শুক্রবার, ২ জানুয়ারী, ২০০৯

হিজরী নববর্ষের তাৎপর্য


হিজরী নববর্ষের তাৎপর্য


গত মঙ্গলবার ছিলো পয়লা মহররম, হিজরী নববর্ষের প্রথম দিন। হিজরী নববর্ষকে খোশ আমদেদ জানাই। হৃদয়ের সব উষ্ণতা দিয়ে তোমাকে গ্রহণ করি। তুমি কেবলই যুগে যুগে নয় শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্বমুসলিমকে নতুন প্রেরণায় উদ্দীপ্ত করে আসছো। তোমাকে আমরা স্মরণ করি। তুমি এলে আমরা আত্মসচেতন হই। নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। দেখতে না দেখতেই আমাদের মাঝ থেকে কালের গর্ভে হারিয়ে গেল ১৪২৯ হিজরী। চলে এলো ১৪৩০ হিজরী। আমরা জানি হযরত ঈসা (আ·) এর তিরোধানের পর হতে খ্রীষ্টাব্দ গণনা করা হয়ে থাকে। আর মুহাম্মদ (সা·) এর মক্কা হতে মদীনায় হিজরতের দিন অর্থাৎ-৬২২ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই হিজরী সালের গণনা করা হয়। হিজরী সালের ক্যালেন্ডার রসূল (সা·) এর সময় হতে প্রচলিত না হলেও তাঁর খলিফা আমিরম্নল মুমেনীন হযরত ওমর (রা·) এর শাসনামলে ১৭ হিজরী বা রসূলের ইন্তেকালের সাত বছর পর হতে এই হিজরী সনের প্রচলন করা হয়। সে সময় হযরত ওমর (রা·) অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা ছিলেন। তখন রাজ্যের বিভিন্নস্থানে চিঠিপত্র প্রেরণের ড়্গেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হয়। তাই তিনি সমসাময়িক সাহাবায়ে কেরামদের পরামর্শক্রমে এই কার্যক্রম পরিচালিত করেন। পৃথিবীতে আজ নানারকম আগ্রাসনে অসহায় মানুষ দিশাহারা। ধর্মগত, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত প্রভাবে উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। তা থেকে বের হয়ে আসার কোন উপায় যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

যার কারণে হিজরী নববর্ষ নিয়ে কোন সাড়া-শব্দ নেই। মহররম আসে আমাদের পুরাতন বছরের জরাজীর্ণতাকে মুছে দিয়ে নতুনরূপে, নতুন স্বপ্নে ডানা মেলে, নতুন প্রত্যাশার ভেলায় চড়ে আজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার ও দুরন্ত সাহসীকতার পথে নির্ভীক পথ চলার কল্যাণময় শুভ বার্তা নিয়ে। গভীরভাবে লক্ষ্য করুন যদি এই নববর্ষ নিরবে নিঃশব্দে চলে যায় তাহলে আমরা কিভাবে নতুন শপথ ও প্রত্যয় নিয়ে পথ চলবো? সবচেয়ে বড় কথা হলো- হিজরী সনের যে প্রেড়্গাপট তা যে কোন মুমিন মুসলামান হৃদয়ে নবী প্রেমের অকৃত্রিম ভালবাসা ও যশোগাঁথা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা কি হয়? হয় না তার কারণ আমরা হিজরী সনের মর্মকথা পটভূমি ও প্রেক্ষাপট জানি না, জানার চেষ্টাও করি না। সে দিন ছিল ১২ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রীষ্টাব্দ। হযরত মুহাম্মদ (স·) মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেছিলেন আলস্নাহ তায়ালার নির্দেশে। কারণ পৃথিবীতে যত নবী রসুল এসেছিলেন সকল নবীও রসুলেরা নির্যাতিত হয়েছেন।

অনেকেই হিজরত করতে বাধ্য হয়েছেন। তেমনিভাবে হযরত মুহাম্মদ (স·) ৬১০ খ্রীষ্টাব্দে নবুওয়াত পাওয়ার পর আলস্নাহ অস্বীকারকারীদেরকে এক আলস্নাহর দিকে আহ্বান করেছিলেন তখন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষেরা বিরোধীতা শুরম্ন করেছিল। গোপনে গোপনে তিন বছর দাওয়াত দিয়েছিলেন। এর পর আলস্নাহর নির্দেশে সাফা পাহাড়ে প্রাকশ্যে এক আলস্নাহর উপর ঈমান আনয়নের ঘোষণা করেছিলেন। তখন থেকেই আরম্ভ হয়েছিল নির্যাতন। পথে প্রান্তে তাকে অপমানিত লাঞ্চিত করা হতো। নামাজরত অবস্থায় উটের নাড়ী ভুড়ি তাঁর পিঠের উপর চাপিয়ে দেয়া হতো। গমনা-গমনের পথে কাটা বিছিয়ে রাখা হতো। শিয়াবে আবু তালিব নামক শিবিরে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এরপর তার সঙ্গি সাথী সাহাবীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছিল। তাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো হযরত খাব্বব (রা·), তালহা (রা·), আবদুর রহমান বিন আউফ (রা·), হযরত বেলাল (রা·) আম্মার ইয়াছির ও সুমাইয়া। হযরত বেলাল (রা·)কে তো মুরম্ন ভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশির উপর চিৎ করে শোয়ায়ে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো। এই অবস্থায় অত্যাচারী উমাইয়া বিন খলফের চাবুকের প্রচন্ড আঘাতে তার গোটা শরীর জর্জরিত হয়ে যেত। হযরত আম্মার ইয়াছির, সুমাইয়া এদের উপরও এই নির্যাতনের ষ্টিম রোলার চালানো হয়েছে। কাফেলারা নবীজীকে শারীরিক নির্যাতনে যখন দ্বীনের দাওয়াত থেকে স্তôব্ধ করতে পারলোনা তখন মানুষিক নির্যাতন দেয়ার জন্য নানা রকম ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগলো। তারা তাকে পাগল, কবি, জাদুকর ইত্যাদি বলে অপপ্রচার করতে থাকলো। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না। বরং মুহাম্মদ (স·) তাঁর মিশন সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন। একদিন তারা নদওয়া নামক তাদের মন্ত্রণাগৃহে সকল গোত্র পতিদের একটি বৈঠক করলো। সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, “আমরা নানা রকম কৌশল করে মুহাম্মদ (সাঃ) কে ঠেকাতে চেয়েছি। কিন্তু সে তো থেমে থাকার লোক নয় বরং তার চেয়ে আমরা মুহাম্মদ (সাঃ) কে দুনিয়া হতে সরিয়ে দেই”। সকলে এই সিদ্ধান্তেôর উপর সমর্থন করলো, তারা সকল গোত্র হতে শক্তিশালী যুবকদের বাছাই করলো। তাদেরকে ঘোষণা দিল, ‘যে মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন্তô অথবা মৃত দেহ এই নদওয়া গৃহে হাজির করতে পারবে। তাকে একশত উট পুরস্কার দেয়া হবে।” যেই কথা সেই কাজ। মক্কার সকল গোত্র হতে শক্তিশালী পাহলোয়ান যুবকেরা একত্রিত হয়ে শপথ নিয়ে বের হলো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাড়ী ঘেরাও করে তাকে আজ রাতেই তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাবে।

এদিকে আলস্নাহতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে নির্দেশ করলেন হে নবী মক্কার মানুষ আপনাকে চায় না। মদীনার মানুষেরা আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেড়্গা করছেন। আপনি মদীনায় হিজরত করে চলে যান। মহানবী (সাঃ) আলস্নাহতায়ালার এই ঘোষণা পাওয়ার পর রাতের অন্ধকারে নিজ বিছানায় হযরত আলী (রাঃ) কে শায়িত রেখে মদীনার পথে রওনা দিলেন। সাথী হিসেবে বন্ধু আবু বকর (রাঃ) কে সঙ্গে নেয়ার জন্য তাঁর বাড়ীর সামনে গিয়ে, আবু বকর! বলে একবার ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আবু বকর (রাঃ) বেরিয়ে এলেন। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এলে? জিজ্ঞাসা করলেন হযরত (সাঃ)। আবু বকর (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসুলুলস্নাহ (সাঃ)! যেদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন, ‘ হে আবুবকর মক্কার কাফেলারা বড়ই ড়্গিপ্ত হয়ে উঠেছে। কবে কখন হয়ত মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করতে হতে পারে। সেদিন হতে একটি রাতের জন্যও আমি বালিশে মাথা রেখে ঘুমাই নাই। কারণ আমি আরাম করে ঘুমিয়ে থাকবো আর কাফেরেরা আপনাকে ধাওয়া করবে আপনি আমাকে ডেকে ডেকে পাবেন না। কাফেরেরা আপনাকে আঘাত করবে, যখম করবে। আমি আবু বকর এটা সইতে পারবো না। মহানবী (সাঃ) বললেন আবু বকর! চলো আর নয় এখানে। কারণ আলস্নাহর নির্দেশ মদীনায় হিজরতে যাওয়ার।’ তারা চললেন মদীনা অভিমুখে। চলতে চলতে রাত শেষ হয়ে সুবহে সাদিক হয়ে গেল। রসুল (সাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) তখন মক্কার অনতি দূরে সওর নামক পর্বতের সন্নিকটে। তারা ভাবলেন কাফেরেরা হয়ত তাকে বাড়ীতে না পেয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। সুতরাং এখানে রাতে আত্মগোপন করে থাকা যাক। তারপর তারা কিছুটা নিবৃত হলে আবার রওনা দেওয়া যাবে। সে হিসেবে সওর পর্বতের একটি গুহার মধ্যে ঢুকলেন। এই গুহায় বিষধর সাপ ছিল। হযরত আবু বকরকে সাপে দংশন করেছিল। মহানবী (সাঃ) তাঁর মুখের থুথু বা লালা আবু বকরের ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিষ চলে গেল।

এদিকে সকাল পর্যন্ত কাফেরেরা রসূল (সাঃ)-এর বাড়ীর চুতুষ্পার্শ্বে ঘিরে থেকে তাকে বের হতে না দেখে বাড়ীতে ঢুকে পড়লো। তারা রসূল (সাঃ)-এর ঘরে হযরত আলী (রাঃ)-কে পেয়ে তাকেই জিজ্ঞাসা করলো -বল! মুহাম্মদ (সাঃ) কোথায়? হযরত আলী (রাঃ) বললেন, মুহাম্মদ (সাঃ) কোথায় সেটা তোমরা দেখ, আমি কি বলবো? এমতাবস্থায় কাফেরেরা সিদ্ধান্ত নিল-মুহাম্মদ (সা·) হয়ত মক্কা হতে মদীনার পথে রওনা দিয়েছে। সুতরাং আর কালড়্গেপন না করে এখনই চলো তা না হলে আমাদের শিকার হাতছাড়া হয়ে যাবে। তারা পথে প্রান্তেô না পেয়ে ভাবছে মুহাম্মদ (সাঃ) নিশ্চয়ই মক্কার আশে পাশে কোন গুহা অথবা অন্য কোন স্থানে আত্মগোপন করে আছে বিধায় কেবলমাত্র পথ নয় পাহাড়-পর্বত এর মাঝে গর্ত গুহা থাকলে সবই খুঁজতে হবে। এসময় কাফেরেরা রসূল (সাঃ) ও আবুবকর যে গুহায় ছিলেন সেদিকে আসছিল। দূর হতে তাদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) ভয় পাচ্ছিলেন। আর বলছিলেন, ‘হে মুহাম্মদ (সাঃ)! ঐ দেখুন শত্রম্নদের পদধ্বনি শোনা যায়। তারা হয়ত আমাদের ধরে ফেলবে।’ মহানবী (সাঃ) তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘ভয় পেওনা আবুবকর! আলস্নাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ কুরআনে আলস্নাহতায়ালা এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আয়াত নাযিল করেছেন, “ইজহুমা ফিল গারে, ইজ ইয়াকুলু লিসাহিবিহি লা তাহবান ইন্নালস্নাহা মাআনা” অর্থাৎ হে নবী (সাঃ) সেই সময়ের কথা স্মরণ করম্নন। যখন আপনি ও আপনার মহানবী গুহার মধ্যে ছিলেন আর আপনার সাহেবী বলছিলেন, ঐ দেখুন শত্র্র্রু আমাদের ধরে ফেললো! তখন আপনি বলেছিলেন ভয় পেওনা, আলস্নাহ আমাদের সঙ্গে আছেন’। তারপর আলস্নাহ কি করলেন? ঐ গুহায় মাকড়সা পাঠিয়ে দিলেন। তারা মুহূর্তের মধ্যে পুরা গুহার মুখ জাল বুনে ঘিরে ফেললো। একটি কবুতর পাঠিয়ে দিলেন। যে ডিম পেড়ে গুহার মুখে’তা দিতে থাকল।

কাফেলারা যখন ঐ গুহার পাশে এলো তখন একজন বললো, দেখ দেখ এই গুহাটিও দেখ। কারণ এখানেও তো তিনি থাকতে পারেন। অন্য একজন বললো, এই গুহায় যে মুহাম্মদ (সা·)নেই তা আমি নিশ্চিত বলতে পারি। কারণ গতরাতেই যারা এসেছে তারা যদি এই গুহায় ঢুকতো তাহলে মাকড়সার জাল ছেড়া থাকতো। আর যে গুহায় লোক থাকে তার মুখে কবুতর ডিমে তা দেয় কেমন করে? সুতরাং অন্যদিকে চলো। এরপর কাফেররা মক্কা থেকে মদীনায় যাওয়ার সকল পথে পাহারাদার নিযুক্ত করলো। কিন্তু মহানবী (সাঃ) এই গুহায় তিনদিন তিন রাত থাকার পর অচেনা-অজানা পথে লোহিত সাগরের তীর দিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে চলতে থাকলেন। পথে আরবের বড় পীর সুরাকা মহানবী (সাঃ)কে হত্যা করতে এসে নিজেই মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। বারিদা নামক অন্য আরেকজন পুরস্কারলোভী ৭০ জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের নিয়ে পথে দাঁড়িয়েছিল। তারাও মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। এরপর মদীনায় পৌঁছলেন। মদীনার আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সকলে মহানবী (সাঃ)-কে স্বাগতম জানালেন। তাকে মদীনার মানুষেরা নেতা মেনে নিলেন। তিনি মদীনা রাষ্ট্রের অধিপতি হলেন। অনেকগুলি যুদ্ধ-বিগ্রহ হলো। সবশেষ মক্কা বিজয় হলো। সমগ্র আরব ভূ-খন্ডে ইসলামের আদর্শ, কুরআনের আলো প্রজ্বলিত হলো এবং তাঁর ইন্তেôকালের পর খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর খেলাফতকালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা হতে মরক্কোর রাবাত পর্যন্ত মুসলমানদের করতলগত হলো। এরপর ইসলামের মহিমা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। যা কেয়ামত অবধি টিকে থাকবে। রাসুলুলস্নাহর (সাঃ)-এর হিজরতের এই প্রেড়্গাপট, পটভূমি যদি হিজরী নববর্ষে স্মরণ করা হয় তাহলে প্রতিটি মুমিন হৃদয়ের আমূল পরিবর্তন হতে পারে।
মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী

কোন মন্তব্য নেই: