেদায়েত করলেন। অর্থাৎ যেহেতু আমরা শুক্রবার পালন করি তাই আমরা অগ্রগামী আর অন্য জাতি এ ব্যাপারে আমাদের পশ্চাৎগামী। ইহুদিরা শনিবার আর খ্রিষ্টানরা পরদিন (রোববার) উপাসনার দিন পালন করে’ (বোখারি ও মুসলিম)।
তা ছাড়া শুক্রবার একটি অনন্য ও মাহাত্ম্যপূর্ণ দিন হিসেবে মুসলমানের কাছে গ্রহণীয় হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, আল্লাহতায়ালা এই দিনে এমন একটি সময় রেখেছেন যা দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ মুহূর্ত। আর এই সময়টি হচ্ছে­ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তাই আমরা যদি এই দিনে ব্যবসা-বাণিজ্যে সময় ব্যয় করি তাহলে গুরুত্বপূর্ণ এই সময় থেকে নিশ্চিত বঞ্চিত হচ্ছি এবং শুক্রবারের জুমার নামাজ ভালোভাবে আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছি। কারণ এই দিনে ভালোভাবে গোসল করে মসজিদে গমন করার পেছনেও অনেক নেকি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই শুক্রবারই আল্লাহতায়ালা হজরত আদম আঃ’কে সৃষ্টি করেন। হজরত নূহ আঃ-এর নৌকা আরোহীসহ রক্ষিত হয়। হজরত ইব্রাহীম আঃ-এর জন্ম এই দিনেই হয়েছিল। হজরত মূসা আঃ এবং বনি ইসরাইল ফেরাউনের নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করেন এই শুক্রবারই। এ রকম আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা এই শুক্রবার দিবসের সাথে জড়িত রয়েছে।

মাওলানা ফিহির হোসাইন

কোন মন্তব্য নেই: