ইসলাম নিয়ে চিত্তবৈকল্য
একবিংশ শতাব্দীতে দৃশ্যত বিশ্বের সর্বজয়ী শক্তি তথা মুকুটহীন সম্রাট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি ক্রমেই বিশ্বের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলছে? হারালে, কবে এবং কিভাবে তা হতে যাচ্ছে? এ চিত্তাকর্ষক প্রসঙ্গ নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন স্খানে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির প্রথিতযশা বিশ্লেষক ও চিন্তাবিদদের বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ফরাসি দার্শনিক ও রাজনীতি-তাত্ত্বিক ইমানুয়েল টড তার ‘দি ব্রেকডাউন অব দ্য অ্যামেরিকান অর্ডার : আফটার দ্য এম্পায়ার’ শীর্ষক বইয়ে সাম্প্রতিক সময়ের এ প্রসঙ্গে বিশ্বরাজনীতির পাঠকদের জন্য জুগিয়েছেন প্রচুর রসদ। ‘নয়া দিগন্ত’-এর পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে বেস্ট সেলার এ বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ করেছেন শাওয়াল খান। আজ প্রকাশিত হলো ৩৪তম কিস্তি বিভিন্ন দেশে অবস্খানকারী মার্কিন সৈন্যদের বন্টনব্যবস্খা পর্যালোচনা করলে তার সত্যিকারের সাম্রাজ্যিক রূপটি খোলাসা হবে। এতে স্পষ্ট হবে যে, শক্তি অর্জনের পরিবর্তে দেশটি দিন দিন শক্তি হারিয়ে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এখনো এমন তিনটি দেশ, যেখানে সর্বোচ্চসংখ্যক মার্কিন সৈন্য অবস্খান করছে। ১৯৯০ সালের পর হাঙ্গেরি, বসনিয়া, আফগানিস্তান ও উজবেকিস্তানেও নতুন ঘাঁটি স্খাপন করা হয়েছে বটে, কিন্তু এ সবের ফলেও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিনগুলোর সামরিক অবস্খানগত চিত্রপটের খুব একটা পরিবর্তনসাধিত হয়নি। সেই দিনগুলোর বিবেচনায় দু’টি মাত্র ঘোষিত শত্রু আজো ময়দানে আছে কিউবা ও উত্তর কোরিয়া। এসব পুঁচকে রাষ্ট্রকে অব্যাহতভাবে সমালোচনা করা হচ্ছে, কিন্তু এসব কটূকাটব্যকে ন্যূনতম সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে অনুসরণের কোনো নজির কিন্তু দেখা যায় না।সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে আজকালকার মার্কিন সামরিক তৎপরতার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম বিশ্ব যে যুদ্ধ ক্ষুদ্র সমরবাদী রঙ্গমঞ্চে তার সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী। যা মূলত একটি বিশেষ অঞ্চলজুড়ে ক্রিয়াশীল, সেই ধর্মটিকে নিয়ে আমেরিকার এ চিত্তবৈকল্যের তিন উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিটি উপাদানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মতাদর্শগত, অর্থনৈতিক ও সামরিক এ তিনটি সীমাবদ্ধতার একটি না একটির সাথে সম্পর্ক আছে, যা কিনা তার সাম্রাজ্যিক বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণও বটে। সর্বজনীনতাবাদী ধারণা থেকে মতাদর্শিকভাবে কেটে পড়ার ফলে মুসলিম দুনিয়ায় নারীর অবস্খান নিয়ে এক নতুন ধরনের অসহিষäু মনোবৃত্তির জন্ম দিয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণে আমেরিকার সব চিত্তবিভ্রমের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে আরব বিশ্বের তেলসম্পদ। এমনিতেই সামরিক দিক দিয়ে মুসলিম দুনিয়ার নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তার ওপর মার্কিন সেনাশক্তির দুর্বলতার কারণে মুসলিম দুনিয়াই হচ্ছে তার সহজ শিকার।নারীবাদ নিয়ে যত বিবাদ একটি বৈচিত্র্যময় জগতের প্রতি দিন দিন অসহিষäু হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র, আর তাই নিজে থেকেই সে আজ আরব দুনিয়াকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেছে। তার বিরোধিতাগুলো অন্তর্গত, আদিম আর গভীরভাবে নৃতাত্ত্বিকতানির্ভর। এটা দুনিয়াকে ধর্মভিত্তিক বিভাজনসংক্রান্ত হান্টিংটনের ব্যাখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়, যাতে তিনি মুসলিম বিশ্বকে পাশ্চাত্যের বলয়ের বাইরেই রেখেছেন। সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে গবেষণাকারী নৃতত্ত্ববিদ মাত্রই লক্ষ করবেন যে, অ্যাংলো-স্যাক্সন ও আরব ব্যবস্খাকে চরম বিপরীত দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।মার্কিন পরিবার আকারে ছোট ব্যক্তিকেন্দ্রিক, সেখানে নারী হিসেবে স্ত্রী আর মায়েদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে উঁচু স্খান। আরব পরিবার আকারে বড়সড়, পিতৃতান্ত্রিক এবং নারীকে সর্বোচ্চ মাত্রায় পরনির্ভরশীলতায় মর্যাদায় স্খান দেয়। যেখানে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের কাছে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়েশাদির ব্যাপারটা অনেকটাই নিষিদ্ধ, সেখানে আরবদের মধ্যে এটা অগ্রাধিকার পায়। কয়েক বছর ধরেই নারীবাদ যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমেই একটা গোঁড়া আর আক্রমণাত্মক রূপ ধারণ করছে, আর বিচিত্রমুখিতার প্রতি সত্যিকারের সহনশীলতা দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে বিদায় নিতে চলেছে। তাই এক অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মুসলিম দুনিয়ার সঙ্ঘাত অনিবার্যই হয়ে উঠেছিল, যেখানকার পরিবার কাঠামোটা আরব দুনিয়ার মতোই। পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের কিছু অংশকে এই ভাগে ফেলা যায়; কিন্তু ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া অথবা ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী আফিন্সকার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নয়। কারণ সেসব দেশে পরিবারে নারীর অবস্খান বেশ উঁচুতে রয়েছে।আমেরিকা ও আরব মুসলিম দুনিয়ায় এ সঙ্ঘাতের অস্বস্তিকর বহি:প্রকাশের মূলে রয়েছে এক গভীর, বদ্ধমূল নৃতাত্ত্বিক বিভাজন, যাকে বিপরীতমুখী প্রধান প্রধান নীতির তর্কাতীত সঙ্ঘাত বলে চিহ্নিত করা যায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবধানের একটা নির্ধারক ভূমিকায় চলে আসার ব্যাপারটা বেশ উদ্বেগজনক। ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে এই সাংস্কৃতিক সঙ্ঘাতটা একটা ভাঁড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, যাকে বিশ্ব পথনাটক হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এর এক দিকে আছে আমেরিকা, যাকে নারীত্ব হরণের দেশ বলা যায়, যে দেশে কর্তৃপক্ষের সামনে একজন প্রেসিডেন্টকে এ কথা প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, হোয়াইট হাউসের একজন শিক্ষানবিসের সাথে তার কোনো যৌনসম্পর্ক ছিল না। অপর দিকে আছেন বহুবিবাহ করা এক সন্ত্রাসবাদী বিন লাদেন, যার আছে অসংখ্য সৎ ভাই-বোন। সব মিলিয়ে আমাদের হাতে থাকছে এমন এক দুনিয়ার ব্যঙ্গচিত্র, যেটি দ্রুত বিলুপ্তির পথে। নিজেদের সামাজিক আচার-রীতির উন্নতি ঘটানোর জন্য মুসলিম দুনিয়ার মার্কিন নসিহত গ্রহণের দরকার নেই।অধিকাংশ মুসলিম দেশে জন্মহারের নিুগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে; এতেই বোঝা যায় যে, সেখানে নারীর অবস্খানের উন্নতি হচ্ছে। প্রথমত, এর অর্থ একই সাথে শিক্ষার উচ্চতর হার এবং দ্বিতীয়ত, এর অর্থ হচ্ছে, নারীপ্রতি ২.১ জন্মহার অর্জনকারী ইরানের মতো একটি দেশকে এমন বড় বড় পরিবারের বিস্তারকে অবশ্যই রোধ করতে হবে, যারা এক বা একাধিক পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়াটা বìধ করে দিয়েছে, আর এভাবেই পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্য থেকে তারা বেরিয়ে আসছে। মিসরের ক্ষেত্রে, সেখানে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়েশাদিসংক্রান্ত নিয়মিত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, এ ধরনের বিয়ে ১৯৯২ সালের ২৫ শতাংশ থেকে ২০০০ সালে ২২ শতাংশে নেমে এসেছে।আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলাকালে আরেকটা সমান্তরাল যুদ্ধ শুরু করা হয়, যার মাধ্যমে আফগান নারীদের জন্য উন্নত অবস্খান দাবি করা হয়। ইউরোপে এসব ধর্মোপদেশের মাত্রাটি ছিল পরিমিত, কিন্তু অ্যাংলো-স্যাক্সন প্রান্তে এটা ছিল খুবই উচ্চস্বরে। আমাদের রীতিমতো গেলানো হয়েছিল যে, মার্কিন বিমানগুলো ইসলামি নারীবিদ্বেষীদের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। পাশ্চাত্যের এ ধরনের দাবি-দাওয়া হাস্যকর। রীতিনীতি অবশ্যই বিকশিত হয়। কিন্তু এর প্রক্রিয়াটি ধীর অথচ আধুনিক যুগে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে যা নিয়ে চাপাচাপির ফলে এটি বরং আরো গতি হারাতে পারে। কারণ নারীবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা এটা সামরিক শক্তি বলে চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়, যার ফলে এর প্রতিরোধকারী আফগান যুদ্ধবাজ সর্দারদের চরম পুরুষবাদী মানসিকতাকে এক ধরনের অযাচিত মহানুভবতায় ভূষিত করা হয়।অ্যাংলো-স্যাক্সন দুনিয়া আর আরব মুসলিম দুনিয়ার মধ্যকার সঙ্ঘাতের মূল আরো গভীরে। আর আফগান নারীদের উদ্দেশে মিসেস বুশ আর মিসেস ব্লেয়ারের দেয়া নারীবাদী মতামতের চেয়েও এ সঙ্ঘাতের আরো খারাপ দিক আছে। ইভানস প্রিচার্ড ও মেয়ার ফটের্সের দৃষ্টান্তমূলক গবেষণায় বিভিন্ন ব্যবস্খার বসবাসকারী মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে উপলব্ধির নানা প্রচেষ্টার পর যেমনটি দেখা গেছে। আমরা নিউগিনিতে নারীদের ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলনকারীদের পুরুষদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে দেখেছি, অথবা উল্টো ক্ষেত্রে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তানজানিয়া ও মোজাম্বিকের সাগরতীরবর্তী অঞ্চলে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্খায় প্রকাশ্য প্রশংসা করতেও দেখেছি। যদি সমাজবিজ্ঞানীরাই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ভালো আর খারাপ কাজের প্রশংসাপত্র বিলানো শুরু করে দেয়, তাহলে সরকার আর সশস্ত্র বাহিনীগুলোর কাছ থেকে পক্ষপাতহীন আচরণ কিভাবে আশা করা যায়? যেমনটি আমরা ইতোমধ্যেই লক্ষ করেছি সর্বজনীনতাবাদ কিন্তু সহনশীলতার কোনো নিশ্চয়তা প্রদান করে না। উদাহরণস্বরূপ, ফরাসিরা কিন্তু মাগরেব অঞ্চলের জনগণের প্রতি বিরূপ আচরণ করতে পুরোপুরি সক্ষম। কারণ আরব নারীদের মর্যাদা ফরাসিদের সামাজিক রীতিনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি সহজাত, এখানে কোনো মতাদর্শগত ব্যাপার-স্যাপার নেই, নেই আরবদের নৃতাত্ত্বিক ব্যবস্খা সম্পর্কে কোনো সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণ। সর্বজনীনতাবাদ একটা আশ্রমের মতো, যেকোনো বৈষম্য করতে জানে না, কোনো ব্যবস্খার নিন্দা বা প্রশংসা করার ধার ধারে না। পক্ষান্তরে, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ কিন্তু আফগান আর আরব ব্যবস্খা নিয়ে সব ধরনের চূড়ান্ত বিচারের রায় ঘোষণার মতো কাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে, যা একটি সমতাবাদী বিন্যাসের পরিপন্থী। আমার কথা হচ্ছে, এসব বোলচাল কিন্তু এলোমেলো চটুল গল্প মাত্র নয়, এটা অ্যাংলো-স্যাক্সন দুনিয়ায় সর্বজনীনতাবাদের ক্ষয়রোগেরও লক্ষণ। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নির্ভেজাল অন্ত:দর্শনের অধিকারী হওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে; ফলে সে মুসলিম দুনিয়ার সাথে সৌজন্যপূর্ণ আর কৌশলগত দিক থেকে আরো সুচারু সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে না
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন