শুক্রবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

শুক্রবার সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর ঘোষণা


শুক্রবার সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর ঘোষণা


শুক্রবার হলো সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। এটি মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদ। সাপ্তাহিক সমাবেশ। হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য। এটি সমাজের মিলনগাহ। এ দিবসে আছে জুমার নামাজ ও খুতবা। এ নামাজ ও খুতবাই হলো এ দিবসের মূল প্রাণপ্রবাহ। একে ঘিরেই এ দিবসের প্রাণময়তা ও কর্মচঞ্চলতা আলোড়িত হয়েছে। এটি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক গৌরবময় সংস্কৃতি। এ দিবসে এমন একটি সময় আল্লাহ রেখে দিয়েছেন, যা দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ মুহূর্ত। আর এটি হচ্ছে­ জুমার খুতবা ও নামাজ। তাই এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী।
জুমার নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরে আল্লাহ বলেন­ হে মুমিনরা! শুক্রবার দিন যখন নামাজের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে (খুতবা ও নামাজের) পানে ছুটে আসো এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। যদি তোমরা বুঝতে পারো (সূরা জুমা)। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাঃ বলেছেন­ তোমরা জুমার নামাজে হাজির হও এবং ইমামের কাছে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো। (মুসনাদে আহমদ)। এ নামাজের মর্যাদা তুলে ধরে রাসূল সাঃ বলেছেন­ যে ব্যক্তি জুমার নামাজে মসজিদে যায়, তার প্রতিটি কদমে কদমে এক বছর নফল রোজা রাখার সওয়াব লেখা হয়। তিনি আরো বলেছেন­ যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করবে, মসজিদে গিয়ে নফল সুন্নাত নামাজ পড়বে, খুতবা শুনবে ও ইমামের সাথে নামাজ আদায় করবে, দুই জুমার মধ্যবর্তী দিবসে ও তার পরবর্তী তিন দিনের গোনা মাফ হয়ে যায়। তাই তো রাসূল সাঃ জোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন­ হে মুমিনগণ! এ দিন আল্লাহ তোমাদের ঈদ বানিয়েছেন। কাজেই এই দিনে গোসল ও মিসওয়াক করা তোমাদের কর্তব্য। (আল মুজাম, আস সগির, তাবারানি)। এ নামাজের বরকত ও ফজিলত পেতে হলে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার। তাই শুক্রবার দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
আল্লাহ পাক তার বান্দাদের কল্যাণে সম্মিলিতভাবে ইবাদতের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আর তা হলো শুক্রবার। কিন্তু ইহুদিরা তা পরিবর্তন করে শনিবার করে, খ্রিষ্টানরা পরের দিন রোববার করে। (বোখারি ও মুসলিম)। আল্লাহ পাক এ জাতিকে তাওফিক দিয়েছেন, তারা শুক্রবারকে ইবাদতের দিন বহাল রেখেছেন। (ইবনে কাসির)। সুতরাং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ইবাদতের দিন, ঈদের দিন, ছুটির দিন শুক্রবারের পরিবর্তে শনিবার কিংবা রোববার করা আল্লাহর সিদ্ধান্তের পরিপন্থী।
জুমার নামাজ সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা আনয়নের অন্যতম সোপান। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং একে অপরের সাথে ভাববিনিময় করার এটি প্রধান সেতুবন্ধ। ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা এক কাতারে শামিল হলে মনে হয় এ জগৎটাই শান্তিময় গ্রহে পরিণত হয়েছে। নামাজের আগে যে খুতবা দেয়া হয়, তাতে কুরআন ও সুন্নাহর অমীয় বাণী ধারাবাহিকভাবে শিক্ষা দেয়া হয়। এ শিক্ষার আলোকেই মানুষ সচ্চরিত্রবান হওয়ার সুযোগ পায়। এটি সুনাগরিক তৈরির সুন্দরতম শিক্ষামঞ্চ। খুতবার দিকনির্দেশনা শুধু আদর্শিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। চলমান সমস্যা-সমাধান নিয়ে আলোচনা হয়। গঠনমূলক ও কল্যাণধর্মী যেকোনো সরকারি কর্মবার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার এটি একটি অতি দ্রুত প্রচারমাধ্যম। মাদকাসক্তি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও রাখা হয় জোরালো ভূমিকা।
গত এক দশকজুড়ে আমাদের দেশে বোমাবাজির উত্থান ঘটে। পরিকল্পিতভাবে জঙ্গিবাদের নামে বোমাবাজি শুরু হয়। ১৭ আগস্ট ২০০৫ তারিখে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা বিস্ফোরিত হলে দেশ ও জাতি চরমভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। এমনি এক সঙ্কট সন্ধিক্ষণে ৯ ডিসেম্বর ২০০৫ তারিখে দেশের সব মসজিদ থেকে একযোগে বোমাবাজদের বিরুদ্ধে জুমার খুতবায় বক্তব্য দেয়া হয়। খুতবায় দেশের সব নাগরিককে সতর্ক থাকতে বলা হয়, যাতে বোমাবাজরা কোথাও পালাতে না পারে। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই জেএমবি নামক বোমাবাজদের পতন শুরু হয়। দেশ ও জাতি মুক্ত হয় এ সঙ্কট থেকে। তাই জুমার নামাজ ও খুতবা জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ অপার সম্ভাবনার দুয়ারকে অনর্গলমুক্ত রেখে দেশের সর্বস্তরের উন্নয়নের প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টির জন্য জুমার দিন ছুটি ঘোষণা বহাল রাখা বাস্তবসম্মত।
জুমার দিন আজানের পর বেচাকেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জুমার নামাজে উপস্থিত হতে বাধাগ্রস্ত করে এমন যেকোনো কাজকর্ম করা নিষিদ্ধ। তাই মুসলিম বিশ্বে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন বহাল রাখা হয়েছে। এমনকি আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) কার্যকরী সিদ্ধান্তে রোববারের পরিবর্তে শুক্রবারকে ছুটির দিন বলবত রাখে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান ছাড়া সব মুসলিম রাষ্ট্র এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। যেসব দেশে শুক্রবার ছুটি রয়েছে, সেসব দেশে আমদানি-রফতানির কোনো ক্ষতি হয়েছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত কারো কাছে নেই। এমনকি আমাদের দেশেও নয়।
সম্প্রতি আমাদের দেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ব্যাংক-বীমার লেনদেনের অজুহাত তুলে পশ্চিমা দেশের সাথে তাল মিলিয়ে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবারের পরিবর্তে রোববার করার দাবি তুলছে, যা অযৌক্তিক। শনিবার বা রোববার যদি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কারণে পশ্চিমা দেশের সাপ্তাহিক ছুটি হয়, তবে আমাদের দেশে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি রাখতে আপত্তি কোথায়। জুমার দিন আজান হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ এবং নামাজ শেষ হলে রিজিক অন্বেষণে জমিনে ছড়িয়ে পড়তে বলা হয়েছে, কুরআনের এ ঘোষণায় কিছু নামধারী আলেম এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলছেন শুক্রবার ছুটি থাকলে রিজিক অন্বেষণে বাধার সৃষ্টি হয়, তাই শুক্রবার কর্মদিবস রাখা উচিত। এসব আলেম স্বল্পজ্ঞানের কারণে হয়তো আয়াতের আসল মর্মার্থ বোঝেনি। অথবা ইচ্ছে করে খ্রিষ্টান জগৎকে খুশি করার উদ্দেশ্যে তারা শুক্রবারকে কর্মদিবস করার পক্ষালম্বন করছেন। জুমার দিন আজান হলে বেচাকেনা নিষিদ্ধ বলতে নামাজে যেতে বাধাগ্রস্ত করে এমন যেকোনো কাজ বন্ধ রাখা। আর নামাজ শেষ হলে রিজিকের জন্য জমিনে ছড়িয়ে পড়ো বলতে কাজকর্ম করার নিষেধাজ্ঞাটি তুলে নেয়া।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকা সত্ত্বেও তারা আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে নেই। বরং আর্থিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে উন্নতির সোপানে এগিয়ে চলেছে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি এটা কুরআন-সুন্নাহর ঘোষণা। কুরআন-সুন্নাহর এ ঘোষণা লঙ্ঘন করে শুক্রবারের পরিবর্তে রোববারকে নির্ধারণ করা মোটেই কল্যাণকর হবে না। পরিশেষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী শেখ হাসিনার গত ২৭ ডিসেম্বর ২০০৮-এ নির্বাচন পূর্ব ভাষণ উল্লেখ করে আমার লেখনীর ইতি টানতে চাই, তিনি সে দিন জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘ক্ষমতায় গেলে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিনি তার এ কথা রক্ষা করবেন এটাই ৯০ ভাগ মুসলমান আশা করছে।
মাওলানা মিনহাজুল ইসলাম

কোন মন্তব্য নেই: