বৈবাহিক সমস্যা ও কুরআনের সমাধান
স্ত্রী পেটানো কি ইসলাম সমর্থন করে এ প্রশ্নটি দীর্ঘকাল ধর্মপরায়ণ শিক্ষিতা মুসলিম নারীদের মনে কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিল। বিভিন্ন সময়ে সূরা নিসার এই ‘দরাবা’ সংক্রান্ত ৩৪ নম্বর আয়াতটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা এসেছে। কোনো কোনো ইসলামি চিন্তাবিদ একে ‘চল্লিশ ঘা’ আবার কেউ কেউ ‘মৃদু আঘাত’ বলেছেন। কিন্তু সব ক’টি ব্যাখ্যার সাথেই শারীরিক আঘাত জড়িত রয়ে গেছে। ফলে এর একটি সুস্পষ্ট প্রভাব আমাদের সমাজে দেখা যায়। কারণে-অকারণে স্ত্রীকে আঘাত করা তাই অনেক মুসলিম পুরুষই তাদের অধিকার মনে করেন। অনেকে আবার একটু আগ বাড়িয়ে স্ত্রীকে পিটিয়ে শাসন করাকে নিজ পবিত্র দায়িত্ব মনে করেন। শরীরের আঘাত শুধু শরীরের সাথেই সম্পর্কিত থাকে না, তা মনের সাথেও গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। শারীরিক আঘাত কম হোক বা বেশি হোক তা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন যেকোনো নারীর মনেই কঠিন অপমানবোধ সৃষ্টি করে। এমনকি তা ওই নারীর পুরুষ আত্মীয়দের মনেও কষ্ট দেয়। কাজেই বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ আব্দুল হামিদ আবু সুলেমান বলেছেন, সূরা নিসায় ব্যবহৃত ‘দরাবা’ শব্দটির অর্থ ‘পেটানো’, ‘প্রহার’, এমনকি ‘মৃদু আঘাত’ হিসেবেও নেয়ার অবকাশ নেই। তিনি তার Marital Discord : Recapturing the Full Islamic Spirit of Human Dignity বইতে বোঝাতে চেয়েছেন আরবি অভিধানে ‘দরাবা’ শব্দটির অনেক অর্থ রয়েছে; সে ক্ষেত্রে অন্য সব অর্থ বাদ দিয়ে স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘পেটানো’ বা ‘আঘাত করা’ অর্থটি গ্রহণ করা কতটা যুক্তিযুক্ত, বিশেষ করে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে, তা ভেবে দেখতে হবে।
সূরা নিসার ৩৪ ও ৩৫ নম্বর আয়াতকে (যাতে এই শাস্তির ব্যাপারটি বিধৃত হয়েছে) বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এ আয়াতের ব্যাখ্যার সময় কুরআনের অন্যান্য আয়াত বিশেষ করে সূরা রুমের ২১ নম্বর আয়াত যেখানে আল্লাহ পারস্পরিক দয়া ও ভালোবাসাকে বিয়ের উদ্দেশ্য হিসেবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তা বিবেচনায় আনতে হবে। ‘আরেক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ [আর রুম২১]। শুধু বিয়ের ক্ষেত্রে নয়, এমনকি বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকের সময়ও নারীকে অসম্মান করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। ‘আর যখন তোমরা স্ত্রীদের তালাক দিয়ে দাও, অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়, তখন তোমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদের রেখে দাও অথবা সহানুভূতির সাথে তাদের মুক্ত করে দাও। আর তোমরা তাদের জ্বালাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্য আটকে রেখো না। আর যারা এমন করবে, নিশ্চয়ই তারা নিজেদের ক্ষতি করবে।’ [বাকারা-২৩১]। যেখানে ইসলামে বিয়ের ভিত্তি সম্প্রীতি ও দয়া এবং এই বিয়ের সমাপ্তিতেও নারীর প্রতি সহানুভূতি ও সম্মানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বিবাহকালীন সম্পর্ক ধরে রাখার মাধ্যম হিসেবে আঘাত ও মানসিক যন্ত্রণাকে ব্যবহার করা ঠিক সামঞ্জস্যশীল মনে হয় না।
বর্তমানে পরিবারে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে; নারীরা অনেকাংশে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছে। কাজেই বর্তমান সময়ে পরিবারের কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বা স্বামী-স্ত্রীর কোনো বিরোধ নিরসনে পরিবারের এই কাঠামোকে বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পারিবারিক এ প্রেক্ষাপটে আমাদের ভাবতে হবে শারীরিক আঘাতের মাধ্যমে কি একটি পারিবারকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা যায়? ইসলাম যেখানে স্বামীর নির্যাতনমূলক আচরণের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে বৈবাহিক সম্পর্ক অবসানের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দিয়েছে সেখানে এরূপ শারীরিক আঘাত ও দমন কি স্ত্রীকে আরো বেশি তালাক বা খুলার দিকে ঠেলে দেবে না? আর যদি তা-ই হয়, তবে কি এ ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ, দমন বা আঘাতের কোনো সুযোগ রয়েছে, যা পরিবারকে পুনর্গঠনের পরিবর্তে বরং ভাঙার দিকে আরো ঠেলে দেবে?
কুরআনকে কুরআন দিয়েই ব্যাখ্যা করা সর্বাপেক্ষা উত্তম উপায়। কুরআনের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা হলো সেটি, যা এই আল্লাহর বাণী কুরআন দিয়ে করা হয় এবং শরিয়াহ্র সাধারণ মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়। আল কুরআনে দরাবা শব্দটির বিবিধ ব্যবহার লক্ষ করলে এর প্রায় ১৭টি অর্থ পাওয়া যায়। নিুলিখিত আয়াতগুলোতে বিভিন্নভাবে দরাবা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
আল্লাহ আর একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন (১৬:৭৬, ১১২); দেখ তারা তোমার কী উপমা দেয়। তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা পথ পাবে না। (১৭:৪৮); তাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, (৩:১১২);তখন কী অবস্থা হবে যখন ফেরেশতাগণ তাদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে? (৪৭ঃ২৭); সুতরাং আল্লাহর কোনো সাদৃশ্য স্থাপন করো না। আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না। (১৬ঃ৭৪); তোমরা যখন জমিনে সফরে বের হতে (৪ঃ১০১); তখন আমরা তাদের শ্রবণশক্তির ওপর পর্দা টেনে দিলাম... (১৮:১১); তোমরা সীমা অতিক্রমকারী সম্প্রদায় এ কারণে কি আমি তোমাদের কাছ থেকে কুরআন প্রত্যাহার করে নেব? (৪৩ঃ৫); তারা নিজেদের বক্ষদেশের ওপর চাদর টেনে রাখবে... এবং তারা জমিনে সজোরে আঘাত করে চলাফেরা করবে না। (২৪:৩১);... আমার বান্দাদের নিয়ে রাত্রিযোগে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্ক পথ তৈরি করো... (২০:৭৭); আল্লাহপাক নিঃসন্দেহে মশা বা তদূর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। (২:২৬) ... আর তাদের ওপর আরোপ করা হলো/চেপে বসল লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। তারা আল্লাহর রোষানলে পতিত হয়ে ঘুরতে লাগল। (২:৬১); অতঃপর সে প্রবল আঘাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। (৩৭:৯৩)
যদি আমরা কুরআনের এই আয়াতগুলো বিশ্লেষণ করি তবে দেখব যে ‘দরাবা’-এর অনেক আক্ষরিক ও রূপক অর্থ রয়েছে। এর অর্থ হতে পারে পৃথক করা, বিচ্ছিন্ন করা, আলাদা করা, প্রস্থান করা, ছেড়ে যাওয়া, দূরত্ব সৃষ্টি করা, বাদ দেয়া, দূরে সরে যাওয়া ইত্যাদি। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর সাথে যুক্ত হলে দরাবা সেই অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। কাজেই প্রশ্ন হলো দরাবা যখন বৈবাহিক সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রীর আবার মিলন ঘটানো ও তাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টির পন্থা হিসেবে বিবেচিত হবে তখন এর কোন অর্থটি সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত হতে পারে?
‘...যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা করো, [প্রথমে] তাদের সদুপদেশ দাও, [তারপর] তাদের শয্যা ত্যাগ করো এবং [শেষে] দরাবা করো; কিন্তু যদি তারা বাধ্যতায় ফিরে আসে তবে আর তাদের জন্য কোনো পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মতো পরিস্থিতিরই আশঙ্কা করো, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে।’ [নিসাঃ ৩৪,৩৫]। পটভূমি বিবেচনা করলে বোঝা যায় যে, এই আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মিলন ঘটানো ও পুনঃসম্পর্ক স্থাপন করা। কিন্তু চাপ প্রয়োগ করা বা শারীরিক আঘাত কখনোই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করতে ও বজায় রাখতে সহায়ক হয় না। এটি তাদের সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধিতে বা পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টিতে কোনোভাবেই সহায়ক ভূমিকা রাখে না। বরং এটি মিলন ঘটানোর পরিবর্তে বিচ্ছেদের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। কেননা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই এই সম্পর্ক অবসানের সুযোগ ও অধিকার ইসলামে রয়েছে। কাজেই দরাবার অর্থ ‘প্রহার করা’ হতে পারে না, যা দ্বারা মানুষ আহত হবে, কষ্ট পাবে বা অপমানিত হবে ও সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটবে।
সূরা নিসার ৩৪-৩৫ নম্বর আয়াতকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় স্ত্রীর নুশুজের কারণে বৈবাহিক সম্পর্কে অবনতি ঘটলে স্বামী-স্ত্রীর পুনঃসম্পর্ক স্থাপনের জন্য চারটি ধাপের উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পদক্ষেপগুলো হলো
১. প্রথমে স্বামী-স্ত্রীকে মৌখিকভাবে বোঝাবেন,
২. তারপর স্ত্রী থেকে বিছানা পৃথক করবেন,
৩. এরপর দরাবা করবেন,
৪. যখন স্বামীর এই তিনটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে তখন স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই নিজ নিজ পরিবার থেকে একজন করে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করবেন, যারা তাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করবে, তাদের উপদেশ দেবে। আল কুরআনের এই সব ক’টি উপদেশেরই মূল উদ্দেশ্য হলো কার্যকরভাবে গঠনমূলক পন্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এবং এ প্রতিটি ধাপেই স্ত্রীর বিবেক ও যুক্তিবোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যখন স্ত্রী (স্বামী ও সংসারের প্রতি) প্রকাশ্য অবজ্ঞা, উপেক্ষা বা অবহেলা প্রদর্শন করে (নুশুজ) তখন আল কুরআন স্বামীকে আদেশ করেছে স্ত্রীকে উপদেশ দিতে, অনুরোধ ও অনুনয় করতে এবং প্রয়োজনে ভর্ৎসনা করতে। এর মাধ্যমে স্বামী তার কথা ও চিন্তাগুলো স্ত্রীকে বলতে ও বোঝাতে পারবে। এ যোগাযোগের মাধ্যমে দু’জনের ভেতরকার পার্থক্যগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে, সম্ভাব্য সমাধানগুলো বের হয়ে আসবে এবং স্ত্রীর মধ্যে বিবেক ও যুুক্তিবোধ বা কাণ্ডজ্ঞান Reason and rationality) জেগে উঠবে।
যদি স্ত্রী তার নিজের অজ্ঞতা বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার কারণে এ ধরনের উপদেশে কোনো কর্ণপাত না করে তখন স্বামীকে আরেক ধাপ সামনে এগোতে হবে। এমতাবস্থায় সে স্ত্রীর সাথে একই বিছানায় না থেকে বরং বিছানা পৃথক করবে। স্ত্রীর প্রতি এ অবহেলা বা আগ্রহের অভাব (Lack of interest) দেখালে স্ত্রী সমস্যার গভীরতা ও এর পরিণামের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারবে। এর ফলে স্ত্রীও একটি সুযোগ পাবে তার নিজের বিরোধী প্রতিকূল আচরণ পরিত্যাগ করার ও পুরো ব্যাপারটি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও স্ত্রীর বিবেক ও যুুক্তিবোধকে জাগ্রত করার আরো এক ধাপ বেশি চেষ্টা করা হয়েছে। এ উদ্যোগও ব্যর্থ হলে পরবর্তী ধাপ হিসেবে এসেছে দরাবা। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের ভাবতে হবে দরাবার অর্থ কি ‘আঘাত করা’, ‘প্রহার করা’ বা ‘শারীরিক শাস্তি প্রদান করা’ হবে যা স্ত্রীর বিবেক ও যুুক্তিবোধকে জাগ্রত করার পরিবর্তে কষ্ট, ব্যথা ও অপমানের জন্ম দেবে? তা ছাড়া দরাবার পরে আরো একটি ধাপ রয়েছে, তা হলো দুই পরিবার থেকে একজন করে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করা। তৃতীয় ধাপেই যদি ‘প্রহার’ করে স্বামী স্ত্রীর মনকে বিরূপ করে তোলে তবে চতুর্থ ধাপটির বাস্তবপক্ষে আর কোনো কার্যকারিতা থাকে না। অর্থাৎ স্ত্রী বা স্ত্রীর পরিবারের কেউ এ পরিস্থিতিতে অনুকূল বা সমঝোতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে না। কাজেই ধারাবাহিকতার বিবেচনায়ও দরাবার অর্থ ‘প্রহার করা’ হয় না। বরং দরাবার অর্থ এমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, যা দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধাপের মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।
দরাবা সম্পর্কিত উপরিউক্ত বিশ্লেষণ রাসূল সাঃ-এর হাদিস ও তার আচরণের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূল সাঃ-এর স্ত্রীগণ জীবনযাত্রার মান কিছুটা বাড়ানোর দাবি করেছিলেন রাসূল সাঃ-এর কাছে। জীবনযাত্রার মান উন্নতকরণের দাবি পূরণ করতে না পারায় তারা যখন বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন, তখন রাসূল সাঃ তার স্ত্রীদের থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। এ পরিস্থিতিতে এক মাসের জন্য তিনি ‘আল মাশরাবাহ’র (আলাদা থাকা) আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাদের এ সুযোগ দিয়েছিলেন যে, তারা ইচ্ছা করলে রাসূল সাঃ-এর যতটুকু সামর্থ রয়েছে সে অনুযায়ী জীবনযাত্রার মান মেনে নিয়ে থাকতে পারে অথবা ইচ্ছে করলে বিবাহের সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিতে পারে এবং সম্মানের সাথে আলাদা হয়ে যেতে পারে। অন্য একটি হাদিসে উল্লেখ আছে যে, হজরত মুহাম্মদ সাঃ একজন ব্যক্তিকে কঠিনভাবে ভর্ৎসনা করেছিলেন। কারণ সে তার স্ত্রীকে পিটিয়েছিল। যে তার স্ত্রীকে ভৃত্যের মতো পেটায় আবার তার সাথে শুতে লজ্জাবোধ করে না। [বুখারি]। মুসলিম শরিফে উল্লেখ আছে যে, আল্লাহর পথে জিহাদ ব্যতীত মুহাম্মদ সাঃ কোনো নারী, ভৃত্য অথবা কোনো ব্যক্তির ওপর কখনো হাত তোলেননি। এমনকি যুদ্ধকালীন অবস্থায়ও শত্রুপক্ষের নিরীহ নারীদের প্রতি আঘাত করা নিষিদ্ধ ছিল। রাসূল সাঃ আরো বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের নির্যাতনের ব্যাপারে রাসূলের পরিবারের কাছে শোক প্রকাশ করতে আসেন। এই নির্যাতনকারী স্বামীরা কখনোই উত্তমদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ [আবু দাউদ]
তা ছাড়া এটাও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, কুরআনের অন্য স্থানে শারীরিক শাস্তি বোঝানোর জন্য দরাবা শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। বরং কুরআন এ ক্ষেত্রে যে শব্দটি ব্যবহার করেছে তা হলো ‘জালাদা’ কশাঘাত/বেত্রাঘাত/প্রহার করা। যেমন সূরা আন নূরে বেত্রাঘাত বোঝাতে ‘জালাদা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিাচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে ১০০ করে বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি তোমাদের মনে যেন দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ [ সুরা আন-নূরঃ ২]
উপরি উক্ত আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট যে, নুশুজ (স্বামী ও সংসারের প্রতি প্রকাশ্য অবজ্ঞা, উপেক্ষা, অবহেলা) বা বিবাদের ফলে বৈবাহিক সম্পর্কে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে কুরআন যে ‘দরাবা’র কথা বলেছে তার সঠিক অর্থ হবে স্ত্রী থেকে ‘দূরে সরে যাওয়া’, স্ত্রী থেকে ‘দূরত্ব সৃষ্টি করা’ এবং ঘর থেকে ‘চলে যাওয়া’, যাতে স্ত্রীর যুক্তিবোধ জাগ্রত হয় বা সে তার আচরণের অন্যায্যতা ও এর সম্ভাব্য পরিণাম উপলদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ স্ত্রীর নুশুজের কারণে বৈবাহিক সম্পর্কে অবনতি ঘটলে প্রথমে স্বামী স্ত্রীকে মৌখিকভাবে বোঝাবেন, তারপর স্ত্রী থেকে বিছানা পৃথক করবেন, এরপর স্ত্রী থেকে দূরে সরে গিয়ে পৃথক বসবাস করবেন এবং সবশেষে নিজ নিজ পরিবার থেকে একজন করে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করবেন যারা, তাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করবে, তাদের উপদেশ দেবে। দরাবার এই অর্থটি দৈহিক আঘাত ও মানসিক যন্ত্রনা দান অপেক্ষা এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য, যুক্তিসঙ্গত ও কুরআনের বাচনভঙ্গির সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। আব্দুল হামিদ আবু সুলেমানের এই ব্যাখ্যাটি একদিকে যেমন সুযোগসন্ধানী কিছু পুরুষের স্ত্রী নির্যাতনের সব পথ বন্ধ করে দেয় তেমনি ইসলামের ছিদ্রান্বেষীদের ‘ইসলাম নারী নির্যাতন সমর্থন করে’ এই চিরায়ত অপবাদের পথও রুদ্ধ করে। এ ব্যাখ্যাটি নারীদের প্রতি ইসলামের সম্মানসূচক দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি স্বাক্ষর বহন করে। কাজেই এটা সময়ের দাবি যে, মুসলমানরা ‘দরাবার’ এই ব্যাখ্যাটি জানবেন ও বিবেচনায় আনবেন।
দরাবা সম্পর্কিত উপরিউক্ত বিশ্লেষণ রাসূল সাঃ-এর হাদিস ও তার আচরণের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূল সাঃ-এর স্ত্রীগণ জীবনযাত্রার মান কিছুটা বাড়ানোর দাবি করেছিলেন রাসূল সাঃ-এর কাছে। জীবনযাত্রার মান উন্নতকরণের দাবি পূরণ করতে না পারায় তারা যখন বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন, তখন রাসূল সাঃ তার স্ত্রীদের থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। এ পরিস্থিতিতে এক মাসের জন্য তিনি ‘আল মাশরাবাহ’র (আলাদা থাকা) আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাদের এ সুযোগ দিয়েছিলেন যে, তারা ইচ্ছা করলে রাসূল সাঃ-এর যতটুকু সামর্থ রয়েছে সে অনুযায়ী জীবনযাত্রার মান মেনে নিয়ে থাকতে পারে অথবা ইচ্ছে করলে বিবাহের সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিতে পারে এবং সম্মানের সাথে আলাদা হয়ে যেতে পারে। অন্য একটি হাদিসে উল্লেখ আছে যে, হজরত মুহাম্মদ সাঃ একজন ব্যক্তিকে কঠিনভাবে ভর্ৎসনা করেছিলেন। কারণ সে তার স্ত্রীকে পিটিয়েছিল। যে তার স্ত্রীকে ভৃত্যের মতো পেটায় আবার তার সাথে শুতে লজ্জাবোধ করে না। [বুখারি]। মুসলিম শরিফে উল্লেখ আছে যে, আল্লাহর পথে জিহাদ ব্যতীত মুহাম্মদ সাঃ কোনো নারী, ভৃত্য অথবা কোনো ব্যক্তির ওপর কখনো হাত তোলেননি। এমনকি যুদ্ধকালীন অবস্থায়ও শত্রুপক্ষের নিরীহ নারীদের প্রতি আঘাত করা নিষিদ্ধ ছিল। রাসূল সাঃ আরো বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের নির্যাতনের ব্যাপারে রাসূলের পরিবারের কাছে শোক প্রকাশ করতে আসেন। এই নির্যাতনকারী স্বামীরা কখনোই উত্তমদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ [আবু দাউদ]
তা ছাড়া এটাও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, কুরআনের অন্য স্থানে শারীরিক শাস্তি বোঝানোর জন্য দরাবা শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। বরং কুরআন এ ক্ষেত্রে যে শব্দটি ব্যবহার করেছে তা হলো ‘জালাদা’ কশাঘাত/বেত্রাঘাত/প্রহার করা। যেমন সূরা আন নূরে বেত্রাঘাত বোঝাতে ‘জালাদা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিাচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে ১০০ করে বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি তোমাদের মনে যেন দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ [ সুরা আন-নূরঃ ২]
উপরি উক্ত আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট যে, নুশুজ (স্বামী ও সংসারের প্রতি প্রকাশ্য অবজ্ঞা, উপেক্ষা, অবহেলা) বা বিবাদের ফলে বৈবাহিক সম্পর্কে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে কুরআন যে ‘দরাবা’র কথা বলেছে তার সঠিক অর্থ হবে স্ত্রী থেকে ‘দূরে সরে যাওয়া’, স্ত্রী থেকে ‘দূরত্ব সৃষ্টি করা’ এবং ঘর থেকে ‘চলে যাওয়া’, যাতে স্ত্রীর যুক্তিবোধ জাগ্রত হয় বা সে তার আচরণের অন্যায্যতা ও এর সম্ভাব্য পরিণাম উপলদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ স্ত্রীর নুশুজের কারণে বৈবাহিক সম্পর্কে অবনতি ঘটলে প্রথমে স্বামী স্ত্রীকে মৌখিকভাবে বোঝাবেন, তারপর স্ত্রী থেকে বিছানা পৃথক করবেন, এরপর স্ত্রী থেকে দূরে সরে গিয়ে পৃথক বসবাস করবেন এবং সবশেষে নিজ নিজ পরিবার থেকে একজন করে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করবেন যারা, তাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করবে, তাদের উপদেশ দেবে। দরাবার এই অর্থটি দৈহিক আঘাত ও মানসিক যন্ত্রনা দান অপেক্ষা এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য, যুক্তিসঙ্গত ও কুরআনের বাচনভঙ্গির সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। আব্দুল হামিদ আবু সুলেমানের এই ব্যাখ্যাটি একদিকে যেমন সুযোগসন্ধানী কিছু পুরুষের স্ত্রী নির্যাতনের সব পথ বন্ধ করে দেয় তেমনি ইসলামের ছিদ্রান্বেষীদের ‘ইসলাম নারী নির্যাতন সমর্থন করে’ এই চিরায়ত অপবাদের পথও রুদ্ধ করে। এ ব্যাখ্যাটি নারীদের প্রতি ইসলামের সম্মানসূচক দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি স্বাক্ষর বহন করে। কাজেই এটা সময়ের দাবি যে, মুসলমানরা ‘দরাবার’ এই ব্যাখ্যাটি জানবেন ও বিবেচনায় আনবেন।
কানিজ ফাতিমা
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন