অপরাধ দমনে ইসলামের ভূমিকা
কোন অপরাধীই অপরাধীরূপে জন্মগ্রহণ করে না। যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে নিষ্পাপ থাকে। তা’ছাড়া অপরাধী সেও সমাজের একজন। সে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে না। সে হয়ত বা আমাদের কারো আত্মীয় নয়তো বা প্রতিবেশী নয়তো বা সহকর্মী ইত্যাদি। আমরা যদি আত্মীয় হিসেবে তার প্রতি যে দায়িত্ব কর্তব্য ছিল তা পালন করতাম, আমরা যদি প্রতিবেশী হিসেবে তার প্রতি যে দায়িত্ব কর্তব্য ছিল-তা পালন করতাম, আমরা যদি সহকর্মী হিসেবে তার প্রতি যে দায়িত্ব ছিল তা পালন করতাম তাহলে সম্ভবতঃ কোন ব্যক্তিই অপরাধীরূপে চিহ্নিত হত না এবং কোন মানুষই অপরাধ করতে পারত না।
কোন মানুষই একদিনে বড় অপরাধী হয়ে ওঠে না। ছোট-খাট অপরাধ করতে করতে বড় অপরাধে পা বাড়ায়। কেউ কোন অন্যায় কাজ করে ফেললে আমরা সকলে মিলে যার যার সামর্থø অনুযায়ী কৌশলে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করি ( তাকে বুঝাই-অন্যায় বলে তিরস্কার করি) তবে তিনি হয়ত কোন এক সময় তার ভুল বুঝতে পারবেন। কেননা এক মনীষী বলেছেন- “আপন চোখ সবকিছু দেখতে পায়-নিজেকে দেখতে পায় না।”
আমরা অনেক সময় নিজের ত্রম্নটি নিজে দেখতে পাই না। কিন্তু পাশে যারা থাকেন তারা যদি আলস্নাহর হুকুমের প্রতি খেয়াল রেখে সময় সুযোগ বুঝে বলতে থাকেন তবে অবশ্যই আলস্নাহপাকের মদদে তিনি একদিন তার ভুল বুঝতে পারবেন এবং অনাকাঙিড়্গত পরিস্থিতি থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। কিন্তু বাস্তôবে আমরা ভাবি অমুক আমার আত্মীয়, বন্ধু লোক, সহকর্মী দলের লোক-তাকে কি করে বাঁচানো যায়, রেহাই দেয়া যায় সে উপায়, পথ খুঁজতে থাকি। ফলে অপরাধী আরও সাহস পেয়ে যায়, উৎসাহ পায়। তবে অপরাধী কেন অপরাধ করল অপরাধের কারণ তথা তার সুখ-দুঃখের কথাগুলো তথা তার বক্তব্য শোনা যায় এবং যাচাই করে বিশেস্নষণ করা যায়। হয়ত হতে পারে আমাদের কারও অবহেলা/নির্যাতন, যুলুমের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। সে যখন বঞ্চিত হয়, নির্যাতিত হয় তখন সে আত্মরড়্গার চেষ্টায় প্রতিবাদ করে, প্রতিরোধ তৈরি করে। এভাবেও সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। সন্ত্রাসী কোন দলের নয় কথাটি অত্যন্তô সঠিক। সন্ত্রাস বেড়ে চলছে এবং এর প্রতিরোধে সমাজের অনেক কিছু করণীয় আছে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সহকর্মীকে ঘিরে ৮০% ভাগ অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে।
আমাদের সন্তôানদের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিড়্গায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিড়্গিত/সচেতন ব্যক্তিদেরকে প্রথমতঃ ইসলামের শিড়্গা তথা আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। ইসলামের আদর্শ মেনে চলার মধ্যে আছে অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা তথা শান্তিô। তাই ইসলামের শিড়্গা/ আদর্শ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা দরকার। ইসলামের আদর্শ-ইসলামের শিড়্গা নামক প্রবন্ধে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমরা যারা সচেতন হিসেবে পরিচিত অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যাদেরকে সচেতন হিসেবে (১০%-২০%) ভাবেন তারা যদি ইসলামের শিড়্গা/ আদর্শ মেনে চলতে সচেষ্ট হতাম তবেই সমাজের মঙ্গল হত এবং অপরাধ কমে যেত। কেননা সচেতন জনগণ সকল অবস্থায় সমাজের সম্পদ। সাধারণ মানুষ এদের আচার ব্যবহার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়। এক কথায় আলস্নাহর দ্বীন বাস্তôবায়নই মুখ্য উদ্দেশ্য। মনীষী বলেছেন-“মুখের ভাল ভাল কথায় ভাল কাজ হয় না। ভাল চিন্তôা থেকেই ভাল কাজের সূচনা হয়। ভাল চিন্তôা মানুষের অন্তôরেই জন্মে।” ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) বলেন- “মানুষের অন্তôর হচ্ছে মনিব। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হচ্ছে তার চাকর। অপরাধ প্রবণতা মূলত অন্তôরেই জন্মে।”
মূলতঃ চারটি কারণে অপরাধ প্রবণতা জন্মেঃ-
১। অন্তôরে খোদাভীতির অভাবে, ২। পরস্পরের প্রতি যে দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে তা পালন না করা, ৩। অশস্নীলতা, বেহায়াপনা, নগ্নতা যা অপরাধ তৈরিতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। (প্রত্যন্তô অঞ্চলেও ভি·সি·পি চলে যা ভয়াবহ), ৪। প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকলে।
আইন-শৃঙ্খলাকে একটি ফলজ বৃড়্গের সাথে তুলনা করা যায়। ধরি একটি টম্যাটো গাছ যা থেকে আমরা টমেটো ফল আশা করি। টমেটো ফল পেতে গাছেল শিকড় যাতে পাকায় না কাটে সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে অন্য দিকে প্রয়োজনীয় সেচ এবং সার, ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু শিকড় পোকায় কাটলে সেচ দিয়ে কি টমেটো পাওয়া যাবে? একদিন হয়তো টমেটো গাছটিই মরে যাবে। শিকড়কে পরস্পরের প্রতি যথাযথ আচরণ, অশস্নীলতা বর্জন, খোদাভীতি অর্জনের সঙ্গে তুলনা করা যায় এবং প্রয়োজনীয় সেচ ও সার ওষুধ প্রয়োগের সঙ্গে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
শুধু প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ দ্বারা অপরাধ কমানো সম্ভব নয় এবং আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ও সম্ভব নয়। কেননা অপরাধের নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং সচেতন মানুষদের মধ্যেই অপরাধীকে ছায়া দিতে ব্যস্তô। সমাজে শান্তিô-শৃঙ্খলা আনয়ন করতে হলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের সুমহান আদর্শ বাস্তôবায়ন করতে হবে। ইসলামের মৌলিক দিকই হচ্ছে ইসলামের শিড়্গা তথা আদর্শের আলোকে মানব জীবনকে আলোকিত করা।
কেননা হুজুরপাক (সাঃ) ঘোষণা করেন, “উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী পূর্ণতা দানের জন্য আমি নবীরূপে প্রেরিত হয়েছি।” নবীদের কাজই হল উত্তম চরিত্র শিড়্গা দেয়া। তৎকালীন আরবের অসভ্য, বর্বর লোকগুলো হুজুরপাক (সাঃ)এৈর সান্নিধ্যে এসে সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।
পাক-ভারত উপমহাদেশে যারা ইসলামের আদর্শ কায়েম করে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মুসলিম মনীষী ছিলেন বাগেরহাটের হযরত খানজাহান আলী (রহঃ)। তিনি পারস্য দেশীয় একজন মুসলমান ছিলেন। প্রায় ছয়শত বৎসর পূর্বে মুহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে ইসলাম প্রচারে ভারতবর্ষে আগমন করেছিলেন একজন সুবেদার হিসেবে। তিনি এদেশে সুবেদার হয়ে এসে থাকলে ও ইসলাম প্রচার করা এবং ইসলাম এদেশে কায়েম করাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। যখন তিনি এলেন তখন দেখলেন এটি সম্পূর্ণ মুসলিম বিবর্জিত বৌদ্ধ, বাগ্মি, পৌধ অধ্যুষিত এলাকা। ধর্ম প্রচারের খাতিরে এদেশে এসে বিধর্মীদের সাথে (আত্মরড়্গামূলক) সশস্ত্র জিহাদ করতে হয়েছে। আবার তাকে নবী করিম (সাঃ) এর পর খলিফাদের মত বাদশাগিরিও করতে হয়েছে ইসলামকে জিন্দা রাখার খাতিরে। মানব কল্যাণের জন্য ও এই শান্তিôর ধর্মে মানবকে দীড়্গিত করার জন্য জোর করে জবরদস্তিô করে নয়- ইসলামকে নিজের জীবনে আচরণে প্রতিফলিত করে মানুষকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করে। তার জীবনী থেকে লড়্গ্য করা যায় নিম্নবর্ণিত চারটি ধাপে ইসলামের আদর্শ বাস্তôবায়ন করতে হবে-
ব্যক্তি পর্যায়েঃ সত্যবাদিতা, বিনয়, নম্রতা, অল্পে তুষ্টি, দায়িত্ব কর্তব্যবোধ, ধৈর্যসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ, ত্যাগ, উদারতা। ব্যক্তিই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। কাউকে শ্রদ্ধা করা, অল্পে তুষ্টি, দায়িত্বের প্রতি আন্তôরিক হওয়া, কারো প্রতি সহানুভূতি দেখানো, কারো ও উপকার করা- এগুলো নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপারÌৈজার করে, আইন প্রয়োগ করে এগুলো নিশ্চিত করা প্রায়ই অসম্ভব।
পারিবারিক পর্যায়েঃ নিজের জীবনে শুধু বাস্তôবায়ন করলে চলবে না। পরিবারের সকল সদস্যকে ইসলামের আদর্শে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে এবং অভ্যস্তô করে তুলতে হবে। কুরআন পাক এবং সুন্নাহও তাই নির্দেশ করে।
সামাজিক পর্যায়েঃ সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণকে শিড়্গা তথা আদর্শ সামাজিকভাবে বাস্তôবায়নে এগিয়ে আসতে হবে এবং এ ব্যাপারে একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। অর্থাৎ সমাজের সকলে যাতে ইসলামের আদর্শ মেনে চলে সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আলস্নাহপাকের হুকুমও তাই।
রাষ্ট্রীয় ও আন্তôর্জাতিক পর্যায়েঃ মানুষ যাতে ইসলামের শিড়্গা/আদর্শ মেনে চলে সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এভাবে পৃথিবীর মানুষ যাতে ইসলামের দাওয়াত পায় সেজন্য সাধ্যমত প্রচেষ্টা করা।
মানব সভ্যতা আজ ভাগ্য বিপর্যয়ের শিকার। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় জর্জরিত এবং উদভ্রান্তô। শূন্যতা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই তার ভাগ্যে জুটছে না। আর এই অসহনীয় বাস্তôবতা থেকে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয় লাভের জন্য আফিম, হেরোইন ও যাবতীয় নেশাকর দ্রব্য সেবন করে সামান্য সময়ের জন্য হলেও শান্তিô চায়। বস্তুগত প্রাচুর্য, পর্যাপ্ত উৎপাদন, উচ্ছল ও বিলাসী জীবন-যাপন যত্নে ও শোচনীয় দুর্দশায় আজ পতিত। বরঞ্চ বস্তুগত সুখ-সমৃদ্ধি সভ্যতার উপকরণের উপচে-পড়া প্রাচুর্য ও সুযোগ-সুবিধার ব্যাপকতা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে-শূন্যতা, উদ্বেগ ও উদভ্রান্তিô ততই প্রকটতর হচ্ছে।
বর্তমান ঝঞ্ঝা বিড়্গুব্ধ পৃথিবীতে একমাত্র ইসলামই পারে শান্তিôর পরিবেশ তৈরি করতে। ইসলামের শিড়্গা/আদর্শ আমাদের অধিকাংশের আচরণে অনুপস্থিত। জর্জ বানার্ড’শ বলেছেন-“ইসলামেই সকল যুগের সকল মানুষের ধর্ম।” অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম হচ্ছে সার্বজনীন ধর্ম। ইসলামের আদর্শ মেনে চলার মধ্যেই শান্তিô নিহিত রয়েছে। আজকের সময়ে বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ নসিহত, সেমিনার, আলোচনা সভা যত বেশি বেশি হয়ে থাকে বিগত দিনে কিন্তু এত আলোচনা সভা হত না। তবু অপরাধ প্রবণতা যেন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যখন আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য থেকে দূরে সরে যাব তখন আলস্নাহপাকের রহমত আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। তাই আলস্নাহপাক ঘোষণা করেন- ‘যা কিছু মঙ্গল আলস্নাহর তরফ থেকেই -যা কিছু অমঙ্গল তা মানুষের হাতের কামাই।” (সূরা নিসা-৭১)
মোঃ আজিজুর রহমান
1 টি মন্তব্য:
ধন্যবাদ......নতুন ধরনের বিষয়ের উপর লেখার জন্য
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন