শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর, ২০০৮

হজ পাপমুক্ত হওয়ার অন্যতম উপায়



হজ পাপমুক্ত হওয়ার অন্যতম উপায়


হজ একটি অন্যতম মৌলিক ইবাদত। মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর ইবাদত করা। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমরা মানুষকে অন্য কোনো কাজের জন্য নয়, বরং ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি। (আল জারিয়াত, ৫১ঃ৫৬)। ইবাদতের অন্যতম অর্থ হলো যাবতীয় কাজে আল্লাহর আনুগত্য করে জীবন পরিচালনা করা। প্রতিটি কাজ ইবাদত হলেও কয়েকটি মৌলিক ইবাদত হলো নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ পালন করা।


প্রতিটি ইবাদতের নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য রয়েছে। যেমন নামাজ হলো অন্যায়, অশ্লীল ও বেহায়াপনা কাজ থেকে বিরত থাকার লক্ষ্যে, রোজা হলো আল্লাহভীতি অর্জন করা, জাকাত হলো মাল ও আত্মার পবিত্রতা সাধন করা, অনুরূপভাবে হজ হলো পবিত্র কাবায় উপস্থিত হয়ে আল্লাহর নিদর্শন দর্শনের মাধ্যমে ঈমানের নবায়ন করা এবং সপ্তাহকালব্যাপী নির্দিষ্ট ছকের কিছু ইবাদত পালনের মধ্য দিয়ে সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে বিরত থাকার অনুশীলনের মধ্য দিয়ে পাপমুক্ত হওয়া। এ পাপ মুক্তি সম্পর্কে রাসূল সাঃ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ পালন করল এবং সর্বপ্রকার পাপকর্ম, যৌন লালসা ও ফাসেকি কর্ম থেকে ফিরে থাকল সে সদ্যজাত শিশুর মতোই নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এলো।’ রাসূল সাঃ-এর এ বাণী অতীব তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ। একজন পাপী আল্লাহর ঘরে হাজিরা দিলেন আর এর বিনিময়ে পাপমুক্ত হয়ে গেলেন­ এমন পাপমুক্ত যেমনটি এই মাত্র ভূমিষ্ঠ হওয়া একটি নবজাতকের মতো­ যার কোনো গুনাহই নেই। ইবাদত হয় শরীর দ্বারা এবং অর্থ দ্বারা। হজের ক্ষেত্রে দু’টোই কার্যকর। হজ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তা মক্কার ঘর তাতে সন্দেহ নেই। এটা অত্যন্ত পবিত্র, বরকতময় এবং সারাদুনিয়ার জন্য হেদায়েতের কেন্দ্রস্থল। এতে আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহ বর্তমান রয়েছে, রয়েছে মাকামে ইবরাহীম এবং যে এখানে প্রবেশ করবে সে-ই নিরাপদে থাকবে।’ (আল ইমরান, ৩ঃ৯৬-৯৭)।


হজ পালনসংক্রান্ত নির্দেশ এসেছে সূরা আল বাকাবার ১৯৬ নম্বর আয়াতে, যাতে বলা হয়েছে, আল্লাহর জন্য হজ ও ওমরা পালন করো... আর এ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস, ঝগড়া-ফাসাদ এবং অপরাপর যেকোনো পাপ কাজ থেকে বিরত থাকো। সূরা আল ইমরানের ৯৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার যার সামর্থø আছে আল্লাহর জন্য হজ করা তার জন্য একটি অনিবার্য দায়িত্ব। মহানবী সাঃ- এ হজের গুরুত্ব ও সুদূরপ্রসারী ফলাফলের বিষয়ে বলেন, যে ব্যক্তি নিছক আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ পালন করল এবং এ ব্যাপারে সব প্রকার লালসা ও ফাসেকি থেকে দূরে থাকল সে সদ্যজাত (নিষ্পাপ) শিশুর মতোই ফিরে এলো। উপরোক্ত বিধানের মূল কথা হলো হজের আইনগত ভিত্তি এবং এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এর অর্থ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে হজ পালন করা-এর বিনিময়ে পাপমুক্ত হয়ে সুস্থ জিন্দেগি যাপন করা। দু’টো উদ্দেশ্যই অর্জিত না হলে হজের যাবতীয় কার্যক্রমই ব্যর্থ হয়ে যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে (১) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজন নিয়তের পরিশুদ্ধতা­ যার অর্থ হলো জান্নাতপ্রাপ্তি। আর মানুষের দেখানোর জন্য হলে তা হবে নির্ঘাৎ জাহান্নাম। এ ছাড়া হজ কবুলের জন্য আর যা যা প্রয়োজন তা হলো (২) শরীর পাক, (৩) খাদ্য পাক, (৪) পোশাক পাক, (৫) অন্তরাত্মা পাক ও (৬) অর্থ পাক। নিØের হাদিসটি এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল আল্লাহ সাঃ বলেন, আল্লাহতায়ালা হচ্ছেন পবিত্র­ পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু তিনি গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের জন্য তাই নির্দেশ করেন যা তিনি নবীদের জন্য করে থাকেন। তিনি (আল্লাহ) বলেন, হে নবী সাঃ যা কিছু পবিত্র তাই ভক্ষণ করুন এবং সৎ কাজ করুন এবং আল্লাহতায়ালা বলেন, হে ঈমানদাররা, আল্লাহ, দেয়া রিজিক থেকে হালাল জিনিস ভক্ষণ করো। তারপর তিনি একটি লোকের কথা উল্লেখ করেন যে ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করেছে যার নজির তার মলিন বদন এবং আলু থালু চুল দেখলেই বোঝা যায়। সে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে বলছে (দোয়া করছে) হে আমার প্রভু... অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম। পোশাক পরিচ্ছদ হারাম দ্বারা তৈরি। তার দোয়া কি গ্রহণযোগ্য? (আবু দাউদ) হাদিসটি সুস্পষ্ট। এতে বোঝা যাচ্ছে প্রার্থনাকারী একজন আমলদারি মুসলিম কারণ সফরের ক্লান্তি অবস্থায় সে আল্লাহর আরাধনায় রত। তবে আরাধনা কবুলের জন্য খাদ্য, পানীয়, পোশাক, দেহ যা পবিত্র হওয়া শর্ত তা সে পূরণ করেনি। অতএব, তার দোয়া গ্রহণযোগ্য নয়।


তেমনিভাবে মক্কা-মদিনা জিয়ারতকারী একজন নারী বা পুরুষের জন্যও তা পাক বা হালাল হওয়া পবিত্র। বাঁচার নতুন কোনো উপায় নেই। যে উপায় আল্লাহ ও তার রাসূল সাঃ বলে দিয়েছেন। আর তা হলো রুজি-রোজগার পবিত্র হওয়ার পাশাপাশি একজন ব্যক্তিকে খাঁটি ঈমানদার ও খাঁটি জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ করতে হবে। এর সংক্ষিপ্ত অর্থ হলো­ নামাজ-রোজার ক্ষেত্রে শুধু ইসলাম স্বীকার করলে চলবে না, বরং জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলামকে জানতে হবে ও মানতে হবে এবং তা প্রতিষ্ঠিত না থাকলে তার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে হবে। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে ইসলাম মানতে হবে। অতীতে তা মানা না হয়ে থাকলে হজের সময়ে অতীতের অপরাধ স্বীকার করতে হবে-এর জন্য অনুশোচনা করতে হবে। অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করে থাকলে, ঋণখেলাপি হয়ে থাকলে তা ফেরত দেয়ার নিয়ত করতে হবে এবং দেশে ফিরে তা দিয়ে দিতে হবে। যার যার মনে কষ্ট দেয়া হয়েছে, কাউকে আহত-নিহত করা হয়েছে। কারো প্রতি বলাৎকার করা হয়েছে­ সবার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নিতে হবে। তা করতে পারলে আশা করা যায় হজের প্রকৃত কল্যাণ পাওয়া যেতে পারে। আর তা করতে না পারলে হজের অনুষ্ঠানে যোগদান আর কোনো ইসলামি সমাবেশে যোগদানের মতোই একটা কিছু হতে পারে, এর বেশি নয়। এ ব্যাপারে বারবার যারা হজ করতে যান বারবারই তা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসবে। তা প্রদর্শন ইচ্ছারও শামিল হতে পারে। সবাইকে ধোঁকা দেয়া বা বোকা বানানো সহজ শুধু আল্লাহকে ছাড়া। সব মুসলিম নর-নারীর হজ মহান আল্লাহ কবুল করেন এ প্রত্যাশা কামনা করছি। কেননা একজন হাজী বেগুনাগার মানুষ কোনো জনপদে থাকাটা ওই জনপদের জন্য রহমতস্বরূপ। এ ক্ষেত্রে এজাতীয় হাজী যত বেশি ততই কল্যাণ, ততই মঙ্গল। এমন হাজীর জন্যই রাখা হয়েছে মূলত হজের বিধান।


প্রফেসর ড. এ বি এম মাহবুবুল ইসলাম

কোন মন্তব্য নেই: