শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০০৮

সন্তানের ব্যাপারে মা-বাবার জবাবদিহিতা


সন্তানের ব্যাপারে মা-বাবার জবাবদিহিতা



আল্লাহতায়ালা মানুষকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। এমনি একটি নেয়ামত হলো সন্তান-সন্তুতি। এ সন্তান যখন দুনিয়াতে আসে তখন সে ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতা নিয়েই আসে। এটাকে আরবিতে ফিতরাত বলা হয়। কিন্তু পরে সে মা-বাবার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নানা রকম মত ও পথ গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাঃ বলেছেন, ‘প্রতিটি শিশুই ফিতরাত তথা ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতাসহ জন্মগ্রহণ করে। তার পর তার মা-বাবা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান অথবা অগ্নিপূজক বানায়। (বুখারি ও মুসলিম)
সহজেই অনুমেয় যে, সুন্দর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার যোগ্যতা প্রতিটি শিশুর মধ্যেই বিদ্যমান আছে। যদি শিশুর মা-বাবা এ ব্যাপারে যত্নবান হয় এবং পরিবেশ যদি সুন্দর চরিত্র গঠনে অনুকূলে থাকে তাহলে শিশুর মধ্যে অনুপম চরিত্রের বিকাশ ঘটে। আর যদি মা-বাবা এ বিষয়ে যত্নবান না হয় কিংবা পরিবেশ যদি চরিত্র গঠনের অনুকূলে না থাকে তবে শিশুর চরিত্র বিনষ্ট হয়ে যায়। কাজেই বুঝা যাচ্ছে সন্তানকে সচ্চরিত্রবান করা কিংবা অকার পথে ঠেলে দেয়ার একমাত্র রূপকার তার মা-বাবা । পবিত্র ধর্ম ইসলাম মা-বাবাকে সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশে দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ প্রদান করেছে এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিধৃত করেছেন।

সন্তানের প্রতি মা-বাবার প্রাথমিক পর্যায়ের কয়েকটি দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে­ যা যথাযথভাবে দায়িত্বশীলতার সাথে পালনের মাধ্যমেই সন্তানকে সৎ, চরিত্রবান এবং একজন পূর্ণাঙ্গ আদর্শ মানুষের মূর্ত প্রতীক বানানো সম্ভব। মহানবী সাঃ সন্তানের প্রতি মা-বাবার দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলতে গিয়ে ঘোষণা করেন, ‘মা-বাবার প্রতি সন্তানের হক হচ্ছে ­ প্রথমত, তিনটি। ১. জন্মের পর পরই তার জন্য একটি সুন্দর নাম রাখা, ২. জ্ঞান বৃদ্ধি হলে তাকে কুরআন তথা দীন শিক্ষা দেয়া, ৩. আর সে যখন বালিগ হবে তখন তার বিয়ের ব্যবস্থা করা।’ বস্তুত সন্তানের ভালো নাম না রাখা, কুরআন ও দীন শিক্ষা দান না করা এবং বালিগ হওয়ার পর তার বিয়ের ব্যবস্থা না করা মা-বাবার জন্য অপরাধের শামিল। এ সব কাজ না করলে মা-বাবার পারিবারিক দায়িত্ব পালিত হতে পারে না এবং ভবিষ্যৎ সমাজ ও ইসলামি আদর্শ মোতাবেক গড়ে উঠতে পারে না। এ কারণেই ইসলাম উপরিউক্ত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ করে শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি জোর তাগিদ প্রদান করেছে। ইসলামে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর জ্ঞানার্জন ফরজ। এ ফরজ কোনো বিশেষ শ্রেণী, দল বা জাতির জন্য নয়। বরং এ হচ্ছে এমন একটি সর্বজনীন অধিকার যা প্রতিটি মানুষকে শামিল করে। এ ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের শিক্ষা দাও।’ ইসলাম সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি কতটা যত্নশীল তা বুঝা যায় বদরের যুদ্ধে বন্দী মুক্তির ঘটনায়। এ যুদ্ধে কিছুসংখ্যক বন্দী এ শর্তে মুক্তি পায় যে তারা দশজন করে মুসলিম সন্তানকে লেখাপড়া শেখাবে।
ইসলাম সন্তানদের আদব-কায়দা, শিক্ষা-দীক্ষা ও সচ্চরিত্রবান করার ব্যাপারে মা-বাবাকে এ রকম তাগিদ দেয়া সত্ত্ব্বেও আমাদের সমাজের চিত্র অনেকটা ব্যতিক্রম। আমাদের সমাজের তথাকথিত এলিট শ্রেণীর লোকদের কাছে এখন ধর্মীয় শিক্ষার চেয়ে পাশ্চাত্য ধারণার রুচিহীন সেকুলার শিক্ষা খুবই সমাদৃত। ফলে আমাদের তরুণ-তরুণীদের নৈতিকতার চরম অবক্ষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। গত ২৭ জুলাই ’০৮ একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিক পত্রিকায় অভিজাত এলাকায় নাইট পার্টির নামে যা হচ্ছে­ শিরোনামে নগ্ন ছবি সংবলিত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সে ছবিটি দেখলে নিজেকে বিশ্বাস করানো কঠিন যে এটা কোনো মুসলিম দেশের মুসলমান সন্তানদের কীর্তিকাণ্ড! ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রাজধানীর অভিজাত পাড়ার কিছু হোটেল রেস্তোরাঁয় নাইট পার্টি আবারো জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতি রাতেই তারা আয়োজন করছে ড্যান্স ও ড্রিংকস পার্টি। প্রাপ্ত বয়স্কদের পাশাপাশি অল্প বয়সী অনেক কিশোর-কিশোরীকেও দেখা যায় এ সব পার্টিতে।

রাতভর উন্মাতাল নাচগান শেষে নেশায় বুঁদে হয়ে শেষ রাতে ঘরে ফিরে যায় তারা। এ ধরনের নাইট পার্টিতে অপ্রীতিকর ঘটনাও অহরহ ঘটার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এ প্রতিবেদন পড়ে বারবার মনের মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি মারছে যে, উঠতি বয়সী সন্তানকে নাইট ক্লাবে পাঠিয়ে মা-বাবা আরামে ঘুমাচ্ছেন­ তারা কেমন মা-বাবা? তাদের মধ্যে কী সন্তানের ব্যাপারে একটুও দায়িত্বানুভূতি নেই? তারা কেন বা কোন স্বার্থে ‘লিভ টুগেদার’কে বর্তমান সমাজের বা যুগের চাহিদা বলে নিজেদের সন্তানদেরকে অকার জগতে ঠেলে দিচ্ছে? তাদের মধ্যে কী পরকালীন কোনো ভয়-ভীতি নেই? তাদের বুঝা উচিত, আল্লাহতায়ালা তাদের যে সন্তান দিয়েছেন সে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করার দায়িত্বও তাদের দিয়েছেন। তারা সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাদের আসামি হিসেবে আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মহানবী সাঃ মা-বাবাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই রাখাল (দায়িত্বশীল), তোমাদের প্রত্যেককেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞসা করা হবে। (বুখারি) আর আল্লাহতায়ালা তো আরো সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ‘তোমরা নিজে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচ এবং তোমাদের আহল তথা পরিবারকেও বাঁচাও। সুতরাং সন্তানকে সৎ ও সচ্চরিত্রবান করার ক্ষেত্রে মা-বাবাকে কখনোই গাফলতি করা সমীচিন নয়। মা-বাবার উচিত তাদের সন্তানদের হজরত লোকমান আঃ-এর মতো নসিহত করা। তাদের চরিত্রবান করে গড়ে তোলার জন্য এক দিকে মা-বাবা যেমনিভাবে সচেষ্ট থাকবেন অপর দিকে আল্লাহর দরবারে দোয়া করবেন। কেননা আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া মানুষের চেষ্টা কখনো ফলপ্রসূ হতে পারে না। কুরআন মজিদে মা-বাবাকে তাদের সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার উপদেশ এবং শিক্ষা দেয়া হয়েছে। সূরা ফুরকানে আল্লাহর নেক বান্দাদের অন্যান্য গুণের সাথে এ গুণটির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহর নেক বান্দাহ তারাই যারা সব সময় এই বলে দোয়া করে হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি দান কর যারা আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর হবে। (২৫ঃ৭৪) আর সুসন্তান রেখে যাওয়ার ফায়দা সম্পর্কে মহানবী সাঃ বলেছেন, মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার আমলের দরজা ব হয়ে যায়। তবে তিনটি কাজ ব্যতীত অর্থাৎ তিনটি কাজের ফল সে মৃত্যুর পরও ভোগ করতে পারে। এক. সাদকায়ে জারিয়া, দুই. এমন এলম­ যা মানুষের উপকারে আসে, তিন. নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করবে। (আল আদাবুল মুফরাদ, পৃ. ৪৯।


লেখকঃ প্রবকার, গবেষক

কোন মন্তব্য নেই: