শনিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

কোরআন ও হাদীসে নারীর অধিকার


কোরআন ও হাদীসে নারীর অধিকার


০ ‘পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে। তেমনি নিয়ম অনুযায়ী স্ত্রীদের ও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর। আর নারীদের উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আলস্নাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, (সুরা বাকারা ২২৮ আয়াত)।

০ ‘স্ত্রীরা তোমাদের পোশাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের জন্য পোশাকস্বরূপ’ (সুরা বাকারা ১৮৭ আয়াত)।

০ ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর খুশি মনে দাও’ (সুরা নিসা-৪ আয়াত)।

০ পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে (সরা নিসা-৭ আয়াত)।

০ তোমরা স্ত্রীদের (হকের ) ব্যাপারে আলস্নাহকে অবশ্যই ভয় করে চলবে।

০ ‘রাসুলস্নাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের নিকট সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম’ (তিরমিজী)।

০ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তির কন্যা সন্তান জন্মলাভের পর সে যেন তাকে জাহেলিয়াতের যুগের ন্যায় জীবিত কবর না দেয় এবং তাপকে তুচ্ছ মনে না করে। আর পুত্র সন্তানকে উক্ত কন্যা সন্তানের উপর প্রাধান্য না দেয়। তাহলে আলস্নাহ তায়ালা তাকে জন্নাত দিবেন’ (আবু দাউদ)।

০ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের মধ্যে মেয়েরাই উত্তম’।

০ রাসুল (সাঃ) বলেছন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যার প্রথম সন্তান কন্যা। পুত্র সন্তানদের আগে কন্যা সন্তানদেরকে উপহার দিবে। যে ব্যক্তি একটি কন্যা সন্তানকে ভালভাবে লালন করেছে, তার জন্য জান্নাত নির্ধারিত হয়ে গেছে।’

০ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘জান্নাত জননীর পায়ের নীচে’।

০ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যাকে আলস্নাহ তায়ালা কন্যা সন্তান দিয়ে পরীড়্গায় ফেলে, অতঃপর সে তার কন্যাদের সাথে ভাল ব্যবহার করে (কেয়ামতের দিন) এ কন্যাই তার জন্য জাহান্নামের ঢালস্বরূপ হবে’ (বুখারী মুসলিম)।


সালাতুত তাসবিহ


সালাতুত তাসবিহ


যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিলেন যাদের প্রতিটি পদক্ষেপ আল্লাহর হুকুম এবং নবীজীর সুন্নত মোতাবেক ছিল। তারা সত্যিই আল্লাহর দরবারে নিজেদের অপরাধী, গুনাহগার, জালেম মনে করতেন। গ্রহণ করতেন তারা গুনাহ মাফের কার্যকরী পন্থা। তাই তো হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ প্রতি শুক্রবার এই নামাজ আদায় করতেন। হজরত আবু জাওযা রহঃ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রতিদিন জোহরের আজানের পর জামাত শুরু হওয়ার আগে সালাতুত তাসবিহ পড়তেন।
সালাতুত তাসবিহ পড়ার নিয়মঃ সালাতুত তাসবিহ চার রাকায়াত নামাজ। প্রত্যেক রাকায়াতে ৭৫ বার করে মোট চার রাকায়াতে ৩০০ বার নিোক্ত দোয়া পড়তে হয়। ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ অর্থঃ ‘আমি আল্লাহ তাআ’লার গুণগান কীর্তন করছি, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআ’লার নিমিত্ত, আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোনো মাবুদ নাই, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।’ ছালাতুত তাসবিহতে উপরোক্ত দোয়া পাঠ করার ব্যাপারে হাদিস ও ফিকাহের কিতাবগুলোর মধ্যে কিছু নিয়ম আছে। প্রথমত, মনে মনে এই নামাজের নিয়ত করে আল্লাহু আকবার বলে ছানা পড়ে যথারীতি সূরা ফাতিহা এবং তার সাথে অন্য সূরা পাঠ করার পর দাঁড়ানো অবস্থাতেই ওই তাসবিহ ১৫ বার পড়বে। তারপর রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবিহ পড়ে রুকুতেই ওই তাসবিহ ১০ বার পড়ে রাব্বানা লাকাল হামদ বলে রুকু থেকে দাঁড়িয়ে যাবে। দাঁড়িয়ে ১০ বার ওই তাসবিহ পড়বে। অতঃপর সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবিহ পাঠ করার পর সিজদাতেই ১০ বার ওই তাসবিহ পাঠ করবে। সিজদা থেকে উঠে দ্বিতীয় সিজদা করার আগে বসা অবস্থায় ওই তাসবিহ ১০ বার পড়বে। এরপর দ্বিতীয় সিজদায় অনুরূপ ১০ বার এবং সিজদা থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগে বসে ১০ বার ওই তাসবিহ পড়বে। এই হলো প্রথম রাকায়াতে ৭৫ বার তাসবিহ। অতঃপর আল্লাহু আকবার বলা ব্যতীতই দ্বিতীয় রাকায়াতের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে যাবে এবং দ্বিতীয় রাকায়াত প্রথম রাকায়াতের অনুরূপ আদায় করবে। যখন দ্বিতীয় রাকায়াত শেষে আত্তাহিয়্যাতু পড়ার পর তাসবিহ ১০ বার পড়ে নেবে। অতঃপর আল্লাহু আকবার বলে তৃতীয় রাকায়াতের জন্য দাঁড়াবে। এরপর তৃতীয় এবং চতুর্থ রাকায়াত আগের নিয়মে আদায় করবে। এভাবে চার রাকায়াত নামাজে প্রতি রাকায়াতে ৭৫ বার করে সর্বমোট ৩০০ বার এই তাসবিহ পড়তে হবে। উল্লেখ্য, এই নামাজ জীবনের সম্পূর্ণ ছগিরা গুনাহ মাফের জন্য, কবিরা গুনাহ নয়। একবার ফরজ নামাজ না পড়লে যে গুনাহ হয়, শতবার এই নামাজ পড়লেও তা মাফ হবে না। কবিরা গুনাহ তাওবা ব্যতীত মাফ হয় না।
মাওলানা নজরুল ইসলাম তাহের

মানবিক মূল্যবোধ ও ইসলাম


মানবিক মূল্যবোধ ও ইসলাম


মহাবিশ্ব সৃষ্টির একচ্ছত্র পরিকল্পনাকারী ও নিরঙ্কুশ অধিপতি আল্লাহতায়ালা মানুষকে কেন্দ্র করেই সব বিধিবিধান জারি করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন হলো বিশ্বমানবতার জন্য জীবনযাপনের সামগ্রিক সমস্যার উৎকৃষ্ট সমাধান। এটি আল্লাহ প্রেরিত অনুপম ঐশী সংবিধান। আল কুরআনের লক্ষ্যবস্তু মানুষ। পবিত্র কুরআনের বহুমুখী নির্দেশনার প্রতিটি স্তরে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় মানুষের আনাগোনা। ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক জীবনঘনিষ্ঠ নিয়ম-কানুনেরই সমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা। ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ, দরদি ও প্রশান্তচিত্ত মানবিক মূল্যবোধের একনিষ্ঠ উদগাতা। বিকৃত ও বিভ্রান্ত বিচারবোধের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ইসলাম কখনো কখনো একটি নির্দয় প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম হিসেবে আখ্যা পায়, যা অতি মাত্রায় দুঃখজনক ও অক্ষমার্হ। শয়তান প্ররোচিত অসুস্থ চিন্তাভাবনার মোহ কাটাতে না পেরে জঘন্য অপব্যাখ্যায় অনেকেই আত্মনিয়োগ করেন। আমরা দেখছি বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অপচেষ্টা সমাজের মূল্যবোধ ক্রমাগতভাবে শুধু বিনষ্ট করেই চলেছে। ফলে হিংসা-হানাহানি ও সঙ্ঘাতের কবলে পড়ে বিশ্বসমাজকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে।
প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে ইসলামে যে বিধান বা নির্দেশনা এসেছে তা চমৎকার মানবিক মূল্যবোধের পরিচায়ক। এ ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ বা কোনো রকম সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিন্দুমাত্র অবকাশ চিহ্নিত করা হয়নি। প্রতিবেশী যে ধর্মের, যে আদর্শের কিংবা যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন তার প্রতি সুবিচার করা ও সদয় হওয়া মুসলমানের নৈতিক কর্তব্য। ইসলামের উদার মানবিক মূল্যবোধের শাণিত প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে। ট্রেনের ওই যাত্রী যিনি ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক, তিনি ইসলামের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়তো দূরে, আদর্শিক মানের বিচারে তার অবস্থান অনেক নিচে, কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি একটি অভিন্ন মর্যাদার অধিকারী। ইসলাম যেকোনো মানুষের এ মর্যাদা ও অধিকারকে সম্মান করে। সাদা-কালো বর্ণের ভেদ বিচার ইসলাম কখনই করতে জানে না। ব্যক্তি দেখতে সুন্দর নয় বলে তার সাথে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ ইসলামসম্মত নয়। অনেকেই ইসলামকে কট্টর পন্থা হিসেবে অপবাদ আরোপের চেষ্টা চালান। বাস্তবিক পক্ষে এ অপবাদ নিরেট মিথ্যাচার অথবা প্রতিহিংসামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামি অনুশাসনকে যারা মনেপ্রাণে ভালোবাসেন এবং মেনে চলেন তাদেরও এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মুসলমানদের একটু ত্রুটিকে ইসলামবিদ্বেষী চক্র বিরাট আকারের পরিণতিতে পর্যবসিত করতে পারে। তখন এর দায়ভার গিয়ে পতিত হয় ইসলামের ওপর। বিশ্বব্যাপী ইসলামকে ভুল বোঝাবুঝির মাত্রা এতই বেড়ে চলেছে যে, এটি একটি উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে মানব জাতিকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি! তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য।’ সৃষ্টি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বই মানুষের মূল্যবোধের উপযুক্ত মাপকাঠি। সৃষ্টি কর্তার পক্ষ থেকে এটা দ্ব্যর্থহীন স্বীকৃতি যে, বিশ্ব চরাচরের কোটি কোটি সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সবার সেরা। সুতরাং প্রত্যেক মানুষ আরেকজন মানুষের কাছ থেকে মর্যাদা পাওয়ার নিশ্চিত দাবিদার। ইসলাম আদম জাতির মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ। জীবনের নানাবিধ ক্ষেত্রে মানুষকে যথার্থ মূল্য দেয়া ইসলামের নৈতিক শিক্ষারই অংশবিশেষ। চলতে-ফিরতে, হাটবাজার কিংবা অফিস-আদালতে কারো সাথে এমন কোনো আচরণ করা ইসলাম পছন্দ করে না, যাতে অপর ব্যক্তির আত্মমর্যাদায় হানি ঘটে। শুধু আপনাকে নিয়েই মানুষের সব চিন্তা আবর্তিত হলে চলে না। সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষের অপরাপর অধিকারের কথাও গুরুত্বের সাথে ভাবতে হয়। মানুষের সাথে অশোভন আচরণের কোনোরূপ অবকাশ ইসলাম তার অনুসারীদের দেয়নি। দল-মত নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ একটি অপরিহার্য চাবিকাঠি। বলতে দ্বিধা নেই, সমাজে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্কটে নানা রকম বিপর্যয় ও অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে।
সহিষ্ণুতা মানুষের একটি অতি প্রয়োজনীয় গুণ। কিন্তু মূল্যবোধের অবক্ষয় মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমিয়ে দেয়। দুনিয়াতে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের যত ঘটনা ঘটে তার অধিকাংশই ঘটে থাকে সহিষ্ণুতার অভাবে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা আদর্শের মানুষের সাথে চলতে হয়, লেন-দেন করতে হয়। কখনো কোনো কাজের জন্য লাইন ধরে দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়ে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের ক্ষেত্রে অসৌজন্যমূলক ও অপ্রীতিকর ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। ইসলাম এটাকে সমর্থন করে না। অপরের অধিকার ও মর্যাদাদানের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত যত্নবান। আমাদের প্রিয় নবী সঃ একজন অমুসলিম মেহমানের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন আমরা জানি। বিশ্বমানবতার পথ প্রদর্শক রাসূল সঃ ঐতিহাসিক সে ঘটনার মাধ্যমে গোটা বিশ্ববাসীর জন্য যে আলোকিত শিক্ষা উপহার দিলেন তার মূল্য কি আমরা পরিমাপের চেষ্টা করি?
ইসলামে মানবিক মূল্যবোধের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনের সময় এসেছে। ইসলামের নামে যেখানে এত দল বিভক্তি, এত আহ্বান, আবার ইসলামের বিরুদ্ধে যেখানে এত বিষোদগার আর এত আক্রমণ সেখানে মুমিনের অধিক সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। ইসলামি অনুশাসনের নিয়ম-নীতির পাশাপাশি এর মহত্তম কল্যাণবোধের দিকটি দক্ষ কুশলতায় ফুটিয়ে তোলা দরকার। মানুষের কাছেই মানুষের অনিরাপত্তা ও ভয়ঙ্কর শত্রুতা ভরা পৃথিবীতে ইসলামের কল্যাণময় ঔদার্য বিপুল জনগোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান দিতে পারে।
মাওলানা সালেহ মতীন

আল কুরআনের অনুবাদ বিভিন্ন ভাষায়


আল কুরআনের অনুবাদ বিভিন্ন ভাষায়


ইসলাম কোনো অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়। এর প্রকৃতি হচ্ছে প্রচারধর্মী। আবেদন বিশ্বজনীন। অতএব কুরআনের বাণীও গোটা বিশ্বমানবতার জন্য। আরবি একটি প্রাণবন্ত, গতিশীল, সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশীল ভাষা। এ ভাষাকেই বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ আল কুরআনের জন্য নির্বাচিত করেছেন যাতে অনাগত কালের মানুষ মূল আরবি ভাষা থেকেই কুরআনের পথনির্দেশ লাভ করতে পারে। সুতরাং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন নাজিল করে সংরক্ষণের নিশ্চয়তাও বিধান করেছেন।
আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক। (সূরা হিজরঃ আয়াত-৯)
কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হলেও তার আবেদন বিশ্বজনীন হওয়ার দরুন বিশ্বমানুষের কাছে কুরআনের বাণী পৌঁছে দেয়া মহানবী সাঃ-এর অন্যতম অবশ্যকর্তব্য ছিল। অতএব তিনি তাঁর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শাসনকর্তাদের নামে পত্রাদির মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত পাঠান। এ ব্যাপারে ভাষার বিভিন্নতা প্রতিবন্ধক হতে দেননি। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরবি না জানা মানুষের কাছে কুরআনের বাণী পৌঁছে দেয়ার তাগিদে অনারবি ভাষায় কুরআনের অনুবাদ বিশ্বনবীর আমলে আরম্ভ হয়ে আজো অব্যাহত আছে। তবে এ কথা মুসলমানরা ভালোভাবে জানেন, অনুবাদ কোনো অবস্থাতেই মূল কুরআনের বিকল্প হতে পারে না। কারণ কুরআন হচ্ছে হজরত জিব্রাইল আনীত ভাষা ও অর্থের সমন্বয়ে আল্লাহর বাণী। সুতরাং মূল আরবি ভাষায় কুরআন পাঠ করতে এবং কুরআনের মূল বাণী বুঝতে সক্ষম হওয়া পর্যন্ত কুরআনের অনুবাদের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়। এই অনুপ্রেরণা নিয়েই বিভিন্ন ভাষাভাষী মুসলিম মনীষী ও পণ্ডিতগণ কুরআন অনুবাদের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসেন। পক্ষান্তরে অমুসলিম পণ্ডিতরাও ধর্ম প্রচারের গরজে এই গ্রন্থ অনুবাদে এগিয়ে আসেন।
সাম্প্রতিক কালের এক জরিপে জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৭০টি প্রধান ভাষায় আল কুরআন অনূদিত হয়েছে। অমুসলিমদের ভাষাতেও পর্যাপ্ত অনুবাদ হয়েছে। নিØে কয়েকটি ভাষায় অনূদিত কুরআনের উল্লেখ করা হলো।
বাংলাঃ ইসলামী ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদের ক্ষেত্রে বাংলাও পিছিয়ে নেই। সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়, ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন নামের একজন অমুসলিম পণ্ডিতই বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন (১৮৮১-১৮৮৬)। কুরআনের প্রথম আংশিক অনুবাদ সম্পর্কেও মতভেদ আছে। কারো কারো মতে মীর্জাপুরের গোলাম আলী আকবর ১৮৬৪ সালে সর্বপ্রথম ৩০তম পারার বাংলা অনুবাদ করেছেন। আবার কারো কারো মতে মৌলভী আমীরুদ্দীন বিচ্ছুনিয়াকৃত অনুবাদই প্রথম। এক জরিপ অনুযায়ী বাংলা ভাষায় এ যাবত ৩৯টি পূর্ণাঙ্গ ও ৯৫টি আংশিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
উর্দুঃ শাহ রফীউদ্দীন কৃত কুরআনের তরজমা উর্দু ভাষায় কৃত প্রথম তরজমার মর্যাদা রাখে। এই অনুবাদ ঈসায়ী ১১৯০ সালে সম্পন্ন হয় এবং ১৮৪০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। প্রায় একই সময় শাহ আবদুল কাদির কৃত অনুবাদ ১২০৫ হিজরি মোতাবেক ১৭৯০ সালে সুসম্পন্ন হয়ে ১৮২৯ দিল্লি থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। উর্দু ভাষায় এ যাবৎ প্রায় তিন শতাধিক অনুবাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
তুর্কিঃ তুর্কি ভাষায় পবিত্র কুরআনের প্রথম অনুবাদ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে। প্রফেসর ‘জাকি ভালিদি তুগানের’ মতে তাফসিরে তাবারির ফার্সি অনুবাদকমণ্ডলীর মধ্যে কিছু তুর্কিভাষী পণ্ডিতও ছিলেন। তারা ফার্সি অনুবাদের সাথে সাথে তাফসিরের তুর্কি অনুবাদও করেছিলেন। তবে স্পষ্টভাবে জানা যায়, ৭৩৪ হিজরিতে পূর্ব তুর্কি ভাষায় কুরআন প্রথম অনূদিত হয়েছে। ছাপার অক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালে ‘তাফসির আল তিরিয়ান’ কায়রো থেকে। এ পর্যন্ত তুর্কি ভাষায় অনূদিত পূর্ণাঙ্গ তাফসির ও তরজমার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৭-এর মতো।
গুজরাটিঃ আবদুল কাদির বিন লোকমান কর্তৃক প্রথম গুজরাটি অনুবাদ সর্বপ্রথম ১৫৭৯ইং বোম্বাই থেকে প্রকাশিত হয়। এ ভাষায় এ যাবৎ প্রায় এক ডজন পূর্ণাঙ্গ ও দু’টি আংশিক অনুবাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
হিন্দিঃ পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের রাজা মেহরুকের অনুরোধক্রমে ২৭০ হিজরিতে কুরআন মজিদ প্রথম হিন্দি ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে এই অনুবাদ সূরা ইয়াসিন পর্যন্ত সমাপ্ত হতে পেরেছিল। আহমদ শাহ মসীহী কর্তৃক হিন্দি অনুবাদই সম্পূর্ণ কুরআনের অনুবাদ হিসেবে স্বীকৃত। এটি ১৯১৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে।
কাশ্মীরিঃ মুহাম্মদ ইয়াহিয়া শাহ কাশ্মীরি ভাষায় কুরআন মজিদ প্রথম অনুবাদ করেন। এটা একটা আংশিক অনুবাদ। এই অনুবাদ ১৮৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
সিন্ধিঃ একজন আরব পণ্ডিত কর্তৃক সিন্ধি ভাষায় কুরআন মজিদ প্রথম অনূদিত হয়েছিল বলে জানা যায়। জ্ঞাত তথ্য অনুসারে আখুন্দ আযিবুল্লাহ মটালাভি কর্তৃক অনূদিত সিন্ধি অনুবাদই প্রথম অনুবাদরূপে স্বীকৃত। এটি ১৮৭০ ইং গুজরাট থেকে প্রকাশিত হয়। সিন্ধি ভাষায় ছাপার অক্ষরে মুদ্রিত প্রথম অনুবাদ হচ্ছে মুহাম্মদ সিদ্দিক কর্তৃক অনুবাদ। এটি ১৮৬৭ ইং লাহোর থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
তামিলঃ মুস্তাফা আলিম হাজিয়্যার নুই তামিল ভাষায় কুরআন মজিদ প্রথম অনুবাদ করেছেন। এটা একটা আংশিক অনুবাদ হলেও কুরআনের প্রথম তামিল অনুবাদ হওয়ার মর্যাদা রাখে। এটি ১৮৩৭ সালে বোম্বাই থেকে প্রকাশিত হয়। হাবিব মুহাম্মদ আল কাহিরি কর্তৃক তামিল অনুবাদই এ ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। এটি ১৮৮৪ সালে বোম্বাই থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়।
পশতুঃ এ ভাষায় প্রথম কুরআন মজিদ অনুবাদ করেন মাওলানা মুরাদ আলি। এটা ১৯০৬ সালে লাহোর থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ১৮৬১ সালে ভুপাল থেকেও একখানা পশতু তরজমা প্রকাশিত হয় বলে জানা যায়।
পাঞ্জাবিঃ এ ভাষায় অনূদিত সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ কুরআন হচ্ছে হাফিজ মুবারকুল্লাহ কর্তৃক পাঞ্জাবি অনুবাদ। এটি প্রকাশিত হয় ইংরেজি ১৮৭০ সালে। এর আগে একটি আংশিক অনুবাদ লাহোর থেকে ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেন নুয়ান কুটি শাহ।
চৈনিকঃ বিংশ শতকের গোড়ার দিকে শায়থ লিউ চি কর্তৃক নির্বাচিত বিভিন্ন পারার অনুবাদের মাধ্যমে আধুনিক চীনা ভাষায় কুরআনের অনুবাদের সূচনা হয়। অতঃপর শেখ মাফু সু ২০ পারা পর্যন্ত সমাপ্ত করেন। মালিয়ান ইয়ান অনূদিত চীনা কুরআন ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে লি টিয হং কর্তৃক চীনা অনুবাদই এ ভাষায় প্রথম কুরআনের প্রকাশিত অনুবাদ।
জাপানিঃ জাপানে ইসলামের ইতিহাস যেমন অতি আধুনিক এ ভাষায় কুরআনের অনুবাদের ইতিহাসও অতি সাম্প্রতিক। ১৯২০ সালে কে আই স্যাকামুটু কর্তৃক অনুবাদের মাধ্যমে জাপানি ভাষায় কুরআনের অনুবাদের সূচনা হয়। বর্তমানে এ ভাষায় নয়খানা অনুবাদমূলক বলে জানা যায়।
কোরিয়ানঃ কোরিয়ান ভাষায় কুরআনের অনুবাদের ইতিহাস আরো সাম্প্রতিক। ইউয়াং সান কিম নামের এক পণ্ডিত কোরিয়ান ভাষায় পবিত্র কুরআন প্রথম অনুবাদ করার সৌভাগ্য লাভ করেন। এটি ১৯৭১ সালে রাজধানী সিউল থেকে প্রকাশিত হয়।
ইংরেজিঃ ইংরেজি অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা। সুতরাং মুসলিম অমুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বীরাই এ ভাষায় পবিত্র কুরআন অনুবাদ করেছেন। ১৫১৫ ইং কুরআন চয়নিকারূপে প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তবে আলেকজান্ডার রস কর্তৃক অনূদিত কুরআনই এ ভাষায় কৃত প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ।
ল্যাটিনঃ বরাটুস কেটে নেনসিস নামের এক পণ্ডিত ল্যাটিন ভাষায় প্রথম কুরআন অনুবাদ করেন। এটা ১১৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সমাপ্ত হয় এবং ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ ইং পর্যন্ত এ ভাষায় মোট পাঁচখানা সম্পূর্ণ ও ২৮ খানা আংশিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
স্প্যানিশঃ অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা স্প্যানিশ। ডি জসি গার্বার ডি রবলিস এ ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআন অনুবাদ করেন। তার অনূদিত কুরআন ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রিদ থেকে প্রকাশিত হয়।
ইতালিয়ানঃ ইতালিয়ান ভাষায় পবিত্র কুরআন প্রথম অনূদিত হয় ১৫৪৭ ইং। আঁন্দ্রে এবিভাবেনে ইতালিয়ান ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআন অনুবাদ করেন। ১৯৮০ পর্যন্ত এ ভাষায় মোট ৮০খানা সম্পূর্ণ ও চারখানা আংশিক অনুবাদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
উপসংহারঃ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা অব্যাহত গতিতে চলছে। তথ্যদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, এ ধারা আরো ব্যাপকরূপে পরিগ্রহ করবে।
জি এম এমদাদ

বৈরী পরিবেশে ইসলামী জীবন


বৈরী পরিবেশে ইসলামী জীবন


ব্যক্তিগতভাবে মানুষের ক্ষমতার তারতম্য এবং জীবনের রূঢ় বাস্তবতার বিভিন্ন স্তর থাকে। অন্তদৃêষ্টি ও ফিকহের জ্ঞানের পাশাপাশি অন্যের এই বাস্তবতার প্রতিও পরস্পর সহৃদয় অনুভূতি থাকা আবশ্যক। আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবার কাছ থেকে হজরত হামজাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব রাঃ মতো শাহাদতের শৌর্য প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। এটি এমন একটি মহৎ গুণ, গভীরতম নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় ছাড়া যার প্রকৃত মর্ম খুব কম লোকই অনুধাবন করতে পারে।
কেউ কেউ শান্তভাবে সত্যের পক্ষে কথা বলে তৃপ্তি বোধ করে; অন্যরা তাদের ধারণা অনুযায়ী বিরাজমান মারাত্মক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নীরব থাকাই নিরাপদ মনে করে। আবার অনেকে মনে করে আগা নয়, গোড়া থেকে সংস্কার কাজ চালাতে হবে। এ জন্য তারা ব্যক্তিবিশেষের প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তারা মনে করে, এসব লোকের দৃষ্টিভঙ্গি সংযত ও পরিশুদ্ধ করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু এটা বলা বাহুল্য, পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা নির্মূল করতে হলে সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির ভিত্তিতে একটি ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্বে সম্মিলিত সংগ্রাম ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবশ্য শরিয়ত এক মুনকার থেকে যেন আরেকটি বড় মুনকারের সৃষ্টি না হয় সে জন্য অনেক ক্ষেত্রে নীরবতাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল করীমে হজরত মূসা আঃ-এর ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়। মূসা আঃ সিনাই পর্বতে ওঠার আগে তার ভাই হজরত হারুন আঃকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যান। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরপরই ইসরাইলিরা সামেরিদের পরামর্শে একটি সোনার গো-মূর্তি বানিয়ে পূজা করতে শুরু করে। এই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে হারুন আঃ-এর বক্তব্য শুনতেও তারা অস্বীকার করে। কুরআন বলছেঃ
‘হারুন তাদেরকে আগেই বলেছিলেন, হে আমার স্বজাতি! তোমাদের এর দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। তোমাদের প্রভু দয়াময়; সুতরাং তোমরা আমাকে অনুসরণ করো এবং আমার আদেশ মেনে চলো। তারা বলেছিলঃ আমাদের কাছে মূসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজা থেকে কিছুতেই বিরত হবো না।’ (২০ঃ ৯০-৯১)
তাদের অনমনীয়তা দেখে হারুন আঃ নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। মূসা আঃ ফিরে এসে ক্রোধে ও দুঃখে অগ্নিশর্মা হয়ে হারুন আঃকে রূঢ়ভাবে তিরস্কার করলেন। কুরআনের বর্ণনা, ‘মূসা বললেন, ও হারুন! তুমি যখন দেখলে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তখন কিসে তোমাকে নিবৃত্ত করল আমার অনুসরণ করা থেকে? তবে কি তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে!’ (২০ঃ ৯২-৯৩)
হারুন আঃ জবাব দিলেন ‘হে আমার সহোদর! আমার দাড়ি ও চুল ধরে টেনো না; আমি আশঙ্কা করেছিলাম, তুমি বলবে, তুমি বনী ইসরাইলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ এবং তুমি আমার কথা পালনে যত্নবান হওনি।’ (২০ঃ ৯৪)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সামাজিক ঐক্য ও সম্প্রীতির স্বার্থে হারুন আঃ হজরত মূসা আঃ ফিরে না আসা পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করলেন। এ ঘটনার সাথে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর হাদিসের সাযুজ্য লক্ষণীয়। তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর অনুসারীরা সবেমাত্র পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে ইসলামে এসেছে, এটা বিবেচনা করেই তিনি পুরনো কাবাকে ধ্বংস করে নতুন করে কাবা নির্মাণ থেকে বিরত থেকেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর অন্যান্য আদেশ থেকেও এরূপ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন যদি অত্যাচারী-অনাচারী শাসককে হটিয়ে সৎ ব্যক্তির সরকার কায়েমের ক্ষমতা না থাকে তাহলে শাসকের অবিচার সহ্য করার কথা আছে। কেননা প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন বৃহত্তর ফেতনার সৃষ্টি না হয়, মুসলমানদের অযথা রক্তপাত বা সামাজিক স্থিতিশীলতা যেন বিনষ্ট না হয় অর্থাৎ বাস্তব ফল ছাড়া শুধু অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে এমন প্রতিবাদের চেয়ে নীরবতাই কাম্য। অন্যথায় পরিস্থিতি এমনও হতে পারে যে, কুফরির দিকেও মোড় নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন, ‘যতক্ষণ না তুমি প্রকাশ্য কুফরি প্রত্যক্ষ করো, যার পক্ষে তোমার কাছে আল্লাহর তরফ থেকে প্রমাণ আছে।’ (বুখারী, মুসলিম)
দু’টি দৃষ্টান্তই অনিশ্চিত সাফল্যের মুখে ঐক্য বজায় রাখার ওপর আলোকপাত করেছে। পক্ষান্তরে ইসলামী শিক্ষা পালনের ক্ষেত্রে যেসব ভাববাদী মুসলমান চরম পূর্ণতা দেখতে চায় অথবা যারা একেবারে বর্জন করতে চায় তাদের উভয়ের জন্য এ ঘটনাগুলো শিক্ষণীয়। এদের কাছে কোনো মধ্যপন্থা নেই। ভাববাদীরা মুনকার উচ্ছেদে শক্তি প্রয়োগকেই শেষ হাতিয়ার মনে করেন। তারা অন্য দু’টি পথ অর্থাৎ কথা ও হৃদয় দিয়ে প্রতিরোধের কথা বেমালুম ভুলে যান। মোট কথা, প্রতিটি উপায় প্রয়োগ নির্ভর করে ব্যক্তির ক্ষমতা ও পরিস্থিতির ওপর। আশ শরিয়াহ বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করার ওপর এত দূর গুরুত্ব দিয়েছে যে, নিরুপায় অবস্থায় হারামও হালাল হয়ে যায় এবং ওয়াজিব স্থগিত হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ এ বিষয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
‘আল্লাহতায়ালা কুরআনুল করীমে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, তিনি ক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত বোঝা মানুষের ওপর চাপাতে চান না।’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ কারো ওপর এমন কোনো কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা তার সাধ্যাতীত।’ (২ঃ ২৮৬)
‘আমরা কাউকেই তার সাধ্যাতীত ভার অর্পণ করি না, যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে তারাই জান্নাতবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।’ (৭ঃ ৪২)
‘কাউকেই তার সাধ্যাতীত কার্যভার দেয়া হয় না এবং আল্লাহ যাকে যে সামর্থø দিয়েছেন তদপেক্ষা গুরুতর বোঝা তিনি তার ওপর চাপান না।’ (৬৫ঃ ৭)
আল্লাহ মানুষকে যথাসাধ্য তার আদেশ পালন করতে বলেছেন। তিনি বলেনঃ‘তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করো।’ (৬৪ঃ ১৬)
ঈমানদাররাই তাঁর কাছে প্রার্থনা করেছেঃ‘হে প্রভু, আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যেমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন আমাদের ওপর তেমন দায়িত্ব অর্পণ করবেন না। হে প্রভু! এমন ভার আমাদের ওপর অর্পণ করবেন না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই।’ (২ঃ ২৮৬)
আল্লাহ তাদের প্রার্থনা কবুল করেছেন। এসব আয়াত প্রমাণ করছে যে, তিনি মানুষের ওপর এমন বোঝা চাপান না, যা সে বহন করতে পারবে না। এটা নিশ্চিত যে, জাহমিয়া, কাদিরিয়া ও মুতাজিলা দর্শনের সাথে এর কোনো সঙ্গতি নেই। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝে নিতে হবে, যদি কোনো শাসক, ইমাম, বুদ্ধিজীবী, ফকিহ অথবা মুফতি আল্লাহর খালেস ভয়ে তার সাধ্য অনুযায়ী যে ইজতিহাদ করবে তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহ তার কাছ থেকে এটাই চেয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, তাকে শাস্তি দেয়া হবে না। এর বিপরীত কাদিরিয়া ও মুতাজিলারা যে ধারণা পোষণ করে তা বাতিল।
কাফেরদের বেলায়ও একই বিষয় প্রযোজ্য। যারা কুফরির দেশে রাসূল সাঃ-এর দাওয়াত পেয়ে তাকে রাসূল বলে স্বীকার করলেন এবং তাঁর ওপর অবতীর্ণ ওহিকে বিশ্বাস করে যথাসাধ্য আনুগত্য করলেন­ যেমন নাজ্জাশী ও অন্যান্য, কিন্তু ইসলামের ভূখণ্ডে যেতে না পারার দরুন শরিয়তকে সামগ্রিকভাবে মানতে পারলেন না; কারণ তাদেরকে দেশত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়নি অথবা প্রকাশ্যে আমলের সুযোগ পাননি এবং তাদেরকে সমগ্র শরিয়াহ শিক্ষা দেয়ার মতো লোক ছিল না। এমন সব মানুষের জন্য আল্লাহ জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরূপ আরো উদাহরণ আছে। আল্লাহতায়ালা ফেরাউনের লোকদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী ছিল তাদের সম্পর্কে বলছেন, ‘এবং তোমাদের কাছে আগে ইউসুফ এসেছিলেন স্পষ্ট নিদর্শনসহকারে, কিন্তু তিনি যা নিয়ে এসেছিলেন তাতে তোমরা বারবার সন্দেহ পোষণ করতে। অবশেষে তিনি যখন ইন্তেকাল করলেন তখন তোমরা বলেছিলে তার পরে আল্লাহ আর কাউকে রাসূল করে পাঠাবেন না।’ (৪০ঃ ৩৪)
নাজ্জাশী খ্রিষ্টানদের রাজা ছিলেন; কিন্তু তিনি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে বললে তারা অস্বীকার করল। শুধু মুষ্টিমেয় লোক তাঁকে অনুসরণ করেছিল। তিনি যখন মারা গেলেন তখন তার জানাজা পড়ারও কেউ ছিল না। অবশ্য রাসূলুল্লাহ সাঃ মদিনায় তার জানাজা পড়েন এবং উপস্থিত সবাইকে বলেন, ‘আবিসিনিয়ায় তোমাদের মধ্যকার একজন সৎ কর্মশীল ভাই মারা গেছেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)
যদিও নাজ্জাশী ইসলামের অনেক শিক্ষা মানতে পারেননি, দেশত্যাগ করেননি, জিহাদে অংশ নেননি অথবা হজও করেননি। এটাও বর্ণিত আছে যে, তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, সিয়াম অথবা জাকাতের কর্তব্য পালন করতে পারেননি; কেননা তার ঈমানের কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে জনগণ তার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। আমরা জানি, তিনি আল কুরআনের বিধানও প্রয়োগ করেননি, যদিও আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে আহলে কিতাবরা চাইলে তাঁর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করার আদেশ দিয়েছিলেন। আবার আল্লাহ্‌ তাঁর রাসূলকে এই মর্মে সতর্কও করে দিয়েছেন, ‘আহলে কিতাবরা যেন তাকে ওহির অংশবিশেষ থেকেও বিচ্যুত করার জন্য প্রলুব্ধ করতে না পারে।’
কঠোর ন্যায়পরায়ণতার জন্য উমর ইবনে আবদুল আজিজ রাঃকে অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে। এ জন্য তাকে বিষ প্রয়োগও করা হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু নাজ্জাশী এবং তার মতো অন্যরা এখন জান্নাতে শান্তিতে আছেন, যদিও তারা শরিয়তকে পূর্ণরূপে পালন ও প্রয়োগ করার সুযোগ পাননি বরং তা-ই করেছেন, যা তাদের কাছে প্রযোজ্য মনে হয়েছে। (মাজমুয়া আল ফাতওয়া)
ড. ইউসুফ আল কারজাভী
ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জি

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় মুসলমান


বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় মুসলমান


আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। রাষ্ট্রীয় ও জীবনের সর্বস্তরে এখন তার অবাধ ব্যবহার আমাদের গৌরবান্বিত করে। মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, রাজভাষা ও মাতৃভাষা অভিন্ন হইলে দেশের ও জাতির উন্নতির পথ যেরূপ সুগম হয়, বিভিন্নাবস্থায় সেরূপ হইতে পারে না।
তিনি যখন এ উক্তি করেছিলেন তখন ব্রিটিশের রাজত্ব চলছে। তার এই উক্তির ভেতর দিয়ে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তার সমকালে তিনি মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং মাতৃভাষাচর্চার অভাব যে মুসলমানদের দুর্দশার প্রধান কারণ, এ কথাও তিনি স্পষ্টভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন।
মধ্যযুগে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এখনকার মতো মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার অবাধ ছিল না। প্রথম দুই আমলে বাংলা ভাষা এককভাবে রাষ্ট্রভাষা ছিলই না; এবং এর ব্যবহার নিয়ে বাঙালি মুসলমানদের ভেতর দ্বিধা ছিল। তবুও দেখা যায়, শিক্ষিত ও সাহিত্যানুরাগী মুসলমানদের ভেতরে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা একেবারে থেমে থাকেনি। পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালি তরুণদের বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করতে হয়েছিল। এ ছাড়াও বাংলা ভাষার ওপর নানা ধরনের অনাবশ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার মৌলিক রূপ ও চরিত্র বদলিয়ে ফেলার অপচেষ্টা সে সময় কম হয়নি। কিন্তু সে সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী প্রমুখ পণ্ডিত ও সাহিত্যিকের প্রবল যুক্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মুখে এবং ভাষা আন্দোলনের উত্তাল স্রোতে তা ভেস্তে যায়। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের মানচিত্রে।
আমরা এবার একটু পেছনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারি। প্রথমেই মধ্যযুগ। মাতৃভাষা বাংলা, আমরা জানি, সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছিলেন মুসলমান সুলতান ও রাজন্যবর্গ। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও এক দিকে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের রক্তচক্ষু ও অপর দিকে মুসলমান সমাজের বিরোধিতা উভয় সম্প্রদায়ের সাহিত্যিক-কবিদের সাহিত্যচর্চার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। মধ্যযুগের সাহিত্য মূলত ধর্মসাহিত্য। দেবভাষা সংস্কৃত থেকে ‘অনার্য ভাষা’ বাংলায় শাস্ত্রের রূপান্তর যেমন সেকালের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের কাছ থেকে ছাড়পত্র পায়নি, তেমনি আরবি-ফারসি থেকে বাংলায় কুরআন-কেতাবের কথা ভাষান্তরের ব্যাপারেও মুসলমান সমাজের একটি বড় অংশ তেমন উদ্যোগী ছিল না। কিন্তু সেকালেও বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশ ছিল বাংলাভাষী। সুফিদের কাছে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও সাধারণ মুসলমানরা শরা-শরিয়ত সম্পর্কে ছিলেন অজ্ঞ। তাদের কাছে ইসলাম ধর্মের এই মূল বিষয়গুলো পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ তারা নিয়েছিলেন।
গবেষকের ভাষায়
শাস্ত্রকথা বাংলায় লেখা বৈধ কি না সে বিষয়ে সতের শতক অবধি মুসলিম লেখকরা নিঃসংশয় ছিলেন না, শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ সুলতান, হাজী মুহম্মদ, আবদুল নবী, আবদুল হাকিম প্রমুখ কবির উক্তিতে আমরা দ্বিধার আভাস পেয়েছি। অতএব, তবু যারা এ সময় বাংলায় শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেছেন, তারা দ্বিধা ও পাপের ঝুঁকি নিয়েই করেছেন, এতে তাদের স্বধর্মপ্রীতি, লোক-হিতৈষণা, মনোবল ও যুক্তিপ্রিয় মনের পরিচয় মেলে।
শেখ মুত্তালিব কেফায়তুল মুসল্লিন এবং কায়দানী কিতাবের লেখক। তিনিও সপ্তদশ শতাব্দীর কবি। তিনি এসব গ্রন্থ বাংলায় লিখতে গিয়ে যে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন, তার কিছু উদ্ধৃতি এখানে দেয়া হলো। তিনি লিখেছেন,
আরবিতে সকলে না বুঝে ভালো মন্দ
তে কারণে দেশীভাষে রচিলুঁ প্রবন্ধ।
মুসলমানি শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুঁ
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলুঁ।
কিন্তু মাত্র ভরসা আছএ মনান্তরে
বুঝিয়া মুমীন দোয়া করিব আমারে।
মুমীনের আশীর্বাদে পুণ্য হইবেক
অবশ্য গফুর আল্লাহ পাপ ক্ষেমিবেক
এসব জানিয়া যদি করএ রক্ষণ
তেবে সে মোমোর পাপ হইব মোচন।
মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তৎকালীন সমাজের মাতৃভাষার প্রতি উপেক্ষার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি নিজেও ইসলামবিষয়ক গ্রন্থাদি রচনা করেছেন বাংলায়। তার গ্রন্থাবলির নামঃ সভারমুখতা, নসিয়তনামা বা সাবাবনামা তথা শাহাবউদ্দীননামা এবং দোররে মজলিস। শেখ মুত্তালিবের পিতা শেখ পরাণ কায়দানী কিতাব ও নূরনামা গ্রন্থের রচয়িতা। এ সময় লিখিত আশরাফের কিফায়তুল মুসলেমিন এবং মুজাম্মিলের নীতিশাস্ত্রবার্তা এবং আলাউলের তোহফা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ ছাড়া মুসলিম আমলে রোমান্টিক কাব্যও বঙ্গানুবাদের দ্বারা মধ্যযুগে ধর্ম সাহিত্যের পাশাপাশি নতুন স্বাদ এনে দেয়। কোরেশী মাগন, আলাউল, শা’বারিদ খান প্রমুখ কবিরা সে যুগে বাংলা সাহিত্যের চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন বলেই আমরা সে যুগের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত পেয়েছি। এ ক্ষেত্রে শ্রদ্ধার সাথে আমরা স্মরণ করি পুঁথি সংগ্রাহক ও গবেষক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদকে। মধ্যযুগে মুসলিমদের বাংলা সাহিত্যচর্চার নজির তুলে ধরার কৃতিত্ব তারই। পরে অধ্যাপক আলী আহমদও পুঁথি সংগ্রহে অবদান রেখেছেন।
ব্রিটিশ আমলে মধ্যযুগের এই আলোকিত দিকটি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা কেবল থেকে গেল দৈনন্দিন কার্যাবলিতে, সাহিত্যের দিকটি হলো উপেক্ষিত। কেবল তাই নয় ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষা থেকেও তারা দূরে সরে গেল। অভিজাত নাগরিক মুসলমানদের উর্দুকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে দেখি। কিন্তু গ্রামবাংলার অসংখ্য মুসলমানের মাতৃভাষা তখনো বাংলা কিন্তু এই অন্ধকার বেশি দিন থাকেনি। বাঙালি মুসলমানদের এই হতদশা থেকে তুলে আনার জন্য প্রশস্তহৃদয় শিক্ষিত মুসলমানরাই ত্রাণকর্তা হয়ে আসেন।
মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে এরা কেবল ভেবেছেন তাই নয়, মাতৃভাষা বাংলায় তারা সাহিত্যচর্চার ওপর জোর দিয়েছেন। যে গুরুত্ব দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে মাতৃভাষাকে ব্যবহার করেছিলেন মধ্যযুগের মুসলিম কবিরা, তারই পুনরাবৃত্তি করতে হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের শিক্ষিত মুসলমানদের। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝাতে হয় ওই সব উন্নাসিক শিক্ষিত মুসলমানদের, যারা মাতৃভাষা চর্চাকে কেবল উপেক্ষা করেননি, এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ বোধ করেননি। ইসলামাবাদী সাহেব মাতৃভাষা কী এবং তার গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছেনঃ
মাতৃক্রোড়ে থাকিতেই শিশু আধআধ স্বরে স্বভাবের প্রেরণায় মুখে যে কথা ব্যক্ত করে, তাহাই মাতৃভাষা। এই হিসেবে বাংলা বাঙ্গালার পৌনে ষোল আনা লোকের মাতৃভাষা। ইহাতে হিন্দু মোছলমানের কোনো পার্থক্য নাই। ঢাকা, কলিকাতা, মোর্শেদাবাদ ও চট্টগ্রাম টাউনের মোছলমানের ভাষা মাতৃভাষা কিংবা বিকৃত উর্দু ও বাংলায় মিশ্রিত হইয়া গেলেও তাঁহারা উভয় ভাষাতেই মনোভাব প্রকাশ করিতে অভ্যস্ত বরং তাঁহাদের সংসার জীবনের প্রত্যেক স্তরেই তাঁহারা উর্দু অপেক্ষা বাংলার অধিকতর মুখাপেক্ষী।
খাতাপত্র, দলিল দস্তাবেজ ও পত্র ব্যবহার সমস্তই তাহাদিগকে বাংলাতেই করিতে হয়। সুতরাং বাংলা যে তাহাদেরও মাতৃভাষা, ইহাতে দ্বিমত হইতে পারে না।
সাহিত্যের বাহন সম্পর্কে জ্ঞানতাপস প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র উক্তি এখানে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তিনি বলছেন,
বাহন উপযুক্ত না হলে কেউ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে না। লক্ষ্য লাভ করতে গেলে সাহিত্যের বাহন উপযুক্ত হওয়া চাই। সেই বাহন মাতৃভাষা।
আর একজন মনীষীর নাম আমরা স্মরণ করতে চাই। তিনি খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ। ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ভারতীয় এবং মুসলমান এডিপিআই কেবল শিক্ষাবিদ ছিলেন না, ছিলেন সমাজসেবী এবং সুফি সাধক। তিনি তার দায়িত্ব পালনকালে মুসলিমদের দুর্দশা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। তিনি মুসলিমদের শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যম ছাড়া স্বজাতির উন্নতি সম্ভব নয়। তিনি লিখেছেনঃ
মাতৃভূমি হিন্দুর নিকট যেরূপ আদরণীয়, মুসলমানের নিকটও তদ্রূপ। বঙ্গভাষা একের পক্ষে যেমন নিজস্ব, অপরের পক্ষেও সেইরূপ। তাই বলি, যদি বঙ্গদেশের উন্নতি চাও, যদি বঙ্গভাষার প্রাধান্য দেখিতে চাও, যদি মঙ্গলময়ের ইচ্ছা পূর্ণ করিতে চাও, তবে ভাষা ব্যবচ্ছেদ হইতে বিরত হও।
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন খান বাহাদুর সাহেবের এই ভাষণের তিন বছর আগে প্রায় অভিন্ন উক্তি করেছিলেন। তার ভাষায়ঃ
বর্তমান সময়ে এই ভাষায় (বাংলা লেখক) নানারূপ বিপ্লব সৃষ্টি হইতেছে। এই বঙ্গে অর্ধাধিক মুসলমান। সুতরাং বলা বাহুল্য যে, বঙ্গভাষার ওপর মুসলমানের ন্যায্য অধিকার বিদ্যমান। কিন্তু এ যাবৎ বঙ্গীয় মুসলমান নানা কারণে বঙ্গভাষার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়াছেন। তাহাদের মধ্যে কম লোকই ইহার সেবা করিয়াছেন। কিন্তু এখন বঙ্গীয় মুসলমানগণ বঙ্গভাষাকে ভালো মতেই চিনিয়াছেন, এই সাহিত্যের প্রতি অনাসক্তি প্রদর্শন যে জাতীয় উন্নতির পক্ষে প্রধান অন্তরায়, তাহা তাহারা খুব ভালো করিয়া বুঝিয়াছেন।
অতঃপর তিনি মাতৃভাষা বাংলা সম্পর্কে একটি উল্লেখযোগ্য প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বেশ জোরালোভাবে, তবে এইমাত্র বলিতে পারি, বাঙ্গালি মুসলমান­ যাহারা দৈনন্দিন কথাবার্তায় বাঙ্গালা ভাষাই ব্যবহার করেন, যাহাদের অস্থিমজ্জায় পর্যন্ত বাঙ্গালা ভাষা অনুপ্রবিষ্ট তাহাদের মাতৃভাষা বাঙ্গালা ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে না।
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যচিন্তক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ছিলেন মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ‘বাংলা ভাষা ও মুসলমান সাহিত্য’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে মাতৃভাষা বাংলা সম্পর্কে এক অবিস্মরণীয় বক্তব্য রেখেছেন। তার বক্তব্যটি নিুরূপঃ
বাংলা দেশবাসী মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা­ সে বিষয়ে কাহারো মতবিরোধ নাই। আমরা বাঙলায় কথাবার্তা কহি, বাঙলায় স্বপ্ন দেখি, বাঙলায় চিন্তা করি, আমাদের প্রাণ বাঙালীর প্রাণ, হাসিকান্না বাঙালীর হাসিকান্না, এমন কি আমাদের রক্তমাংস বাঙালীর রক্তমাংস। অতএব, অপ্রতিরোধীয় রূপে আমাদের মাতৃভাষা­ যে দেশের মাটিতে আমাদের বাস, যে দেশের বায়ু আমাদের শ্বাস, যে দেশের ফল জলে আমরা পালিত, যে দেশের নদনদীর স্নেহধারায় আমরা পরিপুষ্ট, সেই দেশের ভাষা­ বাঙলা। এমন কথা কেহ বলিতে পারেন না যে, বাঙলা ভাষা হিন্দুর নিজস্ব ভাষা, উহা কখনো মুসলমানের ভাষা হইতে পারে। প্রকৃতপক্ষে কোন ভাষা কোনকালে বিশিষ্ট ধর্মসম্প্রদায়ের নিজস্ব খাস সম্পত্তি হয় নাই এবং বোধ হয় কোনকালেও হইবে না।
মাতৃভাষা বাংলা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েও সে স্বমহিমায় দেদীপ্যমান। মধ্যযুগে, ব্রিটিশ আমলে এমন কি পাকিস্তান আমলেও এর অপ্রতিরোধ্য গতিকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। ১৯৫২ সালে যারা বুকের রক্ত দিয়েছিলেন, তাদের স্বপ্ন এখন সার্থকতায় পূর্ণ। বাংলা সাহিত্যচর্চায় এখন সব শ্রেণীর মানুষ নিবেদিতপ্রাণ। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিদ্যা ইত্যাদি এখন মাতৃভাষায় হচ্ছে। অফিস-আদালতেও এর ব্যবহার এখন স্বতঃস্ফূর্ত। ধর্মীয় বিষয়াদি বাংলায় লিখিত হওয়ায় অধিকসংখ্যক মুসলমান এর অন্তর্গূঢ় তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছে।
বাংলা ভাষা বিশ্বের অষ্টমতম ভাষা। স্বাধীনতার পর থেকে মাতৃভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে। ‘বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্র’ হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা।
ডক্টর মোমেন চৌধুরী
ক্যালিগ্রাফিঃ আরিফুর রহমান

মাতৃভাষার অধিকারঃ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি


মাতৃভাষার অধিকারঃ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি


মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা­ মানুষের অস্তিত্বের এ তিনটি প্রধান অবলম্বন। মানুষের জীবন হচ্ছে তার মাতৃভাষা, দেশের ভাষা, জাতির ভাষা। মানুষের যতগুলো জন্মগত অধিকার আছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে মাতৃভাষার অধিকার। নিজের মতো করে কথা বলার অধিকার। স্বতঃস্ফূর্ত চেতনায় স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার। এ অধিকার আল্লাহই মানুষকে দিয়েছেন। তবুও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যুগে যুগে এই জন্মগত অধিকার হরণ করার হীন প্রচেষ্টা চলেছে আমাদের এই স্বাধীনচেতা বীর বাঙালিদের ভূখণ্ডে। বাংলা ভাষায় হিন্দু ধর্ম চর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যাওয়ার হুলিয়া ছিল অথচ বাংলা ভাষার প্রতি মুসলিম সুলতানদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকার পরিপ্রেক্ষিতে দিন দিন এ দেশে বাংলার প্রভূত উন্নতি ও সমৃদ্ধি সাধিত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে মাতৃভাষার ওপর বড় ধরনের আঘাত আসে পাকিস্তানি শাসকদের থেকে। যেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের, সেই মানুষের জন্মগত অধিকার হরণ করে নেয়ার মতো দুঃখ আর কী ইবা থাকতে পারে! ইসলামের দৃষ্টিতে বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা ছিল মারাত্মক অপরাধ। আর এ কথাটিই ১৯৪৭ থেকে জোরগলায় বলে আসছিল মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রপথিক তমদ্দুন মজলিস। ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর থেকে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সুসংগঠিতভাবে তমদ্দুন মজলিসই সূচনা করে­ যার বিস্ফোরণোন্মুখ বহিঃপ্রকাশ ঘটে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে।
মাতৃভাষা যে আল্লাহপ্রদত্ত জন্মগত অধিকার তার একটি প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহতা’আলা মানুষকে লক্ষ করে ইরশাদ করেছেনঃ আর তাঁর নিদর্শনাবলির অন্যতম নিদর্শন হলো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন। (সূরা রুমঃ ২১ আয়াত) এ আয়াতে দেখা যায়, মানুষের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতা আল্লাহর সুনিপুণ সৃষ্টিকৌশলের অন্যতম সুশীলিত বহিঃপ্রকাশ। এ জন্য ভাষা-বর্ণ প্রভৃতির কারণে কোনো বিশেষ অঞ্চলের মানুষদের পর্যুদস্ত করার চেষ্টা ইসলামসম্মত নয়। ইসলামের নামে অন্যের ভাষা কেড়ে নেয়ার সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলাম সব বর্ণের মানুষের ধর্ম। ইসলাম সব ভাষাভাষী মানুষের ধর্ম।
অতীতকাল থেকে যত ইসলাম প্রচারক এসেছেন তারা প্রধানত এখানকার মানুষের মাতৃভাষায়ই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। ইসলাম যেহেতু সব ভাষার ক্ষেত্রে উদার ও অকৃত্রিম, সেহেতু মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা সব দেশে সব অঞ্চলে সব যুগে স্ব স্ব অঞ্চলের মাতৃভাষায় কুরআন-সুন্নাহর দাওয়াত তুলে ধরেছেন। হজরত আদম আঃ থেকে রাসূলুল্লাহ সাঃ পর্যন্ত এবং রাসূলুল্লাহ সাঃ থেকে আজ পর্যন্ত সর্বশ্রেণীর ধর্মপ্রচারকদের ক্ষেত্রে এটি সত্য।
আল্লাহ্‌র প্রেরিত প্রধান চার কিতাবও অবতীর্ণ হয়েছে প্রেরিত রাসূল ও জাতির মাতৃভাষায়। হজরত মুসা আঃ এবং তার জাতি ইহুদিদের মাতৃভাষা হিব্রু ছিল বলে তার প্রতি অবতীর্ণ তাওরাতের ভাষা ছিল ইবরানি বা হিব্রু। হজরত ঈসা আঃ ও তার জাতি খ্রিষ্টানদের মাতৃভাষা গ্রিক ছিল বলে তার প্রতি অবতীর্ণ ইনজিলের ভাষা ছিল সুরইয়ানি বা গ্রিক।

হজরত দাউদ আঃ-এর ওপর অবতীর্ণ জবুরের ভাষা ছিল ইউনানী। শেষনবী ও বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাঃ-এর মাতৃভাষা আরবি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর প্রতি যে কুরআন অবতীর্ণ হয় তার ভাষা আরবি। কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল হওয়ার কারণ উল্লেখ করে আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে আরবি ভাষায় নাজিল করেছি এ জন্য যে যাতে তোমরা তা বুঝতে পারো। (সূরা ইউসুফঃ ২ আয়াত)। একজন রাসূল হিসেবে মুহাম্মদ সাঃ-এর সর্বপ্রথম কর্তব্য ছিল তাঁর নিজস্ব পরিবার ও নিজস্ব জাতির কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। তাঁর জাতি আরবদের মাতৃভাষা আরবি ছিল বলে তাঁর জাতির কাছে তার দাওয়াত আরবিতেই হওয়া যুক্তিসঙ্গত। আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় তিনি দাওয়াত দিলে কিংবা কোনো অনারব ভাষায় কুরআন নাজিল হলে তারা কিছুই বুঝত না। তাদের হিদায়াত করা সম্ভব ছিল না। এ বিষয়ে আল্লাহ্‌তা’আলা বলেনঃ আমি যদি আরবি ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায় কুরআন পাঠাতাম তাহলে তারা বলতঃ এর বাক্যগুলো ভালো করে বুঝিয়ে বলা হলো না কেন? সেকি! কিতাব আরবিতে নয় অথচ পয়গম্বর আরব।’ (সূরা হামিম আস্‌ সাজদাহ্‌ঃ ৪৪ আয়াত)।
আরবিতে কুরআন নাজিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আরবি ভাষা মহিমান্বিত হলেও কোনো ভাষাই ইসলামে উপেক্ষিত বা অবহেলিত নয়। মূলত সব ভাষা নিরপেক্ষ। কোনো ভাষার ভাষা হিসেবে কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে ওই ভাষায় অমর-অবিস্মরণীয় কীর্তির বদৌলতে। আরবদের আরবি ভাষা একদা লাত-মানাত-উজ্জা প্রভৃতি প্রতিমার স্তুতিগান, শিরক-কুফর ও অশ্লীলতায় পূর্ণ ছিল। মহানবী সাঃ ও কুরআনের আবির্ভাবে তা ইসলামের প্রধান ভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। কাজেই ভাষার জন্য ইসলাম নয় বরং ইসলামের জন্যই ভাষা। ইসলাম কোনোভাবেই আরবি ভাষার কাছে ঋণী নয় বরং আরবি ভাষাই ইসলামের কাছে ঋণী। ঋণী ফার্সি, উর্দু, বাংলা প্রভৃতি ইসলামসমৃদ্ধ ভাষাও।

অন্য কথায় মুসলমানদের ইসলাম চর্চাই উপরিউক্ত ভাষাগুলোকে গৌরবান্বিত করেছে। আরবি ভাষাকে এক পক্ষ ধরে এবং অন্যান্য ভাষাকে আরেক পক্ষ ধরে বিচার করলে পারস্পরিক সম্পর্ক দাঁড়ায় ঊর্ধ্বমুখী ও নিুমুখী। অর্থাৎ আরবি ভাষাভাষী ধর্মপ্রচারকরা প্রথমে অন্যান্য ভাষা (যথা ফার্সি, উর্দু, বাংলা) চর্চা শুরু করছেন বলেই এসব ভাষাভাষী মুসলিমরা আরবি চর্চায় উৎসাহিত হয়েছিল। আবার বহু অনারব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ইসলামের টানে আরবি শিক্ষায় নিয়োজিত থাকেন এবং কালের পরিক্রমায় আরবিকেই পরিণত করেন তাদের দেশ ও জাতির মাতৃভাষায়।
হজরত মুহাম্মদ সাঃ পর্যন্ত প্রত্যেক জাতির জন্য অন্তত একজন করে নবী নির্দিষ্ট ছিল। (দেখুন সূরা ইউনুসঃ ৪৭ আয়াত) আর এই জন্যই প্রত্যেক রাসূলের ভাষা ছিল তাঁর জাতির তাঁর অঞ্চলের মাতৃভাষা। আল্লাহ্‌তা’আলা ইরশাদ করেনঃ আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার জন্য। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন আর যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়, (সূরা ইবরাহিমঃ ৪ আয়াত) জাতির মাতৃভাষায় রাসূল প্রেরণ করা আল্লাহ্‌র বড় নিয়ামত। অবশ্য শেষনবী মুহাম্মদ সাঃ নির্দিষ্ট কোনো ভূখণ্ডের জন্য বা নির্দিষ্ট কোনো সময়ের জন্য প্রেরিত হননি। তিনি প্রেরিত হয়েছেন কিয়ামত অবধি বর্ণ-গোত্র-ভাষা-জাতি নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য। তাঁর দাওয়াত সব ভাষাভাষী মানুষের জন্য গ্রহণীয়। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন দাঁড়ায় তা হলো কুরআন আরবি ভাষায় না হয়ে ইংরেজি বা বাংলা ভাষায় হলো না কেন? এর উত্তরে বলা যায়, ইংরেজি কুরআন অবতীর্ণ হলে তো ফার্সি ভাষাভাষীরা প্রশ্ন করতে পারত তা ফার্সি ভাষায় হলো না কেন? আসল কথা হচ্ছে­ সব জাতির সব ভাষাভাষীর একই কুরআন একই রাসূল পথপ্রদর্শক হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দু’টি পথ খোলা ছিলঃ এক. হয়তো সব ভাষায় কুরআন প্রেরণ করা হবে অথবা দুই. মাত্র একটি ভাষায় কুরআন প্রেরণ করা হবে। বিভিন্ন ভাষায় কুরআন অবতরণের যে প্রয়োজনীয়তা নেই তার কারণ হচ্ছে­ এ ক্ষেত্রে অনুবাদই যথেষ্ট। তা ছাড়া বিভিন্ন ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ হলে পরিবর্তন ও মতদ্বৈধতার আশঙ্কা ছিল প্রচুর। ফলে মূল হিসেবে কোনো ভাষার কুরআনের ওপর নির্ভর করা যেত না। একই ভাষায় একই কুরআন অবতীর্ণ হওয়ায় অনুবাদ ও বিশ্লেষণে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে মূল কুরআনের আশ্রয় নিয়ে তার সমাধান সহজতর হয়ে ওঠে।
প্রত্যেক জাতির জন্য আল্লাহ্‌তায়ালা একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন বলে বাঙালি জাতির জন্যও একজন রাসূল এসে থাকবেন। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলের কোনো মহাপুরুষ এই অঞ্চলবাসীর রাসূল ছিলেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে বাংলা ভাষাভাষী যেকোনো রাসূল আসেননি তাও নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ বাংলা ভাষার জন্ম রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর জন্মের পরে হয়েছে। আর এটি সত্য যে, রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর পরে কোনো নবী-রাসূল আসেননি, আসবেন না। তাই বলে ভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা রাসূলসমৃদ্ধ ভাষার নিচে তা বলা যায় না। সব ভাষাই আল্লাহ্‌র দান, আল্লাহ্‌র সৃষ্টি। আল্লাহ্‌ মানুষ সৃষ্টির সাথে সাথে মানুষ জাতিকে ভাষাও শিখিয়ে দিয়েছেন। প্রথম মানুষ হজরত আদম আঃ প্রসঙ্গে আল্লাহ্‌ ইরশাদ করেনঃ আর তিনি (আল্লাহ্‌) আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন। (সূরা বাকারাঃ ৩১ আয়াত) জগতে কোন বস্তুর কী নাম, কার কী কাজ, কার সাথে কার কেমন সম্পর্ক­ প্রভৃতি সব বিষয়ের ভাষাজ্ঞান আল্লাহ্‌ আদম আঃ-কে শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ্‌ অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ আর রহমান-দয়াময় আল্লাহ্‌। তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা। (সূরা আর রহমানঃ ১-৪ আয়াত)।
ইসলাম মাতৃভাষার অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করে বলে, জুমার নামাজের খুতবা মাতৃভাষায় হলে ইসলামের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আপত্তি নেইও মূলত। ইসলাম-বিশেষজ্ঞ বহু আলিম মনে করেন, জুমার খুতবা যদি আরবিতে দেয়া হয় এবং মুসল্লিরা যদি আরবি বুঝতে অক্ষম হন তবে মুসল্লিদের মাতৃভাষায় জুমার খুতবা দেয়া বিধিসম্মত। আর এ জন্যই বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে জুমার খুতবা আরবিসমেত বাংলাভাষায় প্রদান করা হয়। যারা জুমার খুতবা কেবল আরবিতে দেয়ার পক্ষে মত দেন তাদের যুক্তি হলো­ খুতবা নামাজের অংশ-নামাজ যেহেতু আরবি ছাড়া অন্যভাষায় আদায় করা যায় না, সেহেতু খুতবাও আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় আদায় করা যাবে না। আর যারা মাতৃভাষায় জুমার খুতবা আদায়ের কথা বলেন, তাদের যুক্তি হলোঃ খুতবা বা বক্তৃতার উদ্দেশ্য হলো­ শ্রোতাদের উপদেশ দেয়া, শরিয়তের হুকুম-আহকাম বলা, তাদের সমস্যার সমাধান দেয়া। ফলে শ্রোতারা যদি বুঝতেই না পারে কী উপদেশ দেয়া হলো কিংবা সমস্যার কী সমাধান করা হলো তাহলে খুতবার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে বাধ্য।
সৌদি আরবের ইসলামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দারুল ইফতার কাছে স্থানীয় ভাষায় (মাতৃভাষায়) জুমার খুতবা দেয়া যাবে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে দারুল ইফতা জবাব দেয়ঃ
‘প্রকৃতপক্ষে জুমার খুতবা আরবি ভাষাতেই দেয়া উচিত। খতিব যদি আরবি ভাষায় খুতবা দিতে সক্ষম হন তার কিছুসংখ্যক শ্রোতা তা বুঝতে পারেন তাহলে আরবি ভাষা ব্যতীত অন্যভাষায় খুতবা দিলে গ্রহণযোগ্য হবে না।’ .... ‘আর তা না হলে অন্তত হামদ-না’ত প্রসঙ্গে আরবি শব্দ ব্যবহার করতে হবে। এরপর আরবি ভাষা ছাড়া যদি অন্য কোনো ভাষার একান্ত প্রয়োজন হয় তাহলে ওই প্রয়োজনীয় ভাষায় এর অনুবাদ করে দিতে হবে।’ (দেখুন জুমার খুতবাঃ ড. এ এইচ এম ইয়াহইয়ার রহমান) যে জুমার মুসল্লিরা আরবি ভাষা বুঝেন না তাদের আরবিতে খুতবা দেয়া হলে তাদের কোনোই লাভ হবে না। না বোঝার কারণে তখন অনেক মুসল্লি অন্যমনস্ক কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারেন, এ ক্ষেত্রে আরবির পাশাপাশি মুসল্লিদের মাতৃভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেয়া বাঞ্ছনীয়। ইমাম আবু হানিফা রহঃ এই কাজটি করতেন। তিনি তার প্রদত্ত জুমার আরবি খুতবা একই সাথে ফার্সিতে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন। কারণ মুসল্লিদের মাতৃভাষা ছিল ফার্সি। বাংলাদেশের আহলে হাদিসের মসজিদে আরবি ও বাংলায় জুমার খুতবা দেয়া হয়, ইউরোপ ও আমেরিকার মসজিদগুলোতেও আরবি সমেত ইংরেজিতে খুতবা দেয়া হয়।
অধ্যাপক মাওলানা আহমদ আবুল কালাম

ইসলামে মাতৃভাষার চর্চা

ইসলামে মাতৃভাষার চর্চা


আল্লাহপাক মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা আখ্যায়িত করেছেন এবং তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন যাতে তারা একে অন্যের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুলতে পারে। কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছেঃ ‘আর তার নির্দেশনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য।’ বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৬ হাজারের অধিক ভাষা প্রচলিত আছে। এর প্রত্যেক ভাষায়ই কথা বলে একেকটি জনগোষ্ঠী।

এ ভাষাগুলোই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের মাতৃভাষা। ইসলাম প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেছে। কারণ ইসলাম মনে করে মাতৃভাষার সাথে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি জড়িত থাকে। একে অপরের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করা, সৎ ও ন্যায় কাজ করা অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা বা বাধা প্রদান করা, ধর্মের বিধিবিধান প্রতিপালন করা, আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা কেবল মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। ইসলাম ভাষার বিষয়টিকেও সার্বজনীন আখ্যা দিয়েছে। বর্ণ, আঞ্চলিকতা ও ভাষার সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে ইসলাম ধর্মীয় প্রচারে মাতৃভাষা চর্চার জোরালো তাগিদ দিয়ে বলেছে­ ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে বিজ্ঞানসম্মত ও উত্তম ভাষণ দ্বারা আহ্বান করো এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে আলোচনা করো [নাহলঃ ১২৫]।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাঙালি জাতির জীবনে কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ ভাষার এক বেদনাবিধুর ইতিহাস রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এক বাঙালি ছাড়া আর কোনো ভাষাগোষ্ঠীর জীবনে ভাষার জন্য আন্দোলন হয়নি। রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়নি। রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে কেবল বাঙালিরাই বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পেরেছে। সে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আজ পৃথিবীজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কেবল আমাদের চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। শহীদ মিনার ধোয়ামোছা, শহীদ মিনারে প্রভাতফেরির অনুষ্ঠান, গান গাওয়া, সরকারি-বেসরকারি নানা মাত্রিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমেই আমরা একুশকে স্মরণ করি। একুশ আসে, একুশ যায়। আজ ৫৫ বছর হলো আমাদের অর্জিত অমর একুশে। একুশের চেতনা কি বছরের বাকি ১১ মাস আমাদের মাঝে জাগ্রত থাকে­ এ প্রশ্ন অনেকের মনেই উদয় হয়। সর্বস্তরে মাতৃভাষার চর্চা এখনো কাগুজেই রয়ে গেছে, দেশের সব শিশুকে আমরা মাতৃভাষা শিক্ষা দিতে পারিনি।
পাকিস্তানিদের মতো অনেক বাঙালি মুসলমান ও আলেম-ওলামা-ইমাম আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি উদাসীন। আরবি-ফার্সি-উর্দু ভাষায় যত ধর্মগ্রন্থ লেখা হয়েছে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় ততটা নেই। এটি বাংলা ভাষাভাষী আলেম-ওলামাদের ব্যর্থতা। আমাদের অনেকের এ উপলব্ধি বোধ নেই যে, আরবি-ফার্সি ও উর্দু ভাষায় রচিত সিনেমার চেয়ে বাংলা ভাষায় রচিত নজরুলের হামদ ও নাত হাজার গুণ শ্রেয়। আমাদের ভাষাসৈনিক ও তাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি যথাযথ সম্মান জানাতে আমরা ভুলে গেছি। আমরা যে বায়ান্নর রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা পেয়েছি­ সে কথাটিও আজ আর বোধ হয় মনে নেই। আমরা আশা করব, আমাদের ধর্ম-কর্মে, আচার-ব্যবহারে, অফিস-আদালতে তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে এবারের একুশ বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন

শুক্রবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

ইসলাম ও মানবতা

ইসলাম ও মানবতা


সকল সৃষ্টির স্রষ্টা মহান রাব্বুল আল-আমীন এই পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বা স্থলাভিষিক্তরূপে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আর খিলাফত পরিচালনা তথা পার্থিব ও পারলৌকিক শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকনির্দেশনা-সম্বলিত জীবন বিধান হিসেবে ইসলামি জীবন ব্যবস্থা বা ইসলামি দর্শনের উৎস হিসেবে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ অবতীর্ণ করেছেন তার প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর মাধ্যমে। আর জ্ঞানদান করার কারণে তাঁর সকল সৃষ্টির ওপর মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেনঃ এই জ্ঞান দ্বারা মানুষ ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা দেখতে পারে, বুঝতে পারে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে। তিনি আলস্নাহ, যিনি তোমাদের জন্য জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন, যেন পরীড়্গা করতে পারেন তোমাদের মধ্যে কারা সঠিক-সুন্দর পথে জীবন-যাপন করে (৬৭:২)। আলস্নাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে সকল মানুষকেই ভালোবাসেন। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেছেন, হে! মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রভুর নির্দেশ মেনে চলো, যিনি তোমাদের একই ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন আর তাদের থেকেই বহু নর ও নারী বিস্তৃত করেছেন। (৪ঃ১)। ইসলামের মূল উৎস আল-কোরআনের উলেস্নখিত আয়াতের মাধ্যমেই ইসলামি দর্শনে বিশ্বমানবতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

সৃষ্টি-জগতে মানবজাতি একটি জাতি। এই মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করবে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসা। সাম্প্রদায়িকতা নয় বরং সম্প্রীতি। ঘৃণা, নিন্দা, হিংসা, প্রতিহিংসা বা পশুত্ব নয় বরং মানবতা। মানবপ্রেম তথা সৃষ্টি প্রেমের মাধ্যমেই লাভ করা যায় মানবজীবনের কাঙিক্ষত লক্ষ্য, মহান স্রষ্টা আলস্নাহ রাব্বুল আলামীনের প্রেম। আর এটাই শিড়্গা দিয়েছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর নবুয়তের ২৩ বছর তথা পার্থিব জগতের ৬৩ বছরের জীবনে। মহানবী (সাঃ) বলেছেনঃ তোমরা সবাই আদম সন্তান আর আদমকে বানানো হয়েছে মাটি দ্বারা। সুতরাং মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই।

হ্যাঁ যে মানুষ মানবতাবোধের অধিক মর্যাদা দিয়ে মানব তথা সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে মহান স্রষ্টার নির্দেশ অধিক পালন করবে, সে আলস্নাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী হবে। আলস্নাহ বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আলস্নাহর কাছে অধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয় আলস্নাহর নির্দেশ অধিক পালন করে, মন্দ কাজ পরিহার করে (৪৯ঃ১৩)। কাজী নজরম্নল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, কারো মনে তুমি দিও না আঘাত, সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে। কারণ মানুষের মনই তো কাবা, যেখানে আলস্নাহ বিরাজ করেন। ইসলামী দর্শনানুযায়ী মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম সালাত ও নামাযেই সে মানবতাবোধ, একথা, সৌহার্দ, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বে শিক্ষা দেয়া হয়। যে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়, সে সমাজেই দেখা দেয় অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা, অন্যায় ও অবিচার।

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পর ইসলাম প্রচারের প্রারম্ভে একবার তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন। রাস্তায় এক বৃদ্ধ মহিলাকে বড় বোঝা বহন করে নিয়ে যেতে দেখে মহানবী (সাঃ) তার সাহায্যার্থে বোঝাটি নিজের কাঁধে নিয়ে পথ চলতে চলতে জিজ্ঞেস করলেন, মা, তুমি এত বড় বোঝা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? বৃদ্ধা জানালেন, তার এলাকায় মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি বেরিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে যার দেখা হয়, সে-ই পিতৃধর্ম হারিয়ে ফেলে। তাই বৃদ্ধ বয়সে পিতৃধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধা এই এলাকা ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছেন। মহানবী (সাঃ) আর কিছু না বলে বৃদ্ধাকে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিয়ে বিদায় চাইলে বৃদ্ধা মহানবী (সাঃ)-এর মানবতা ও মহানুভবতায় বিমুগ্ধ হয়ে তার নাম ও পরিচয় জানতে চান। মহানবী (সাঃ) মিথ্যা বলতে জানতেন না এবং কখনো মিথ্যা বলেননি। তিনি বললেন, আমার নাম মুহাম্মদ ইবনে আবদুলস্নাহ। বৃদ্ধা মহানবী (সাঃ)-এর মমতা ও মানবতা প্রেমে মুগ্ধ হন এবং বুঝতে পারেন এমন চরিত্র সত্য নবী ছাড়া কারো হতে পারে না। তিনি মহানবী (সাঃ)-এর সাক্ষাৎধন্য হয়ে মহাসত্য ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করেন। ইসলামি দর্শন হলো, মানবতার জন্য, মানুষের জন্য। ধর্ম তথা ইসলাম মানুষের কল্যাণের জন্য দেয়া হয়েছে। মানুষের ধর্ম বা ইসলামের জন্য বানানো হয়নি। মানুষের জন্যই ধর্ম বা ইসলাম। মানুষের পদভারে পৃথিবী প্রকম্পিত হলেও মানবতা আজ ভুলুক্তিত। প্রকৃত মানুষের অভাব বড় বেশী। যে মানুষরূপী মানুষের কাছে মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তাহীনতা বোধ হয়, তাকে কি মানুষ বলা যায়? সবচেয়ে কষ্ট ও যন্ত্রণাদায়ক হলো মানুষ ধর্মের বৈপরীত্যের কারণে অমানুষিক, পশুসুলভ ও বর্বর আচরণ করছে। অথচ পৃথিবীর সব ধর্মই তো মনুষ্যত্ব পেশায় শান্তির কথা বলে এবং মানবতার বাণী শোনায়। আমাদের সমাজে তথা বিশ্বসমাজে সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করলে মানবসমাজে অশান্তি থাকতে পারে না। কারণ সকল ধর্মই ভালো কাজ করা, মন্দ পরিহার করা এক কথায় মানবতার শিড়্গা দেয়। অথচ পৃথিবীর বহু ধর্মের পার্থক্যের কারণে তথাকথিত মানুষ মানুষকে হত্যা করছে, সম্পদ লুট করছে, এমনকি মা বোনদের সম্ভ্রম পর্যন্ত লুটছে।

প্রায়ই মানবিক মুল্যবোধ বলে একটি কথা বলা হয়। আসলে এ পৃথিবীতে মানুষ সবকিছুরই মূল্য দেয়, শুধু মানুষের মূল্য দিতে কেন যে কুণ্ঠিত হয়। অথচ আলস্নাহ তাআলা এ পৃথিবীর সবকিছুই বানিয়েছেন মানুষের জন্য। বলেছেনঃ তিনি মহান আলস্নাহ যিনি মানুষের মঙ্গলের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন (২ঃ২৯)। আর মানুষ বানিয়েছেন তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে, তাঁকে জানতে ও তাঁর নির্দেশিত পথে পরিচালিত হয়ে বাহ্যিক ও আত্মার শান্তি লাভ করতে। এ শান্তিôর জন্য প্রয়োজন আত্মার পরিশুদ্ধতা। আবার আত্মার পরিশুদ্ধতার জন্য কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ঘৃণা, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি ব্যাধিমুক্ত হয়ে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। আর মানবপ্রেম তথা সৃষ্টিপ্রেম ছাড়া এসব নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না।

অপরদিকে মানবতাবোধ, মানবপ্রেম সৃষ্টি তথা সৃষ্টি-প্রেমের মাধ্যামেই স্রষ্টাপ্রেম অর্জন করা যায়। ইসলামের মূল উৎস পবিত্র কোরআনে ঘোষিত বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বমানবতার আদর্শ অনুসরণ করার মাধ্যমেই বর্তমান ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিশ্বে মানবসমাজে মানুষের প্রতি মানুষের স্নেহ, মমতা, সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব তথা মনুষ্যত্ব ও মানবতার যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে তা হ্রাস পেতে ও দূর হতে পারে।

ইসলামের মানবতার শিক্ষা হলো সংঘাত নয় সমঝোতা, সাম্প্রদায়িকতা নয় সহমর্মিতা, যুদ্ধ নয় শান্তি, পরনিন্দা নয় আত্মসমালোচনা, কুৎসা নয় আত্মশুদ্ধি, অহঙ্কার নয় বিনম্রতা, শত্রম্নতা নয় বন্ধুত্ব, পরশ্রীকাতরতা নয়, ভ্রাতৃত্ব, জবরদস্তি নয় ন্যায় পরায়নতা, অমঙ্গল কামনা নয় সমবেদনা, ক্ষতিসাধন নয় কল্যাণ কামনা এবং হিংস্রতা ও পশুত্ব নয় সদাচরণ ও মানবতা। মহান আলস্নাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে মানবতাবোধে উদ্‌ভাসিত হয়ে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ ও শান্তি লাভ করার শক্তি দান করুন।

প্রফেসরড আ ন ম রইছ উদ্দিন
লেখকঃ সাবেক চেয়ারম্যান, ইসঃ স্টাডিজ বিভাগ, ঢা বি।

শনিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

অবুঝ মন্ত্রীর নির্বোধ আপত্তি


অবুঝ মন্ত্রীর নির্বোধ আপত্তি


‘অবুঝ’ মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। নিজের ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকার কারণে এটা হতে পারে। সম্ভবত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষতার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে জাহির করার জন্য তিনি গত ৮ ফেব্রুয়ারি চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিটিএমএ’র মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতে আপত্তি তুলেছেন। তিনি হয়তো জানেন না, তিনি যে দলের টিকিট নিয়ে এমপি নির্বাচিত এবং পরে মন্ত্রী হয়েছেন; সেই দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলে ‘কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করা হবে না’। সুতরাং লতিফ সিদ্দিকী কুরআন তেলাওয়াতে আপত্তি তুলে কেবল সংবিধানই লঙ্ঘন করেননি; তার নিজ দলের অঙ্গীকারের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন। এখানে উল্লেখ করতে হয়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ অন্তর্ভুক্ত করেছিল, এ দল ক্ষমতায় গেলে কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করা হবে না। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমনভাবে বিজয়ী হয়েছিল যে, জনগণ স্বাধীনতার পুরোপুরি ম্যান্ডেট দিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তাই হয়েছিল।

কিন্তু স্বাধীনতার পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড শুরু হয় উল্টো। এবারো প্রায় একইভাবে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিপরীতমুখী হয়ে উঠেছে বলে আশঙ্কা হচ্ছে। অন্তত বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর আচরণে তারই প্রতিফলন লক্ষণীয়। অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে­ যে দু’বার আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে ‘কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন করা হবে না’ বলে উল্লেখ করেছে, সে দু’বারই নির্বাচনে তাঁরা আশাতীত ফল লাভ করেছেন। কিন্তু প্রথমবার নেতারা নির্বাচনী অঙ্গীকার ভুলে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এমন সব কর্মকাণ্ড করেছেন, যার পরিণতি কল্যাণকর হয়নি। সেসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ ফুটে উঠেছিল। এটা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর বিরূপ রেখাপাত করেছিল। তখন কবি নজরুল ইসলাম কলেজের ‘ইসলাম’ কেটে দেয়া হয়েছিল। বাদ দেয়া হয়েছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ‘মুসলিম’ শব্দটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’ তুলে দেয়া হয়েছিল। আসলে এসব কাজের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

এগুলো ছিল অতিউৎসাহী চাটুকারদের কাজ। অথচ দায় বহন করতে হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে; যিনি ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় কলকাতার মুসলমানদের পক্ষে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমার ধারণা, শেখ মুজিব রহমান ওই ধরনের কর্মকাণ্ড মনেপ্রাণে চাননি। সম্ভবত তার অবস্থা হয়েছিল সেই প্রবাদ বাক্যের মতো, ‘দশের চক্রে, ভগবান ভূত।’ এবারো আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলে ওই সব কর্মকাণ্ড দেখতে চান না। হয়তো আগের মতোই অতি উৎসাহীরা শুরু করেছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দেবেন বলে কি আশা করা যায় না?। যারা এসব করছেন তাদের মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার তার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন সিলেটে প্রসিদ্ধ আউলিয়া হজরত শাহজালাল রহঃ-এর মাজার থেকে; কোনো গির্জা, মন্দির বা মঠ থেকে নয়। এটা হয়েছে, তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের কারণে। আবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এখন যাচ্ছেন পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য মক্কা ও মদিনায়। অন্য ধর্মের কোনো প্রসিদ্ধ স্থানে যাচ্ছেন না। এই বিশ্বাসকে কি রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক বাগাড়ম্বর দিয়ে ্লান করা যাবে? আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কাছে একটি প্রশ্ন, তিনি প্রতিদিন যেসব খাদ্য গ্রহণ করে থাকেন; সে তালিকায় এমন সব খাবার থাকে কি­ যা খাদ্যাভ্যাসের বিপরীত? অর্থাৎ আপনার তালিকায় কী আপনার খাদ্যাভ্যাসের বিপরীত শূকরের মাংস, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি যা কিছু অন্য ধর্মের লোকেরা ভক্ষণ করে, তা কি থাকে? নিশ্চয় থাকে না। আর আপনার এই খাদ্যের অভ্যাস ছোটবেলা থেকে গড়ে উঠেছে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। তাই খাদ্যাভ্যাসের কারণে যদি আপনার রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতার জাত না যায়; তাহলে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করলে আপনি ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না, তা কি যুক্তিগ্রাহ্য হবে? আর ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থাৎ যদি এটা হয়, কোনো ধর্মকে অবজ্ঞা না করা কিংবা কোনো ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত না দেয়া; তাহলে তো এ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশ মুসলমানের মনে কিছুতেই আঘাত দিতে পারেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শেরও অবমাননা করেছেন। আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশে এমন কিছু ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানুষ আছেন, যারা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ইসলামের বিরোধিতা করা বুঝে থাকেন।

আসলে মূল কথা হচ্ছে, সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা এবং ধর্মীয় কারণে কারো প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ পোষণ না করা। যেমন, আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা তার শপথ অনুষ্ঠানের ঐতিহাসিক ভাষণে আমেরিকাকে খ্রিষ্টান, মুসলিম, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অবিশ্বাসীদের আবাসস্থল হিসেবে অভিহিত করলেও তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছেন নিজ ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের ওপর হাত রেখে। এতে কি আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি ধ্বংস হয়ে গেছে? আসলে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেই সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের অধিকার নিশ্চিত হয়। এজন্য উচ্চকণ্ঠে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলার প্রয়োজন নেই। বরং আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে­ অতিমাত্রায় ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যেকোনো বিবেচনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যে ভারত আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দিয়েছে, সে ভারতের তুলনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বর্গরাষ্ট্র। ধর্মীয় কারণে এ দেশে কখনো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয়নি। কয়েকবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু দাঙ্গা হয়নি। সেটাও হয়েছে ভারতের ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই। আবার গভীরভাবে অনুসন্ধান চালালে দেখবেন, যেভাবে ভারতে ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে শত শত মসজিদ, মাদ্রাসা দখল করে গোয়ালঘর বা অন্য কিছু করা হয়েছে; তার দৃষ্টান্ত কিন্তু বাংলাদেশে নেই। কেউ উদাহরণ দিতে পারবে না, এ দেশে কোনো মানুষ বা রাজনৈতিক শক্তি কোনো মন্দির দখল করেছে। বরং বিভিন্ন সরকার নতুন নতুন মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছে। ভারতে মুসলমানদের সরকারি চাকরি নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে নেই সে অবস্থা। এ ছাড়া এনজিও, প্রাইভেট ব্যাংক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমানতালে সংখ্যালঘুরা কাজ করছেন। এর কারণ হচ্ছে ইসলামে জাত-পাতের বিভেদ ও বর্ণবিদ্বেষের কোনো স্থান নেই।

আমার এই লেখায় ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দেয়ার কথা এ কারণেই উল্লেখ করেছি যে, এর একটা ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। সে পটভূমিতে আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পাঠক আপনাদের অনেকের জানা নেই, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে ছিল। এরপর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভার অধিবেশনে বলেন, বাংলাদেশের নেতারা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটা তিনি বলেছিলেন স্বীকৃতির পটভূমি হিসেবে। সেই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অথচ ভারতের সংবিধানে এটা অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৭৪ সালে। এ দিক দিয়ে বিচার করলেও বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। সুতরাং আবদুল লতিফের হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া এ সত্য স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ। সে কারণে আমরা ওআইসি’র সদস্য। অপর দিকে ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না।’ স্বয়ং সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা অন্যের উপাসনালয়ে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। আমাদের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রাঃ একবার সিরিয়ার শাসকের উদ্দেশে লিখিত এক চিঠিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে নির্দেশ দেন, তোমার রাজত্বে কোনো অবস্থাতে যেন সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের স্বীকার না হয়। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ শাসকদের উদ্দেশে বলেছেন, খবরদার, তোমরা সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন করো না। যদি তা করো তাহলে কাল কিয়ামতের ময়দানে আমার শাফায়াত বা সুপারিশ পাবে না। এমনকি নবী সাঃ যুদ্ধগামী সৈন্যদের এই মর্মে উপদেশ দিতেন, তোমরা দেখো কোনো অবস্থায় যেন যুদ্ধকালে নিরীহ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার না হয়; ফলবতী গাছ যেন কর্তন না করা হয়। এর চেয়ে মহান বাণী আর কী হতে পারে।’ সুতরাং মন্ত্রী মহোদয় কুরআন তেলাওয়াতে আপত্তি করে কোন লক্ষ্য হাসিল করতে চেয়েছেন, তা বোধগম্য নয়। নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করবেন।

এলাহী নেওয়াজ খান

শুক্রবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

রাষ্ট্র পরিচালনায় মহানবী (সা•)


রাষ্ট্র পরিচালনায় মহানবী (সা•)


কখন কিভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের উৎপত্তি ও আবির্ভাব ঘটে, সে বিষয়টি অদ্যাবধি অমীমাংসিত রয়ে গেলেও এ বিষয়ে সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একমত যে, মানব সমাজের বৃহত্তর প্রয়োজনেই রাষ্ট্রযন্ত্রের উদ্‌ভব। দার্শনিক পেস্নটো, এরিস্টটল ও অন্যান্য প্রখ্যাত পণ্ডিত রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ক বিভিন্ন তাত্ত্বিক বক্তব্য পেশ করলেও রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে তাঁদের প্রত্যড়্গ কোন যোগসূত্র ছিল না এবং আমাদের জানামতে তাঁদের দর্শন ও চিন্তা-চেতনার আলোকে কখনও কোথাও কোন আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত তাঁদের বক্তব্য, চিন্তা-চেতনা, নীতিমালা ও দর্শন তাত্ত্বিক কাঠামো পেরিয়ে বাস্তôবে রূপ লাভ করেনি। পক্ষান্তরে, সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মহাম্মদ (সা•) মদীনা সনদের আলোকে মদীনাতে যে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, মানব জাতির ইতিহাসে এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে তা সর্বোত্তম জনকল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে।একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমদের প্রিয় রাসূল, বিশ্বনবী, বিশ্ব মানবতার মহান আদর্শ ও মহান শিড়্গক, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা•)-এর আবির্ভাবকালীন সময়ে তাঁর প্রিয় জন্মভূমি হিজায অঞ্চলসহ সমকালীন বিশ্বের তিনটি মহাদেশ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা ছিল রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সকল দিক দিয়ে পশ্চাপদতা ও পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ। মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক কোন উপাদন তখন বিদ্যমান ছিল না। অপর দিকে হিজাযের আশপাশের নিকটবর্তী ও দূরবর্তী দেশসমূহ, যেমন-পারস্য, রোম, মিশর, ইথিওপিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে তখন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল।

কিন্তু হিজাযে তখন রাজতন্ত্রের পরিবর্তে শায়েখতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। অর্থাৎ সেখানে শায়খ কর্তৃক শাসিত গোত্র ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মক্কাকেন্দ্রিক এ গোত্রভিত্তিক শাসন ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রথম পর্যায় হিসেবে অভিহিত করেন।৬১০ ঈসায়ী সালে নবুয়ত প্রাপ্তির পর মহানবী (সা•) মক্কাকেন্দ্রিক জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দাওয়াতের মাধ্যমে আদর্শিক প্রচার-প্রসারমূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মক্কার বৈরি পরিবেশ, কায়েমী স্বার্থবাদীদের প্রচণ্ড বিরোধিতা, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও গোত্রপতিদের অসহযোগিতা, সর্বোপরি জীবনের প্রতি চরম হুমকি প্রভৃতি কারণে তিনি আল আক্বাবার শপথের আলোকে মহান আলস্নাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশে ৬২২ সালে মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন। এ সময় মদীনাতে তিন শ্রেণীর জনগোষ্ঠী বসবাস করতো। এরা হচ্ছে-মদীনার আদিম পৌত্তলিক সম্প্রদায়, বহিরাগত ইহুদী সম্প্রদায় এবং নবদীড়্গিত মুসলিম সম্প্রদায়। মহানবী (সা•)-এর হিজরতের অব্যবহিত পরে মদীনায় মুহাজির ও আনসার মিলে মোট মুসলিম সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েকশ’। পক্ষান্তরে এ সময় মদীনা নগরীর মোট জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক দশ হাজার, যার প্রায় অর্ধেকই ছিল ইহুদী।

তখন মদীনাকেন্দ্রিক কোন সুসংঘবদ্ধ প্রশাসনিক কাঠামো এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা না থাকার কারণে উক্ত সব গোত্র প্রায়ই পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকতো। রাষ্ট্র গঠনের মূল চারটি উপাদান-নির্দিষ্ট ভূখন্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্বের মধ্যে প্রথম দু’টি উপাদান তখন সেখানে বিদ্যমান থাকলেও শেষোক্ত দু’টি উপাদান ছিল অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় মহনবী, রহমতের নবী, নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সা•) নিজের অবস্থান নির্ণয়, স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ, পারস্পারিক সম্পর্ক ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা, গোত্রভিত্তিক সমাজ কাঠামোর পরিবর্তে একটি সার্বজনীন, বহুজাতিক ও বহুমাত্রিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং মদীনার প্রতিরড়্গা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষে হিজরতের প্রথম বর্ষেই মক্কা হতে আগত মুহাজির সম্প্রদায়, মদীনার আনসার সম্প্রদায়, ইহুদী ও আদিম পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের সাথে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে একটি লিখিত দলিল সম্পাদান করেন, যা ‘কিতাবুর রাসূল’ বা ‘মদীনা সনদ’ নামে বহুল পরিচিত। এটিই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সনদ বা সংবিধান, যা মহানবী (সা•) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনা রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান এবং মূল ভিত্তি।

মহানবী (সা•) মদীনা সনদ জারি করেন মদীনায় বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, এ সনদ জারির পূর্বেই তিনি মদীনা রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং মদীনার সর্বময় শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী হন। আর রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে তিনি এ সনদ জারি করেন, নতুবা সনদ জারি করার কোন আইনগত কর্তৃত্ব তাঁর থাকে না এবং তা মেনে চলার ড়্গেত্রে সংশিস্নষ্ট পক্ষগুলোরও কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না। পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয় এবং তাঁকে মদীনার সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অন্য দিকে নাগরিকদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকার নির্ধারণ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং মহানবী (সা•)-এর পূর্বানুমতি ব্যতীত কোন পড়্গ যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার ঘোষণা, প্রকারান্তরে তাঁর চূড়ান্ত নির্বাহী কর্তৃত্বের অবস্থানকে আরও সুসংহত করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। সনদের ২৪তম এবং ৪৬তম ধারার আলোকে মদীনার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে আলস্নাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মহানবী (সা•)-এর নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এবং রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ভার গ্রহণের বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। ফলে মদীনা সনদ মদীনায় জনকল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ড়্গেত্রে লিখিত সংবিধানের আইনগত মর্যাদা লাভ করে।সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে তথা প্রশাসনিক কর্মকান্ড সুসম্পন্ন করার লড়্গ্যে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা•) মদীনা রাষ্ট্রের প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি ১৯টি স্তর বিশিষ্ট একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামো মদীনাবাসীকে উপহার দেন।


এগুলো হচ্ছে-

১• রাষ্ট্র প্রধানের ব্যক্তিগত বিভাগ।

২• সীলমোহর বিভাগ।

৩• ওহী লিখন বিভাগ।

৪• রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধি প্রেরণ বিভাগ।

৫• অনুবাদ বিভাগ।

৬• অভ্যর্থনা বিভাগ।

৭• দাওয়াহ্‌ বিভাগ।

৮• প্রতিরক্ষা বিভাগ।

৯• আল্‌-শুরতাহ বা নিরাপত্তা বিভাগ।

১০• সমরাস্ত্র তৈরি ও সংরক্ষণ বিভাগ।

১১• বিচার বিভাগ।

১২• বায়তুল মাল বা রাজস্ব বিভাগ।

১৩• যাকাত ও সাদাকাহ্‌ বিভাগ।

১৪• জনস্বাস্থ্য বিভাগ।

১৫• শিক্ষা বিভাগ।

১৬• পরিসংখ্যান বিভাগ।

১৭• নগর প্রশাসন বিভাগ।

১৮• নগর উন্নয়ন ও প্রকৌশলী বিভাগ।

১৯• স্থানীয় সরকার বিভাগ।


পরিশেষে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সামাজিক সুবিচার ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে মহানবী (সা•)-এর জীবনের এক চূড়ান্ত সফলতা। মনীষীকুল শ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মদ (সা•) ছিলেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ, আদর্শ সমাজ সংস্কারক এবং সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক। বিখ্যাত পণ্ডিত জর্জ বার্নার্ড শ’ যথার্থই বলেছেন, যদি গোটা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদ সম্পন্ন মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এক নায়কের শাসনাধীনে আনা হত, তাহলে একমাত্র মুহাম্মদ (সা•)-ই সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতা হিসেবে তাদেরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হতেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষ্য অনুসারে, তিনি হলেন বিশ্বমানবতার মহান আদর্শ এবং একমাত্র মুক্তির কান্ডারী। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনাসহ জীবনের সর্বড়্গেত্রে ও সর্ব অবস্থায় তাঁর মহত্তম আদর্শ অনুসরণ করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প নেই। মহান আলস্নাহ্‌ তা’আলা আমাদেরকে সঠিক সত্য উপলব্ধি করে তদনুসারে আমল করার তৌফিক দিন-এই কামনা করে সকলকে এ পথে ধাবিত হওয়ার আহবান জানিয়ে এখানেই আলোচনা শেষ করছি। আল্লাহ্‌ হাফেজ।


প্রফেসরড মোঃ আতাউর রহমান মিয়াজী

কুরআন ও হাদীসেপিতা-মাতার মর্যাদা


কুরআন ও হাদীসেপিতা-মাতার মর্যাদা


০“ আর তোমার প্রতিপালন এই আদেশ করেছেন যে, একমাত্র আলস্নাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। যদি তাদের একজন কিংবা উভয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদেরকে কখনোও “উহ” শব্দটি উচ্চারণ করবে না এবং তাদেরকে ধমক দিবে না। বরং তাদের সাথে সম্মানজনক ও নরম ভাষায় কথা বলবে। আর তাদের উদ্দেশ্যে বিনয়ের বাহু অবনত করে দাও। আর বলো, হে আমার প্রতিপালক! আমার পিতা-মাতা শৈশবে যেমন আমাকে লালন-পালন করেছেন, তুমি তাদের প্রতি তেমনি দয়া কর” (সুরা বনি ইসরাইল ২৩-২৪ আয়াত)।
০“তোমরা আলস্নাহর ইবাদত কর, কোন কিছুর সাথে তার শরিক করোনা এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার কর” (সুরা নিসা ৩৬ আয়াত)।
০‘হে রাসুল! বলেদিন! তোমরা যদি কিছু আর্থিকভাবে দান করে থাক তা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয় স্বজনকে করো” (সূরা বাকারা-২১৫ আয়াত)।
০রাসুল (সঃ) বলেছেন, তার নাক ধূলায় মলিন হোক (৩ বার) সাহাবীরা বললেন, আলস্নাহর রাসুল। সেই হতভাগ্য ব্যক্তিটিকে ? রাসুল (সঃ) বললেন সে হলো ঐ ব্যক্তি যে তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তাদের সেবা করে জান্নাত হাছিল করতে পারলো না” (মুসলিম)।
০“এক ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে হিজরতের উদ্দেশ্যে বাইয়াত করার জন্য নবী করিম (সঃ) -এর নিকট এসে পৌঁছলেন। রসুল (সঃ)বৈললেন, ফিরে যাও তোমার পিতা-মাতার কাছে এবং তাদেরকে খুশি করে এসো যেমনভাবে তাদেরকে কাঁদিয়ে এসেছো। (আদাবুল মুফরাদ)।
০‘হযরত আবু তোফায়েল থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুল (সঃ) কে জায়ারানা নামক স্থানে গোশত বন্টন করতে দেখলাম। এমন সময় জনৈক এক মহিলা এসে তাঁর সামনে হাজির হলো। তখন রাসুল (সাঃ) নিজের চাদর বিছিয়ে দিলে মহিলা সেই চাদরের উপর বসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কে? লোকেরা বললো উনি হলেন তার দুধ মাতা হালিমা। যিনি তাকে দুধ পান করিয়েছেন” (আবু দাউদ)।
০ হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, জনৈক এক ব্যক্তি রাসুল (সঃ) কে প্রশ্ন করলো, হে আলস্নাহর রাসুল (সঃ)! সন্তানের উপর পিতা-মাতার হক কি আছে? তিনি বললেন, তারা তোমার বেহেশত ও দোযখ। (ইবনে মাজাহ)।
সংকলণে হোসাইন আল খালদুন

বৈবাহিক সমস্যা ও কুরআনের সমাধান


বৈবাহিক সমস্যা ও কুরআনের সমাধান


স্ত্রী পেটানো কি ইসলাম সমর্থন করে­ এ প্রশ্নটি দীর্ঘকাল ধর্মপরায়ণ শিক্ষিতা মুসলিম নারীদের মনে কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিল। বিভিন্ন সময়ে সূরা নিসার এই ‘দরাবা’ সংক্রান্ত ৩৪ নম্বর আয়াতটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা এসেছে। কোনো কোনো ইসলামি চিন্তাবিদ একে ‘চল্লিশ ঘা’ আবার কেউ কেউ ‘মৃদু আঘাত’ বলেছেন। কিন্তু সব ক’টি ব্যাখ্যার সাথেই শারীরিক আঘাত জড়িত রয়ে গেছে। ফলে এর একটি সুস্পষ্ট প্রভাব আমাদের সমাজে দেখা যায়। কারণে-অকারণে স্ত্রীকে আঘাত করা তাই অনেক মুসলিম পুরুষই তাদের অধিকার মনে করেন। অনেকে আবার একটু আগ বাড়িয়ে স্ত্রীকে পিটিয়ে শাসন করাকে নিজ পবিত্র দায়িত্ব মনে করেন। শরীরের আঘাত শুধু শরীরের সাথেই সম্পর্কিত থাকে না, তা মনের সাথেও গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। শারীরিক আঘাত কম হোক বা বেশি হোক তা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন যেকোনো নারীর মনেই কঠিন অপমানবোধ সৃষ্টি করে। এমনকি তা ওই নারীর পুরুষ আত্মীয়দের মনেও কষ্ট দেয়। কাজেই বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ আব্দুল হামিদ আবু সুলেমান বলেছেন, সূরা নিসায় ব্যবহৃত ‘দরাবা’ শব্দটির অর্থ ‘পেটানো’, ‘প্রহার’, এমনকি ‘মৃদু আঘাত’ হিসেবেও নেয়ার অবকাশ নেই। তিনি তার Marital Discord : Recapturing the Full Islamic Spirit of Human Dignity বইতে বোঝাতে চেয়েছেন­ আরবি অভিধানে ‘দরাবা’ শব্দটির অনেক অর্থ রয়েছে; সে ক্ষেত্রে অন্য সব অর্থ বাদ দিয়ে স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘পেটানো’ বা ‘আঘাত করা’ অর্থটি গ্রহণ করা কতটা যুক্তিযুক্ত, বিশেষ করে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে, তা ভেবে দেখতে হবে।
সূরা নিসার ৩৪ ও ৩৫ নম্বর আয়াতকে (যাতে এই শাস্তির ব্যাপারটি বিধৃত হয়েছে) বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এ আয়াতের ব্যাখ্যার সময় কুরআনের অন্যান্য আয়াত বিশেষ করে সূরা রুমের ২১ নম্বর আয়াত যেখানে আল্লাহ পারস্পরিক দয়া ও ভালোবাসাকে বিয়ের উদ্দেশ্য হিসেবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তা বিবেচনায় আনতে হবে। ‘আরেক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ [আর রুম­২১]। শুধু বিয়ের ক্ষেত্রে নয়, এমনকি বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকের সময়ও নারীকে অসম্মান করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। ‘আর যখন তোমরা স্ত্রীদের তালাক দিয়ে দাও, অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়, তখন তোমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদের রেখে দাও অথবা সহানুভূতির সাথে তাদের মুক্ত করে দাও। আর তোমরা তাদের জ্বালাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্য আটকে রেখো না। আর যারা এমন করবে, নিশ্চয়ই তারা নিজেদের ক্ষতি করবে।’ [বাকারা-২৩১]। যেখানে ইসলামে বিয়ের ভিত্তি সম্প্রীতি ও দয়া এবং এই বিয়ের সমাপ্তিতেও নারীর প্রতি সহানুভূতি ও সম্মানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বিবাহকালীন সম্পর্ক ধরে রাখার মাধ্যম হিসেবে আঘাত ও মানসিক যন্ত্রণাকে ব্যবহার করা ঠিক সামঞ্জস্যশীল মনে হয় না।
বর্তমানে পরিবারে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে; নারীরা অনেকাংশে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছে। কাজেই বর্তমান সময়ে পরিবারের কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বা স্বামী-স্ত্রীর কোনো বিরোধ নিরসনে পরিবারের এই কাঠামোকে বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পারিবারিক এ প্রেক্ষাপটে আমাদের ভাবতে হবে শারীরিক আঘাতের মাধ্যমে কি একটি পারিবারকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা যায়? ইসলাম যেখানে স্বামীর নির্যাতনমূলক আচরণের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে বৈবাহিক সম্পর্ক অবসানের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দিয়েছে সেখানে এরূপ শারীরিক আঘাত ও দমন কি স্ত্রীকে আরো বেশি তালাক বা খুলার দিকে ঠেলে দেবে না? আর যদি তা-ই হয়, তবে কি এ ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ, দমন বা আঘাতের কোনো সুযোগ রয়েছে, যা পরিবারকে পুনর্গঠনের পরিবর্তে বরং ভাঙার দিকে আরো ঠেলে দেবে?
কুরআনকে কুরআন দিয়েই ব্যাখ্যা করা সর্বাপেক্ষা উত্তম উপায়। কুরআনের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা হলো সেটি, যা এই আল্লাহর বাণী কুরআন দিয়ে করা হয় এবং শরিয়াহ্‌র সাধারণ মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়। আল কুরআনে দরাবা শব্দটির বিবিধ ব্যবহার লক্ষ করলে এর প্রায় ১৭টি অর্থ পাওয়া যায়। নিুলিখিত আয়াতগুলোতে বিভিন্নভাবে দরাবা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
আল্লাহ আর একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন (১৬:৭৬, ১১২); দেখ তারা তোমার কী উপমা দেয়। তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা পথ পাবে না। (১৭:৪৮); তাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, (৩:১১২);তখন কী অবস্থা হবে যখন ফেরেশতাগণ তাদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে? (৪৭ঃ২৭); সুতরাং আল্লাহর কোনো সাদৃশ্য স্থাপন করো না। আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না। (১৬ঃ৭৪); তোমরা যখন জমিনে সফরে বের হতে (৪ঃ১০১); তখন আমরা তাদের শ্রবণশক্তির ওপর পর্দা টেনে দিলাম... (১৮:১১); তোমরা সীমা অতিক্রমকারী সম্প্রদায়­ এ কারণে কি আমি তোমাদের কাছ থেকে কুরআন প্রত্যাহার করে নেব? (৪৩ঃ৫); তারা নিজেদের বক্ষদেশের ওপর চাদর টেনে রাখবে... এবং তারা জমিনে সজোরে আঘাত করে চলাফেরা করবে না। (২৪:৩১);... আমার বান্দাদের নিয়ে রাত্রিযোগে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্ক পথ তৈরি করো... (২০:৭৭); আল্লাহপাক নিঃসন্দেহে মশা বা তদূর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। (২:২৬) ... আর তাদের ওপর আরোপ করা হলো/চেপে বসল লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। তারা আল্লাহর রোষানলে পতিত হয়ে ঘুরতে লাগল। (২:৬১); অতঃপর সে প্রবল আঘাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। (৩৭:৯৩)
যদি আমরা কুরআনের এই আয়াতগুলো বিশ্লেষণ করি তবে দেখব যে ‘দরাবা’-এর অনেক আক্ষরিক ও রূপক অর্থ রয়েছে। এর অর্থ হতে পারে পৃথক করা, বিচ্ছিন্ন করা, আলাদা করা, প্রস্থান করা, ছেড়ে যাওয়া, দূরত্ব সৃষ্টি করা, বাদ দেয়া, দূরে সরে যাওয়া ইত্যাদি। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর সাথে যুক্ত হলে দরাবা সেই অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। কাজেই প্রশ্ন হলো দরাবা যখন বৈবাহিক সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রীর আবার মিলন ঘটানো ও তাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টির পন্থা হিসেবে বিবেচিত হবে তখন এর কোন অর্থটি সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত হতে পারে?
‘...যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা করো, [প্রথমে] তাদের সদুপদেশ দাও, [তারপর] তাদের শয্যা ত্যাগ করো এবং [শেষে] দরাবা করো; কিন্তু যদি তারা বাধ্যতায় ফিরে আসে তবে আর তাদের জন্য কোনো পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মতো পরিস্থিতিরই আশঙ্কা করো, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে।’ [নিসাঃ ৩৪,৩৫]। পটভূমি বিবেচনা করলে বোঝা যায় যে, এই আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মিলন ঘটানো ও পুনঃসম্পর্ক স্থাপন করা। কিন্তু চাপ প্রয়োগ করা বা শারীরিক আঘাত কখনোই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করতে ও বজায় রাখতে সহায়ক হয় না। এটি তাদের সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধিতে বা পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টিতে কোনোভাবেই সহায়ক ভূমিকা রাখে না। বরং এটি মিলন ঘটানোর পরিবর্তে বিচ্ছেদের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। কেননা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই এই সম্পর্ক অবসানের সুযোগ ও অধিকার ইসলামে রয়েছে। কাজেই দরাবার অর্থ ‘প্রহার করা’ হতে পারে না, যা দ্বারা মানুষ আহত হবে, কষ্ট পাবে বা অপমানিত হবে ও সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটবে।
সূরা নিসার ৩৪-৩৫ নম্বর আয়াতকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় স্ত্রীর নুশুজের কারণে বৈবাহিক সম্পর্কে অবনতি ঘটলে স্বামী-স্ত্রীর পুনঃসম্পর্ক স্থাপনের জন্য চারটি ধাপের উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পদক্ষেপগুলো হলো­
১. প্রথমে স্বামী-স্ত্রীকে মৌখিকভাবে বোঝাবেন,
২. তারপর স্ত্রী থেকে বিছানা পৃথক করবেন,
৩. এরপর দরাবা করবেন,
৪. যখন স্বামীর এই তিনটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে তখন স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই নিজ নিজ পরিবার থেকে একজন করে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করবেন, যারা তাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করবে, তাদের উপদেশ দেবে। আল কুরআনের এই সব ক’টি উপদেশেরই মূল উদ্দেশ্য হলো কার্যকরভাবে গঠনমূলক পন্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এবং এ প্রতিটি ধাপেই স্ত্রীর বিবেক ও যুক্তিবোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যখন স্ত্রী (স্বামী ও সংসারের প্রতি) প্রকাশ্য অবজ্ঞা, উপেক্ষা বা অবহেলা প্রদর্শন করে (নুশুজ) তখন আল কুরআন স্বামীকে আদেশ করেছে স্ত্রীকে উপদেশ দিতে, অনুরোধ ও অনুনয় করতে এবং প্রয়োজনে ভর্ৎসনা করতে। এর মাধ্যমে স্বামী তার কথা ও চিন্তাগুলো স্ত্রীকে বলতে ও বোঝাতে পারবে। এ যোগাযোগের মাধ্যমে দু’জনের ভেতরকার পার্থক্যগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে, সম্ভাব্য সমাধানগুলো বের হয়ে আসবে এবং স্ত্রীর মধ্যে বিবেক ও যুুক্তিবোধ বা কাণ্ডজ্ঞান Reason and rationality) জেগে উঠবে।

যদি স্ত্রী তার নিজের অজ্ঞতা বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার কারণে এ ধরনের উপদেশে কোনো কর্ণপাত না করে তখন স্বামীকে আরেক ধাপ সামনে এগোতে হবে। এমতাবস্থায় সে স্ত্রীর সাথে একই বিছানায় না থেকে বরং বিছানা পৃথক করবে। স্ত্রীর প্রতি এ অবহেলা বা আগ্রহের অভাব (Lack of interest) দেখালে স্ত্রী সমস্যার গভীরতা ও এর পরিণামের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারবে। এর ফলে স্ত্রীও একটি সুযোগ পাবে তার নিজের বিরোধী প্রতিকূল আচরণ পরিত্যাগ করার ও পুরো ব্যাপারটি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও স্ত্রীর বিবেক ও যুুক্তিবোধকে জাগ্রত করার আরো এক ধাপ বেশি চেষ্টা করা হয়েছে। এ উদ্যোগও ব্যর্থ হলে পরবর্তী ধাপ হিসেবে এসেছে দরাবা। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের ভাবতে হবে দরাবার অর্থ কি ‘আঘাত করা’, ‘প্রহার করা’ বা ‘শারীরিক শাস্তি প্রদান করা’ হবে­ যা স্ত্রীর বিবেক ও যুুক্তিবোধকে জাগ্রত করার পরিবর্তে কষ্ট, ব্যথা ও অপমানের জন্ম দেবে? তা ছাড়া দরাবার পরে আরো একটি ধাপ রয়েছে, তা হলো দুই পরিবার থেকে একজন করে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করা। তৃতীয় ধাপেই যদি ‘প্রহার’ করে স্বামী স্ত্রীর মনকে বিরূপ করে তোলে তবে চতুর্থ ধাপটির বাস্তবপক্ষে আর কোনো কার্যকারিতা থাকে না। অর্থাৎ স্ত্রী বা স্ত্রীর পরিবারের কেউ এ পরিস্থিতিতে অনুকূল বা সমঝোতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে না। কাজেই ধারাবাহিকতার বিবেচনায়ও দরাবার অর্থ ‘প্রহার করা’ হয় না। বরং দরাবার অর্থ এমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, যা দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধাপের মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।
দরাবা সম্পর্কিত উপরিউক্ত বিশ্লেষণ রাসূল সাঃ-এর হাদিস ও তার আচরণের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূল সাঃ-এর স্ত্রীগণ জীবনযাত্রার মান কিছুটা বাড়ানোর দাবি করেছিলেন রাসূল সাঃ-এর কাছে। জীবনযাত্রার মান উন্নতকরণের দাবি পূরণ করতে না পারায় তারা যখন বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন, তখন রাসূল সাঃ তার স্ত্রীদের থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। এ পরিস্থিতিতে এক মাসের জন্য তিনি ‘আল মাশরাবাহ’র (আলাদা থাকা) আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাদের এ সুযোগ দিয়েছিলেন যে, তারা ইচ্ছা করলে রাসূল সাঃ-এর যতটুকু সামর্থ রয়েছে সে অনুযায়ী জীবনযাত্রার মান মেনে নিয়ে থাকতে পারে অথবা ইচ্ছে করলে বিবাহের সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিতে পারে এবং সম্মানের সাথে আলাদা হয়ে যেতে পারে। অন্য একটি হাদিসে উল্লেখ আছে যে, হজরত মুহাম্মদ সাঃ একজন ব্যক্তিকে কঠিনভাবে ভর্ৎসনা করেছিলেন। কারণ সে তার স্ত্রীকে পিটিয়েছিল। যে তার স্ত্রীকে ভৃত্যের মতো পেটায় আবার তার সাথে শুতে লজ্জাবোধ করে না। [বুখারি]। মুসলিম শরিফে উল্লেখ আছে যে, আল্লাহর পথে জিহাদ ব্যতীত মুহাম্মদ সাঃ কোনো নারী, ভৃত্য অথবা কোনো ব্যক্তির ওপর কখনো হাত তোলেননি। এমনকি যুদ্ধকালীন অবস্থায়ও শত্রুপক্ষের নিরীহ নারীদের প্রতি আঘাত করা নিষিদ্ধ ছিল। রাসূল সাঃ আরো বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের নির্যাতনের ব্যাপারে রাসূলের পরিবারের কাছে শোক প্রকাশ করতে আসেন। এই নির্যাতনকারী স্বামীরা কখনোই উত্তমদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ [আবু দাউদ]
তা ছাড়া এটাও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, কুরআনের অন্য স্থানে শারীরিক শাস্তি বোঝানোর জন্য দরাবা শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। বরং কুরআন এ ক্ষেত্রে যে শব্দটি ব্যবহার করেছে তা হলো ‘জালাদা’­ কশাঘাত/বেত্রাঘাত/প্রহার করা। যেমন­ সূরা আন নূরে বেত্রাঘাত বোঝাতে ‘জালাদা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিাচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে ১০০ করে বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি তোমাদের মনে যেন দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ [ সুরা আন-নূরঃ ২]
উপরি উক্ত আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট যে, নুশুজ (স্বামী ও সংসারের প্রতি প্রকাশ্য অবজ্ঞা, উপেক্ষা, অবহেলা) বা বিবাদের ফলে বৈবাহিক সম্পর্কে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে কুরআন যে ‘দরাবা’র কথা বলেছে তার সঠিক অর্থ হবে স্ত্রী থেকে ‘দূরে সরে যাওয়া’, স্ত্রী থেকে ‘দূরত্ব সৃষ্টি করা’ এবং ঘর থেকে ‘চলে যাওয়া’, যাতে স্ত্রীর যুক্তিবোধ জাগ্রত হয় বা সে তার আচরণের অন্যায্যতা ও এর সম্ভাব্য পরিণাম উপলদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ স্ত্রীর নুশুজের কারণে বৈবাহিক সম্পর্কে অবনতি ঘটলে প্রথমে স্বামী স্ত্রীকে মৌখিকভাবে বোঝাবেন, তারপর স্ত্রী থেকে বিছানা পৃথক করবেন, এরপর স্ত্রী থেকে দূরে সরে গিয়ে পৃথক বসবাস করবেন এবং সবশেষে নিজ নিজ পরিবার থেকে একজন করে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করবেন যারা, তাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করবে, তাদের উপদেশ দেবে। দরাবার এই অর্থটি দৈহিক আঘাত ও মানসিক যন্ত্রনা দান অপেক্ষা এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য, যুক্তিসঙ্গত ও কুরআনের বাচনভঙ্গির সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। আব্দুল হামিদ আবু সুলেমানের এই ব্যাখ্যাটি একদিকে যেমন সুযোগসন্ধানী কিছু পুরুষের স্ত্রী নির্যাতনের সব পথ বন্ধ করে দেয় তেমনি ইসলামের ছিদ্রান্বেষীদের ‘ইসলাম নারী নির্যাতন সমর্থন করে’­ এই চিরায়ত অপবাদের পথও রুদ্ধ করে। এ ব্যাখ্যাটি নারীদের প্রতি ইসলামের সম্মানসূচক দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি স্বাক্ষর বহন করে। কাজেই এটা সময়ের দাবি যে, মুসলমানরা ‘দরাবার’ এই ব্যাখ্যাটি জানবেন ও বিবেচনায় আনবেন।


কানিজ ফাতিমা
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব


ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব


এ পৃথিবীতে ১ লাখ বা ২ লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বর বা নবী রাসূল এসেছেন। তারা স্বজাতির মাতৃভাষায় কথা বলতেন। তাদের প্রতি নাজিলকৃত আসমানি কিতাব ও ছহিফাগুলো স্বীয় মাতৃভাষায় প্রচার করতেন। আল্লাহপাক কুরআনে উল্লেখ করেছেনঃ আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি যাতে তাদের পরিষ্কার করে বুঝাতে পারে। (সূরা ইব্রাহিমঃ আয়াতঃ ৪)। হাদিস শরিফ থেকে প্রমাণিত হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহপাক পয়গম্বরেরগণের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন সেগুলোর আসল ভাষা ছিল আরবি জিব্রাঈল আঃ তার নিজ নিজ পয়গম্বরের জাতীয় ভাষায় অনুবাদ করে নবী রাসূলগণের কাছে পৌঁছাতেন। যেমন তাওরাত, জাবুর, ইনজিল প্রভৃতি কিতাব কোনোটা ইবরানি, কোনোটা হিব্রু, কোনোটা সুরিয়ানি বা ইউনানি ভাষায় রূপান্তরিত করে নবী-রাসূলগণ তাদের মাতৃভাষায় বা স্বজাতীয় ভাষায় বুঝাতেন। এতে বোঝা গেল যে, প্রত্যেক নবী-রাসূলই আপন জাতির মাতৃভাষায় আসমানি গ্রন্থাবলির নির্দেশিকা প্রচার করতেন। মূলত পয়গম্বরদের ইসলাম প্রচারের মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা।
বিশ্বনবীর মাতৃভাষায় ইসলাম প্রচারঃ আমাদের সর্বশেষ প্রিয়নবী বিশ্বনবীর মাতৃভাষা ছিল আরবি। আর সর্বশেষ আসমানিগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে প্রিয়নবীর মাতৃভাষাতেই। অতঃপর তিনি মাতৃভাষাতেই কুরআনের বাণী প্রচার করে জগৎকে আলোকিত করেছেন।
আল্লাহ পাক নবীজীর মাতৃভাষাতে কুরআন নাজিল করে তা সহজ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অতঃপর আমরা এ কুরআনকে তোমার মাতৃভাষায় সহজ করে দিয়েছি। যাতে মুত্তাকিদেরকে এর (বেহেশতের) সুসংবাদ দিতে পার আর এর সাহায্যে কলহে লিপ্ত জাতিকে (দোজখের) ভয় দেখাতে পারো। (সূরা মারইয়ামঃ আয়াত-৯৭) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, এটা রুহুল আমিন-জিব্রাইলের মাধ্যমে আপনার অন্তকরণে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। যাতে ভয় প্রদর্শনকারী হতে পারো। (সূরা শুয়ারাঃ আয়াত ১১৩-১১৫)।
বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারঃ রাসূল সাঃ আরবে মাতৃভাষার মাধ্যমে ইসলামকে প্রসারিত করে কুরআনের ভাষা আরবি ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হন। আমাদের এ ভারতীয় উপমহাদেশেও ইসলাম প্রচারক উলামায়ে কেরামগণ যারা ইসলামের বাণী প্রচার করতে এসেছিলেন, তারাও আরবি ভাষাকেই এ দেশের মাতৃভাষায় রূপান্তর করে আমাদের পূর্বপুরুষদের ইসলামে দীক্ষিত করে তুলেছিলেন। এ দেশে ইংরেজদের আগমনে আগে মুসলমানরা প্রায় ৭০০ বছর পর্যন্ত শাসন করে শিক্ষাসভ্যতা প্রবর্তন করেছিলেন। এ উপমহাদেশে ফার্সি, উর্দু, বাংলা ভাষায় কুরআন, হাদিসের প্রচুর গবেষণা ও বই পুস্তক রচনা করা হয়। আরবি ভাষার কুরআন ও হাদিসের বাণী এ দেশের মাতৃভাষার মাধ্যমে ব্যাপক চর্চার ফলে এখানকার মানুষের মধ্যে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বাংলা ভাষায় কুরআন তাফসির, হাদিস ও অন্যান্য বিষয়ের যে বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে তাতে মাতৃভাষায় যে গুরুত্ব বহন করে তা অবাক করার মতো। বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আধুনিক প্রকাশনীসহ অসংখ্য প্রকাশনা সংস্থা মাতৃভাষায় যে সব কিতাবাদি বই পুস্তক রচনা ও অনুবাদ করেছে তা সত্যিই অতুলনীয়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা এ দেশে এক যুগান্তকারী অধ্যায় সূচিত করেছে। সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চা এটা এক বিরাট অবদান।
বাংলা ভাষা তথা আমাদের মাতৃভাষা আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন এ ভাষাতে ইসলাম চর্চা আরো ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হবে। ইসলাম যেমন আরবীয় মরু অঞ্চল পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল ঠিক তেমনি বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষার মাধ্যমে আমরা ইসলামের চর্চাকে আরো বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হবো।
অধ্যাপক মাওলানা মোঃ শফিকুর রহমান

শুক্রবার সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর ঘোষণা


শুক্রবার সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর ঘোষণা


শুক্রবার হলো সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। এটি মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদ। সাপ্তাহিক সমাবেশ। হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য। এটি সমাজের মিলনগাহ। এ দিবসে আছে জুমার নামাজ ও খুতবা। এ নামাজ ও খুতবাই হলো এ দিবসের মূল প্রাণপ্রবাহ। একে ঘিরেই এ দিবসের প্রাণময়তা ও কর্মচঞ্চলতা আলোড়িত হয়েছে। এটি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক গৌরবময় সংস্কৃতি। এ দিবসে এমন একটি সময় আল্লাহ রেখে দিয়েছেন, যা দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ মুহূর্ত। আর এটি হচ্ছে­ জুমার খুতবা ও নামাজ। তাই এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী।
জুমার নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরে আল্লাহ বলেন­ হে মুমিনরা! শুক্রবার দিন যখন নামাজের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে (খুতবা ও নামাজের) পানে ছুটে আসো এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। যদি তোমরা বুঝতে পারো (সূরা জুমা)। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাঃ বলেছেন­ তোমরা জুমার নামাজে হাজির হও এবং ইমামের কাছে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো। (মুসনাদে আহমদ)। এ নামাজের মর্যাদা তুলে ধরে রাসূল সাঃ বলেছেন­ যে ব্যক্তি জুমার নামাজে মসজিদে যায়, তার প্রতিটি কদমে কদমে এক বছর নফল রোজা রাখার সওয়াব লেখা হয়। তিনি আরো বলেছেন­ যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করবে, মসজিদে গিয়ে নফল সুন্নাত নামাজ পড়বে, খুতবা শুনবে ও ইমামের সাথে নামাজ আদায় করবে, দুই জুমার মধ্যবর্তী দিবসে ও তার পরবর্তী তিন দিনের গোনা মাফ হয়ে যায়। তাই তো রাসূল সাঃ জোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন­ হে মুমিনগণ! এ দিন আল্লাহ তোমাদের ঈদ বানিয়েছেন। কাজেই এই দিনে গোসল ও মিসওয়াক করা তোমাদের কর্তব্য। (আল মুজাম, আস সগির, তাবারানি)। এ নামাজের বরকত ও ফজিলত পেতে হলে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার। তাই শুক্রবার দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
আল্লাহ পাক তার বান্দাদের কল্যাণে সম্মিলিতভাবে ইবাদতের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আর তা হলো শুক্রবার। কিন্তু ইহুদিরা তা পরিবর্তন করে শনিবার করে, খ্রিষ্টানরা পরের দিন রোববার করে। (বোখারি ও মুসলিম)। আল্লাহ পাক এ জাতিকে তাওফিক দিয়েছেন, তারা শুক্রবারকে ইবাদতের দিন বহাল রেখেছেন। (ইবনে কাসির)। সুতরাং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ইবাদতের দিন, ঈদের দিন, ছুটির দিন শুক্রবারের পরিবর্তে শনিবার কিংবা রোববার করা আল্লাহর সিদ্ধান্তের পরিপন্থী।
জুমার নামাজ সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা আনয়নের অন্যতম সোপান। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং একে অপরের সাথে ভাববিনিময় করার এটি প্রধান সেতুবন্ধ। ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা এক কাতারে শামিল হলে মনে হয় এ জগৎটাই শান্তিময় গ্রহে পরিণত হয়েছে। নামাজের আগে যে খুতবা দেয়া হয়, তাতে কুরআন ও সুন্নাহর অমীয় বাণী ধারাবাহিকভাবে শিক্ষা দেয়া হয়। এ শিক্ষার আলোকেই মানুষ সচ্চরিত্রবান হওয়ার সুযোগ পায়। এটি সুনাগরিক তৈরির সুন্দরতম শিক্ষামঞ্চ। খুতবার দিকনির্দেশনা শুধু আদর্শিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। চলমান সমস্যা-সমাধান নিয়ে আলোচনা হয়। গঠনমূলক ও কল্যাণধর্মী যেকোনো সরকারি কর্মবার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার এটি একটি অতি দ্রুত প্রচারমাধ্যম। মাদকাসক্তি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও রাখা হয় জোরালো ভূমিকা।
গত এক দশকজুড়ে আমাদের দেশে বোমাবাজির উত্থান ঘটে। পরিকল্পিতভাবে জঙ্গিবাদের নামে বোমাবাজি শুরু হয়। ১৭ আগস্ট ২০০৫ তারিখে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা বিস্ফোরিত হলে দেশ ও জাতি চরমভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। এমনি এক সঙ্কট সন্ধিক্ষণে ৯ ডিসেম্বর ২০০৫ তারিখে দেশের সব মসজিদ থেকে একযোগে বোমাবাজদের বিরুদ্ধে জুমার খুতবায় বক্তব্য দেয়া হয়। খুতবায় দেশের সব নাগরিককে সতর্ক থাকতে বলা হয়, যাতে বোমাবাজরা কোথাও পালাতে না পারে। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই জেএমবি নামক বোমাবাজদের পতন শুরু হয়। দেশ ও জাতি মুক্ত হয় এ সঙ্কট থেকে। তাই জুমার নামাজ ও খুতবা জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ অপার সম্ভাবনার দুয়ারকে অনর্গলমুক্ত রেখে দেশের সর্বস্তরের উন্নয়নের প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টির জন্য জুমার দিন ছুটি ঘোষণা বহাল রাখা বাস্তবসম্মত।
জুমার দিন আজানের পর বেচাকেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জুমার নামাজে উপস্থিত হতে বাধাগ্রস্ত করে এমন যেকোনো কাজকর্ম করা নিষিদ্ধ। তাই মুসলিম বিশ্বে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন বহাল রাখা হয়েছে। এমনকি আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) কার্যকরী সিদ্ধান্তে রোববারের পরিবর্তে শুক্রবারকে ছুটির দিন বলবত রাখে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান ছাড়া সব মুসলিম রাষ্ট্র এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। যেসব দেশে শুক্রবার ছুটি রয়েছে, সেসব দেশে আমদানি-রফতানির কোনো ক্ষতি হয়েছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত কারো কাছে নেই। এমনকি আমাদের দেশেও নয়।
সম্প্রতি আমাদের দেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ব্যাংক-বীমার লেনদেনের অজুহাত তুলে পশ্চিমা দেশের সাথে তাল মিলিয়ে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবারের পরিবর্তে রোববার করার দাবি তুলছে, যা অযৌক্তিক। শনিবার বা রোববার যদি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কারণে পশ্চিমা দেশের সাপ্তাহিক ছুটি হয়, তবে আমাদের দেশে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি রাখতে আপত্তি কোথায়। জুমার দিন আজান হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ এবং নামাজ শেষ হলে রিজিক অন্বেষণে জমিনে ছড়িয়ে পড়তে বলা হয়েছে, কুরআনের এ ঘোষণায় কিছু নামধারী আলেম এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলছেন শুক্রবার ছুটি থাকলে রিজিক অন্বেষণে বাধার সৃষ্টি হয়, তাই শুক্রবার কর্মদিবস রাখা উচিত। এসব আলেম স্বল্পজ্ঞানের কারণে হয়তো আয়াতের আসল মর্মার্থ বোঝেনি। অথবা ইচ্ছে করে খ্রিষ্টান জগৎকে খুশি করার উদ্দেশ্যে তারা শুক্রবারকে কর্মদিবস করার পক্ষালম্বন করছেন। জুমার দিন আজান হলে বেচাকেনা নিষিদ্ধ বলতে নামাজে যেতে বাধাগ্রস্ত করে এমন যেকোনো কাজ বন্ধ রাখা। আর নামাজ শেষ হলে রিজিকের জন্য জমিনে ছড়িয়ে পড়ো বলতে কাজকর্ম করার নিষেধাজ্ঞাটি তুলে নেয়া।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকা সত্ত্বেও তারা আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে নেই। বরং আর্থিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে উন্নতির সোপানে এগিয়ে চলেছে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি এটা কুরআন-সুন্নাহর ঘোষণা। কুরআন-সুন্নাহর এ ঘোষণা লঙ্ঘন করে শুক্রবারের পরিবর্তে রোববারকে নির্ধারণ করা মোটেই কল্যাণকর হবে না। পরিশেষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী শেখ হাসিনার গত ২৭ ডিসেম্বর ২০০৮-এ নির্বাচন পূর্ব ভাষণ উল্লেখ করে আমার লেখনীর ইতি টানতে চাই, তিনি সে দিন জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘ক্ষমতায় গেলে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিনি তার এ কথা রক্ষা করবেন এটাই ৯০ ভাগ মুসলমান আশা করছে।
মাওলানা মিনহাজুল ইসলাম

সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত সালাত


সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত সালাত


ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সালাত বা নামাজ তার মধ্যে অন্যতম এবং ইবাদতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই পবিত্র কুরআনে ৮২ জায়গায় সালাত কায়েম করার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। ইসলামে সালাতের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমনি আল্লাহ পাকের রহমত এবং ইহ-পরোকালের মুক্তিলাভের প্রধান অবলম্বন হিসেবে সালাতের বৈশিষ্ট্য তাৎপর্যবহ।
আমরা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে থাকি। এই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মধ্যে ১৭ রাকাত ফরজ সালাত আল্লাহ পাক নির্ধারিত করে দিয়েছেন। ইবাদতের ক্ষেত্রে ফরজ সালাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি আল্লাহ পাকের হুকুম। সালাত (নামাজ) প্রধানত চার প্রকার। ফরজ, সুন্নাত, ওয়াজিব ও নফল। স্বয়ং আল্লাহ পাক যে সালাত আদায় করতে বলেছেন, তাই ফরজ সালাত। ফরজ সালাত আবার দুই প্রকার­ ফরজে আইন ও ফরজে কেফায়া। ফরজ সালাত প্রত্যেক মুসলমানের জন্য সমানভাবে ফরজ। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও জুমার সালাত। ফরজে কেফায়া প্রত্যেকের ওপর সমান ফরজ হলেও তা একটি এলাকায় সবার পক্ষে কিছুসংখ্যক লোক আদায় করলে এই ফরজে কেফায়া আদায় হয়ে যায়। যেমন জানাজার সালাত। সুন্নাত সালাত আবার দুই প্রকার­ সুন্নাতে মোয়াক্কাদা ও সুন্নাতে জায়েদা।
ওয়াজিব সালাত হচ্ছে­ দুই ঈদের সালাত ও বিতরের সালাত। নফল সালাত আদায় করার মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত সাওয়াব অর্জনের স্বীকৃতি। প্রকৃতপক্ষে বেশি বেশি নফল ইবাদতের মাধ্যমেই আমরা আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। মাকরুহ সময় ছাড়া অন্য যেকোনো সময় নফল সালাত আদায়কালে অশেষ রহমত, বরকত ও নেয়ামত পাওয়া যায়।
তারাবির সালাত আদায় করার মধ্যে রয়েছে অনেক ফজিলত। হজরত রাসূলে পাক সাঃ এরশাদ করেছেনঃ যে ব্যক্তি ঈমানের অনুভূতিসহ আখিরাতের প্রতিদান নাজাতের উদ্দেশ্যে রমজানের রাতগুলোতে তারাবিহ পড়বে আল্লাহপাক পরওয়ারদেগার তার কৃত সব গুনাহরাশি ক্ষমা করে দেবেন। এতদ্ব্যতীত সালাতের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেনঃ সালাত কঠিন কাজ। তবে ওই সব লোকের প্রতি নয় যারা ভয়ভীতির সাথে সালাত আদায় করে এবং মনে করে যে, তারা আখিরাতে আল্লাহর সামনে হাজির হবে এবং প্রত্যাবর্তন করবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন, সেই সব সালাত (নামাজ) আদায়কারীদের জন্য সর্বনাশ। যারা নিজ নিজ সালাত সম্পর্কে উদাসীন এবং যে বা যারা মানুষকে দেখানোর জন্য সালাত (নামাজ) পড়ে।
সালাত (নামাজ) ইসলামের দ্বিতীয় রোকন এবং ইবাদতসমূহের মধ্যে সালাতের স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। তাই সালাতের গুরুত্ব মরতবা বর্ণনা করে শেষ করে যায় না। সালাত আমাদের জন্য আল্লাহ পাকের বড় একটি রহমত, বরকত ও নেয়ামত। মহান পাক পরওয়ারদেগারের সামনে হাজির হওয়ার জন্য বড় মাধ্যম। হজরত রাসূলে পাক সাঃ বলেছেন, আসসালাতু মিরাজুল মুমিনিন। অর্থাৎ সালাত মুমিনদের জন্য মেরাজ। শুধু গুনাহ খাতা মুক্তিই নয়। যেকোনো কঠিন থেকে কঠিনতম সমস্যাসঙ্কুল বালা মুসিবতে আপতিত হলে সালাতের মাধ্যমে কায়মনে আল্লাহপাক পরওয়ারদেগারের কাছে ফরিয়াদ মুনাজাত করলে মুক্তি নাজাত লাভ করা যায়। এ জন্য সালাতুল হাজতও পড়ার বিধান রয়েছে। আখিরাতে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে সালাত। এই পবিত্র সালাতের মাধ্যমেই এক কাতারে শামিল হয়ে আমরা শ্রেণী বৈষম্য ভুলে যাই এবং স্ব স্ব দেহমন পরিশুদ্ধ হয়। অতএব আসুন, আমাদের চলমান জীবনে আল্লাহর নৈকট্য, সন্তুষ্টি, রহমত, বরকত, নেয়ামত ও নাজাত লাভে সালাতের মাধ্যমে নিজেদের একাকার করে দুনিয়া ও আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করি এবং আল্লাহর মকবুল বান্দা হিসেবে সমর্পিতচিত্তে রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাজির হই আল্লাহ পাক আপনার আমার ও সব মুমিন মুসলমানের সালাত কবুল করুন।
মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার

শনিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

ধর্ম ও আদর্শের প্রশ্নে আশা-আকাঙ্ক্ষার সমর্থনে

ধর্ম ও আদর্শের প্রশ্নে আশা-আকাঙ্ক্ষার সমর্থনে



বিশ শতকের প্রথম পাদে বাঙালি মুসলমান সমাজে ধর্মজিজ্ঞাসা প্রবল হয়েছিল। তৎকালীন মাদ্রাসা-শিক্ষিত আলেম-সমাজ যেভাবে ইসলাম ও মুসলমানের কর্তব্য সম্পর্কে মত ব্যক্ত করতেন, তা নিয়ে নতুন ইংরেজি-শিক্ষিত লোকেরা সন্তুষ্ট হতেন না। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানের কর্তব্য বিষয়ক নানা প্রশ্নে তুমুল বিতর্ক দেখা দেয়। এর মধ্যে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অল্প দিনের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বিতর্কটি ঘনীভূত রূপ নেয়। নব্যশিক্ষিতদের পক্ষ থেকে তখন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে আন্দোলন পরিচালনা করা হয়েছিল। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কালে এই আন্দোলনের কার্যক্রম চলে। নব্যশিক্ষিতেরা ক্রমে সংখ্যায় ও চিন্তাশক্তিতে বড় হতে থাকেন। পাকিস্তান-আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচি, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ­ এ সবই ঘটেছে নব্যশিক্ষিতদের দিয়ে। মুসলিম লীগ ধর্মের ব্যাপারে সুবিধাবাদী ভূমিকা নিয়ে এগিয়েছিল এবং পাকিস্তান-আন্দোলন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেই অত্যন্ত রক্ষণশীল ভূমিকা নেয়, ফলে নব্যশিক্ষিতদের বিকাশমান ধারা থেকে পিছিয়ে পড়ে। প্রাচীনপন্থীরা তত দিনে অতীতের গর্ভে বিলীন হয়। নব্যশিক্ষিতরা এগিয়েছিলেন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি আদর্শকে অবলম্বন করে। প্রাচীনপন্থীরা ছিলেন ইসলামের অতীতমুখী ব্যাখ্যা নিয়ে। দুই পক্ষের মধ্যে স্বার্থের সঙ্ঘাতও ছিল। মুসলিম লীগ ব্রিটিশ-শাসনের শেষ দিকটায় জাতীয়তাবাদের স্থলে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ অবলম্বন করে এগিয়েছিল, এবং পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরেই পাকিস্তানে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ আবেদনহীন হয়ে পড়ে। তাতে মুসলিম লীগ আদর্শহীন হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ কখনো ধার্মিকদের সংগঠন ছিল না। সে পর্বে প্রাচীনপন্থী আলেম-সমাজের বিরুদ্ধে নব্যশিক্ষিতদের এবং সাধারণ মানুষের অভিযোগের অন্ত ছিল না। আলেম-সমাজের নেতৃত্বকে দায়ী করা হয়েছিল মুসলমান সমাজের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও পশ্চাৎবর্তীতার জন্য। তৎকালীন মাদ্রাসা-শিক্ষার বিরুদ্ধে বহুমুখী অভিযোগ তুলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অনুকূলে প্রবল জনমত গড়ে তোলা হয়েছিল। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি আদর্শ এবং মানুষের পার্থিব উন্নতির রাজনৈতিক বক্তব্য তখন ওয়াজ-নসিহত ও মিলাদ মহফিলের বক্তব্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি আকর্ষণীয় হয়েছিল সাধারণ অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোকদের কাছে­ যারা তখন ছিল মোট জনসংখ্যার নয়-দশমাংশের বেশি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রে ঘোষিত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলে। আদর্শ যাই ঘোষণা করা হোক­ কোনোটারই প্রস্তুতি ছিল না কোনো রাজনৈতিক দলে। পরবর্তী কালেও কোনো রাজনৈতিক দল আদর্শগত প্রস্তুতির কথা ভাবেনি। বাস্তবে দেখা যায়­ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সার্বিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায়। রাষ্ট্রীয় অপব্যবস্থা ও দুর্নীতির ফলে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি আদর্শ আবেদনহীন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই ধর্মের প্রতি মানুষের কিছুটা ঝোঁক দেখা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই সময় থেকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে দুর্বল গরিব দেশগুলোতে ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার নানা কৌশল অবলম্বন করে। মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন তখনই পরিচালনা করা হয় আর বিবিসি ও তার সহযোগী প্রচারমাধ্যমগুলো এই দু’টি আন্দোলনকে প্রচার দিয়ে খুব সহায়তা করে। এরই মধ্যে ধর্মীয় শক্তি দ্রুত পুনরুজ্জীবিত হয়।
গণতন্ত্র যখন অপব্যবস্থায় নিপতিত হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার ফলে বিশ্বব্যবস্থা ওয়াশিংটন-কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন পরিচালিত হয়, তখন অশিক্ষিত- অর্ধশিক্ষিত লোকদের মধ্যে ধর্মের প্রতি ঝোঁক বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এখন দেখা যাচ্ছে, অন্ধভাবে ধর্মের নামে এগোবার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। ধর্ম সম্পর্কেও মানুষ পুনরায় জিজ্ঞাসু হতে আরম্ভ করেছে। মানুষ গত প্রায় চার দশকের গণতন্ত্রে যেমন ভরসা পাচ্ছে না তেমনি গত প্রায় তিন দশকের ইসলামেও ভরসা পাচ্ছে না। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটে গেছে। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত­ এ কথা ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পঁচানব্বই শতাংশ লোকের ভোট পড়ার পরেও এখনও বলা হচ্ছে। জনমনের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন এবং সন্দেহ বিরাজ করছে। দলীয় সঙ্কীর্ণতা ও জুলুম-জবরদস্তি কমছে না, আইনের শাসনও কায়েম হচ্ছে না। সামনে অবস্থা উন্নত হবে কি?
বাঙালি মুসলমান সমাজের মানসিকতার ও চিন্তা-ভাবনার অগ্রগতির নৈরাজ্যজনক ইতিহাস নিয়ে ভাবতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের চিত্তশুদ্ধির কথা মনে আসছে। চিত্তশুদ্ধিকে হিন্দুধর্মের সার বলে উল্লেখ করে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেনঃ
‘‘চিত্তশুদ্ধি থাকিলে সকল মতই শুদ্ধ, চিত্তশুদ্ধির অভাবে সকল মতই অশুদ্ধ। যাহার চিত্তশুদ্ধি নাই, তাহার কোনো ধর্ম নাই।... চিত্তশুদ্ধি কেবল হিন্দু ধর্মেরই সার, এমত নহে, ইহা সকল ধর্মের সার। ইহা হিন্দু ধর্মের সার, খ্রিষ্ট ধর্মের সার, বৌদ্ধ ধর্মের সার, ইসলাম ধর্মের সার, নিরীশ্বর কোঁৎ ধর্মেরও সার। যাঁহার চিত্তশুদ্ধি আছে, তিনি শ্রেষ্ঠ হিন্দু, শ্রেষ্ঠ খ্রিষ্টিয়ান, শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ, শ্রেষ্ঠ মুসলমান, শ্রেষ্ঠ পজিটিভিস্ট। যাঁহার চিত্তশুদ্ধি নাই, তিনি কোনো ধর্মাবলম্বীদিগের মধ্যেই ধার্মিক বলিয়া গণ্য হইতে পারেন না। চিত্তশুদ্ধিই ধর্ম।... চিত্তশুদ্ধি মানুষদিগের সকল বৃত্তিগুলির সম্যক স্ফূর্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যের ফল।’’
এখানে যে চিত্তশুদ্ধির কথা বলা হয়েছে তা ধর্ম ও আদর্শের বেলায় সবচেয়ে মর্মগত ব্যাপার। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মপন্থী, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী­ কোনো দলের মধ্যেই এ ব্যাপারে কোনো সচেতনতার কিংবা জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যে নফস, আহরিমান ও অসুর মাজদা, ফ্রয়েডে ইড, ইগো, সুপার ইগো­ ইত্যাদির কথা আছে। এসব নিয়েও চিন্তা-ভাবনা দেখা যায় না। এর ফলে এ দেশে ধর্ম, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ­ সবই ব্যর্থ হয়ে আসছে। সাফল্যের জন্য ধর্মপন্থী, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী­ সকলের মধ্যেই চিত্তশুদ্ধির ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত অনুশীলন দরকার। চিত্তশুদ্ধি চূড়ান্তভাবে অর্জন করার কোনো ব্যাপার নয়, চিত্তশুদ্ধি জীবনব্যাপী নিরন্তর অনুশীলনের ব্যাপার। চিত্তশুদ্ধিতে পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয় না; তবে পূর্ণতা অর্জনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়।
চিত্তশুদ্ধি ব্যাপারটিকে বুঝতে হলে মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়ে মানুষের বৃত্তি-প্রবৃত্তির, কামনা-বাসনার ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতিকে, তাদের মধ্যকার বিরোধ ও সামঞ্জস্যের প্রয়োজনকে বুঝতে হবে। নীতিবিজ্ঞানের দিক দিয়ে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে বৃত্তি-প্রবৃত্তির, কামনা-বাসনার ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পারস্পরিক বিরোধের প্রকৃতি, সামঞ্জস্যের সমস্যাবলি এবং সামঞ্জস্যের উপায় বিবেচনা করতে হবে­ সব সময় বিবেচনা করতে হবে। মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়ে বিষয়টিকে বিবেচনা করতে গেলেই দেখা যাবে­ মানবীয় বৃত্তি-প্রবৃত্তি, কামনা-বাসনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্তর্গত দিকের মতোই রয়েছে বাহ্য দিক। অন্তর্গত দিকের মধ্যে রয়েছে মানুষের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমণ্ডলী।
মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমণ্ডলীকে অবলম্বন করেই বৃত্তি-প্রবৃত্তি কামনা-বাসনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার অস্তিত্ব। মানুষের স্নায়ুমণ্ডলী জাগ্রত হয় ও সক্রিয় হয় বাইরের নানা কিছুর স্পর্শে ও প্রভাবে। এ জন্যই এক দিকে অন্তর্গত, অপর দিকে বহির্জগৎ। একদিকে অহং, অপর দিকে ইদং। দুটো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত। এ জন্য মানবীয় সমস্যাবলির বিচারের ও সমাধানের বেলায় মনোজগত ও বৈষয়িক দুই দিককার তথ্যাবলিকেই বিবেচনায় ধরতে হবে। এক দিকে মনোবিজ্ঞান ও নীতিবিজ্ঞান এবং অপর দিকে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ইত্যাদি। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত কাজের বেলায় দুটো দিককেই পরিপূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে পথ চলতে হবে।
চিত্তশুদ্ধি ব্যাপারটিকে এভাবেই, দু’দিক থেকে দেখতে হবে। শুধু আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে বিষয়টিকে গ্রহণ করলে তাতে কোনো সুফল হবে না। প্রাচীনপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি নয়, চাই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। শুধু আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, চাই বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলোঃ সমর্থক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে হবে­ নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গি নয়।
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ­ এসবে সফল হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক জীবনে যে চরিত্রবল দরকার, তা জন্মগতভাবে মানুষ লাভ করে না, তা তাকে টেষ্টার মধ্য দিয়ে, সাধনার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। এই অর্জনের জন্য রাজনীতিতে­ রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে অনুশীলন চালাতে হয়। দলের ভেতরে সকলকে চরিত্র অনুশীলন করতে হয়। চরিত্র কোনো নিশ্চল, সারাজীবনের জন্য অর্জন করে নেয়ার ব্যাপার নয়। চরিত্রও এমন এক ব্যাপার যে, এর জন্য জীবনব্যাপী নিরন্তর অনুশীলন দরকার হয়।
রাষ্ট্রসৌধের ভিত্তিতে রয়েছে জনগণের, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের, বৃত্তি-প্রবৃত্তির, কামনা-বাসনার, আশা-আকাঙ্ক্ষার কাঠামো। সেই কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত আছে এক দিকে মানুষের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমণ্ডলী এবং অপর দিকে বস্তুগত সম্পদ। এইসব দিক দিয়ে ধর্ম ও আদর্শকে দেখতে হবে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক
রাষ্ট্রচিন্তক ও রাজনীতি বিশ্লেষক