মঙ্গলবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

ইসলাম প্রচারে গুরুত্ব দিতে হবে


ইসলাম প্রচারে গুরুত্ব দিতে হবে



ইসলাম প্রচারে স্বাধীনতার প্রতি আমাদের গুরুত্ব দেয়া দরকার। ইসলাম শুধু নিজেকে সৎ হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেয় না, অন্যকেও সংশোধনের তাগিদ দেয়। মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দেয়া ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টাকে এ কারণে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানকে তার সামর্থ অনুযায়ী ইসলাম প্রচারের কাজে অংশ নিতে হবে। এ জন্য কুরআনে বলা হয়েছে­ ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো।’ ... (১৬:১২৫)
রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর প্রত্যেক সাহাবি ছিলেন ইসলাম প্রচারক (দাইয়া)। কুরআন আরো বলছে­ ‘বলো, এটাই আমার পথঃ আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহ্বান করি সজ্ঞানে। আমি ও আমার অনুসারীরা।’ (১২ঃ১০৮)
অতএব সংস্কার কর্মীদের লক্ষ্য হচ্ছে­ ‘নিজে সৎ হও, অপরকে সৎ করো।’ আল কুরআনের ভাষায়­ ‘কে উত্তম­ যে আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকে, সৎ কর্ম করে এবং বলে, আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (৪১ঃ ৩৩)
ইসলাম চায় না যে, একজন মুসলমান একাই কাজ করুক। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন­ ‘আল্লাহর (সাহায্যের) হাত জামাতের সাথেই থাকে।’ তিনি আরো বলেন­ ‘একজন ঈমানদার আরেকজন ঈমানদারের কাছে সেই ইমারতের মতো যার বিভিন্ন অংশ একে অপরের সাথে সংযুক্ত।’ (বুখারি)
নিজেদের মধ্যে সহৃদয় সহযোগিতা এবং সৎ কাজের আদেশ কেবল একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একটি অপরিহার্য শর্ত। অতএব দাওয়াতি ক্ষেত্রে সামষ্টিক কাজ বাধ্যতামূলক­ এ ছাড়া দায়িত্ব অপূর্ণ থাকে। বাস্তব কথা হচ্ছে ইসলামবিরোধী শক্তি বিভিন্নভাবে সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করছে, অতএব মুসলমানদেরকেও সঙ্ঘবদ্ধ হয়েই ওই শক্তির মোকাবেলা করতে হবে। অন্যথায় আমরা পিছিয়ে পড়তে থাকব যখন অন্যরা এগোতে থাকবে। অতএব যেসব মুসলিম দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত দাওয়াতি কাজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়, সরকারিভাবে এমনকি সেন্সরশিপের মাধ্যমে তারা মস্ত বড় গুনাহ করে। দাওয়াতি কাজে ভীতি প্রদান ও বাধা সৃষ্টিও চরমপন্থী মনোভাব সৃষ্টির প্রধান কারণ, বিশেষ করে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা ও মার্ক্সবাদ প্রচারে কোনো বাধা দেয়া হয় না, বরং সব সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়; তখন এটাকে কিছুতেই সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এ কারণে যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী বিপ্লবের কাজে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই, কোনো সরকারেরও থাকতে পারে না।
বস্তুত মুসলিম দেশগুলোতেই ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে গিয়ে সেন্সরশিপ ও নানা রকম দলনের শিকার হতে হচ্ছে। সেখানে কেবল দরবেশ মার্কা ইসলাম ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের সুযোগ দেয়া হয়। এদের ইসলামের চেহারা হচ্ছে পশ্চাৎপদতা ও অবজ্ঞায় এবং আচার-অনুষ্ঠান, বিদাতি কাজকাম, শাসক-তোষণ এবং শাসকদের গদি বহাল রাখার দোয়ার মধ্যে সীমিত। আর দুর্নীতিপরায়ণ শাসকরাও এ ধরনের ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় অতি উৎসাহী। এভাবে অন্যায়-অবিচার, শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদকে তারা স্যাবোটাজ করার অপচেষ্টা চালায়। মার্কস সম্ভবত এই অর্থে দাবি করেছিলেন, ‘ধর্ম জনগণের জন্য আফিম।’
কিন্তু কুরআনুল কারিম, সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন যে ইসলাম রেখে গেছেন তা হচ্ছে সত্য, শক্তি, সম্মান-মর্যাদা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জিহাদের প্রতিভূ। আর শাসকরা এই ইসলামকে ভয় পায়; কারণ তাদের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে কী জানি কখন বিদ্রোহ দেখা দেয়! পক্ষান্তরে এই ইসলাম তার অনুসারীদেরকে বলে­ ‘তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করত এবং তাঁকে ভয় করত, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করত না।’ (৩৩ঃ৩৯)
এই পরিচ্ছন্ন বিশ্বাসের আলোকে ঈমানদাররা মনে করে যেহেতু জীবনের মেয়াদ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত, অতএব কাউকে ভয় করার দরকার নেই, আর তিনি ছাড়া কারো কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনারও দরকার নেই। সমসাময়িক তুরস্কের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার একজন উপপ্রধান মন্ত্রীকে মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি একটি দলেরও নেতা। তাদের বিরুদ্ধে শরিয়ত প্রবর্তন করার দাবি জানানোর অভিযোগ আনা হয়। অথচ তুরস্কের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান! ওই নেতা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ খাড়া করা হয়। অভিযোগগুলোর মূল বিষয় ছিল তারা ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ককে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। ধর্মনিরপেক্ষ আতাতুর্কের অনুসারী তুরস্কের তদানীন্তন সামরিক সরকার শরিয়ত তথা ইসলামী জীবন বিধান পুনঃপ্রবর্তনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে অপরাধ বলে গণ্য করে। অথচ ওই গ্রুপ সর্বসম্মত আইনানুগ পন্থায় গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা শক্তি প্রয়োগ করে সহিংস পন্থায় সরকার উৎখাত করতে চাননি। সামরিক কৌঁসুলি তাদের বিরুদ্ধে নানা আপত্তিকর ্ল্লোগান তোলার অভিযোগও উত্থাপন করে। ্ল্লোগানগুলো হচ্ছে­ ‘ইসলামই হচ্ছে একমাত্র পথ’, ‘হজরত মুহাম্মদ সাঃ একমাত্র নেতা’, ‘আশশারিয়াহ এবং ইসলাম এক ও অভিন্ন’ এবং ‘আল কুরআনই হচ্ছে সংবিধান।’ প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মুসলমানই যিনি আল্লাহকে প্রভু, ইসলামকে দীন ও হজরত মুহাম্মদ সাঃ’কে রাসূল হিসেবে স্বীকার করেন তার পক্ষে কি এগুলো অস্বীকার করা সম্ভব? যখন ঈমানের পরিবর্তে কুফর এবং হারামকে হালাল করা হয় তখন মুসলমানদের কী করা উচিত? এসব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কি বাড়াবাড়ি ও চরমপন্থার মূল কারণ নয়? একটি আফ্রো-আরব দেশে কম্যুনিস্ট তৎপরতার জন্য সাংবিধানিক সুযোগ ও নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলামী ভাবধারা জাগ্রত করার সব প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ ওই দেশটি নিজেকে তথাকথিত ‘স্বাধীন বিশ্বের অংশ’ বলে বিবেচনা করে। আরো মারাত্মক হচ্ছে ওই দেশটির মুসলিম নেতাকর্মীদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধেও একমাত্র অভিযোগ, তারা আল্লাহকে প্রভু, সত্যকে লক্ষ্য, ইসলামকে একমাত্র পথ, কথাকে অস্ত্র এবং জ্ঞানকে তাদের একমাত্র খোরাক বলে ঘোষণা করেছিল।
অতএব, হেকমত ও সুন্দর ভাষণের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তরুণরা যদি শক্তিকে ও সহিংসতাকে সহিংসতা দিয়ে মোকাবেলা করতে চায় তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যায়? এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। ইনশাআল্লাহ ইসলাম যেভাবে হোক সঙ্ঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবে। তাদেরকে সুস্থ ও স্বাধীন পরিবেশে কাজ করতে দেয়া উচিত। অন্যথায় ঘটনাবলি অবাঞ্ছিত বিপরীত খাতে প্রবাহিত হতে পারে। খোলাখুলি কাজ করতে না দিলে দাওয়াতি কাজ বিভ্রান্তিকর গোপন সহিংসতা কিংবা চরমপন্থার রূপ নিতে পারে। ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের মারাত্মক ভুল হচ্ছে তারা ইসলামী আন্দোলন দমনে বন্দিশিবিরে সহিংস মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। বন্দিশিবিরগুলোতে মানুষের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে ১৯৫৪ ও ১৯৬৫ সালের মিসরের ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। সামরিক কারাগারে ইসলামী বিপ্লবের নেতা ও কর্মীদেরকে লোমহর্ষক ও অবিশ্বাস্য পন্থায় শাস্তি দেয়া হয়। এখনো এসব কথা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। তাদের দেহে আগুন ও সিগারেটের ছ্যাঁক দেয়া হয়, নারী ও পুরুষ বন্দীকে জবাই করা পশুর মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়, কারারক্ষীরা পালাক্রমে রক্ত ও পুঁজ জমে না ওঠা পর্যন্ত বন্দীদেরকে আগুনে ঝলসাতে থাকে। এই পাশবিক আচরণে অনেকেই শাহাদতবরণ করেন। কিন্তু শাস্তি দাতাদের দিল আল্লাহর ভয়ে এতটুকু কেঁপে ওঠেনি। নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সমাজবাদের উদ্ভাবিত সব নির্যাতন কৌশল তারা নির্বিচারে আল্লাহর পথের মুজাহিদদের ওপর প্রয়োগ করে।
এই বন্দিশালায় চরমপন্থা ও তাকফিরের প্রবণতা জন্ম নেয়। বন্দীদের মনে প্রশ্ন জাগেঃ আমরা কী অপরাধে নির্যাতিত হচ্ছি? আমরা আল্লাহর কালামের কথা ছাড়া আর কিছু তো বলিনি? আল্লাহর পথে জিহাদে আমরা কেবল আল্লাহরই সাহায্য চেয়েছি, অন্য কারো কাছে তো পুরস্কার বা প্রশংসা চাইনি? এই প্রশ্ন আরো প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই পশুরা কে, যারা আমাদের নির্যাতন করে; আমাদের মানবসত্তাকে অপমানিত করে, আমাদের ধর্মকে অভিশাপ দেয়, আমাদের পবিত্র ঈমানকে অমর্যাদা করে; আমাদের ইবাদতকে ঠাট্টা করে, এমনকি আমাদের প্রভুরও অমর্যাদা করার মতো ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে! একজন পদস্থ কর্মকর্তা একদিন বলে­ ‘তোমাদের প্রভুকে আমার কাছে হাজির করো, তাকে আমি জেলে পুরব।’ এই পশুগুলোকে কি মুসলমান বলা চলে? এরা যদি মুসলমান হয় তাহলে কুফরি কী? এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এরাই হচ্ছে কাফির, এদেরকে ইসলামের আওতা থেকে বিতাড়িত করতেই হবে। এরপর আরো প্রশ্নের উদয় হয়ঃ এদের সম্পর্কে এই যদি হয় আমাদের বিচার, তাহলে এদের মনিব সম্পর্কে আমরা কী সিদ্ধান্ত নেব? ক্ষমতার আসনে বসে যেসব নেতা ও শাসক ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদেরকেই বা কিভাবে বিচার করা উচিত? তুলনামূলক বিচারে তাদের অপরাধ অধিকতর মারাত্মক এবং তাদের রিদ্দাহ আরো স্পষ্ট­ যে সম্পর্কে কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে­ ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারা সত্যত্যাগী।’ (৫ঃ৪৭)।
এই সিদ্ধান্তে আসার পর ওই নির্যাতিত মুসলমানরা তাদের সহবন্দীদের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়­ যেসব শাসক আল্লাহর বিধান মোতাবেক বিচার করে না এবং যারা শরিয়তের বাস্তবায়নে সংগ্রামরত তাদের ওপর নির্যাতন চালায়, এসব শাসকদের তোমরা কী মনে করো? বন্দীদের মধ্যে যারা তাদের সাথে একমত হলো তাদেরকে তারা বন্ধু এবং যারা দ্বিমত পোষণ করল তাদেরকে শত্রু গণ্য করল। এমনকি কাফিরও মনে করল, কেননা কাফিরের কুফরি সম্পর্কে যে সন্দেহ পোষণ করে সে নিজেই কাফির। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। যেসব লোক ওইরূপ শাসকের আনুগত্য করে তাদের সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠল। জবাব তৈরি ছিল­ তাদের শাসকদের মতো তারাও কাফির, কেননা দাবি করা হয়­ যে কাফিরের আনুগত্য করে সে নিজেও কাফির।
এভাবে ব্যক্তি, গ্রুপবিশেষকে কুফরি ফতোয়া দেয়ার প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সহিংসতা শুধু সহিংসতার জন্ম দেয় না, সুস্থ চিন্তাকেও দূষিত করে এবং ওই দলন-দমন অনিবার্য বিদ্রোহের জন্ম দেয়।

ড. ইউসুফ আল কারজাভী
অনুবাদঃ মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী

কোন মন্তব্য নেই: