মানব প্রেমের সাঁকো মায়ের ভাষা
প্রত্যেক রাসূলকেই আমি স্বজাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি যেন জাতিকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারে (সূরা ইব্রাহিম, ৪ আয়াত)। আল্লাহ কোরআন পাকে ভাষার মানবাধিকারের ঘোষণা দিয়েছেন এবং সব জাতির ভাষার অধিকার সংরক্ষণ করেছেন। কোরআন আমাদের এ শিক্ষাই দেয় যে ভাষা নয়, কোন উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক, নয় কোন ধর্মের প্রতীক। ভাষা জাতিসত্তারই প্রতীক। তাই তিনি (আল্লাহ) নবীদের ধর্মের বুকেও প্রতিটি জাতির জাতিসত্তার প্রতীকটাই ঠিক রেখেছেন। নবী-রাসূলদের ধর্মের বুকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন আল্লাহ প্রতিটি জাতির জাতিগত এ ভাষাগত পরিচয় অধিকারকে। তাই ধার্মিকদের মাঝে মাতৃভাষার প্রেম জাগ্রত হোক।
পাক কোরআনের সূরা রুমের ২২ আয়াতে মানুষের ভাষা বৈচিত্র্যতাকে সৃষ্টির নিদর্শন বর্ণনা করেছেন। তাই ধর্মের জন্য কোন ঐশী ভাষা না দিয়ে দিয়েছেন সব ভাষাকেই ধর্মীয় ভাষার মর্যাদা ও যোগ্যতা। যেন ধর্মের বুকেই টিকে থাকে তার ভাষা বৈচিত্র্যতার নিদর্শন, আর দাপটের সঙ্গেই পৃথিবীতে জীবন্ত থাকে সব জাতির ভাষা ও সব জাতিরই জাতিসত্তা এবং সব জাতিতে জীবন্ত থাকে ধর্ম, জীবন্ত থাকে তার কিতাবের জ্ঞান ও শিক্ষা। কিন্তু আল্লাহর বিধান অমান্য করে ইসলামের দিকনির্দেশনাকারী অনেক সমাজ ও অনারব রাষ্ট্রগুলো অনারব জাতিদের ভাষার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে ধর্মের ঘটিয়েছেন মৃত্যু। তাই সরে গেছে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান প্রশিক্ষণ। তারা ভাষা দিয়ে উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি করেছেন চরম অবিচার। উম্মাহর স্বার্থেরও ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন। অজ্ঞতার কাফনে মুড়িয়ে দিয়েছেন অনারব মুসলমানদের। তাই আজও এ দেশের হাজারে ৯৯৯ জনই বুঝে না তারা খতমে তারাবিতে কোরআনের কি শোনে। কিংবা নামাজ-কোরআন পাঠে তারা কি বলে। অপরপক্ষে মাতৃভাষার ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত ইবাদত এবং ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা।
সূরা ইব্রাহিমের ৪ আয়াতে আল্লাহর স্পষ্ট কথা, জাতিকে দেয়া হয়েছে জাতিরই ভাষা যেন আল্লাহ-রাসূলদের কথা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে। এ আয়াতে সব জাতির জন্য বোঝার নির্দেশও জারি করা হয়েছে। কোনক্রমে এ নির্দেশও অমান্য করা যাবে না। বোঝাটা তো আল্লাহর নির্দেশ তাই তাও ফরজ। এ ফরজ ছেড়ে দিলে নামাজ কোরআন পাঠ সফল হতে পারে না। সূরা ইব্রাহিমের শিক্ষা থেকে আমাদেরও দাবি ‘জাতিকে দাও জাতিরই ভাষা।’ যেন নামাজ-কোরআন-হাদিস যা কিছু পড়ি আল্লাহ-নবীর সেই অমূল্য কথাগুলো বুঝতে পারি। ইসলামের বুকে জীবন্ত করে তোল সব জাতির ভাষা অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টি ভাষা বৈচিত্র্যতার নিদর্শন। জীবন্ত করে তোল আল্লাহর কিতাবের এবং ইবাদতের জ্ঞান ও শিক্ষা। যে জাতি ধর্মের বুকে আল্লাহর নিদর্শন জীবন্ত না করবে সেখানে ধর্মও জীবন্ত হয়ে উঠবে না, উঠতে পারে না- এটাই আল্লাহর শিক্ষা। আল্লাহ এ আয়াত দ্বারা ১ লাখ ২৪ হাজার নবী-রাসূলদের ধর্মীয় ভাষানীতির ইতিহাস-ঐতিহ্য আমাদের সামনে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে ব্যাপক সময়ের ভাষানীতির সত্য ও বাস্তবতার মুখোমুখি করে দিয়েছেন যেন আমরা ইতিহাস ও অতীত থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করি। কেননা ইতিহাস ও অতীত সবচেয়ে বড় শিক্ষাক্ষেত্র। আল্লাহ এখানে মুসলমানদের শিক্ষা দিয়েছেন, কোন নবী-রাসূলই কোন ধর্মীয় ভাষা, ঐশী ভাষা নিয়ে কোন জাতিতেই আবিভূêত হয়নি। ধর্মের নামে আল্লাহ কোন জাতির ভাষার অধিকার কিংবা জাতিগত অধিকার বা পরিচয় ছিনিয়ে নেননি। কেননা জাতির ভাষাই জাতির ন্যায্য অধিকার ও প্রাপ্য পাওনা ধর্মের ক্ষেত্রেও তাই আল্লাহ সব জাতিকে তাদের ন্যায্য অধিকার এ প্রাপ্য পাওনা মিটিয়ে দিয়েছেন নিজ নিজ জাতির ভাষাতেই নবী-রাসূল, কিতাব কিংবা সহিফা প্রকাশ করে। সুতরাং ধর্মের নামে মানুষের এ আল্লাহ প্রদত্ত ভাষার অধিকার ছিনিয়ে নেয়া তা হচ্ছে চরম অন্যায়, অবিচার, জুলুম ও বঞ্চনা। তাই দয়া করে আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার যেন আমাদের প্রতি এ জুলুম আর করেন না। কোরআনের আয়াত দেখে আমাদের ভাষার অধিকার ফিরিয়ে দেন ও নামাজ-কোরআন পাঠের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মসজিদ-মাদ্রাসায় তা প্রতিষ্ঠিত করেন। এটাই রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি আমাদের জোরালো দাবি।
সূরা ইব্রাহিমের ৪ আয়াতের স্বজাতির-ভাষা শব্দটিই বুঝিয়ে দেয় যে ভাষার দ্বারাই সৃষ্টি হয় জাতি ও স্বজাতি। ভাষাই জাতির পরিচয়ের ফুল। ভাষা জাতিসত্তারই প্রতীক। ভাষা থেকে জাতিকে কোন ক্রমেই পৃথক করা যায় না, যায়নি এবং যাবেও না। তাই ধর্মের দ্বারাও আল্লাহ জাতিকে ভাষা থেকে আলাদা করেননি।
ভাষার বিষয়ে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বলেছেন, কোরআন নাজিল হয়েছে ৭টি (আরবের) আঞ্চলিক ভাষাতে। এতেও প্রমাণ হয় যে, আল্লাহ ধর্মের ক্ষেত্রেও সর্বাবস্থা বেছে নিয়েছেন। গণমানুষের মুখের ভাষা তাই আঞ্চলিক ভাষাকেও দিয়েছেন সমান মূল্য, মর্যাদা-গুরুত্বের এবং ধর্মের জন্য যে কোন অঞ্চলের ভাষাও রেখেছেন মুক্ত। নির্দিষ্ট কোন ধর্মের জন্য কোন জাতির ভাষাকেও নির্দিষ্ট করে দেননি। অর্থাৎ ধর্মচর্চা ও আল্লাহর ইবাদত হতে পারে যে কোন আঞ্চলিক ভাষাতে। এছাড়াও দেখা যায় ইঞ্জিল শরিফকে আল্লাহ নাজিল করেছেন হিব্রু ভাষার আঞ্চলিক ভাষা এরামাইককে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর সব কিতাবেই সূরা ইখলাস নাজিল করা হয়েছে।’ কিন্তু কোরআন বাদে আল্লাহর বিভিন্ন ভাষাই নাজিল হয়েছে বিভিন্ন অনারবি ভাষাতে। এতেও অকাট্যভাবে প্রমাণ হয়ে যায় শুধু আরবিই নয়, সব ভাষাতেই ধর্মের প্রকাশ পেয়েছে এবং সব ভাষাই আল্লাহর কাছে ঈমানের ভাষা বলেই গণ্য হয়েছে, হয় এবং হবেও। ধর্মের প্রকাশের জন্য, ঈমান ও ইবাদতের জন্য বিশেষ কোন ভাষার প্রয়োজন নেই।
নাগরিকের বা জনগণের ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করার দায়বদ্ধতা রাষ্ট্রের। সুতরাং রাষ্ট্র ও সরকারের চোখ যেন ধর্মে অন্ধ না হয় এবং বন্ধ না রয়। রাষ্ট্র ও সরকারের ধর্মের চোখ অন্ধ হলে সেখানে মরবে ধর্ম, মরবে তার জ্ঞান ও শিক্ষা। জনগণও হবে ধর্মান্ধ ও বিপর্যস্ত। রাষ্ট্র ও সরকারের ধর্মের চোখকে মুক্ত করতে ও মুক্ত রাখতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকারকেই জনগণের ধর্মের চোখকে জাগিয়ে তুলতে হবে। পাক কোরআনে আল্লাহ মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে।’ সুতরাং আমাদের রাষ্ট্র, সরকার ও মুসলিম সমাজকে ডাকছি, আসুন মাতৃভাষার পথে। এ পথই জ্ঞানের পথ, কল্যাণের পথ, অসীম সম্ভাবনাময় আলোকিত পথ। মাতৃভাষার পথই আমাদের পৌঁছে দেবে ধর্মেরি দীপ্ত অবস্থানে।
মাহমুদা আক্তার নীনা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন