মসজিদ হবে সব কল্যাণের স্রোতস্বিনী
রাসূল সাঃ এবং খোলাফায়ে রাশেদার যুগে যে এলাকায় মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে এলাকায়ই ইনসাফ বাস্তবতা পেয়েছে। সমাজের হতদরিদ্র মানুষ নিজেদের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। এতিম ও অসহায় শিশুরা মসজিদের মুসল্লিদের মধ্যে তাদের নতুন অভিভাবক খুঁজে পেয়েছে। মসজিদের মুসল্লিরাও এতিমদের আপন সন্তানের মতো বরণ করে নিয়েছেন। যেখানেই মসজিদ হয়েছে সেখানেই বেকার যুবক ও হতাশাগ্রস্ত মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছে। কেননা তখন মসজিদ ছিল সমাজের সব কল্যাণমূলক কাজের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদ মানুষের আত্মশুদ্ধিমূলক কর্মসূচির পাশাপাশি জাগতিক সমস্যা সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এমনকি রাস্তাঘাট, কালভার্ট, পুল ইত্যাদি নির্মাণ করে মানুষের প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রেও মসজিদ থেকে অনন্য অবদান রাখা হতো। মসজিদকেন্দ্রিক সেসব কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে গণমানুষের সাথে মসজিদের একটি সুগভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কালক্রমে মুসলিমদের নানাবিধ অবক্ষয়ের সাথে সাথে মসজিদের বহুমাত্রিক কল্যাণকর ভূমিকা স্তিমিত হয়ে গেছে। মসজিদ তার আপন মহিমা হারিয়ে শুধু ‘নামাজঘর’ এর মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে। সার্বজনীন কোনো সেবামূলক কর্মকাণ্ড না থাকার কারণে এখন অমুসলিমদের সাথে মসজিদের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে তারা ইসলামের দাওয়াত পাচ্ছে না, ইসলাম সম্পর্কে জানার ও বোঝার সুযোগ পাচ্ছে না।
শিশু-কিশোরদের জন্য মসজিদের কোনো কর্মসূচি না থাকায় তারা মসজিদমুখী হচ্ছে না এবং সমাজে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। অথচ শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে মসজিদ থেকে ওদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে অবদান রাখা যায়। হতদরিদ্র মানুষের কল্যাণের জন্য মসজিদ থেকে কোনো ভূমিকা না নেয়ায় তারা মসজিদ থেকে বিমুখ হয়ে সুদের ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হচ্ছে।
বস্তুত বর্তমানে মসজিদ শুধু ‘নামাজঘর’ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় যারা নামাজ আদায় করছে না তারা মসজিদে আসছে না। ফলে তাদের সাথে দিন দিন মসজিদের দূরত্ব বাড়ছে এবং সেই মানুষের নাফরমানির মাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে। সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মসজিদের প্রতি সব শ্রেণীর মানুষের আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হচ্ছে না। এমনকি কেউ কেউ মসজিদের আজান নিয়ে কটাক্ষ করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। তাই মানুষের জাগতিক প্রয়োজন বিবেচনায় এনে প্রতিটি মসজিদে এমন কিছু কার্যক্রম থাকা উচিত যাতে বেনামাজিসহ সবার সাথে মসজিদের সম্পর্ক ঘনীভূত হয় এবং দূরত্ব দূর হয়।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন ‘মসজিদে বসে দুনিয়াবি কথা বলা যাবে না’। তাদের কথা যথার্থ। কিন্তু মানুষের কল্যাণের কথা বলা, অভাবীদের অভাব মোচনের পরিকল্পনা করা, শিশু-কিশোরদের মানবিক উন্নয়নের কথা বলা অবশ্যই দুনিয়াবি কথা নয়। বরং সুনিশ্চিত করেই এগুলো ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। কিছুসংখ্যক মন্দির ও গির্জায় যাদের রক্তের প্রয়োজন তাদের সহায়তার জন্য রক্তের গ্রুপের তালিকা সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের কোনো মসজিদে এমন কোনো ব্যবস্থা আছে বলে শোনা যায়নি। অথচ ইসলাম মুসলমানদের সব কল্যাণকর্মে অগ্রগামী থাকতে উৎসাহিত করে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মসজিদগুলোতে ওয়াজ মাহফিল, তা’আলিমি জলসা হালকায়ে জিকির ইত্যাদি আত্মশুদ্ধিমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি গণমুখী ও সার্বজনীন কল্যাণকর কিছু কর্মসূচিও গ্রহণ করতে হবে। যেমনঃ
১. মসজিদকেন্দ্রিক পরিকল্পিত উপায়ে জাকাত দানঃ প্রতিটি মসজিদের মুসল্লিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ প্রতি বছর জাকাত আদায় করে থাকেন। তারা যদি মসজিদকেন্দ্রিক ঐক্যবদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করে প্রতি বছর কিছুসংখ্যক দরিদ্র পরিবারকে পর্যাপ্ত পুঁজি দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে প্রতি বছর কিছু দরিদ্র কমবে। যে মসজিদে দরিদ্রের চেয়ে জাকাত দানকারীর সংখ্যা বেশি সে মসজিদ এলাকা পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে, আর যেখানে দরিদ্রদের সংখ্যা বেশি সে এলাকা ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে দারিদ্র্রøমুক্ত হবে। এমনকি দারিদ্র্যের মধ্যেও অনেকে এ সময়ের মধ্যে জাকাত দেয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।
এভাবে প্রতিটি এলাকায় অন্তত একটি মসজিদ থেকে পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে ২০ বছরের মধ্যে দেশ পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত হবে। যদিও এতে সুদের ব্যবসায়ীরা খুশি হবে না। কিন্তু আল্লাহতায়ালা খুশি হবেন। কেননা তিনিই নামাজের মতো জাকাত ফরজ করে দিয়েছেন।
২. মসজিদকেন্দ্রিক কর্জে হাসানা (বিনা সুদে ঋণদান) কার্যক্রমঃ সুদ-ব্যবসায়ীরা যাতে হঠাৎ অভাবে পড়ে মানুষকে অভাবের সুযোগে শোষণ করতে না পারে সে জন্য কিছু বিত্তবানের মাধ্যমে মসজিদকেন্দ্রিক তহবিল গঠন করা যায়, যা থেকে অতীব প্রয়োজনীয় সময় যেকোনো ধর্ম ও যেকোনো শ্রেণীর মানুষকে সুদবিহীন ক্ষুদ্রঋণ দেয়া হবে। এতে এক দিকে সব শ্রেণীর মানুষ আশ্রয় খুঁজে পাবে, অন্য দিকে আল্লাহ তা’আলা খুশি হবেন।
৩. মসজিদকেন্দ্রিক যুব মজলিস গঠনঃ এলাকার যুবসমাজকে কোনো সংস্থা বা সমিতির অধীনে মসজিদকেন্দ্রিক ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে তাদের দ্বারা এলাকায় অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন করা যাবে। মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে কর্মমুখী জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে যুবকদের জন্য মাঝে মাঝে তালিমের ব্যবস্থাও করতে হবে যাতে তারা নৈতিক ও মানবিক দিক দিয়ে উন্নত ও কঠোর পরিশ্রমী হতে পারে। যুবকদেরকে এভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে মসজিদের সাথে তাদের সম্পর্ক তৈরি হবে। ফলে তারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ সব অপরাধ থেকে ফিরে থাকবে।
৪. মসজিদকেন্দ্রিক কিশোর মজলিস গঠনঃ এর মাধ্যমে সব কিশোরকে মানবিক বিকাশে সহায়তা করা হবে। প্রতি সপ্তাহে অথবা মাসে অন্তত একবার কিশোর মাহফিল করে শিশু-কিশোর উপযোগী ভাষায় তাদেরকে মহামানবদের গল্প বলা হবে। ইসলামের কথা বলা হবে। সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত জীবনের গল্প শোনানো হবে। ফলে শৈশব থেকেই তারা মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। চারদিকে আলো ছড়াতে শুরু করবে।
৫. মসজিদকেন্দ্রিক বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দানঃ মসজিদ এলাকায় অথবা পার্শ্ববর্তী এলাকার কোনো চিকিৎসককে অনুপ্রাণিত করে অথবা বিত্তবানদের সহায়তায় স্থানীয় গরিবদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়ার ব্যবস্থা করা হতে পারে।
৬. রক্তদান কার্যক্রমঃ যেকোনো মানুষের যেকোনো সময় রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। তাই মসজিদে সুস্থ মানুষের রক্তের গ্রুপ লিখে একটি রেজিস্টার সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যাদের প্রয়োজনের সময় কাউকে উদ্দেশ্যহীনভাবে দৌড়ঝাঁপ করতে না হয়। এ কাজটিতে শুধু একটি রেজিস্টার ক্রয় ছাড়া আর কোনো খরচ না থাকায় সব মসজিদেই অন্তত এ সেবাটুকু থাকা উচিত।
৭. নারী নির্যাতন ও অ্যাসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধঃ আধুনিক সমাজ ও পরিবারে নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। আর যেকোনো নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো ও নির্যাতনকারীকে প্রতিহত করা মুসলিমদের ঈমানি দায়িত্ব। তাই নারী নির্যাতন, অ্যাসিড সন্ত্রাস ও যৌতুক প্রতিরোধে মসজিদ থেকে শান্তিপূর্ণ কিন্তু কার্যকরী ভূমিকা রাখা সম্ভব।
উপরিউক্ত কর্মসূচিগুলো অথবা এ ধরনের জনকল্যাণমুখী অন্য কোনো উদ্যোগ প্রতিটি মসজিদ থেকে গৃহীত হলে এক দিকে মানবতা লাভবান হবে, ইসলামী সভ্যতা বিকশিত হবে, মসজিদের সাথে নামাজি-বেনামাজি সবার আত্মার বন্ধন গড়ে উঠবে। নামাজিদের সংখ্যা বাড়বে। সমাজে নামাজিদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। মসজিদভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। সর্বোপরি সমাজে শান্তির সুবাতাস বইবে। সমাজ থেকে অপরাধ, দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচার দূর হবে। সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব শ্রেণীর মানুষ মসজিদ থেকে উপকৃত হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরো দৃঢ় হবে। মসজিদের সাথে সবার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
মাওলানা বাকীবিল্লাহ আনজুম
লেখকঃ লেখক ও প্রবন্ধকার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন