মানবিক মূল্যবোধ ও ইসলাম
মহাবিশ্ব সৃষ্টির একচ্ছত্র পরিকল্পনাকারী ও নিরঙ্কুশ অধিপতি আল্লাহতায়ালা মানুষকে কেন্দ্র করেই সব বিধিবিধান জারি করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন হলো বিশ্বমানবতার জন্য জীবনযাপনের সামগ্রিক সমস্যার উৎকৃষ্ট সমাধান। এটি আল্লাহ প্রেরিত অনুপম ঐশী সংবিধান। আল কুরআনের লক্ষ্যবস্তু মানুষ। পবিত্র কুরআনের বহুমুখী নির্দেশনার প্রতিটি স্তরে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় মানুষের আনাগোনা। ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক জীবনঘনিষ্ঠ নিয়ম-কানুনেরই সমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা। ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ, দরদি ও প্রশান্তচিত্ত মানবিক মূল্যবোধের একনিষ্ঠ উদগাতা। বিকৃত ও বিভ্রান্ত বিচারবোধের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ইসলাম কখনো কখনো একটি নির্দয় প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম হিসেবে আখ্যা পায়, যা অতি মাত্রায় দুঃখজনক ও অক্ষমার্হ। শয়তান প্ররোচিত অসুস্থ চিন্তাভাবনার মোহ কাটাতে না পেরে জঘন্য অপব্যাখ্যায় অনেকেই আত্মনিয়োগ করেন। আমরা দেখছি বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অপচেষ্টা সমাজের মূল্যবোধ ক্রমাগতভাবে শুধু বিনষ্ট করেই চলেছে। ফলে হিংসা-হানাহানি ও সঙ্ঘাতের কবলে পড়ে বিশ্বসমাজকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে।
প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে ইসলামে যে বিধান বা নির্দেশনা এসেছে তা চমৎকার মানবিক মূল্যবোধের পরিচায়ক। এ ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ বা কোনো রকম সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিন্দুমাত্র অবকাশ চিহ্নিত করা হয়নি। প্রতিবেশী যে ধর্মের, যে আদর্শের কিংবা যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন তার প্রতি সুবিচার করা ও সদয় হওয়া মুসলমানের নৈতিক কর্তব্য। ইসলামের উদার মানবিক মূল্যবোধের শাণিত প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে। ট্রেনের ওই যাত্রী যিনি ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক, তিনি ইসলামের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়তো দূরে, আদর্শিক মানের বিচারে তার অবস্থান অনেক নিচে, কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি একটি অভিন্ন মর্যাদার অধিকারী। ইসলাম যেকোনো মানুষের এ মর্যাদা ও অধিকারকে সম্মান করে। সাদা-কালো বর্ণের ভেদ বিচার ইসলাম কখনই করতে জানে না। ব্যক্তি দেখতে সুন্দর নয় বলে তার সাথে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ ইসলামসম্মত নয়। অনেকেই ইসলামকে কট্টর পন্থা হিসেবে অপবাদ আরোপের চেষ্টা চালান। বাস্তবিক পক্ষে এ অপবাদ নিরেট মিথ্যাচার অথবা প্রতিহিংসামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামি অনুশাসনকে যারা মনেপ্রাণে ভালোবাসেন এবং মেনে চলেন তাদেরও এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মুসলমানদের একটু ত্রুটিকে ইসলামবিদ্বেষী চক্র বিরাট আকারের পরিণতিতে পর্যবসিত করতে পারে। তখন এর দায়ভার গিয়ে পতিত হয় ইসলামের ওপর। বিশ্বব্যাপী ইসলামকে ভুল বোঝাবুঝির মাত্রা এতই বেড়ে চলেছে যে, এটি একটি উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে মানব জাতিকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি! তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য।’ সৃষ্টি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বই মানুষের মূল্যবোধের উপযুক্ত মাপকাঠি। সৃষ্টি কর্তার পক্ষ থেকে এটা দ্ব্যর্থহীন স্বীকৃতি যে, বিশ্ব চরাচরের কোটি কোটি সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সবার সেরা। সুতরাং প্রত্যেক মানুষ আরেকজন মানুষের কাছ থেকে মর্যাদা পাওয়ার নিশ্চিত দাবিদার। ইসলাম আদম জাতির মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ। জীবনের নানাবিধ ক্ষেত্রে মানুষকে যথার্থ মূল্য দেয়া ইসলামের নৈতিক শিক্ষারই অংশবিশেষ। চলতে-ফিরতে, হাটবাজার কিংবা অফিস-আদালতে কারো সাথে এমন কোনো আচরণ করা ইসলাম পছন্দ করে না, যাতে অপর ব্যক্তির আত্মমর্যাদায় হানি ঘটে। শুধু আপনাকে নিয়েই মানুষের সব চিন্তা আবর্তিত হলে চলে না। সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষের অপরাপর অধিকারের কথাও গুরুত্বের সাথে ভাবতে হয়। মানুষের সাথে অশোভন আচরণের কোনোরূপ অবকাশ ইসলাম তার অনুসারীদের দেয়নি। দল-মত নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ একটি অপরিহার্য চাবিকাঠি। বলতে দ্বিধা নেই, সমাজে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্কটে নানা রকম বিপর্যয় ও অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে।
সহিষ্ণুতা মানুষের একটি অতি প্রয়োজনীয় গুণ। কিন্তু মূল্যবোধের অবক্ষয় মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমিয়ে দেয়। দুনিয়াতে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের যত ঘটনা ঘটে তার অধিকাংশই ঘটে থাকে সহিষ্ণুতার অভাবে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা আদর্শের মানুষের সাথে চলতে হয়, লেন-দেন করতে হয়। কখনো কোনো কাজের জন্য লাইন ধরে দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়ে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের ক্ষেত্রে অসৌজন্যমূলক ও অপ্রীতিকর ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। ইসলাম এটাকে সমর্থন করে না। অপরের অধিকার ও মর্যাদাদানের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত যত্নবান। আমাদের প্রিয় নবী সঃ একজন অমুসলিম মেহমানের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন আমরা জানি। বিশ্বমানবতার পথ প্রদর্শক রাসূল সঃ ঐতিহাসিক সে ঘটনার মাধ্যমে গোটা বিশ্ববাসীর জন্য যে আলোকিত শিক্ষা উপহার দিলেন তার মূল্য কি আমরা পরিমাপের চেষ্টা করি?
ইসলামে মানবিক মূল্যবোধের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনের সময় এসেছে। ইসলামের নামে যেখানে এত দল বিভক্তি, এত আহ্বান, আবার ইসলামের বিরুদ্ধে যেখানে এত বিষোদগার আর এত আক্রমণ সেখানে মুমিনের অধিক সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। ইসলামি অনুশাসনের নিয়ম-নীতির পাশাপাশি এর মহত্তম কল্যাণবোধের দিকটি দক্ষ কুশলতায় ফুটিয়ে তোলা দরকার। মানুষের কাছেই মানুষের অনিরাপত্তা ও ভয়ঙ্কর শত্রুতা ভরা পৃথিবীতে ইসলামের কল্যাণময় ঔদার্য বিপুল জনগোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান দিতে পারে।
মাওলানা সালেহ মতীন