শনিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০০৯

ধৈর্যশীলতা হচ্ছে সফলতার সোপান

ধৈর্যশীলতা হচ্ছে সফলতার সোপান


বিপদে ধৈর্যধারণ করা একটি মহৎ গুণ। যার মধ্যে এই গুণ আছে সে চরম সংকটের সময়ও নিজের লক্ষ্যপথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যার মধ্যে ধৈর্যধারণের ক্ষমতা নেই তিনি সামান্য প্রতিবন্ধকতা কিংবা বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়লেই স্বীয় লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়ান। এই শ্রেণীর দুর্বল চিত্তের লোকদের সমাজে কোনো মূল্য নেই এবং জনগণের কাছেও তারা নগণ্য। জগৎসংসারে যতো সমস্যাই আসুক না কেন তা ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করতে হবে। ধৈর্য না রাখতে পারলে ব্যর্থতা এসে জীবনকে গ্রাস করে নিবে এবং ব্যক্তিত্বও নতমুখী হয়ে যাবে। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব অর্জনের জন্য ধৈর্যধারণ যেমন অপরিহার্য, তেমনি সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যও তা প্রয়োজন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যারা ধৈর্যধারণ করেছে তারাই কামিয়াব হয়েছে। পৃথিবীর নবী, পয়গম্বর এবং জগৎবিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনে এর প্রমাণই পাওয়া যায়।আরবি ’সবর’ শব্দটি বাংলায় ধৈর্য ও সহনশীলতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থে ’সবর’ হলো-বিরত রাখা বা সংযত রাখা। অর্থাৎ স্বীয় নফসকে অধীরতা ও ভীতিপ্রদ অবস্থা থেকে বিরত রেখে স্বস্থানে বহাল রাখা এবং সুদৃঢ় রাখা। শব্দটি ছোট্ট হলেও এর অর্থ ব্যাপক। আল-কোরআনে বহু স্থানে এ শব্দটি এসেছে এবং মুমিনদেরকে এ গুণটি সঞ্চয় করে জীবনের সমস্যা-সংকুল সুবিশাল পথ পাড়ি দিতে বলা হয়েছে।
জীবনে সাফল্য পেতে চাইলে ধৈর্য আবশ্যক। ধৈর্যধারণ ছাড়া কোনো কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। নামাজ পড়তে গেলে সময় দিয়ে ধৈর্য ধরতে হবে। রোজার ড়্গেত্রেও তাই। সেখানে ড়্গুধার যন্ত্রণা এবং নিষিদ্ধ কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকতে হবে। হজ্জ করতে গেলেও ধৈর্য আবশ্যক। সেখানে সময় এবং অর্থ দুটোই দিতে হবে। যাকাত দিতে গেলেও ধৈর্যের পরীড়্গা রয়েছে। সেখানে সম্পদ ব্যয় করতে হবে। অনুরূপভাবে প্রতিটি ইবাদতেই ধৈর্যের প্রয়োজন রয়েছে। জাগতিক ড়্গেত্রেও যদি হালাল রিযিক উপার্জন করতে হয় তাতেও ধৈর্য আবশ্যক। সৎভাবে চলাটা কঠিন কাজ। কিন্তু যারা সহনশীলতাকে জীবনের সঙ্গী করে নিয়েছেন তারাই সফলকাম হয়েছেন। আলস্নাহ বলেন ৈ”যারা এমন যে, যখন আলস্নাহর বিধান উলেস্নখ করা হয়, তখন তাদের অন্তôর ভীতিপূর্ণ হয় আর যারা নিজেদের উপর আপতিত মুসিবতে ধৈর্যধারণ করে এবং যারা নামাজের পাবন্দী করে এবং যা কিছু আমি দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।” (সূরা হজ্জ, আয়াতঃ ৩৫এৈর পূর্বের আয়াতে এই সমস্ত গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাফল্যের শুভ সংবাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আলস্নাহপাক পবিত্র কোরআনে সূরা যুমারের ১০ নং আয়াতে বলেছেন “দৃঢ়পদ ধৈর্যশীল লোকগণ অগণিত পুরস্কার লাভ করবে।”
মানুষ ধৈর্যশীল হলেই কেবল যে-কোনো পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবেলা করতে পারে। ধৈর্য থাকলে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মস্তিôষ্ককে কাজে লাগিয়ে সংকট মোচনের জন্য সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়। যার ধৈর্য নেই সে অযথা দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে এবং হিংসাত্মকভাবে সমস্যার সমাধান করতে চায়। যার ফলে সমাজে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম কখনো সহিংসতা পছন্দ করে না।
হাদীস শরীফে উলেস্নখ করা হয়েছে ”সহনশীলতা উত্তম মর্যাদার অধিকারী; আর সহিংসতা অপেড়্গা সহনশীলতা শ্রেষ্ঠ।”
বিপদে ধৈর্যধারণ করা অর্থ পিছিয়ে আসা নয়; বরং আবেগতাড়িত না হয়ে জ্ঞান-বুদ্ধি প্রয়োগ করে যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করা। ধৈর্য ধরলে সাফল্য আসবেই। মহানবী (সা•) সারাজীবন ধৈর্যধারণ করেছেন। ৬৩ বছরের জীবনে কখনো তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। এজন্যই তিনি বিশ্বময় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে সড়্গম হয়েছিলেন।
এবার আমরা সবর বা ধৈর্যের তাৎপর্য নিয়ে কিছু বলব। সবরের অনেক তাৎপর্য এবং বিশেষত্ব রয়েছে। এর প্রথম তাৎপর্য হলো- যথার্থ সময়ের প্রতীড়্গা করা। সকল দুঃখ, কষ্ট, বেদনা ও প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্যের সাথে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সাধনে সুদৃঢ় থাকা। যত বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন আস্থার সাথে কাজ করে যাওয়া। যথা সময়ে সাফল্য আসবেই। আলস্নাহ বলেন- ”আর তুমি দৃঢ়পদে প্রতীক্ষf করতে থাক এ পর্যন্ত যে, আলস্নাহপাক ফায়সালা করে দেবেন। কেননা তিনিই উত্তম ফায়সালাকারী।” (সূরা ইউনুস, আয়াতঃ ১০৯)
সবরের দ্বিতীয় তাৎপর্য হলো- বিপদের সময় অস্থির না হওয়া; বরং এর মধ্যে কোনো কল্যাণ আছে বলে সানন্দে বরণ করে নেয়া। একই সাথে এই বিশ্বাসও করা যে, যখন সময় আসবে তখন আলস্নাহ তা স্বীয় রহমতে বিদূরিত করবেন। বিপদের সময় ধৈর্যহারা না হয়ে বরং দোয়া করাই উচিত। কেননা ধৈর্য এবং দোয়া এ দুটোই পারে বান্দাকে বিপদ থেকে মুক্তি দিতে। আলস্নাহপাক বলেন ৈ“আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে ভয়, ড়্গুধা, সম্পদহানি, স্বাস্থ্যহানি, ফল ও ফসলহানির মাধ্যমে পরীড়্গা করব। তবে সুসংবাদ রয়েছে ধৈর্যশীলদের জন্য- যারা মুসিবতে নিপতিত হবে বলে অবশ্যই আমরা আলস্নাহর জন্য এবং অবশ্যই আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাবো। তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পড়্গ থেকে অফুরন্ত অনুগ্রহ ও শান্তি এবং তারাই সঠিক পথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।”(সূরা বাকারা, আয়াতঃ ১৫৫-১৫৭)
সবরের তৃতীয় বিশেষত্ব হলো কাঙিড়্গত লড়্গ্যে পৌঁছার জন্য যে সকল বিপদ ও সংকট আপতিত হবে বা যে সকল প্রতিবন্ধকতা আসবে তার দ্বারা যেন অন্তরে দুর্বলতা ও ভয়-ভীতির সঞ্চার না হয়ঃ বরং এর মধ্যে যেন দৃঢ়তা ও অবিচল থাকার ভাব ফুটে ওঠে। আলস্নাহপাক বলেন- ”নামাজ কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, মন্দকাজের নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ।” (সূরা লুকমান, আয়াতঃ ১৭) সবরের চতুর্থ বিশেষত্ব হলো- শত্রম্নর কষ্টদায়ক পদচারণার প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে তাকানো।
তার দুর্ববহারের প্রতিশোধ না নিয়ে বরং তাকে ড়্গমা করলে সে পরবর্তীতে ভালো আচরণ করার সুযোগ পাবে। আলস্নাহপাক রাসুলুলস্নাহ (সা•) কে উদ্দেশ্য করে বলেন- “যদি আপনি শাস্তির পথ গ্রহণ করেন তাহলে তদনুরূপ শাস্তির পথ তারাও গ্রহণ করবে, আর যদি আপনি ধৈর্যধারণ করেন তাহলে তা ধৈর্যশীলদের উপকারে লাগবে। তাই আপনার উচিত তাদের কথিত বাক্যাবলী ও আচরণের উপর ধৈর্যধারণ করা, আপনার ধৈর্য আলস্নাহর সাহায্যেই বাস্তবায়িত হবে। তাদের কাজে চিন্তান্বিত হবেন না, এমনকি তাদের ষড়যন্ত্রের জন্য বিষন্নও হবেন না।” (সূরা নাহল, আয়াতঃ ১২৬-১২৭) এভাবে আলস্নাহ নবীজীকে ধৈর্যের শিক্ষা দিয়েছেন। শত্রুর এমন রূঢ় ব্যবহারে ধৈর্যধারণকারীর কোনো ড়্গতি নেই বরং সমাজের উপকারই বেশী।
পৃথিবীতে সুখ ও দুঃখ হচ্ছে আপেড়্গিক বিষয়। বৃহৎ কিছু পাবার পর মানুষ আনন্দে আত্মহারা হতে পারে আবার কিছু হারানোর বেদনায় সে অস্থিরও হতে পারে। এই উভয় অবস্থায় ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে কাজ করা খুবই কঠিন। কিন্তু আত্মসংযমের এটাই আসল সময়। তাই আনন্দ ও বেদনা জীবনে যা-ই আসুক না কেন নিজেকে স্থির রেখে সকলের সাথে শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। সহনশীলতার মহৎ গুণ অর্জন করে সর্বড়্গেত্রে নিজেকে বিজয়ী করাই মুমিনের মূল লক্ষ্য।

মীযানুর রহমান রায়হান

কোন মন্তব্য নেই: