মঙ্গলবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

মসজিদকে কেন্দ্র করে আদর্শ সমাজ গড়ে উঠতে পারে

মসজিদকে কেন্দ্র করে

আদর্শ সমাজ গড়ে উঠতে পারে


এদেশে সিংহভাগ লোক মুসলমান। মুসলমানগণ একতাবদ্ধ হয়ে কল্যাণকর কাজ করার জন্য এবং ইবাদত বন্দেগী করার লক্ষে মসজিদ তৈরি করে। হুজুর পাক (সা•) ঘোষণা করেন-কলেমা, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত হচ্ছে দ্বীনের স্তম্ভ বা খুঁটি। খুঁটি ছাড়া যেমন ঘর তৈরি করা যায় না, তদ্ররুপ শুধু কলেমা, নামায, রোযা, হজ্ব যাকাত আদায় না করলে মুসলমান হওয়া যায় না। আবার শুধু খুঁটি যেভাবে রোদ, বৃষ্টি, ঝড় থেকে রেহাই দিতে পারে না তদ্রম্নপ শুধু নামায, রোযা জাতীয় ইবাদত করলে মুসলমান হওয়া যায় না। ঘরের সুবিধা পেতে যে রকম খুঁটির সঙ্গে ছাউনি প্রয়োজন তদ্রম্নপ মুসলমান হতে গেলে নামায রোযা পালনের সঙ্গে মানবিক ও নৈতিক গুনাবলী অর্জন করা দরকার এসব হুকুমগুলোকে গুরম্নত্ব দিয়ে পরীড়্গার এক একটি বিষয় হিসাবে বিবেচনা করতে আবেদন জানাচ্ছি। কোন বিষয়কে উপেক্ষা করে মুসলমান দাবি করা যাবে কি? যেমন- পরীক্ষার দশটি বিষয়ের ৯টিতেও লেটার নম্বর পেয়ে একটি বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যাবে কি?
বর্ণিত কল্যাণকর কাজ সমূহের আলোচনা, আহ্বান প্রেরণা ও তাগিদ দেয়ার জন্যই মুসলামনদের মসজিদ। জামায়াত বদ্ধ হওয়ার কারণে অল্প সময়ে বেশি লোকের কাছে কল্যাণকর কাজের দাওয়াত পৌঁছানো সহজ হয়। খেলাফতের শেষ সূর্য অস্তমিত হওযার পূর্ব পর্যন্ত মসজিদে কাতারবন্দী হয়ে নাজায পড়া ছাড়াও এটাই ছিল মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক- আধ্যাত্বিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল কাজের কেন্দ্রস্থল। কি দ্বীনি, কি বৈষয়িক মুসলিম মিলস্নাতকে স্বার্থে সকল প্রকার অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ের আলোচনা, পরামর্শ, সমাধান ও তাগিদ মসজিদেই সম্পন্ন হত। মসজিদ মুসলিম মিলস্নাতের প্রাণকেন্দ্র। জমুআ তার স্পন্দন এবং খোৎবা তার জীবনীশক্তি। জীবনী শক্তির অভাব ঘটলে জুমআর হয় নিস্ত্র্নিয়, মসজিদ হয় নিস্প্রাণ। আর মুসলিম সমাজও সভ্যতার পতন অনিবার্য। আজকে বাংলাদেশের মুসলমানগণের দূরবস্থার কারণ হচ্ছে-মসজিদ সমুহে জীবন জিন্দেগী নির্বাহের ক্ষেত্রে ইসলামের বিবিধ-বিধানগুলো যা পূর্বে উলেস্নখ করা হয়েছে (ঝগড়া বিবাদ মিমাংসা করে দেয়া আত্নীয়ের জন্য সম্পদ ব্যয় করার গুরম্নত্ব ও তাগিদ) সে বিষয়গুলো সম্পর্কে কোন আলোচনা ও তাগিদ নেই বললে চলে- (থাকলেও তা বত্রিশ দাঁতের এক দাঁত থাকার মত কার্যকরি তা দ্বারা না চিবিয়ে খাওয়া যায় না ছিড়ে খাওয়া যায়) যে আদর্শের বিষয়গুলো আজ মুখের আলোচনায় নেই তা কিভাবে ময়দানে (জীবন জিন্দেগীতে) আশা করতে পারি। জীবন জিন্দেগী নির্বাহের ড়্গেত্রে আলস্নাহ পাকের হুকুম এবং রাসুল (সা•) এর আদর্শের আলোচনা করতে কারা নিষেধ করেছে আমাদেরকে। আমরা নামায পড়ার আড়ালে কাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছি। মসজিদে প্রায় সকল মুসলস্নীদের মনে এরকম ধারণা জন্মেছে যে, জীবন জিন্দেগী নির্বাহের কোন বিষয়াদি আলোচনা করা যেন পাপের কাজ। হুজুর পাক (সাঃ) এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন, তোমরা অন্য ধর্মের অনুসারীদের ন্যায় মসজিদকে গীর্জা বা মন্দিরে রূপান্তরিত করো না। মসজিদ হওয়া চাই চির জীবন্ত, মসজিদ হওয়া চাই প্রাণবন্ত। হুজুর পাক (সাঃ) যে কাজ নিষেধ করেছেন, যে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন- সে কাজটিই বর্তমানে মসজিদে বাস্তবায়ন করে চলেছি। অনেক মসজিদের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ নামাযের আগে কোন আলোচনা করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। নামাযের পরে কি আর মুসলস্নী থাকে? এটা হচ্ছে আলোচনা এড়ানোর একটা কৌশলমাত্র। সপ্তাহের জুমাআর দিনে কেবলমাত্র এক ওয়াক্ত নামাযের পূর্বে তথা জুমআর নামাযের পূর্বে শতকরা দু’একটি মসজিদে কিছু আলোচনা হয়ে থাকে যা সমসাময়িক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তো নয়ই, জীবন গঠনমূলক ও চরিত্র গঠনমূলকও নয়। কিচ্ছা, কাহিনী, দোয়া-মোনাজাত তথা ফজিলত সম্পর্কে কিছু আলাপ-আলোচনা হয়ে থাকে। সপ্তাহে বাকি ৩৪ ওয়াক্ত নামাযের সময় মসজিদ থাকে শান্ত, নিরব, নিথর ও নিস্প্রাণ। এ সম্পর্কে হুজুর পাক (সাঃ) সতর্ক করে দিয়েছেন যা পূর্বে উলেস্নখ করা হয়েছে। মুসলমানগণকে মানব কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মসজিদের প্রতিষ্ঠা। মসজিদকে আমরা মানব কল্যাণে প্রেরণা যোগাতে অফার করছি না কেবল নামায পড়ার কাজে ব্যবহার করছি- বাস্তবতার আলোকে বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করছি। হুজুর পাক (সাঃ) মসজিদকে শুধু নামায পড়ার কাজে ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন যা বর্ণিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত আজকাল ৯৯% মসজিদ শুধু নামায পড়ার কাজেই ব্যবহার করছি আমরা। কল্যাণকর কাজ/সৎ কাজ সম্পাদনের জন্যই মুসলামানগণকে সৃষ্টি করা হয়েছে। “তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে” ৩:১১০। যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক জীবিকা ও ড়্গমা ২২:৫০। “যারা কল্যাণকর কাজে অমনোযোগী তারা চুতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট” ৭:১৭৯। যে সমস্ত মুসলমানগণ কল্যাণকর কাজের গুরম্নত্ব দেয় না তথা মানবতা ও নৈতিকতার গুরুত্ব দেয় না তারা হচ্ছে পশু বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট বলে বর্ণিত আয়াতে নির্দেশ করা হয়েছে। আজকে মসজিদে সে কল্যাণকর কাজের আলোচনাও নেই, তাগিদও নেই। যা আছে তা বত্রিশ দাঁতের এক দাঁত থাকার মত কার্যকরী। যে বিষয় যত গুরম্নত্বপূর্ণ সে বিষয় তত বেশি বেশি আলোচনা হওয়া দরকার কি? লড়্গ্য করা গেছে সাধারণ বিষয়ে বার বার আলোচনা ও তাগিদের ফলে তার গুরম্নত্ব বেড়ে যায় পক্ষান্তরে গুরম্নপূর্ণ বিষয়েও আলোচনার অভাবে তাগিদের অভাবে গুরম্নত্ব কমে যায়, এক সময় অপ্রয়োজনীয়ও মনে হতে পারে।
অধিকাংশ মসজিদে ইমাম সাহেব নামাযের পূর্বক্ষণে মসজিদে প্রবেশ করেন তা হুজরা থেকে হোক কিংবা বাজার থেকেই হোক। এসেই দাঁড়ানো অবস্থায়ই ইমাম সাহেবেরই নির্দেশে একামতের তাকবীর দেয়া শুরম্ন হয়ে যায়। ফরয নামাযের পর দোয়া কবুল হওয়ার ঘোষণা থাকলেও, আজ অধিকাংশ মসজিদ থেকে মোনাজাত উঠে গেছে। সুন্নত পড়েই ৯০% মুসলস্নী তাৎক্ষাণিক মসজিদ ত্যাগ করে থাকেন। ভাবখানা এরকম-যেন মসজিদ নামক খাঁচা থেকে বের হতে পারলেই যেন বাঁচি। (হুজুর পাক (সাঃ) ঘোষণা করেন-মসজিদে মুমিনের অবস্থান পানিতে মাছের অবস্থান, মসজিদে মুনাফিকের অবস্থান খাঁচায় পাখির অবস্থান। মসজিদকে আমরা ৯০% মুসলস্নী খাঁচার মত মনে করে এখানে যত কম সময় কাটানো যায় ভেবে নিয়েছি ১০% মুসলস্নী যারা মসজিদে থাকেন তারাও জিকির, মোরাকাবা কিংবা মসলা-মাসায়েল, মাখরাজ, ব্যাকরণ শিখে মসজিদ থেকে বের হয়ে পড়ি। কোন আলোচনা হতে থাকলে মসজিদে মন বসে না। অথচ মসজিদে থেকে বের হয়ে মসজিদের পাশের দোকানে চা পান করে, গল্প করে সময় অতিবাহিত করলেও মসজিদে বসে থাকতে ভাল লাগে না। জীবন জীন্দেগী নির্বাহের ক্ষেত্রে হুজুর পাক (সাঃ) এর আদর্শের বিষয়গুলো আজ মসজিদে আলোচনায়ও নেই। যা মুখের আলোচনাও নেই তা কি করে ময়দানে (জীবন-জীন্দেগীতে) আশা করা যায়? হুজুর পাক (সাঃ)এৈর আদর্শই হচ্ছে কল্যাণকর কাজ। ইসলামের চেতনাও হচ্ছে কল্যাণকর কাজ। দোয়া, মোনাজাত, মোরাকাবা, জিকির কল্যাণকর কাজ নয়। এগুলো কল্যাণকর কাজ করতে সহায়তা করে থাকে মাত্র। কল্যাণ শুধু কথায় আসবে না, কল্যাণ আসবে কল্যাণকর কাজে। যে ধর্ম-কল্যাণকর কাজে উৎসাহ যোগায় না ওটা ধর্ম নয়, ওটাই হচ্ছে বড় অধর্ম। আজকে ধর্মকে পুঁজি করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চলছে বাণিজ্য। ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আসলে এক শ্রেণীর সত্য বিমুখ মানুষ সব কিছু জেনে, শুনে বুঝে সত্যকে এড়িয়ে চলে স্বার্থের টানে এবং দলদারীর জন্য।
আমরা যখন মসজিদে যাই তখন অন্তরটা একটু নরম থাকে। নামাযের আগে কিংবা পরে অব্যাহতভাবে কল্যাণকর কাজের তাগিদ দেয়ার জন্যই তো মুসলমানদের মসজিদ বর্তমান সময়ে আমরা তো মসজিদকে শুধু নামায পড়ার কাজেই ব্যবহার করছি। অথচ সেই নামাযের আযান একামতেই আহ্বান জানানো হচ্ছে নামাযের জন্য এস, কল্যাণের জন্য এস। কল্যাণ রয়েছে উলেস্নখিত মানবতা ও নৈতিকতায়। যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। তবে কেন নামাযের আগে/ পরে বর্ণিত বিষয়গুলোর উপর আলোচনা ও তাগিদ দেয়া হচ্ছে না।
যে মসজিদে একদা নখ কাটা থেকে শুরু করে যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে কিরম্নপ আচরণ করতে হবে ইত্যাদি জীবন জিন্দেগীর বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে আলোচনা ও পরামর্শ হত, তাগিদ দেয়া হত, সেখানে আজ পরামর্শেরও তাগি নেই, মিমাংসায়ও উৎসাহিত করা হয় না। আপোষ করে নেয়ায়ও কোন প্রেরণা যোগানো হয় না। এক এক মসজিদে এক এক বিষয়ের প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা করায় মুসলস্নীগণও ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। যে যখন মঞ্চে উঠেন এমনভাবে আলোচনা করতে থাকেন যে, ওনার দলই সঠিক, বাকি সব দল বিভ্রান্ত এমনভাব দেখান-প্রত্যেকের কাছে যেন ভিন্ন ভিন্ন কোরাআন নাযিল হযেছে (নাউযুবিলস্নাহ)। কোরআন থেকে তাফসীর করার চেয়ে দলীয় কিতাবের আলোচনায় তৃপ্তি পান বেশি। প্রত্যেক দলে কিছু জানবাজ কর্মী আছেন যারা দলের জন্য জান দিতে সদা প্রস্তুত থাকলেও ভিন্ন দলের আয়োজিত কোরআন হাদীসের কোন আলোচনা শুনতেও রাজী নয়। যদি আবার দলে ভিড়ে যেতে হয়। মুখে স্বীকার করবে খোদাভীতি দরকার, আত্মশুদ্ধি দরকার কিন্তু, খোদাভীতি অর্জনে কোন আগ্রহও নেই, প্রচেষ্টাও নেই এমনকি মনে মনে ব্যাকুলতাও নেই। এরা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে দ্বীনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে গুরম্নত্ব না দিয়ে দলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে পেরেশান এদের দ্বারা দল কিছু উপকার পেলেও দ্বীন হয় এদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। সাধারণ মানুষ হয় বিভ্রান্ত। তাই এদেরকে কোন মণীষী ধর্ম সন্ত্রাসী হিসাবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছেন। কুরআনের বড় অলৌকিকত্ব হচ্ছে মানবের জীবন জীন্দেগী নির্বাহে আদেশ নিষেধ সম্পর্কিত বিধি বিধানসমূহ।
মোঃ আজিজুর রহমান

কোন মন্তব্য নেই: