মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত, আল্লাহ ও রাসূল সাঃ-এর প্রিয় ও খাস মেহমান সম্মানিত হাজীদের হজ শেষে দেশে আগমনকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা, মুবারকবাদ ও স্বাগতম। রাসূল সাঃ বলেন, ‘হজ সমাপনকারী সদ্যজাত ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ।’ রাসূল সাঃ আরো বলেন, ‘হজের বিনিময় একমাত্র জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়।’ (আল-হাদিস)
পবিত্র হজ পালনকারী আল্লাহর খাস মেহমান ও প্রিয় বান্দারা দেশে আগমন করার সাথে সাথেই শুরু হবে তাদের আত্মজিজ্ঞাসা এবং আত্মসমালোচনা ও শুষ্ক মরুপ্রান্তরে যখন আল্লাহর রহমতের বারিধারা মুষলধারে বর্ষিত হয় তখন ধরণীর ধুলার ধারাসহ সব ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে মুছে মরুভূমি যেমন হয় পূত-পবিত্র তেমনি হয় তার বুকের তরুলতা, গাছ-গাছালি তরু তাজা, ফুলে ফলে হয় সুশোভিত, ঠিক তেমনভাবেই হজ সমাপনান্তে প্রত্যেক হাজী সর্বপ্রকার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে তাদের অন্তর, মন আত্মা ও দেহ বিবেক বুদ্ধি হয় পূত-পবিত্র এবং আল্লাহর গুণে গুণান্বিত। প্রত্যেক হাজীকে নবজীবন ধারণ করে আলোকময় সমাজ গড়ার চেষ্টা করতে হবে। আর এ চেষ্টা করাটাই হবে হজের সার্থকতা।
হাজীরা হজের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর যে যেভাবে মক্কা শরিফ গমন করেন সে সেই অবস্থায়ই আল্লাহর গৃহ কাবা শরিফ দেখা মাত্রই এবং আল্লাহর গৃহ তাওয়াফকালীন সময়ে আবেগাপ্লুত হয়ে মনের গভীর থেকে আল্লাহর কাছে প্রেম নিবেদনের সময় বলতে থাকেন লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নেয়মাতালাকাল মুলক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। অর্থ ‘হে প্রভু! দয়াময় খোদা! আমি তোমার দরবারে হাজির, তোমার কোনো শরিক বা অংশীদার নেই, আমি তোমার দরবারে হাজির হতে পেরে তোমার সব নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।’ প্রত্যেক হাজী কাবাগৃহের সামনে এবং বিশাল আরাফাতের ময়দানে এ কথাগুলো বারংবার মনের আবেগে উচ্চারণ করে থাকেন।
প্রত্যেক হাজী হজ পালন করার সময় বারংবার যেভাবে তালবিয়া পাঠের মধ্যে সে নিজেকে আল্লাহর সমীপে উৎসর্গ করে থাকেন, ঠিক তেমনভাবে হজ শেষে দেশে ফিরে তার প্রতিটি মুহূর্ত ও কর্মক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করা এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা একান্ত কর্তব্য। হজ পালনকারী ব্যক্তি হজের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য। আমাদের প্রিয় নবী উম্মতের কাণ্ডারি রহমতের ভাণ্ডার, হজরত মুহাম্মদ সাঃ যেভাবে তার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক জীবন অতিবাহিত করেছেন সেভাবেই প্রত্যেক হাজীকে তাদের নতুন জীবন শুরু করতে হবে। নতুবা হজ পালনকারী হাজীদের আসল উদ্দেশ্য সফল হবে না। আর হজেরও যথাযথ মূল্যায়ন হবে না।
প্রত্যেক হজ পালনকারী আল্লাহর মেহমান। হাজীরা মুসলিম মিল্লাতের জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিমসহ (আঃ) ইসমাঈল (আঃ) এবং আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ সাঃ সুন্নাত তরিকা অনুসারে মিনাপ্রান্তরে শয়তানের উদ্দেশে তিনটি জামরাতে তিন দিনে ৭ ী ৭-৪৯টি পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন। মূলত সেগুলো কিন্তু শয়তান নয়, তা ছিল শয়তানের প্রতীক মাত্র। আর সেখানে পাথর নিক্ষেপ করাও একটি প্রতীকী স্মৃতি চিহ্ন কাজ মাত্র। মানুষকে সৎ পথ থেকে দূরে সরানোর লক্ষ্যে শয়তান হাজীদের পদে পদে ধোঁকা দেবে তাই শয়তানকে উপেক্ষা করে সৎ পথে থাকার জন্য দৃঢ় চেষ্টা ও আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োজিত থাকতে হবে।
প্রত্যেক হাজী হজের নীতি অনুসরণে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে সর্বপ্রকার পাপাচার-কামাচার ভোগ-বিলাস, হিংসা, অহঙ্কার, ক্ষোভ, সুদ, ঘুষ, জুয়া, মদপান, ধূমপান, দাড়ি কামানো গিবত, শেকায়াত, অপচয় খেল-তামাশাসহ মিথ্যা কথা ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিহার করতে হবে। সর্বপ্রকার পাপকাজ থেকে বিরত থেকে শয়তানের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা ধিক্কার, উপেক্ষাই হবে মিনার ময়দানে শয়তানের উদ্দেশে পাথর নিক্ষেপ করার বাস্তব নমুনা হাজীরা মিনার ময়দানের পাথর নিক্ষেপের পর আল্লাহর প্রেমে পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন, মনে রাখতে হবে এই পশুটি কোরবানি করাও একটি প্রতীকী বা স্মৃতি চিহ্ন আমল বা কাজ। আল্লাহ হজরত ইব্রাহিমকে (আঃ) স্বপ্নের মাধ্যমে আদিষ্টিত করেছেন তার প্রিয় বস্তুটি কোরবানি করার জন্য। হজরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর প্রেম-প্রীতি ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে প্রায় ৯৯ বছর বয়সে প্রাপ্ত একমাত্র সন্তান ইসমাঈলকে (আঃ) আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি করার জন্য চরমভাবে আত্মত্যাগের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। ইব্রাহিম (আঃ) সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর উদ্দেশে আত্মত্যাগের মহান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খলিল উপাধি লাভ করেন। যার ফলে মহান আল্লাহতায়ালা তার কাজে খুশি হয়ে তার একমাত্র সন্তানের পরিবর্তে একটি পশু কোরবানির জন্য ছুরির নিচে হাজির করে দেন। এ ঘটনাটি আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয় হয়েছে বিধায় আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রেম নিবেদনের স্মৃতিটুকু ধরে রাখার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত সব সামর্থøবান মুসলমানের ওপর কোরবানি ওয়াজিব করেছেন।
পশু কোরবানি করা প্রতীকী বা স্মৃতি চিহ্ন আমল। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব সকল! জেনে রেখো কোরবানির গোশত ও রক্ত কিছুই আমার কাছে পৌঁছে না। কেবলমাত্র পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া, আমি দেখতে চাই তোমরা কে কতটুকু আমাকে ভালোবাস এবং ভয় করো।’
আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী খরচ করাই কোরবানির প্রধান লক্ষ্য, উদ্দেশ্য। তাই আল্লাহপাক বলেন, ‘হে আমার বান্দা সকল! তোমরা বলো, নিশ্চয় আমার সালাত বা নামাজ, আমার কোরবানি বা আত্মত্যাগ, আমার হায়াত বা জীবন, আমার মরণ সব কিছুই বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করলাম। তাই প্রত্যেক হাজীর উচিত হজ থেকে ফিরে এসে হজের সব বিধিবিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য চেষ্টা করা।
মাওলানা আবুল হোসাইন পাটওয়ারী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন