অবুঝ মন্ত্রীর নির্বোধ আপত্তি
‘অবুঝ’ মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। নিজের ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকার কারণে এটা হতে পারে। সম্ভবত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষতার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে জাহির করার জন্য তিনি গত ৮ ফেব্রুয়ারি চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিটিএমএ’র মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতে আপত্তি তুলেছেন। তিনি হয়তো জানেন না, তিনি যে দলের টিকিট নিয়ে এমপি নির্বাচিত এবং পরে মন্ত্রী হয়েছেন; সেই দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলে ‘কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করা হবে না’। সুতরাং লতিফ সিদ্দিকী কুরআন তেলাওয়াতে আপত্তি তুলে কেবল সংবিধানই লঙ্ঘন করেননি; তার নিজ দলের অঙ্গীকারের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন। এখানে উল্লেখ করতে হয়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ অন্তর্ভুক্ত করেছিল, এ দল ক্ষমতায় গেলে কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করা হবে না। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমনভাবে বিজয়ী হয়েছিল যে, জনগণ স্বাধীনতার পুরোপুরি ম্যান্ডেট দিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তাই হয়েছিল।
কিন্তু স্বাধীনতার পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড শুরু হয় উল্টো। এবারো প্রায় একইভাবে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিপরীতমুখী হয়ে উঠেছে বলে আশঙ্কা হচ্ছে। অন্তত বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর আচরণে তারই প্রতিফলন লক্ষণীয়। অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে যে দু’বার আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে ‘কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন করা হবে না’ বলে উল্লেখ করেছে, সে দু’বারই নির্বাচনে তাঁরা আশাতীত ফল লাভ করেছেন। কিন্তু প্রথমবার নেতারা নির্বাচনী অঙ্গীকার ভুলে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এমন সব কর্মকাণ্ড করেছেন, যার পরিণতি কল্যাণকর হয়নি। সেসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ ফুটে উঠেছিল। এটা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর বিরূপ রেখাপাত করেছিল। তখন কবি নজরুল ইসলাম কলেজের ‘ইসলাম’ কেটে দেয়া হয়েছিল। বাদ দেয়া হয়েছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ‘মুসলিম’ শব্দটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’ তুলে দেয়া হয়েছিল। আসলে এসব কাজের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
এগুলো ছিল অতিউৎসাহী চাটুকারদের কাজ। অথচ দায় বহন করতে হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে; যিনি ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় কলকাতার মুসলমানদের পক্ষে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমার ধারণা, শেখ মুজিব রহমান ওই ধরনের কর্মকাণ্ড মনেপ্রাণে চাননি। সম্ভবত তার অবস্থা হয়েছিল সেই প্রবাদ বাক্যের মতো, ‘দশের চক্রে, ভগবান ভূত।’ এবারো আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলে ওই সব কর্মকাণ্ড দেখতে চান না। হয়তো আগের মতোই অতি উৎসাহীরা শুরু করেছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দেবেন বলে কি আশা করা যায় না?। যারা এসব করছেন তাদের মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার তার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন সিলেটে প্রসিদ্ধ আউলিয়া হজরত শাহজালাল রহঃ-এর মাজার থেকে; কোনো গির্জা, মন্দির বা মঠ থেকে নয়। এটা হয়েছে, তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের কারণে। আবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এখন যাচ্ছেন পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য মক্কা ও মদিনায়। অন্য ধর্মের কোনো প্রসিদ্ধ স্থানে যাচ্ছেন না। এই বিশ্বাসকে কি রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক বাগাড়ম্বর দিয়ে ্লান করা যাবে? আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কাছে একটি প্রশ্ন, তিনি প্রতিদিন যেসব খাদ্য গ্রহণ করে থাকেন; সে তালিকায় এমন সব খাবার থাকে কি যা খাদ্যাভ্যাসের বিপরীত? অর্থাৎ আপনার তালিকায় কী আপনার খাদ্যাভ্যাসের বিপরীত শূকরের মাংস, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি যা কিছু অন্য ধর্মের লোকেরা ভক্ষণ করে, তা কি থাকে? নিশ্চয় থাকে না। আর আপনার এই খাদ্যের অভ্যাস ছোটবেলা থেকে গড়ে উঠেছে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। তাই খাদ্যাভ্যাসের কারণে যদি আপনার রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতার জাত না যায়; তাহলে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করলে আপনি ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না, তা কি যুক্তিগ্রাহ্য হবে? আর ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থাৎ যদি এটা হয়, কোনো ধর্মকে অবজ্ঞা না করা কিংবা কোনো ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত না দেয়া; তাহলে তো এ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশ মুসলমানের মনে কিছুতেই আঘাত দিতে পারেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শেরও অবমাননা করেছেন। আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশে এমন কিছু ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানুষ আছেন, যারা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ইসলামের বিরোধিতা করা বুঝে থাকেন।
আসলে মূল কথা হচ্ছে, সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা এবং ধর্মীয় কারণে কারো প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ পোষণ না করা। যেমন, আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা তার শপথ অনুষ্ঠানের ঐতিহাসিক ভাষণে আমেরিকাকে খ্রিষ্টান, মুসলিম, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অবিশ্বাসীদের আবাসস্থল হিসেবে অভিহিত করলেও তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছেন নিজ ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের ওপর হাত রেখে। এতে কি আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি ধ্বংস হয়ে গেছে? আসলে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেই সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের অধিকার নিশ্চিত হয়। এজন্য উচ্চকণ্ঠে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলার প্রয়োজন নেই। বরং আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে অতিমাত্রায় ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যেকোনো বিবেচনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যে ভারত আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দিয়েছে, সে ভারতের তুলনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বর্গরাষ্ট্র। ধর্মীয় কারণে এ দেশে কখনো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয়নি। কয়েকবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু দাঙ্গা হয়নি। সেটাও হয়েছে ভারতের ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই। আবার গভীরভাবে অনুসন্ধান চালালে দেখবেন, যেভাবে ভারতে ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে শত শত মসজিদ, মাদ্রাসা দখল করে গোয়ালঘর বা অন্য কিছু করা হয়েছে; তার দৃষ্টান্ত কিন্তু বাংলাদেশে নেই। কেউ উদাহরণ দিতে পারবে না, এ দেশে কোনো মানুষ বা রাজনৈতিক শক্তি কোনো মন্দির দখল করেছে। বরং বিভিন্ন সরকার নতুন নতুন মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছে। ভারতে মুসলমানদের সরকারি চাকরি নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে নেই সে অবস্থা। এ ছাড়া এনজিও, প্রাইভেট ব্যাংক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমানতালে সংখ্যালঘুরা কাজ করছেন। এর কারণ হচ্ছে ইসলামে জাত-পাতের বিভেদ ও বর্ণবিদ্বেষের কোনো স্থান নেই।
আমার এই লেখায় ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দেয়ার কথা এ কারণেই উল্লেখ করেছি যে, এর একটা ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। সে পটভূমিতে আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পাঠক আপনাদের অনেকের জানা নেই, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে ছিল। এরপর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভার অধিবেশনে বলেন, বাংলাদেশের নেতারা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটা তিনি বলেছিলেন স্বীকৃতির পটভূমি হিসেবে। সেই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অথচ ভারতের সংবিধানে এটা অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৭৪ সালে। এ দিক দিয়ে বিচার করলেও বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। সুতরাং আবদুল লতিফের হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া এ সত্য স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ। সে কারণে আমরা ওআইসি’র সদস্য। অপর দিকে ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না।’ স্বয়ং সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা অন্যের উপাসনালয়ে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। আমাদের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রাঃ একবার সিরিয়ার শাসকের উদ্দেশে লিখিত এক চিঠিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে নির্দেশ দেন, তোমার রাজত্বে কোনো অবস্থাতে যেন সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের স্বীকার না হয়। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ শাসকদের উদ্দেশে বলেছেন, খবরদার, তোমরা সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন করো না। যদি তা করো তাহলে কাল কিয়ামতের ময়দানে আমার শাফায়াত বা সুপারিশ পাবে না। এমনকি নবী সাঃ যুদ্ধগামী সৈন্যদের এই মর্মে উপদেশ দিতেন, তোমরা দেখো কোনো অবস্থায় যেন যুদ্ধকালে নিরীহ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার না হয়; ফলবতী গাছ যেন কর্তন না করা হয়। এর চেয়ে মহান বাণী আর কী হতে পারে।’ সুতরাং মন্ত্রী মহোদয় কুরআন তেলাওয়াতে আপত্তি করে কোন লক্ষ্য হাসিল করতে চেয়েছেন, তা বোধগম্য নয়। নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করবেন।
এলাহী নেওয়াজ খান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন