ইসলামে আমানতদারি
গচ্ছিত জিনিসের সংরক্ষণ ও হেফাজত করার নাম আমানতদারি। হেফাজতের দায়িত্ব যার ওপর ন্যস্ত করা হয় তাকে ‘আমিন’ অর্থাৎ আমানতদার বলা হয়। সমাজে প্রচলিত অর্থে আমিন বলা হয় ওই ব্যক্তিকে বা জমিজমার খোঁজখবর রাখেন ও জরিপ করেন। বিশিষ্ট তাফসিরবিদ আল্লামা কুরতুবি রহঃ-এর দৃষ্টিতে আমানতদারির বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক। ইসলামী জীবনপদ্ধতির সব কিছুর সাথে আমানতদারির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অর্থাৎ ফরজ, ওয়াজিব, ইবাদত, মুয়ামালাত (দৈনিক আচার ব্যবহার) সব কিছুই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। আর এ সব আমানত আল্লাহপ্রদত্ত।
আল্লাহর অবতীর্ণ কুরআন মাজিদ (জীবনপদ্ধতির শ্রেষ্ঠগ্রন্থ) একটি আমানত। তাই কুরআনে এ মহাগ্রন্থকে আমানত নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর দেয়া খেলাফত একটি আমানত। যাকে খেলাফতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তিনিও আমিন। সালাত, সাওম, জাকাত, হজের মতো মুয়ামালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান সন্ততি, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বু-বাব এমনকি প্রতিটি মানুষের হাত-পা, চোখ-কান, নাক, মাথা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সবই আমানতের আওতাভুক্ত। হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ সবটাই আমানত।
রাষ্ট্র পরিচালনা, সরকারি ও বেসরকারি দাফতরিক কাজকর্ম, শিক্ষকতা, সমাজের নেতৃত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, মজুরি, শ্রম-মেহনত, দেশপ্রেম ইত্যাদি সবই আমানত। সুতরাং আমানত শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হয়। অনেকে অর্থ সম্পদের মধ্যে আমানতটি সীমিত রাখে, যা সম্পূর্ণ ভুল। বরং মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সাথে আমানত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই প্রতিটি ব্যক্তি একজন আমানতদার। আমানতদার ব্যক্তি সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয়, সুনামি ও সুখ্যাত। আমানতদারি এমন এক মহৎ গুণ, যার ওপর জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল।
এরই বিপরীত হলো খেয়ানত। কোনো দেশ যা জাতীয় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য, দেউলিয়াপনা, অকার্যকরতা সৃষ্টি হয় আমানতকারীর অভাবে এবং খেয়ানতের কারণে। মানুষ যখন আমানতদারিকে বিসর্জন দিতে থাকে এবং খেয়ানতকে আসল সম্বল হিসেবে গ্রহণ করে তখন তার বিপর্যয় ঘটতে থাকে। ইসলামী বিধানে ইমাম, মোয়াজ্জিন ও উপদেষ্টাকে আমিন উপাধি দেয়া হয়েছে।
আল্লাহর সৃষ্টি অসংখ্য ফেরেশতা আমানতদারঃ জিব্রাইল, মিকাইল, ইস্রাফিল, আজরাইল প্রমুখ ফেরেস্তা আমানতদারির ব্যাপারে প্রসিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে জিব্রাইলকে অনুগতশীল এবং আমিন বলা হয়েছে। আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তারা বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেন না। সে জন্য তারা সবাই আল্লাহর কাছে নির্দোষ। আমানতের মহান দায়িত্ব পালন করছেন বলে আল্লাহ জিব্রাইলকে ওহি বহনের কাজ অর্পণ করেন। সৃষ্টিলগ্ন থেকে যে ফেরেশতা যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা হুবহু দায়িত্ব পালন করছেন।
আল্লাহর নবী-রাসূলগণ আমানতদারঃ বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাঃ নবুয়ত প্রাপ্তির বহু আগে থেকেই আমানতদার ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার আগে প্রেরিত সব নবী-রাসূল আমানতদারির সুনাম অর্জন করেছিলেন। নিজ নিজ জাতির কাছে নিজেদের পরিচিতি পেশ করার সময় তারা বলেন, ‘ইন্নিলাকুম রাসূলুন আমিন’ আমি তোমাদের জন্য একজন আমানতদার রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।
আমানতদারির গুরুত্বঃ ১. আমানত রক্ষার ওপর নির্ভর করে দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের উন্নতি। সম্ভাবনাময় জাতির জন্য আমানত একটি অপরিহার্য ব্যাপার।
২. আমানতদারি না থাকলে জাতির বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। বর্তমানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধ্বংসের একমাত্র কারণ আমানতের খেয়ানত, আত্মসাৎ, লুটতরাজ, অবৈধ উপার্জন ইত্যাদি।
৩. সমাজের মধ্যে ঐক্য, সংহতি, হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা, স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা সৃষ্টির মূল হলো আমানতদারি। পরস্পরের আস্থা প্রতিষ্ঠার একটি মাত্র উপায় হলো আমানতদারি।
৪. পারিবারিক জীবন হোক অথবা ব্যক্তিগত জীবন, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, হাটবাজার, ব্যবসায়-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে আমানতদারি বিশেষ প্রয়োজন। এগুলোর পাশাপাশি আমাদের হাত, পা, চোখ, কান, জিহ্বা, পাকস্থলী, বুক ইত্যাদি অঙ্গ-প্রতঙ্গ আমানত হিসেবে দেয়া হয়েছে। এ সবের ব্যবহারের বেলায় আমানতদারি পালন করা প্রয়োজন। কুখাদ্য-ধ্বংসাত্মক খাদ্য থেকে শরীর ও স্বাস্থ্য রক্ষা করা, রোগের চিকিৎসা করা আমানতদারি।
৫. এ ভূমণ্ডলে মানবজাতির শান্তি ও উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে সব মানবরচিত বিধিবিধানের পরিবর্তে এক আল্লাহর জীবনবিধান চালু করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমানত।
ভোট একটি আমানতঃ রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সাথে জাতীয় সংসদে সৎ, যোগ্য, বিচক্ষণশীল, প্রজ্ঞাবান, মুত্তাকি ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে পাঠানো একটি বড় আমানত। অতএব দেশের প্রতিটি ভোটার আমানতদার। আমানতের সঠিক প্রয়োগ না করার অর্থ বড় ধরনের খেয়ানত করা, যা দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
সংবাদ সংগ্রহ এবং তথ্য সরবরাহ একটি আমানতঃ মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম জাতি ও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ অবদান রখে। যেকোনো ভুল তথ্য ও মিথ্যা সংবাদ সরবরাহের কারণে একটি দেশের ভিত নড়বড়ে হতে বিলম্ব হয় না। বিরাট হুমকির সম্মুখীন হতেও সময় লাগে না। সুতরাং সঠিক তথ্য সরবরাহ ও সংগ্রহ একটি বড় আমানত। অন্যভাবে বলতে গেলে সাংবাদিকতা একটি বড় আমানত। এই আমানতের খেয়ানত দেশ ও জাতির কাম্য হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, হে মুমেনগণ, কোনো অনৈতিক ব্যক্তি যখন তোমার কাছে সংবাদ বহন করে থাকে, তখন তুমি সেটা ভালো করে যাচাই-বাছাই করো। (তারপর তার ওপর আমল দাও) যাচাই-বাছাই ছাড়া সংবাদে আমল দেয়ায় একটি জাতি সমূলে বিপর্যস্ত হতে বাধ্য, তখন তোমাদের আক্ষেপ করা ছাড়া কিছু করণীয় থাকবে না। (সূরা হুজুরাত-৬)
ভেজাল খাদ্য, কুখাদ্য, কৃত্রিম সঙ্কট, মূল্যবৃদ্ধি বড় খেয়ানতঃ ইসলামে ব্যবসায়ীদের যথেষ্ট মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাঃ বলেছেন, সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের ময়দানে আমার সঙ্গ লাভ করবে।
আমানত রক্ষায় ইসলামী বিধানঃ আমানত রক্ষায় ইসলামের বিধান হচ্ছে আমানতের হেফাজত করা। খেয়ানত না করা। যার জিনিস তার কাছে হুবহু পৌঁছে দেয়া। কুরআনে বলা হয়েছে ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে খেয়ানত করো না। তোমরা কী করে খেয়ানত করতে পার, অথচ তোমরা অবগত।’ (সূরা আল-আনফাল-২৭) অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেয়া যাবতীয় বিধানগুলোর অমান্য করাই খেয়ানত। সূরা নিসার প্রসিদ্ধ আয়াতে আল্লাহ আমানতের হকদারদের আমানত দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (আয়াত ৫৮) গচ্ছিত জিনিসের মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন বৈধ নয়। এখানে তিনটি মৌলিক গুণ আমানতদারের মধ্যে থাকতে হবে। ১. আমানত যার কাছে রাখা হয় তাকে পবিত্র নিষ্ঠাবান হতে হবে। ২. আমানত রক্ষার ব্যাপারে সার্বিক দায়দায়িত্ব পালন করতে হবে। ৩. আমানতের হুবহু জিনিসটি মালিকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। ‘যে আমানত রক্ষার ব্যাপারে স্বচ্ছ না, সে মুমিন নয়’। অন্য হাদিসে আল্লাহর নবী সাঃ বলেছেন, ‘আমানতের খেয়ানতকারী ইসলামচ্যুত গণ্য হবে।’ রাসূলুল্লাহ সাঃ আমানত লঙ্ঘনকারীকে মুনাফেক সাব্যস্ত করেছেন। কোনো লোক নেক আমল করা সত্ত্বেও আমানতের খেয়ানতের কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। হাশরের মাঠে তিনি আমানত আদায়ের জন্য হুকুম দেবেন। হাদিসে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি আল্লাহর পথে শাহাদতবরণ করেন, কিন্তু সে মানুষের আমানত না বুঝিয়ে মারা যান। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে বলবেন, মালিকের কাছে আমানত ফেরত দাও। কিন্তু সে মালিককে খুঁজে পাবে না। তখন আমানতের বোঝা তার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এ লোক বান্দার অধিকার নষ্ট করার কারণে জাহান্নামের ভাগী হলো।
বনি কোরাইজা যুদ্ধের সময় আল্লাহর নবী সাঃ কোরাইজার ইহুদিদের সাথে সংলাপের জন্য আবু লুবাবা ইবনুল মুনজের রাঃ-কে সেখানে পাঠালেন। সংলাপ চলাকালীন সময়ে তিনি আকার ইঙ্গিতে কথায় আমানত রক্ষা করতে পারেননি বলে নিজ অপরাধ স্বীকার করে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর দরবারে হাজির হন। এক পর্যায়ে তিনি তওবা মাফের লক্ষ্যে মসজিদে নববির একটি খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে দিলেন। তিন দিন অনবরত তওবা করার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ক্ষমা ঘোষিত হওয়ার পর আল্লাহর নবী সাঃ স্বহস্তে তার বাঁধনটি খুলে দিলেন। মসজিদে নববির ভেতরে আবু লবাবা খুঁটিটি এই নামে এখনো বিদ্যমান আছে, যা আমানতের খেয়ানত করার পরিণাম সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ নবুয়তের মহা আমানত পালন করার ব্যাপারে বিদায় হজের ভাষণে সমবেত হাজার সাহাবির সাক্ষ্য গ্রহণ করে বললেন, বল তো তোমরা, আমি কি আমানতের হক আদায় করতে পেরেছি? উপস্থিত সবাই একযোগে জবাব দিলেন, আপনি রিসালাত ও আমানতের অর্পিত দায়িত্ব সম্পূর্ণ পালন করেছেন। তখন আল্লাহর নবী হাতের শাহাদাত আঙুল ওপরের দিকে উত্তোলন করে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো। আমানত রক্ষা প্রসঙ্গে ইসলামের ইতিহাসে বহু ঘটনা রয়েছে।
মানুষ কখন আমানতের খেয়ানত করে? আমানতের খেয়ানত করা হয় কয়েকটি কারণে।
যেমনঃ ১. ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের জ্ঞানের অভাব। ২. নৈতিকতার অভাব। ৩. ধন-সম্পদের লোভ। ৪. পরকালের জবাবদিহিতার অনুভূতির অভাব। ৫. হঠকারিতা, অহমিকা ও দাম্ভিকতা।
আমানতদারির অনুভূতি সৃষ্টির উপায়ঃ ১. হালাল উপার্জন, ২. পরকালের জবাবদিহিতার স্মরণ, ৩. ঈমান ও আমলে সালেহ মনে নিয়োজিত থাকা, ৪. মনের তুষ্টি ও তৃপ্তির অন্বেষণে থাকা, ৫. সবসময় ইস্তেগফার করতে থাকা, ৬. সবসময় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকা।
ড. হাসান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন