পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলামের জোয়ার
এগারো সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়ার পর গোটা দুনিয়ার প্রচার মাধ্যমে আল কায়দা আর ইসলামকে এক সূতোয় গেঁথে সুপরিকল্পিত অপপ্রচার যখন চলছিল তখন অনেক ইসলামবিরোধী শক্তি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে এমন কথাও বলেছে, ‘ইসলাম এবার বিলুপ্ত হবে। জঙ্গিবাদী সবুজ পতাকার ধর্মে আগুন লেগেছে।’
ইসলাম ধর্মকে অপমানিত করার টার্গেট নিয়ে শুধু প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াই ব্যস্ত হয়নি, শক্তিশালী হলিউডে তৈরি হয়েছে ‘ট্র--লাই’র মতো অসংখ্য চলচ্চিত্র। যেখানে ইসলাম ধর্মকে দেখানো হয়েছে রক্তপিপাসু-নারী লিপ্সু এক বিকৃত মতবাদ হিসেবে। আর এসবের পেছনে হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে নাস্তিক্যবাদী চক্র, যাদের মূল লক্ষ্য হল মানুষকে ধর্মবিমুখ করে তুলে সামাজিক রীতির বিপক্ষে বিকৃত কামাচার আর পাপাচারের এক উন্মত্ত সমাজ গঠন। কিন্তুশত অপপ্রচারের মুখেও এগারো সেপ্টেম্বর ঘটনার দশ মাস সময়ে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই চৌত্রিশ হাজার লোক এবং ইউরোপে ২৩ হাজার লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পশ্চিমা দুনিয়ায় গত তিন বছরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী নওমুসলিমদের শতকরা ৬৫ ভাগই নারী। যেখানে ইসলামকে দেখানো হয় নারীর অধিকার হরক ধর্ম হিসেবে, সেখানে পশ্চিমা নারীদের বিরাট অংশ ইসলাম গ্রহণ করছেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী ড· স্টিকানি (বর্তমান নাম ড· আয়েশা) বলেন, ‘পশ্চিমা দুনিয়ায় নারীকে সংক্ষিপ্ত বস্ত্র পরাতে পরাতে প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলা হচ্ছে। নারীকে একজন মা অথবা বোনের বদলে নেহায়েত ভোগ্যপণ্য ঠাহর করা হচ্ছে। অনেকেই যখন বলেন, এটাই নারী স্বাধীনতা। আমি বলি, এটা নারীর মর্যাদাকে পদদলিত করে তাকে প্রমোদপণ্য বানানোর ফন্দিফিকির।
পশ্চিমা দুনিয়ায় বাবার মৃত্যু হলে সন্তানরাই মাকে নতুন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ‘ডেটিং’-এর নামে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে স্বাভাবিকভাবেই নেয়। একজন সন্তান যখন তার গর্ভধারিণী মাকে পরপুরুষের সঙ্গে রাত যাপনের বিষয়কে অন্যায় মনে করে না তখন তারা নিজের মায়ের ইজ্জতকে কিভাবে অবজ্ঞা করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘পশ্চিমা দুনিয়ায় শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ নারী বিয়ের আগেই দৈহিক মিলনে রত হয়। এদের অনেকেই গর্ভধারণ করে তথাকথিত সিঙ্গেল মাদার হয়ে আধুনিকতার ভান করে। কিন্তু নির্মোহভাবে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলে আমরা নারী জাতিরাই টের পাব এই অবাধ স্বাধীনতা আমাদের কতটা নীচ আর পরাধীন করে তুলছে।
‘পশ্চিমা দুনিয়ায় এমন অনেক সন্তানই আছে যারা বড় হন সৎ পিতার ঘরে। তাদের মায়ের বিবাহপূর্ব বাঁধহীন যৌনাচারে কোন বাবার ঔরসে ওদের জন্ম তাও বলতে পারবে না। এটাকে কি সভ্যতার বিকাশ বা আধুনিকতা বলা যায়? এসব প্রশ্ন যখন নারীদের কাছে ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে তখনই তাদের অস্থির চিত্র খোঁজ করে পবিত্রতার, শান্তির। আর সেই প্রসন্নতাকে ওরা খুঁজে পায় ইসলাম ধর্মে।’
পোল্যান্ডের বনেদী পরিবারে জন্ম আন্না মাজদউবের। ছোটবেলা থেকেই বিলাস-বৈভবের মাঝে কেটেছে তার সময়। বাড়ির আঙিনায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকত দামি দামি গাড়ি। পোল্যান্ডের সমাজতন্ত্রের অবসানের পর যে ক’টি পরিবার বিশাল সম্পদে বনে যায়, আন্না মাজদউবদের পরিবার এদের একটি। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের একটি অতি-অভিজাত এবং ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি নিচ্ছেন। বছর চারেক আগে অনেকটা হঠাৎ করেই তার মা নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। যেদিন আন্না মা স্থানীয় এক ইমামের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বাড়িতে ফেরেন তখন তাকে দেখে পরিবারের অন্য সদস্যরা হতবাক। তার হাতে পোলিশ ভাষায় অনুবাদ করা এক খণ্ড কোরআন, চেহারার মধ্যে কেমন যেন এক স্বর্গীয় দ্যুতি। বাড়িতে প্রবেশ করেই আন্নার বাবাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আজ থেকে তুমি আর আমার কেউ নও। আমি আলোর সন্ধান পেয়েছি।’ কথাগুলো এক লহমায় বলে তিনি যখন ঘর থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত তখন পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে বলল, এ কোন ধর্ম যা তোমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করল? তিনি স্মিত হেসে বললেন, তোমরা যদি চাও আমি ইমামকে ডাকি। উনি তোমাদের শোনাবেন এ প্রশ্নের উত্তর।
কিছুক্ষণ পর ইমাম এলেন। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত এত সুন্দরভাবে আবৃত্তি করলেন যে, সারাটি ঘরে অন্যরকম এক পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়ল। মাত্র এক ঘণ্টা ইসলামের মহান বাণী শুনতে শুনতে আন্না, তার তিন ভাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। আন্নার বাবা নাস্তিক। কোন ধর্মীয় বিশ্বাসই তাকে কাছে টানতে পারেনি। কিন্তু ইসলামের দাওয়াত তাকে শুধু কাছেই টানলো না, একেবারে বুকে জড়িয়ে ফেলল। গোটা পরিবার সমস্বরে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল। এমন একটা বিত্তবান পরিবারের সব সদস্যের একসঙ্গে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের খবর রীতিমতো চারপাশে চাউড় হয়ে গেল। ইসলাম গ্রহণের আগে আন্নার বাবার বিত্তবান জীবনের সন্ধ্যাগুলো কাটত সরাইখানায় অথবা অসৎ বন্ধুদের সান্নিধ্যে। আর এখন প্রতি সন্ধ্যায় তিনি বেরিয়ে পড়েন প্রতিবেশী অথবা শহরের বাসিন্দাদের খোঁজখবর নিতে। আল্লাহর রাস্তায় দান করেন অকৃপণভাবে। আগে আন্না মাজদউবদের পরিবারে বিত্ত ছিল, প্রশান্তি ছিল না। এখন বিত্ত আছে- আছে পবিত্রতা আর স্বর্গীয় পরিবেশ।
পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলামী জুজুর ভয় যদিও বিরামহীনভাবেই ছড়ানো হচ্ছে তার পরও অপপ্রচারকারীদের মুখে চুন-কালি দিয়ে ইসলামের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে অপ্রতিরোধ গতিতে। পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট শাসিত দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ক্রমশই দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর বিরাট একটা অংশ, যারা নিজেদের ধর্মহীন ঘোষণা করে গর্বিত হতেন তাদের মাঝেও বিশ্বাসের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রুশ ফেডারেশনের সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায় বিষয়ক পণ্ডিত ড· পল গোবল মনে করেন, আগামী কয়েক যুগের মধ্যেই রাশিয়ায় মুসলমান জনসংক্যা মোট জনসংখ্যার ৬৩ ভাগ ছাড়িয়ে যাবে। এই তথ্যে রুশ ফেডারেশনের নীতিনির্ধাকরা চিন্তিত। প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন রুশ নারীদের আহ্বান জানিয়েছেন, অধিক সন্তান গ্রহণের। কারণ, জনসংখ্যা বিশারদদের মতে ২০৫০ সাল নাগাদ রুশ ফেডারেশনের জনসংক্যা ১৪৩ মিলিয়ন থেকে কমে ১০০ মিলিয়নে নেমে আসবে। কারণ রুশ নারীদের অমুসলমান অংশটি সন্তান ধারণে একেবারেই অনাগ্রহী। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেকা গেছে, ১৯৮৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রুশ ফেডারেশনে মুসরিম জনসংখ্যা প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে অমুসলমান জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধি ৫ থেকে ৮ ভাগ মাত্র। মুসলমান জনসংখ্যার এই বিরাট বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ১৫ বছর আগে যেখানে গোটা রুশ ফেডারেশনে ৩০০ মসজিদ ছিল তা এখন ৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পরিসংখ্যানবিদদের মতে ২০১৫ সাল নাগাদ রুশ ফেডারেশনে মসজিদের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। রুশ ফেডারেশনে মূলত দু’ধরনের মসজিদ আছে। কমিউনিটি মসজিদগুলোয় ৮-১০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। অন্যদিকে জেনারেল মসজিদগুলোয় একসাথে ৫-৬ শ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কমিউনিটি মসজিদের সংখ্যাই বেশি।
কমিউনিটি মসজিদে ইমাম অথবা মুয়াজ্জিন নেই। কমিউনিটির সদস্যরাই পালাক্রমে এবং নিজেদের সুবিধামতো এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ২০১২ সাল নাগাদ মস্কো শহরের উপকণ্ঠে গড়ে উঠবে একটি ‘গ্রান্ড’ মসজিদ, যেখানে প্রায় ৫ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় কতে পারবেন। আর এটি নির্মাণে আর্থিক সহায়তা করছেন রুশ ফেডারেশনেরই বেশ কয়েকজন মুসলমান ধনকুবের যাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশীও আছেন। এই বাংলাদেশী ১৯৮১ সনে উচ্চ শিক্ষার্থে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। সেখানে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের সময় এক রুশ তরুণীকে বিয়ে করেন। বর্তমানে তিনি রুশ ফেডারেশনে কয়েক শ কোটি টাকার বিশাল ব্যবসা পরিচালনা করছেন। মস্কোর গ্রান্ড মসজিদ প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য অংকের দানের পাশাপাশি তিনি নিয়মিত বিভিন্ন তাবলিগ জামাতের পৃষ্ঠপোষকতাও করে থাকেন।
রুশ ফেডারেশনে ইসলামের ব্যাপক প্রসারের পেছনে কাজ করে যাচ্ছে কয়েক ডজন ইসলামী এনজিও। যেগুলো শুধুমাত্র ইসলামী দাওয়াত দিয়েই বসে থাকছে না বরং গোটা রুশ ফেডারেশন জুড়েই নানা ধরনের কল্যাণমুখী প্রকল্প পরিচালনা করছে্সেব প্রকল্প শুধু মুসলমান নয় বরং অমুসলমানদেরও সেবা দিয়ে যাচ্ছে। রুশ নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এসব ইসলামী এনজিওর বিস্তৃত কর্মসূচির ফলে রুশ ফেডারেশনে ইসলাম ছড়িয়ে পরার পাশাপাশি এসবের মাধ্যমে ইসলামী জঙ্গিবাদও ছড়িয়ে পড়ছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তবে রুশ নীতিনির্ধারকরা ইসলামী এনজিওগুলোকে যতটাই নেতিবাচকভাবে দেখার চেস্টা করুক না কেন, এখন পর্যন্ত এসব ইসলামী এনজিওর নেতিবাচক কোন দিকই খুঁজে পায়নি রাশিয়ার চৌকষ গোয়েন্দারা।
ইসলাম পশ্চিমা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে- একথা আজ আর কারো কাছেই নতুন বিষয় নয়। ইসলামী জাগরণের এই মহা জোয়ারে আগামী দশকগুলো রীতিমতো স্নাত হবে পশ্চিমা দুনিয়ার লাখ-লাখ মানুষ।
রূহানী মুসাফির
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন