বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮

ষোড়শ শতকের আরমানিয়ান গির্জা


ষোড়শ শতকের আরমানিয়ান গির্জা



পারস্যের সাফাভি শাসকরা ষোল শতকে পশ্চিমের পাহাড়ি দেশ আরমানিয়া দখলের প্রেড়্গাপটে আরমানিয়ানরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরম্ন করে। মোগলদের সমসাময়িক সময়ে ঢাকায় আরমানিয়ানদের আগমন ঘটে। ভাগ্য বদলের লড়্গ্যে ঢাকায় আসা আরমানিয়ানরা অল্পদিনের মধ্যেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

এখানে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য দ্রম্নত বিস্তôারের মাধ্যমে তারা শহরের গুরম্নত্বপূর্ণ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। আঠারো শতকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা ব্যবসা ছিল লবণ। এই লবণ উৎপাদন এবং বিতরণের জন্য কোম্পানির ঠিকাদারদের অধিকাংশ ছিল আরমানিয়ান। ব্যাবসায়িকে সাফল্যের কারণে আরমানিয়ান পরিবার আঠারো শতকে ঢাকয় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরম্ন করে। ঢাকা শহরের যে স্থানটিতে তারা শ্রেণীবদ্ধভাবে বসত শুরম্ন করে সে স্থানটি আরমানিটোলা নামে পরিচিত। আরমানিটোলা ছাড়াও ঢাকার অনেকাংশে আরমানিয়ানরা ছড়িয়ে পড়েছিল। সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুরের মতে, সব আরমানিয়ানই এক জায়গায় বাস করতো না, কেউ কেউ বাস করতো মৌলভীবাজার নলগোলায়। আরমানিয়ান স্টিফেন থাকতেন আনন্দরায় স্ট্রিটে, তাজমহল সিনেমা হলের স্থলে ছিল পটিয়াটির বাড়ি, কাচাতুরের বাড়ি ছিলো বাবু বাজার পুলের উত্তর পশ্চিমে আর কাজী আলাউদ্দিন রোডের মোড়ে ছিল বাগান বাড়ি, আরমানিয়ান নাগরিক প্রথম দিকে সদরঘাটে থাকলেও পরবর্তীকালে চলে যান মতিঝিলের দিলকুশা এলাকায়।

ইউরোপিয়ানদের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ঢাকার প্রথম যে আরমানিয়ানের নাম জানা যায় তিনি হচ্ছেন কোজা ফানুস কলন্দর, কলন্দর তার সম্প্রদায়ের বণিকদের মালামাল ইংরেজদের জাহাজের বহন করার জন্য ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে-১৬৮৮ সালে একটি চুক্তি করেন। এ চুক্তির সুবাদে ঢাকায় আরমানিয়ানদের অবস্থা সুদৃঢ় হতে শুরম্ন করে। সামাজিক প্রতিপত্তির পাশাপাশি তারা সমাজসেবামূলক কর্মকান্ড শুরম্ন করে।

ঊনিশ শতকে ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী আরমানিয়ানদের মধ্যে ছিলেন পোগজ, আরাতুন, পানিয়াটি, কোজা মাইকেল, মানুক,হার্নি ও সার্কিস প্রমুখ। এরা মূলত ছিলেন জমিদার এবং ব্যবসায়ী। ধারণা করা হয় প্রভাব ও সামাজিক আধিপত্য বিস্তôারের জন্য ঢাকায় বসবাসরত আরমানিয়ানরা পরবর্তী সময়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে জমিদারি কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েন।

ঢাকার আরমানিয়ানরা ছিল বেশ গুরম্নত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নাগরিক। তাদের প্রতি প্রশাসনের সব সময়ই সু-নজর ছিল। তাদের সুবিধার জন্য প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের পদড়্গেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো আরমানিটোলার ঝিলে জমে থাকা পানি নিঃসরণের জন্য খাল খনন। জানা যায় ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেট ডস ১৯১৬ সালে ৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ধোলাই খাল থেকে আরমানিটোলা পর্যন্তô ৭২৩ ফিট দীর্ঘ, ১৮ ফিট প্রস্থ ও ১৬ফিট গভীর একটি সংযোগ খাল খনন কাজ করান। কননকৃত খালের উপর সে সময় একটি পুলও নির্মাণ করা হয়।

পুরনো ঢাকার আরমানিটোলায় ১৭৮১ সালে বসবাসকারী আর্মেনিয়ানদের উদ্যোগে “চার্চ অফ হলি রিজারেকশন” নামে একটি গির্জা নির্মাণ করে। গির্জাটির মিনার চারটি স্তôরে বিভক্ত এবং কয়েক’শ ফুট উঁচু। চারটি দরজা বিশিষ্ট গির্জাটিতে ৭২টি জানালা রয়েছে। গ্রিক স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত গির্জাটির প্রবেশ পথটি বিশাল এবং কারম্নকার্যময়। প্রতি শুক্রবার গির্জায় উপাসনা হয়।

ঢাকায় অবিকৃত অবস্থায় টিকে থাকা এই উপাসনালয়টি আরমানিয়ানদের একমাত্র স্থাপনা। এ গির্জার প্রাঙ্গণে আরমানিয়ানদের ব্যক্তিগত কবরস্থানে অষ্টাদশ শতকের বেশ কিছু পুরনো সমাধিগুলোতে বিভিন্ন ভাষা ও বৈচিত্র্যের সব এফিটাপ। বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকায় প্রভাবশালী আরমানিয়ান নাগরিকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আরাতুন। আরাতুন ছিলেন ঢাকা জার্নাল স্কুলের অধ্যড়্গ। তিনি ঢাকাবাসীর কাছে অধিক পরিচিত ছিলেন সৌখিন আরাতুন নামে। আরাতুন ভালবাসতেন ঘুড়ি ও পায়রা ওড়াতে। মোরগের লড়াই ও তার খুব পছন্দ ছিল। শ্যামবাজারে ‘রূপলাল হাউস’ নামে পরিচিত বাড়িটি আদিতে ছিল আরাতুনের। বর্তমানে শাহবাগ এলাকার বাংলা একাডেমির পার্শ্ববর্তী আণবিক শক্তি কমিশন ভবনের স্থলে ছিল তার বাগানবাড়ি। দড়্গিণ শাহবাজপুর (ভোলা) ও ময়মনসিংহের হোসেন শাহী পরগনায় ছিল আরাতুনের বিশাল জমিদারি। তার মৃত্যুর পরে জমিদারি ভাগ হয়ে যায় তার দুই কন্যার মাঝে। অল্পদিনের মধ্যেই তারা জমিদারি বিক্রি করে পাড়ি জমান কলকাতায়।

আরমানিয়ান নাগরিক নিকি পোগজও ঢাকাবাসীর কাছে ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কোতোয়ালি থানাসংলগ্ন ওয়াইজ ঘাটের বাফা’র (বুলবুল ললিতকলা একাডেমি) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভবনটি এক সময় ছিল নিকি পোগজের বাড়ি। তখন এ বাড়িটি পরিচিত ছিল ‘নিকি সাহেবের কুঠি’ নামে। পরে তিনি ঢাকার আরমানিয়ান অধ্যুষিত এলাকা আরমানিটোলায় একটি কুঠি নির্মাণ করে সেখানে চলে যান।
ঢাকার প্রথম ইউরোপিয়ান জিনিসপত্র বিক্রির দোকানটি খোলেন আরমানিয়ান নাগরিক জি এম সিরকোর। ১০৫৭ সালে শাঁখারিবাজারে প্রতিষ্ঠিত তার দোকানটির নাম ছিল ‘ সিরকোর অ্যান্ড সন্স’। এ দোকানে বিক্রীত জিনিসের মধ্যে অন্যতম ছিল চা। সম্ভবত তিনিই ঢাকায় প্রথম ঘোড়াগাড়ি প্রবর্তন করেন। তার প্রবর্তিত ঘোড়াগাড়ি ঢাকায় পরিচিতি পায় ঠিকাগাড়ি নামে। অল্পদিনের মধ্যেই তার ঠিকাগাড়ি ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে।
এছাড়া আরমানিয়ান জে জি এন পোগজ ছিলেন ঢাকা ব্যাংকের একজন পরিচালক। আর মাইকেল সার্কিস ছিলেন ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য। ঢাকার আমানিটোলায় তাদের গির্জা নির্মাণেও তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ঢাকার বিশিষ্ট আরমানিয়ান নাগরিকদের মধ্যে কমিশন এজেন্সিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন জে লুকাস, এ এম ডেভিড, এ থমাস, জে মিনাস, মার্গার ডেভিড, এম হাইকাজোনি, এ এস ম্যাকর্টিচ, পি আরথন, যোসেফ ল্যাজারাস, আব্রাহাম লুকাস, টিগ্রন নাহাপিত, ম্যাকর্টিচ আব্রাহাম, ছাদিউস নাহাপিত প্রমুখ।
আরমানিয়ান নাগরিক মার্গার ডেভিড ঢাকাবাসীর কাছে পরিচিত ছিল ‘মার্চেন্ট প্রিন্স অফ ইস্টার্ণ বেঙ্গল’ নামে। ১৮৬০-৭০ সালের মধ্যে আব্রাহাম পোগজ, মাইকেল সার্কিস, মার্গার ডেভিড, এম ক্যাচাটুর, এ টমাস ওপি আরাতুন পাট ব্যবসায় অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন। ১৮৩০ সালে ঢাকায় আরমানিয়ানদের সংখ্যা ছিল ১২৬ জন। হেনরি ওয়ালটার্সের তথ্য মতে, ১৮৩২ সালে ঢাকায় আরমানিয়ানদের মোট বাড়ির সংখ্যা ছিল ৪২টি। মোট আরমানিয়ান নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১২৬ জন। ১৮৫৭ সালে ঢাকায় সিপাহী বিদ্রোহ চলার সময়ে আগস্ট মাসে ঢাকা থেকে বহু আরমানিয়ান কলকাতায় পালিয়ে যান।
এক সময়কার ঢাকার প্রভাবশালী আরমানিয়ান সম্প্রদায়ের কথা আজ অনেকেরই অজানা। কালের পালাবদলে রাজধানী ঢাকায় কিছু আরমানিয়ান থাকলেও এখানো তাদের আরমানিটোলা আরমানিয়ান গির্জা, রূপলাল হাউস, নিকি সাহেবের কুঠি, পোগোজ স্কুল ভবন টিকে আছে। বহু ঘটনার সাড়্গী এসব অট্টালিকার যথাযথ সংরড়্গণ জরম্নরি।
মিলন সব্যসাচী

কোন মন্তব্য নেই: