শুক্রবার, ২ জানুয়ারী, ২০০৯

মুজাদ্দিদ-ই-আল্‌ফ-ই-সানি

মুজাদ্দিদ-ই-আল্‌ফ-ই-সানি


শেখ আহমেদ শিরহিন্দী একজন মহান মরমী চিন্তাবিদ। তিনি সাধারণত মুজাদ্দিদ-ই-আল্‌ফ-ই-সানি নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। ইসলামের পুনরম্নজ্জীবনকারী হিসেবে তাঁকে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হওয়ার পর তা’ একটি ভিন্নরূপ ধারণ করে। এখানে এসে ইসলাম বিভিন্ন ভাবধারার সাথে সংমিশ্রিত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপড়্গে, ভারত সুফীবাদের সক্রিয় কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এখানে বহু উপদলেরও সৃষ্টি হয়। কালের গতিতে সুফীবাদ মানুষের মনে এত বেশি প্রভাব ফেলে যে তারা ইসলামের সত্যিকার ভাবধারা থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়ে পড়ে। সময়ের অগ্রগতিতে বহু অনৈসলামি ভাবধারা ইসলামে প্রবেশ করে। মুসলমানগণ বহু কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে শুরম্ন করে এবং মরমীবাদের বহু সম্প্রদায়েরও উদ্‌ভব ঘটায়। ফলে ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, এমন কি জীবন সম্পর্কে সমগ্র ধারণারও পরিবর্তন হতে শুরম্ন করে।

ইসলামের এহেন অবস্থার মধ্যেই আর্বিভাব ঘটে মহান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও সুফি মুজাদ্দিদের। তিনি ইসলামি মরমীবাদের নব দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন এবং মূল ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি এমন এক সময়ে আবিভূêত হন যখন প্রায়োগিক ধর্ম হিসেবে ইসলাম তার মূল প্রাণশক্তি ও গতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সুফি ও সাধারণ মানুষ ইসলামের মূল ভাবধারার চেয়ে এর আচার ও আনুষ্ঠানিকতাকে ঘিরেই জড়িত থাকে। ইসলামের মূল উৎস কোরআন ও হাদীসকে উপেড়্গা করা হয়। অন্ধ ও আচারি ভাবধারা বিরাজ করতে থাকে এবং ইসলামের মূল ভাবধারাকেও খর্ব করা হয়। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতির দুর্বলতার জন্য ইসলামকে ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করার সম্রাট আকবরের নীতিও এজন্য অনেকাংশ দায়ী ছিল। মুজাদ্দিদ তাকলিদ (কর্তৃত্বের অন্ধ অনুকরণ)-এর বিরোধী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় মতবাদের ব্যক্তিগত বোধ ও ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন।

সময়েরই প্রয়োজন ছিল ইসলামের একজন সত্যতা প্রতিপাদনকারী ব্যক্তির আবির্ভাবের। ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই মুজাদ্দিদের আবির্ভাব ঘটে। তিনি তৎকালীন অনৈসলামি ভাবধারার বিরম্নদ্ধে রম্নখে দাঁড়ান এবং তাঁর পুনরভ্যুদয়ের ক্রিয়া-তৎপরতার দ্বারা বৈপস্নবিক পরিবর্তন আনয়ন করেন। সুফিদের সর্বেশ্বরবাদী মতবাদের বিরম্নদ্ধে তিনি বলেন, আলস্নাহ ও জগৎ ভিন্ন, তারা এক নয়। ধর্মতত্ত্ববিদগণের বিরম্নদ্ধে তিনি বলেন যে, মুসলমানদের কোরআন ও হাদিসে ফিরে যেতে হবে। তৎকালীন দূষিত প্রভাব থেকে ইসলামকে মুক্ত করার জন্য তিনি সুদূর গ্রামাঞ্চলে প্রচারকবৃন্দকে প্রেরণ করেন। তাঁরা সেখানে কোরআন ও হাদিসের মৌলিক শিড়্গা প্রচার করে বেড়ান।

যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সমস্ত মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তিকে তাঁর মতবাদের প্রতি আস্থাবান হওয়ার জন্য আবেদন জানান। তিনি জনগণের নিকট থেকে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পান এবং ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা অনুভব করে সম্রাট জাহাঙ্গীর বিচলিত হয়ে উঠেন এবং অচিরেই তাঁকে কারারম্নদ্ধ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি মুক্তি পান এবং সম্রাটের বিশেষ পরামর্শক নিযুক্ত হন।

মুজাদ্দিদ কোরআন ও হাদিসের গুরম্নত্ব পুনরম্নজ্জীবন করতে সড়্গম হন যা থেকে জনগণ বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল। তবে মরমীবাদে তাঁর অবদান ছিল বিপস্নবাত্মক। তিনি আলস্নাহ্‌ ও জগতের অভিন্নতার সর্বেশ্বরবাদীর ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে স্রষ্টা ও সৃষ্টি দ্বৈততা এবং আলস্নাহ্‌র অতিবর্তিতা (Transcendence) প্রতিষ্ঠিত হয়। নবী-পত্যাদেশ (ওহি) ও সুফীবাদের ভাবোচ্ছ্বাস (ইলহাম) এর মধ্যে প্রকারগত পার্থক্য নির্দেশ করা হয়। ইলমে বাতিন (গূঢ় রহস্যের জ্ঞান) এবং ইলমে জাহির (প্রকাশ্য জ্ঞান)-এর মধ্যে পার্থক্য করা হয়। এই অভিমতও ব্যক্ত করা হয় যে, অজ্ঞাত গূঢ়রহস্যকে জ্ঞাত অভিজ্ঞতাভিত্তিক ঘটনার দ্বারাই জানা যেতে পারে।

তবে, ইলমে বাতিন-২ জ্ঞানের জন্য সুফিকে হাদিস পাঠ ও অধ্যয়ন করতে হবে।

তাওহিদ বা আলস্নাহ্‌র একত্ব এবং এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাঁর ধারণা ছিল অত্যন্ত গুরম্নত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁর এই ধারণা ছিল আলস্নাহ্‌র সম্পর্কে সর্বেশ্বরবাদীর ধারণার বিপরীতে। তিনি সুফীদের প্রথমে হাদিস অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তারপর যিকর (স্মরণ) ও ফিকর (অনুধ্যান) অবলম্বন করার পরামর্শ দেন। তন্ময়াবস্থা অর্জনের জন্য সুফীদের কর্তৃক গ্রহীত সঙ্গীত ও অন্যান্য চর্চাকে নিন্দে করা হয়। অলস অনুধ্যানের চেয়ে সক্রিয় সমাজসেবাকে উৎকৃষ্টতর বলে মনে করা হয়। কোরআন ও হাদিস অনুসরণে সকল প্রকার নবসংযোজন (বিদাত) নিন্দে করা হয়। মুজাদ্দিদ মনে করেন যে, ইমামদের অন্ধ অনুসরণের ফলেই কালের অগ্রগতিতে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে এবং ইসলামের প্রকৃত ভাবধারা ও উৎস থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছেন।


প্রফেসর এম এ হালিম

1 টি মন্তব্য:

অবাক পৃথিবী বলেছেন...

কাইউমে জামান ইমামে রব্বানী হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানি শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দী (রঃ)-এর সম্পর্কে অপরিমিত জ্ঞানের আলোকে রচিত আপনার লেখাটি পড়ে ব্যথিত হলাম।

আপনি উল্লেখ করেছেন, " মুজাদ্দিদ তাকলিদ (কর্তৃত্বের অন্ধ অনুকরণ) এর বিরোধী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় মতবাদের ব্যক্তিগত বোধ ও ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন।"

সর্বশেষ, যে অসত্য মন্তব্যটি আপনি করেছেন, তা হচ্ছে-" মুজাদ্দিদ মনে করেন যে, ইমামদের অন্ধ অনুসরণের ফলেই কালের অগ্রগতিতে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে এবং ইসলামের প্রকৃত ভাবধারা ও উৎস থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছেন।"

অথচ হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানি (রাঃ) এ মর্মে উল্লেখ করেছেন যে, বরেণ্য ইমামদের তাকলীদ করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। এমনকি তিনি তার মকতুবাত শরীফে এও উল্লেখ করেছেন যে আখেরি জামানায় হজরত ঈসা (আঃ) যখন আবির্ভূত হবেন তিনিও হানাফী মাজহাবের অনুসারী হবেন।



অথচ আপনি তার নামে তাকলীদ বিরোধিতার মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন। এটা সত্যিই দুঃখজনক।