শুক্রবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০০৯

মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম


মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম


বাংলাদেশে প্রায় ৩ লাখ মসজিদ রয়েছে। প্রতিটি মসজিদে কমপক্ষে একজন করে ইমাম আছেন। যেখানেই জনপদ সেখানেই মসজিদ সেখানেই ইমাম। একজন ইমাম একজন ধর্মীয় নেতা হিসেবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এক ব্যক্তিত্ব। বলা যায়, তার অবস্থান সর্বজনীন। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তিনি হতে পারেন সমাজপতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা অন্য কিছু। কিন্তু অবস্থানগত কারণে তার কথা সবাই শুনতে চান না বা শুনলেও সবাই আস্থা রাখেন না। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেন ইমাম। তিনি যা বলেন তা আমজনতা শুধু শোনেন-ই না, বরং দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করেন। ফলে একটি সমাজ তথা একটি দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনে একজন ইমামের ভূমিকা অপরিসীম। এই শুভবোধ থেকেই জাতিসঙ্ঘ টঘঋচ-এর মাধ্যমে, মানবসম্পদ উন্নয়নে ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্তকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে ইমামদের প্রশিক্ষণ দান করে আসছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির মাধ্যমে ইমামদের ৪৫ দিনের লং কোর্স প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তাদের অংশীদারিত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। উপরোল্লিখিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে রিসোর্সপারসন হিসেবে উপস্থিত থাকেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইমাম সাহেব তার ধর্মীয় চিন্তাচেতনার সাথে সমসাময়িক বিশ্বের বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করে সমাজে তার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হন। তিনি ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে নিাক্ত বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির প্রয়াস চালান।
১. নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ২. কুসংস্কার প্রতিরোধ, ৩. ধর্মীয় গোঁড়ামির উৎসাদন, ৪. ধর্মীয় লেবাসের জঙ্গিবাদ নির্মূল, ৫. যৌতুক প্রথা রোধ, ৬. এইচআইভি অওউঝ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি, ৭. জাতীয় যক্ষ্মা নির্মূল অভিযান জোরদারকরণ, ৮. মাদকাসক্তি ও ধূমপান রোধ, ৯. শিশুদের টিকাদান, ১০. বৃক্ষরোপণ, ১১. সন্ত্রাস ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, ১২. কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ, ১৩. পরিকল্পিত পরিবার গঠন ও ১৪. স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক মোটিভেশন।
ইমামদের মাধ্যমেই সব সরকার তাদের পলিসি সহজেই জনগণের কাছে পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে ইমামদের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাব সবাই অবগত আছেন, যে কারণে তাদের কোনো কাজের দায়িত্ব দেয়া হলে তারা তা স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পন্ন করেন। কিন্তু কী নৈতিকতাবোধ আমাদের, যারা সমাজের জন্য দেশের জন্য এত কিছু করছেন আমরা কি তাদের খোঁজ রাখি? আমরা সরকারের আমলা, বড় রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কত কিছু; কিন্তু আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পাড়ার মসজিদে যেই লোকটি আমাদের আদর করে সূরা শিখিয়েছেন, অক্ষর শিখিয়েছেন, আদব-কায়দার হাতেখড়ি দিয়েছেন, আমরা কি তার কথা একবারো চিন্তা করি? সমাজের জন্য অবিশ্রান্ত খেটেখাওয়া এই মানুষের কোনো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নেই, নেই চাকরির নিশ্চয়তা। নূøনতম খেয়ে-পরে থাকার কোনো ব্যবস্থা কি আমরা তার করতে পেরেছি। সম্পূর্ণ সমাজের দয়ার ওপর নির্ভর এই শ্রেণীর আর্থিক সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কোনো উদ্যোগ কি নেয়া হয়েছে। মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০০৬ নামে একটি অধ্যাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস হয়েছে।

কিন্তু নীতিমালা রাষ্ট্রীয় গেজেটেই সীমাবদ্ধ আছে। বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ পরিকল্পিত হচ্ছে না। সরকারের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অন্যতম লক্ষ্য দেশকে ২০১৫ সালের মধ্যে নিরক্ষরমুক্ত করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারের বাস্তবানুগ কর্মতৎপরতা কতটুকু তা জানি না। তবে ১৯৯২ সালে স্বল্প পরিসরে শুরু হওয়া একটি প্রকল্প ‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম’ এই লক্ষ্য অর্জনে সরকারকে সহযোগিতা করছে। মসজিদের অবকাঠামোগত সুবিধা গ্রহণ করে স্বল্প ব্যয়ে এ প্রকল্পের মাধ্যমে মসজিদের প্রশিক্ষিত ইমামদের দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত অনগ্রসর শ্রেণীকে শিক্ষার মূল ধারায় যুক্ত করা হচ্ছে। প্রকল্পটির যথাযথ সাফল্য লক্ষ্য করে সব গণতান্ত্রিক সরকার প্রকল্পটির কলেবর জ্যামিতিকহারে বৃদ্ধি করেছে। এ প্রকল্পটির মাধ্যমেই দায়িত্বশীলতার সাথে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। ইতঃপূর্বে এ ধরনের সব কার্যক্রমই টেকনিক্যাল ত্রুটিজনিত কারণে ব্যর্থ হওয়ায় ওই কার্যক্রমটি আশার আলো জ্বালিয়েছে।
এ কার্যক্রমের ফলে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের স্কুলভীতি দূর হচ্ছে, ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির হার আশানুরূপ বাড়ছে এবং ঝরে পড়ার হার কমছে। শিশুশিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভালো পারফরম্যান্স প্রদর্শন করতে পারছে।

এ কার্যক্রমের ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসচেতন করা হচ্ছে। তাদের সঠিক নিয়মে দাঁত মাজা, সেন্ডেল পায়ে টয়লেটে যাওয়া, টয়লেট থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, খাওয়ার আগে হাত ধোয়া, বেশি করে পানি খাওয়া, নিয়মিত খেলাধুলা করা ইত্যাদি ভালো অভ্যাসগুলোর অনুশীলন করানোর ফলে সুস্থ-সবল জাতি গঠনে এ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আগে উল্লেখ করা দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে দেশের হতদরিদ্র ইমামরা এই ‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা’ কেন্দ্র পরিচালনা করে মাসিক ১ হাজার ২০০ টাকা সম্মানী পেয়ে থাকেন। স্বল্প আয়ে সংসারে মাসিক এই নগণ্য অর্থ তাদের জন্য অনেক কিছু। কষ্টে শিষ্টে জোড়াতালি দিয়ে চালানো সংসারে সরকারিভাবে প্রাপ্ত এই সামান্য সম্মানী পেয়ে তারা আরো বেশি দায়িত্ববান হন। প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান।
পরিশেষে বর্তমান সরকারের কাছে সবিনয় আহ্বান জানাই, প্লিজ আপনারা দেশের সুবিধাহীন হতদরিদ্র ইমাম আর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দিকে তাকিয়ে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পটি পাস করুন এবং এটি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করুন।


খালেদ মোঃ শামছুল ইসলাম

কোন মন্তব্য নেই: