রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০০৮

টেলিভিশন বিজ্ঞাপনগুলো কী শিক্ষা দিচ্ছে?

টেলিভিশন বিজ্ঞাপনগুলো কী শিক্ষা দিচ্ছে?


বিয়ে হওয়া, অভিনয় করা বা ক্রিকেটের কমেন্টেটর হওয়ার জন্য যে গায়ের রঙ ফর্সা হওয়া প্রয়োজন, এটা আমাদের জানা ছিল না। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন দেখেই আমরা এখন এসব ‘শিখছি’। টিভি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই আমরা জানলাম, অন্য কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকুক বা না থাকুক দাঁত ঝকঝকে হলেই রাজকন্যার ছেলে পছন্দ হবে, অথবা ভালো ফার্নিচার থাকলেই মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে।বিজ্ঞাপন তৈরি হয় আমাদের জনসাধারণকে প্রভাবিত করার জন্য। আমরা প্রায় সবাই প্রভাবিতও হই। আমরা এসব বিজ্ঞাপন থেকে তেমন কোনো শিক্ষাই পাই না। প্রায় সব বিজ্ঞাপন বাস্তবতাবিবর্জিত ও ভোগবাদী। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কী শিখাচ্ছি? এসব বিজ্ঞাপনের কিছু কিছু জিঙ্গেলস নিচে তুলে ধরলাম, যেখানে নারীকে অপমানসূচকভাবে উপস্খাপন করা হয়েছে।আমাদের দেশের কোনো সুন্দরী ললনা নারকেল তেল অথবা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে যদি মডেল হিসেবে কাজ করেন অথবা বলেন, ‘আমি এসব তেল-শ্যাম্পু ব্যবহার করি।’ তাহলে আমাদের কাছে তা বেমানান মনে হয় না। সেখানে অস্বাভাবিকতাও দেখি না। কিন্তু রূপবতী ললনা যদি ব্লেড/শেভিং ক্রিমের বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে অভিনয় করতে করতে বলেন, ‘আমার এসব খুব পছন্দ’, অথবা ব্লেড/শেভিং ক্রিমের প্রশংসা করেন, তাহলে কী ভাববেন? এমন উদ্ভট ব্যাপার দেখে কি ভাববেন না­ নারী কি ব্যবসায়-বাণিজ্যের নিছক প্রচারমাধ্যম? নারী কি বাণিজ্যিক পণ্য, না পুরুষের মতোই মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ? একটুখানি হেলেদুলে অধরে লুকোচুরি হাসির রেখা টেনে কোনো সাবানের প্রশংসা করতে না পারলে ওই সাবানের গুণাগুণ হারিয়ে যাবে? এসব বিজ্ঞাপনের ভাব হচ্ছে, গোসলের সাবান শুধু মেয়েরাই ব্যবহার করে।একটা কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল হচ্ছে… ‘মজা কত, তোমার মতো যখন যেমন চাই।’ নারীর প্রতি এমন চরম অপমানসূচক বক্তব্য আর কী হতে পারে? নারীর ইজ্জত-আব্রুর দিকে না তাকিয়ে এ বিজ্ঞাপন শিক্ষা দিচ্ছে, নারীকে যখন ইচ্ছা যেখানে ইচ্ছা যেমন খুশি ব্যবহার করা যায়। নারীবাদীরা নীরব কেন???? একটা ফিন্সজের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, মুরগি জবাই ও বাছাই করে ফিন্সজে রেখে দেয়া হলো। কিছু সময় পর ফিন্সজ খুললে মুরগি জীবিত বের হয়ে এলো। এরকম অন্ত:সারশূন্য বিজ্ঞাপন আমরা অহরহ দেখছি। কোরবানির ঈদে তো আরো জাঁকজমকভাবে ফিন্সজের বিজ্ঞাপন উপস্খাপন করা হয়। ভাবখানা এরকম­ আপনার কোরবানি করে এক টুকরো গোশতও কাউকে বিতরণ করতে হবে না। কারো অধিকার থাকুক বা না থাকুক, কাউকেই আপনার গোশত দিতে হবে না। আপনার কোরবানির গোশত গরিব-মিসকিনকে না দিয়ে বছরজুড়ে খান। কোনো অসুবিধা নেই। আর এভাবেই বিজ্ঞাপনগুলো আমাদের উৎকট ভোগবাদ আকৃষ্ট করছে। আমাদের সমাজে বিজ্ঞাপনের প্রভাব কতটুকু, তা একটা বইয়ে পড়েছিলাম। লেখক বলেছেন, একদিন আমার মেয়ে তার মায়ের কাছে এমন একটা ফল খাওয়ার বায়না ধরল, যার মওসুম তখন বিগত। মা যখন বললেন, এখন ওই ফল পাওয়া যাবে না, তখন তার কথা ছিল, ‘কেন, দোকানে গেলেই তো পাওয়া যাবে’­ অর্থাৎ সবকিছুই দোকান বা বাজার থেকে আসে। ফলের জন্য যে গাছের প্রয়োজন, সঠিক মওসুমে প্রয়োজন এসব সত্যকথা যেন টেলিভিশনের নিরবচ্ছিন্ন বিজ্ঞাপনের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে।টেলিভিশন বিজ্ঞাপন নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানারকম গবেষণা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী হামজা ইউছুফ তার এক বক্তৃতায় AD WEEK নামক বিজ্ঞাপনী পত্রিকায় একটা প্রবìেধর কথা উল্লেখ করেছেন : আমেরিকান পুরুষদের মাঝে, নার্সদের সাথে সম্ভোগে রত হওয়ার একটা সুপ্ত বিকৃতির প্রাধান্য মনস্তাত্ত্বিক জরিপে দেখা যায়। AD WEEK তাই Producer দের প্রস্তাব করেছে, তাদের Producer -এর বিজ্ঞাপনে যদি কোনোভাবে একজন নার্স বা সেবিকার ছবি জুড়ে দেয়া যায়, তাহলে তার কাটতি বেড়ে যাবে। একটি মহৎ পেশায় নিয়োজিত নারীদের প্রতি সর্বাধিক উন্নত রাষ্ট্রের অত্যাধুনিক মানুষের এ মানসিকতা কি সভ্য সমাজের উপযোগী? এভাবে বিজ্ঞাপন কেবল ভোক্তাকে আকৃষ্ট করার জন্যই প্রচার করা হয়। বিজ্ঞাপনগুলো কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতার ধার ধারছে না। এর পরিবর্তে বিজ্ঞাপনগুলো অশিক্ষা ও কুশিক্ষা প্রচার করছে আধুনিকতার আড়ালে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, টেলিভিশন বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে মাত্র তিন শতাংশ বিজ্ঞাপনেই নারীকে ইতিবাচকভাবে উপস্খাপন করা হচ্ছে। অন্যদিকে ৭০ শতাংশ বিজ্ঞাপনেই নারীকে উপস্খাপন করা হয় নেতিবাচক হিসেবে। এটাই কি প্রগতিশীলতা ও মুক্তমনের পরিচয়? কিছু বুদ্ধিবিক্রেতা বিজ্ঞাপনে নারীকে খাটায়। নারীর ওপর জুলুম করে তাদের দেহের প্রদর্শনীর শিল্পে ওরা পারদর্শিতা লাভ করেছে। এভাবে তারা বিরাট বিরাট প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যায় এবং নিজেরা পাজেরো বা মার্সিডিজে চড়ে বেড়ায়। অন্যদিকে সেই নারীও কয়েকটি টাকার বিনিময়ে, শরীর প্রদর্শনের মাধ্যমে লজ্জাবোধ বিসর্জন দিয়ে অন্তত কিছু সময়ের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ বিক্রি করে ফেলে। মজার ব্যাপার হলো, এসব সুন্দরী ললনার সমঝদার মা-বাবারাও কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট। আবার বিভিন্ন মহিলা সংগঠন আর ‘নারী মুক্তি’ সংগঠনের নেত্রীরাও এসব ব্যাপারে নীরব অথবা এগুলো দেখে হাত তালি দেন।পরিশেষে অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশনে একটি ইন্স্যুরেন্সের বিজ্ঞাপনের উদাহরণ দিয়ে আমার লেখার ইতি টানছি। এটা হলো বাবা ঠিকমতো তার জীবনের পরিকল্পনা করেননি, তাই বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক কারণে তিনি ছেলে বাড়ির লন ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছেন। ছেলে বাইরে যাওয়ার সময় বাবার হাতে পারিশ্রমিক গুঁজে দিয়ে বলছে, ‘নিজের যত্ন নিও, আর মাকে আমার তরফ থেকে ‘হ্যালো’ বলো।’ এদিকে গাড়িতে ছেলের স্ত্রী অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে। এই বিজ্ঞাপনে বাবাকে বলা হচ্ছে­ তোমার সময় থাকতেই এ ব্যাপারে ব্যবস্খা নেয়া উচিত ছিল। অর্থাৎ শেষ বয়সের কথা চিন্তা করে (ছেলেদের ওপর ভরসা না করে) আগেই ইন্স্যুরেন্স করা উচিত ছিল। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছেলেকে মনোভাব বদলানো এবং মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনের কথা বলা হচ্ছে না। অপরদিকে তার অসহায় বৃদ্ধ বাবাকেই দোষারোপ করা হচ্ছে কাণ্ডজ্ঞানহীন বলে।এভাবেই আমাদের টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল বিজ্ঞাপনগুলো নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে হাজার বছরের সামাজিক মূল্যবোধকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই: