সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০০৮

মানবাধিকারঃ ইসলাম পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র


মানবাধিকারঃ ইসলাম পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র


মানবাধিকার এর সবিচ্ছেদ হলো মানব+অধিকার বা মানুষের অধিকার। মানুষের সামগ্রিক জীবন পরিচালনার জন্য যে সব মৌলিক অধিকারের উপর একান্ত নির্ভরশীল হতে হয়, যেগুলো ছাড়া মানুষ পৃথিবীতে চলতে বা বাঁচতে পারে না এবং নিজের প্রতিভা, গুণাবলী ও বৃত্তি প্রকাশের স্বাধীনতাকে ভোগ করতে পারে না সে সবই মানবাধিকার। তা অর্থনৈতিক, সামাজিক অথবা যে কোন বিবেচনায় হোক না কেন। সংক্ষেপে মানুষের চাওয়া পাওয়া এবং পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও দেয়া নেয়ার জরমযঃ কে মানবাধিকার বলে। বর্তমানে এটি বহুল আলোচিত বিষয়।পৃথিবী ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে যতদিন বুকে ধারণ করেছিল, মানবাধিকার বিষয়টির সৎ ব্যবহার পৃথিবী ততদিনই উপভোগ করেছে। এ ছাড়া বিষয়টির অপব্যবহারও কম হয়নি। পৃথিবীর সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী যারা গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা, মানবাধিকারের জিকির করে ফিরে এবং বিশ্বের দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের ভিন্ন ভিন্ন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার আড়ালে মুলতঃ তারাই সন্ত্রাস করে যাচ্ছে। এবং জোরপূর্বক নিজেদের স্বৈরাতান্ত্রিক ও জুলুমতান্ত্রিক চিন্তাধারা অন্যদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অপরদিকে মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে গায়ের জোরে পৃথিবীর মানবতার সাথে পাশবিক আচরণ করছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জিকির লোক দেখানো একটা ভাওতাবাজী ছাড়া আর কিছু নয়। মানবাধিকার রক্ষার নামে এ ভাঁওতাবাজী পৃথিবীবাসীর কাছে এখন আর গোপন নেই। ইরাক, আফগানিস্তান এক ধরনের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ভোগ করছে অপরদিকে ফিলিস্তিন কি ধরনের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ভোগ করছে তা বুঝতে কঠিন হওয়ার কথা নয়। ইসলামই মানবতার ধর্ম, হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানবতার প্রকৃত বু, আল কুরআনই মানবতার একমাত্র মুক্তির সনদ। ইসলাম ও সন্ত্রাস শব্দ দু’টি ভাবার্থের দিক থেকে পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। ইসলামে সন্ত্রাসের কোন স্থান তো নেই বরং ইসলামের আবির্ভাবই ঘটেছে সকল প্রকার সন্ত্রাস, রাহাজানি, মারামারি, কাটাকাটি, জুলুম-নির্যাতন এক কথায় যাকে আরবিতে ফিতনা বলা হয় তা সমাজ থেকে সমূলে উচ্ছেদ করার জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “আর তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাও যতক্ষণ পর্যন্ত না ফিৎনা সম্পূর্ণভাবে মিটে যায় এবং একমাত্র আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা অবশিষ্ট থাকে।” (সূরা বাকারাহঃ ১৯৩)

ইসলামে মানবাধিকারঃ পৃথিবীর সমুদয় সম্পদের একচ্ছত্র মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। মানুষ এর ট্রাস্টি মাত্র। তাই এ সম্পদে সকলের অধিকার সমভাবে স্বীকৃত। আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে এটির ঝড়ষব অমবহঃ হিসাবে নিযুক্তি দেননি। এমনকি যারা মহান প্রভুকে বিশ্বাস করে ও মানে তাদেরকেও না। বরং যারা তাঁকে বিশ্বাস করেনা ও স্বীকৃতি দেয়না তাদেরও সমধিকার রয়েছে। হযরত ইবরাহিম (আ.) যখন মানব জাতির নেতৃত্ব সম্পর্কে আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন জবাবে বলা হয়েছিল তোমার সন্তানদের মধ্য থেকে একমাত্র মুমিন ও সত্যনিষ্ঠরাই এ পদের অধিকারী হবে। জালেমদেরকে এ অধিকারী করা হবে না। এ ফরমানটি সামনে রেখে তিনি আবার যখন রিযিকের জন্য কেবলমাত্র নিজের মুমিন সন্তান ও বংশধরদের জন্য দোয়া করলেন তখন আল্লাহ জবাবে সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন যে, সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্ব আর রিযিক ও আহার্য এক কথা নয়। দুনিয়ার রিযিক ও আহার্য মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে সবাইকে দেয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর স্মরণ কর যখন ইবরাহীম (আ.) দোয়া করলেন- হে আমার রব! এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানিয়ে দাও। আর এ অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে মানবে তাদেরকে সব রকমের ফলের আহার্য দান কর। জবাবে তার রব বললেন, আর যে মানবে না, দুনিয়ার গুটিকয় দিনের জীবনের সামগ্রী আমি তাকেও দিব। কিন্তু সব শেষে তাকে জাহান্নামের আযাবের মধ্যে নিক্ষেপ করবো এবং সেটি নিকৃষ্টতম আবাস।” (সূরা বাকারাঃ ১২৬)
ইসলামের জন্ম পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র এর প্রতিক্রিয়ায় হয়নি। বরং ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থকে এক সাথে দেখে। এক দিকে ব্যক্তিকে তার সমৃদ্ধির উৎসাহ দেয়, অন্যদিকে ব্যক্তি সমাজের অংশ হিসাবে সমাজের অন্যদের সুখ ও সমৃদ্ধি সাধনের দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করেছে। আর এটিই ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিটি মানুষের মধ্যে দায়িত্ব-কর্তব্যকে জাগিয়ে তোলে।
রাসূল (সা.) বহুবার প্রতিবেশীদের সাথে সৌজন্য প্রদর্শনের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ তায়ালা প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন যে, মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়েছে প্রতিবেশীদের হয়ত উত্তরাধিকারীর মর্যাদা দেয়া হতে পারে।” একটি সুস্থ সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো ভ্রাতৃত্ববোধ। এটি ছাড়া কখনো একটি সুস্থ-সুশীল সমাজ গঠিত হবে পারে না। আর ইসলামই একমাত্র এ ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে যথোপযুক্ত কর্মসূচি দিয়েছে। মুসলমানদের আল্লাহর পথে দান করার সাধারণ নির্দেশ দিয়ে তাদের অর্থসম্পদে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকার কায়েম করেছে। এর অর্থ হচ্ছে মুসলমানকে দানশীল, উদার হৃদয়, সহানুভূতিশীল ও মানবদরদী হতে হবে। স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতা পরিহার করে নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে প্রতিটি সৎকাজে এবং ইসলাম ও সমাজের বিভিন্ন প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ব্যয় করতে হবে। ইসলামী শিক্ষা ও অনুশীলন এবং ইসলামী সমাজব্যবস্থার সামষ্টিক পরিবেশ কায়েমের মাধ্যমে প্রতিটি মুসলমানের মধ্যে এ নৈতিক বল সৃষ্টি করতে চায়। এ ভাবে কোন প্রকার বল প্রয়োগ ছাড়াই হৃদয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছায় মানুষ সমাজ কল্যাণে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে। ইসলামী সমাজে মানবাধিকার সুসংহত রাখা প্রত্যেকের অপরিহার্য কর্তব্যরূপে চিহ্নিত হবে। এ ধরনের কর্তব্যবোধ একটি সমাজের সুস্থতার পরিচায়ক। যদি কোন সমাজে এর অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় তবে বুঝতে হবে সেখানকার পরিবেশ বিকৃত হয়ে গেছে। এবং সেখানকার অধিবাসীদের বিশ্বাস ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ইবাদাতগুলোর মধ্যে শিথিলতা দেখা দিয়েছে। মুসলমানকে দানশীল, উদার হৃদয়, সহানুভূতিশীল, মানব-দরদী ও পারস্পরিক কল্যাণকামী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য তাওহীদসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলো সামষ্টিকভাবে কাজ করে থাকে।তাওহীদ তথা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থেকে ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধ উদ্ভূত। প্রত্যেকেই এক আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এ বিশ্বাসী এবং প্রত্যেকেই এক আদাম (আ.) এর বংশদ্ভূত। কাজেই ভ্রাতৃত্ব, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সৌহার্দ ঈমানেরই অঙ্গ। ঈমানের এই ঐক্য মানুষের পার্থিব সকল কার্যকলাপকে সুসংহত এবং মানবাধিকারকে সুনিশ্চিত করে।
নামাযঃ প্রতিদিন নামায ধনী-দরিদ্র, রাজা-ফকির সকলকে একই কাতারে একাকার করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে নিশ্চিন্ন করে দিচ্ছে। সকলেই এখানে একই রাজাধিরাজের কাছে ভিক্ষার হাতকে প্রসারিত করে থাকে। যে রাজাধিরাজ কোন ব্যক্তির প্রভাব প্রতিপত্তি, বিশেষ মর্যাদা ও উঁচু নিচুর শ্রেণীবিন্যাস করে না। এবং তাকেও কোনো ব্যক্তি কখনো তার বিশেষ মর্যাদার প্রভাবে প্রভাবিত করতে পারেন না। এভাবে ভ্রাতৃত্বের বন সৃষ্টির জন্য নামাযই এক উপযুক্ত হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। ভ্রাতৃত্বের এ প্রবল টানে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ বণ্টন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।যাকাতঃ যাকাত সমাজে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হ্রাসের একটি কার্যকরী ব্যবস্থা। সমাজের অধিবাসীরা একধারে নৈতিক, কল্যাণকামী এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন পরস্পরের বু। যেমন আল কুরআনের ঘোষণা “ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের দায়িত্বশীল বা সাহায্যকারী বু। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন।” (সূরা তাওবাঃ ৭১) যাকাত মানুষকে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণের মত অতুলনীয় চরিত্রের অধিকারী হিসাবে গড়ে তুলে।

রোযাঃ রোযাদার নিজে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হওয়ার দরুন খুব ভাল করেই অনুভব করতে পারেন যে, আল্লাহর গরীব বান্দাহগণ দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্যে কিভাবে দিনাতিপাত করে। তাছাড়া রোযা তাকওয়া ভিত্তিক সমাজ গঠন করে সামাজিক বনকে সুদৃঢ় করে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) রমযানে অন্যান্য সময় অপেক্ষা অধিক দয়ালু ও সহানুভূতিশীল হতেন। এ সময় কোন প্রার্থী তার দুয়ার হতে বঞ্চিত হতে পারত না।

হজ্বঃ বিশ্বজনিন ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির এক বিশেষ ট্রেনিং এ হজ্ব। কালো-ধলা, বর্ণ-বৈষম্যহীন এক বিশ্ব গঠনের লক্ষ্যে সকলেই একই পোশাকে মাত্র দু’টুকরো কাপড় পরিধান করে দীন-ভিক্ষুকের ন্যায় আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হয়। এখানেও কোন ব্যক্তি বা দেশের বিশেষ মর্যাদা ও উঁচু নিচুর শ্রেণীবিন্যাস করা হয় না এবং তাঁকেও কোন পরাশক্তি প্রতিপত্তির প্রভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। মানবতার বু রাসূল (সাঃ) জীবনের শেষ হজ্ব অনুষ্ঠানে সোনার বাণী শুনিয়েছিলেন যে, “তোমরা সবাই ভাই এবং প্রত্যেকে সমান। তোমাদের কেউ অন্যের উপর বেশি সুবিধা বা মর্যাদা দাবি করতে পারবে না। একজন আরব অনারব থেকে বেশি মর্যাদাশীল নয় এবং একজন অনারবও আরববাসী থেকে অধিক মর্যাদাশীল নয়।” এভাবে হজ্ব ভ্রাত্বত্বের বন সৃষ্টি করে থাকে। হজ্ব মানুষের অধিকারকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশের নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে আন্তর্জাতিক রূপদান করে থাকে।

তাছাড়া আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরে শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তার অনুগ্রহ ও মেহেরবাণীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো। (তোমাদের অবস্থা এমনটি হয়েছিল যে) তোমরা একটি অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে। আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়েছেন। এভাবে আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তোলেন। হয়ত এ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা পথ দেখতে পাবে।” (সূরা আলে ইমরানঃ ১০৩)ইসলামের আগমনের পূর্বে আরব অধিবাসীরা যে সব ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল, সে দিকে দৃষ্টিপাত করলে একটি বিশৃংখল পরিবেশের চিত্র আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। মানবতা ও মানবাধিকার সেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সামাজিক বন বলতে যা তার কিছুই সেখানে ছিল না। পারস্পরিক শত্রুতা, কথায় কথায় ঝগড়া বিবাদ এবং রাতদিন মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সমগ্র জাতি ধ্বংসের কবলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এই আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হওয়া থেকে ইসলামই রক্ষা করেছিল। ইসলামের এ জীবন্ত অবদান তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিল। তারা ছিল পরস্পরে রক্তপিপাসু। ইসলামের বদৌলতে তারা পরস্পর মিলে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এঁদের সম্পর্কে আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন, “মোহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। আর যারা তার সাথে আছে তারা কাফেরদের ব্যাপারে বজ্র কঠোর, নিজেরা পরস্পর দয়াপরাবশ।” (সূরা আল ফাতাহঃ ১৯)। হিজরত পরবর্তী আনসার মোহাজিরদের পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতা পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে আছে। সে সমাজের অধিবাসীরা অন্যের অধিকার পালন করে পরম তৃপ্তি লাভ করত। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মদীনা নামক ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হয়ে ঘোষণা করলেন আজ থেকে অমুসলিমদের জান-মাল আমাদের পবিত্র আমানত। মানবাধিকার বলতে যা বুঝায় এবং এটিকে যে ভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন। ইসলাম ও মানবাধিকার শব্দ দুটি পরস্পরের সহোদরা বলতে পারি। ইসলাম ছাড়া অন্য কোন মত বা পথে এর নিশ্চিত ব্যবহার হতে পারে না।

পুঁজিবাদে মানবাধিকারঃ ব্যক্তি তার সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক। সে তার সকল উপায়-উপাদান স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার সীমাহীন অধিকার ভোগ করে। বৈধ অথবা অবৈধ পথে আয় এবং ব্যয় করার অধিকার তার রয়েছে।তার সম্পদে অন্যের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। অথচ আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন, “তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” (সূরা আল জারিয়াহ্‌­ ১৯) পুঁজিবাদের সংজ্ঞাতেই মানবাধিকারকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাই আলোচনা এখানেই ইতি টানা যেত। কিন্তু সামনে বাড়তে হচ্ছে এ জন্য যে, পুঁজিবাদ মানুষের অধিকারকে বঞ্চিত করেও তো ক্ষান্ত হয়নি বরং পুঁজিবাদীরা সমাজের নিম্ন আয়ের লোকদের অবশিষ্ট সামান্য সম্পদটুকুও সুদের মাধ্যমে চুম্বকের ন্যায় চুষে নেয়। পুঁজিবাদীদের শোষণের প্রধান হাতিয়ার হলো সুদ। যে সমাজে এ মরণ ব্যাধি সুদ প্রচলিত, সে সমাজের বাহ্যিক রূপ দেখে যতই সুস্থ ও সুন্দর মনে হক না কেন, ভেতরে ভেতরে কাঠ কীট কুরে কুরে সে সমাজটিকে তুষ করে দিচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের আধুনিক রাষ্ট্রগুলো তার সাক্ষী। সে সব সমাজের মানুষগুলোর সামাজিক বন খুব নড়বড়ে। এর প্রধান কারণ হলো সুদ। সুদখোর ব্যক্তি টাকার পিছনে পাগলের মতো ছুটে ভারসাম্যহীন ব্যক্তিতে পরিণত হয়। নিজের স্বার্থপরতার মাত্রা এতটুকু বৃদ্ধি পায় যে, সে তখন পৃথিবীর কোন কিছুই পরোয়া করে না। তার সুদখোরীর কারণে এক পর্যায়ে মানবিক প্রেম-প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতির মাত্রা শূন্যের কোটায় নেমে আসে। তখন সে তার নিজের লোককেও চরম বিপদের সামনে বিনা সুদে ধার দিতে কুণ্ঠাবোধ করে। সুদ তাকে এতটুকু অ করে তুলে যে, জাতীয় সামষ্টিক কল্যাণের উপর কোন ধ্বংসকর প্রভাব পড়লো এবং কত লোক দুরবস্থার স্বীকার হলো এসব বিষয়ে তার কোন মাথাব্যথাই থাকে না। এ ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “যারা সুদ খায় তাদের অবস্থা হয় ঠিক সেই লোকটির মত যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে। তাদের এ অবস্থায় উপনীত হওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলে, ব্যবসা তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।” (সূরা বাকারাঃ ২৭৫)

এ সমাজে ধনী ও গরীবের মধ্যে পাহাড়সম বৈষম্য সৃষ্টি হয় এবং সম্পদ গুটিকয়েক ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে কুক্ষিগত হয়। সুদ একটি নিষ্ঠুর জুলুম ছাড়া আর কিছু নয়। ঋণ গ্রহীতা তার শ্রম, মেধা, সময় ব্যয় করে লোকসান করলেও তাতে ঋণদাতার কিছুই যায় আসে না, পূর্বনির্ধারিত হারে সুদ ও আসল তাকে পরিশোধ করতেই হবে। এটি একটি নিদারুণ জুলুম।সমাজতন্ত্রে মানবাধিকারঃ পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট আর এক জুলুমতন্ত্রের নাম সমাজতন্ত্র। যেখানে মানুষের ব্যক্তি মালিকানা খর্ব করে তার সকল উপায়-উপাদান ও যোগ্যতার উপর সামাজিক বা রাষ্ট্রের নিরংকুশ মালিকানা স্থাপন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সমাজতন্ত্র একটা পশুর খোয়াড়ের ন্যয়। পশুর যেমন কোন সহায় সম্পদ থাকে না, থাকে না কোন ব্যাংক ব্যালেন্স, সারাদিন মাঠে ময়দানে শুধুমাত্র পেটের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ভক্ষণ করে আবার খোয়াড়ে ফিরে আসে। এ ধরনের দেশের লোকগুলো তেমনি একটি বড় সাইজের মেশিনের বিভিন্ন কলকব্জার ন্যায় বাকহীন জড় পদার্থ অংশমাত্র। ব্যক্তি নিজের প্রতিভা, গুণাবলী ও বৃত্তি প্রকাশের স্বাধীনতাকে ভোগ করতে পারে না। স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের কোন ধারণা সমাজতন্ত্রে আছে বলে মনে হয় না।
সুতরাং মানবতার কল্যাণ বা মানুষের অধিকারকে সুসংহত ও সুনিশ্চিত করার জন্য ইসলাম ও কুরআনের সুমহান ছায়াতলে বিশ্ববাসীকে ফিরে আসতে হবে।

লেখকঃ সিনিয়র অফিসার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি.

কোন মন্তব্য নেই: