শুক্রবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০০৯

আল্লাহর সৃষ্টিরীতির জ্ঞান


আল্লাহর সৃষ্টিরীতির জ্ঞান


ইসলাম যুক্তি ও অনুসৎিসার ধর্ম। এ কারণে পর্যায়ক্রমে সহিষ্ণুতা ও সঠিক পূর্ণতায় তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে দ্রুতির প্রবণতা অন্তর্নিহিত। অবশ্য এটি আমাদের যুগের বৈশিষ্ট্য। এ জন্য আজ ফসল বুনে কালই তা কাটতে চায়। কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টিরীতি অনুযায়ী এ রূপ দ্রুতির কোনো অবকাশ নেই। গাছ থেকে ফল আহরণ করতে হলে এর পর্যায়ক্রম অতিক্রম করতে দিতে হবে। মানুষের সৃষ্টি তো এর প্রকৃষ্ট নজির। কুরআন বলছে­ ‘অতঃপর আমি শুক্রকে পরিণত করি রক্তপিণ্ডে, তারপর রক্তপিণ্ডকে পরিণত করি মাংসপিণ্ডে, তারপর মাংসপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপঞ্জরে, পরে অস্থিপঞ্জরকে মাংসে আবৃত করে দিই; অবশেষে তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান!’ (২৩ঃ১৪)
এমনভাবে মানুষও শিশু থেকে পর্যায়ক্রমে প্রাপ্তবয়স্কে পরিণত হয়। একইভাবে আল্লাহর সুনান অনুযায়ী মানুষের জীবনও বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে। অনুরূপভাবে আল্লাহর দীন বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে অবশেষে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। তখন এই আয়াত নাজিল হয়েছে­ ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, এই ইসলামকেই তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।’ (৫ঃ৩)
বিষয়টি অত্যন্ত সহজ-সরল; কিন্তু চার দিকের অবস্থা দেখে উৎসাহী তরুণরা এতই বিক্ষুব্ধ যে, এই জ্ঞান তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তারা রাতারাতি ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে চায়। কিন্তু এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, বিপরীত বাস্তবতাকে কেবল ইচ্ছা হাতিয়ার দিয়ে পাল্টানো যাবে না। প্রসঙ্গত একটি অমূল্য বইয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিঃ ‘হাত্তা ইয়ুগাইয়িরু মা বিআনফুসিহিম’ (যতক্ষণ না তারা নিজেরা পরিবর্তিত হয়)। এটি লিখেছেন সিরীয় মনীষী জাওদাত সাঈদ (রহঃ)। বইটিতে আত্মা ও সমাজের পরিবর্তন ধারা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে কুরআনের এই আয়াতঃ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।’ (১৩ঃ১১) এবং ‘কারণ, আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়কে প্রদত্ত সৌভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই পরিবর্তিত করে দেয় নিজের জন্য নির্ধারিত বিষয়।’ (৮ঃ৫৩)
বইটির ভূমিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছেঃ ‘মুসলিম তরুণদের মধ্যে অনেকেরই ইসলামের জন্য জান ও মাল কোরবানির দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদের মধ্যে মাত্র মুষ্টিমেয়সংখ্যক তরুণ জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখায় অথবা দুর্বোধ্য সত্যকে উন্মোচিত করার লক্ষ্যে অধ্যয়নে উৎকর্ষ অর্জনে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। উদাহারণস্বরূপ ঈমান ও আমল তথা বর্ণনা ও বাস্তবের শ্রেণী বিভাগ ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে। এসব বিষয় এমন সমস্যা সৃষ্টি করে যার বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যপূর্ণ সমাধান না হলে গঠনমূলক সংস্কার অসম্ভব। ইসলামি বিশ্ব এখনো গবেষণা ও লেখনীর মর্ম উদ্ধার করতে পারছে না। কারণ তারা এখনো মনে করে যে, ‘মসির চেয়ে অসি শক্তিশালী।’ এ জন্যই আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা স্থবিরতায় পর্যবসিত হয়েছে। ঝাঁপ দেয়ার আগে চিন্তা করার কথা আমরা ভুলেই গেছি। ফলে উপরিউক্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। এসবের মধ্যকার পারস্পরিক সমন্বয় ও শৃঙ্খলার বিষয়টি আমরা অধ্যয়ন বা উপলব্ধির চেষ্টা করছি না।
তদুপরি মুসলিম বিশ্বে ঈমানের অবস্থা সম্পর্কেও আমরা এখানে সতর্ক পর্যালোচনা করছি না। এটার অর্থ এই নয় যে, মুসলমানদের ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান নেই। আমরা বরং মানসিক অবস্থার কথা বলতে চাই যা অবশ্যই মনের গহিন থেকে পরিবর্তন করতে হবে। আর ওই পরিবর্তনই কেবল ঈমানের শর্ত পূরণ করতে পারে অর্থাৎ ঈমান ও আমলের সাযুজ্যের পরিবেশ সৃষ্টিতে সক্ষম।
আত্মত্যাগ ও সাদকার প্রকৃত মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি না করে এখনো বিশ্বাস করা হয়, ওই দু’টো সবচেয়ে মহত্তম পুণ্য। সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত কৌশলের অনুপস্থিতিতে কেবল কোরবানি করলেই এর লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না। অবুঝ বিশ্বাস তরুণ মনে জানমাল কোরবানির আবেগ সৃষ্টি করে বটে, এর তাৎপর্য অধ্যয়ন ও উপলব্ধির চেতনা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। তাৎক্ষণিক ভাবাবেগ বা চাপ থেকে কোরবানির প্রেরণা আসে; কিন্তু জ্ঞানের অন্বেষার জন্য দরকার অবিশ্রান্ত অধ্যবসায়, চৈতন্য, অন্তদৃêষ্টি ও সমীক্ষার মানসিকতা। আর এটিই পরিশেষে নিশ্চিত সাফল্যের সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল করে।
অবশ্য কোনো কোনো তরুণ বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়ন-পঠনের কাজে মনোনিবেশ করলেও শেষাবধি একঘেয়ে ক্লান্তি অনুভব করে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং জ্ঞান-গবেষণা হিমাগারে আশ্রয় নেয়। আমাদের গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই জড়তা ও স্থবিরতার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
আত্মোপলব্ধি ও আত্মসচেতনতা ছাড়াই দ্রুত পরিবর্তন সাধনের প্রবণতা অবান্তর। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি এক জিনিস, আমাদের নিজস্ব ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা অন্য জিনিস। এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আল কুরআনের এ শিক্ষার ওপরেও আলোকপাত করা হয়েছে। কুরআনে সমস্যার অন্তস্তল হিসেবে খুদী বা অহমকে চিহ্নিত করা হয়েছে, বাইরের অসদাচরণ বা অনাচার নয়। কুরআনুল করীমে সম্পদের যে কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে তার মূল কথা হলো এটাই। এই সহজ-সরল সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং তখন নৈরাশ্য, বৈরাগ্য ও স্বৈরাচারী দর্শনের উদ্ভব ঘটে।
অতএব মারাত্মক স্বআরোপিত অবিচার হচ্ছে মানুষ, মহাজগত ও সমাজের অন্তর্নিহিত অনুষঙ্গ অনুধাবনে ব্যর্থতা। ফলে কোনো অবস্থানে নিজেকে স্থাপিত করলে মানুষ আল্লাহর সুনান (রীতি) অনুযায়ী মানবীয় ও প্রাকৃতিক সম্ভাবনাকে সর্বোত্তম উপায়ে আহরণ করতে সক্ষম, তার বিচার করতে ভুল করে সে ব্যর্থতার গ্লানি বহন করে। এই দৃষ্টিতে সমস্যার সম্মুখীন হলে দু’টি মানসিকতার উদ্ভব হয়। প্রথমত, এটা বিশ্বাস করা যে, সমস্যাটি নির্দিষ্ট ধারায় নিয়ন্ত্রিত, অতএব একে সমাধান ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, এই বিশ্বাস দ্বারা চালিত হওয়া যে, এটি রহস্যময় ও অতিপ্রাকৃতিক, অতএব কোনো রীতি দ্বারা এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। এই দুই চরম মানসিকতার মধ্যে বহুবিদ মধ্যবর্তী দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে যা মানুষের অনুসৃত পন্থা, আচার-আচরণ ও ফলাফল থেকে আঁচ করা যায়।
ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মুসলমানদের জীবন নির্বাহে ব্যর্থতা একটি সমস্যা যা সহজেই অনুমেয়। এটি মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গির কোনটি মুসলমানদের পোষণ করা উচিত? বস্তত এরূপ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সচেতনতা সৃষ্টি করলেই মুসলমানরা সমস্যার সমাধানে কোন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে এবং কোনটি পরিহার করবে তা নির্ণয়ে সহায়ক হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দুই দৃষ্টিভঙ্গি গুলিয়ে গিয়ে প্রতিটিই অবান্তর হয়ে গেছে। সুতরাং এর সমাধান বহুলাংশে নির্ভর করে পরিচ্ছন্ন অন্তদৃêষ্টির ওপর।’
লেখকঃ মিসরীয় বিখ্যাত পণ্ডিত। তিনি মিসর সরকারের আওকাফ মন্ত্রণালয়ের বোর্ড অব রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্সের একজন সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি ওআইসি’র ফিকাহ একাডেমিসহ বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য।


ড. ইউসুফ আল কারজাভি

কোন মন্তব্য নেই: