শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০০৮

ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে আত্মকর্মসংস্থান


ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে আত্মকর্মসংস্থান



পরনির্ভরশীল, অকর্মা, অলস কুড়ে বাদাইম্যা লোকের স্থান ইসলামে নেই। ইসলাম সব সময়ই এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছে। কোনো নবী-রাসূল পরনির্ভরশীল ছিলেন না। সবাই পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। মূলত আত্মকর্মসংস্থানহীন লোকের মাধ্যমে সমাজে, দেশে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও অনৈতিক কাজ হয়ে থাকে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আখড়া। যেহেতু একজন লোককে বাঁচার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, অন্ন, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির প্রয়োজন হয় তাই অকর্মা লোকরা অর্থের সংস্থানের জন্য সমাজে অনৈতিক কাজ করে থাকে। বক্ষ্যমাণ শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনার প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।
কর্মক্ষম ব্যক্তির বসে থাকা ঠিক নয়ঃ এক দিকে দেশের জনগণের আত্মকর্মসংস্থান করে দেয়ার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আত্মকর্মসংস্থান করে নেয়াও নৈতিক দায়িত্ব। আমরা বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখতে পাবো লাখো লাখো কর্মক্ষম বেকার যুবক বসে আছে। অথচ তাদের চাহিদা কিন্তু থেমে নেই। চাহিদা পূরণের জন্য তারা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি-রাহাজানি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি তাদের নিত্যদিনের কার্যসূচিতে পরিণত হয়েছে। যেহেতু তাদের পরিশ্রমলব্ধ টাকা নয় তাই টাকাগুলোও ব্যবহার হচ্ছে অনৈতিক কাজে।

মদ, জুয়া, হাউজি, নারীবাজি ইত্যাদিসহ সব অসামাজিক কাজে তারা ব্যবহার করছে কালো টাকা। এসব শিক্ষিত বেকার যুবক সাময়িকভাবে ডিগ্রি অর্জনের অহঙ্কার ত্যাগ করে যদি নিজেরা আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নেয়ার চেষ্টা করত, বসে না থেকে ব্যবসা বা কৃষি যেকোনো কাজে যদি আত্মনিয়োগ করত, তাহলে দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেও সচ্ছল হতো। অবশ্য এর পেছনে আমাদের দেশের একটি ভুল ধারণা কাজ করে থাকে তা হলোঃ শিক্ষিত যুবকদের চাকরি ছাড়া অন্য কাজ করা বেমানান। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি আলোচনা করলে আমরা প্রথমেই দেখতে পাবো কর্মক্ষম ব্যক্তি নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকা হারাম। কোনো মুসলমান কাজ করার শক্তি আছে এবং বাজারে শ্রমের মূল্য আছে, এমতাবস্থায় ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন হওয়ার বা আল্লাহর ওপর নির্ভরতার নাম করে রিজিক উপার্জন থেকে বিরত বা বেপরোয়া হয়ে থাকবে তা কিছুতেই হতে পারে না।
অনুরূপভাবে লোকজনের দান-খয়রাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বসে থাকা বা জীবিকা উপার্জনের উপায়-উপকরণ হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও তা ব্যবহার করে উপার্জনে আত্মনিয়োগ না করা এ পন্থায় নিজের ও নিজ আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজন পূরণ করতে চেষ্টা না করা কোনোক্রমেই জায়েজ হতে পারে না। এ ব্যাপারে রাসূল সাঃ বলেছেন­ দান-খয়রাত গ্রহণ করা কোনো ধনী লোকদের জন্য জায়েজ নয়, শক্তিমান ও সুস্থ ব্যক্তির জন্যও জায়েজ নয়। (তিরমিযী)। মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হয়, তখন জামিনে ছড়িয়ে পড়ো আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহ (জীবিকা) থেকে অন্বেষণ করো। (জুমআঃ ১০)। উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে অকর্মা হয়ে বসে থাকা ইসলামে জায়েজ নেই।
ভিক্ষাবৃত্তি ইসলামে জায়েজ নেইঃ ওপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম। রাসূল সাঃ বলেছেন, মহান আল্লাহর কাছে হালাল কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বা রাগের উদ্রেক সৃষ্টিকারী কাজ হলো স্ত্রীকে তালাক দেয়া, ভিক্ষাবৃত্তি করা। (আল হাদিস)। সামাজিক জীবনে আমরা দেখতে পাই যারা ভিক্ষাবৃত্তি করে তারা অসম্মানজনক, অবহেলিত ও তুচ্ছ জীবনযাপন করে। কোনো মুসলমান অপর কারো কাছে হাত প্রসারিত করলে তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিলীন হয়ে যাবে এবং স্বীয় মনুষ্যত্বের মানমর্যাদা অকারণে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নবী করীম সাঃ এ ব্যাপারে কঠিন ও কঠোর বাণী উচ্চরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে ভিক্ষা চায়, সে নিজ হস্তে অঙ্গার একত্রিত করার মতো ভয়াবহ কাজ করে। (বায়হাকী ইবনে খুজাইমা)। রাসূল সাঃ আরো বলেন- ‘যে লোক ধনী হওয়ার উদ্দেশ্যে লোকদের কাছে ভিক্ষা চাইবে সে নিজের চেহারাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য ক্ষতযুক্ত করে দিল। সে জাহান্নামের গরম পাথর ভক্ষণ করতে বাধ্য হবে। এখানে যার ইচ্ছা নিজের জন্য এ সব জিনিস বেশি পরিমাণে সংগ্রহ করুক আর যার ইচ্ছা কম করুক।’ রাসূল সাঃ আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ভিক্ষা করার কাজে নিজেকে অভ্যস্ত বানায় সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে এমন অবস্থায় যে, তার মুখমণ্ডল এক টুকরা গোশতও থাকবে না।’ (বুখারি মুসলিম) উল্লিখিত হাদিসগুলো থেকে আমরা জানতে পারলাম ভিক্ষাবৃত্তির ভয়াবহ পরিণাম। সুতরাং আত্মনির্ভরশীল না হয়ে পরনির্ভরশীল হওয়া বা পরগাছা হওয়া ইসলাম আদৌ সমর্থন করে না।
আত্মকর্মসংস্থানের ব্যাপারে নবী-রাসূল সাঃদের জীবনী থেকে দৃষ্টান্তঃ আল কুরআন, আল হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই, কোনো নবী-রাসূল অলস বা নিষ্কর্মা ছিলেন না। হাদিসে এসেছে রাসূল সাঃ বলেছেন, হজরত দাউদ আঃ নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। (বুখারি)
অন্য হাদিসে আছে­ হজরত জাকারিয়া আঃ ছিলেন একজন ছুতার বা কাঠমিস্ত্রি। মুস্তাদরাকে হাকেমে হজরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত আছে যে, হজরত আদম আঃ কৃষি কাজ করতেন, হজরত নূহ আঃ কাঠমিস্ত্রি ছিলেন, হজরত ইদ্রিস আঃ কাপড় সেলাই করতেন, হজরত মূসা আঃ রাখালের কাজ করতেন। অন্য একটি হাদিসে এসেছে­ রাসূল সাঃ বলেছেন, এমন কোনো নবী-রাসূল ছিলেন না যিনি বকরি বা ছাগল চরাননি। তা ছাড়া রাসূল সাঃ নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাসূল সাঃ ইহুদির কূপ থেকে খাদ্যের বিনিময়ে পানি তুলে দিয়েছেন। ব্যবসা পরিচালনা করেছেন­ ছাগল চরিয়েছেন। বিভিন্ন মানুষকে কামলা দিয়েছেন। সুতরাং কাজ না করে বসে থাকার কোনো অবকাশ অন্য ধর্মে থাকলেও ইসলামে নেই। নবী-রাসূলগণ ইচ্ছা করলে বর্তমান পীর মুরিদী ব্যবসার চেয়ে আরো আলিশানভাবে থাকতে পারতেন। রাজকীয় হালতে চলতে পারতেন। কিন্তু ইসলাম এগুলো সাপোর্ট করে না। যেখানে নবী-রাসূল আঃ কামার, ছুতার কৃষকের কাজ করতেন, রাখালের কাজ করতেন, কামলা দিতেন, সেখানে আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিরা কেন এসব কাজ করতে লজ্জাবোধ করি। নবী-রাসূল সাঃ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতেন সেখানে কেন আমরা অপরের গলগ্রহ বা অকর্মা, নিষ্কার্মা পরজীবি হয়ে জীবনযাপন করব? কোনো বিবেকবান মানুষ অকর্মা হয়ে বসে থাকতে পারে না। পরগাছা, পরজীবীরা সমাজে অসম্মানিত, লাঞ্ছিত, ধিকৃত, অবহেলিত, অপাঙক্তেয়। সুস্থ, সবল শিক্ষিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো লোক পরজীবী বা পরগাছা হয়ে জীবনযাপন করতে পারে না।
জীবিকা উপার্জনে উৎসাহ প্রদানঃ বাবুই পাখি চড়ুই পাখির কাহিনী অর্থাৎ নিজে বাসা নির্মাণ এবং পরের ঘরে থাকার মধ্যে পার্থক্য কী? কবি পরোক্ষভাবে আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। আসলে আত্মতৃপ্তি বলে একটি কথা আছে। নিজ হাতে উপার্জন এবং অপরের ঘরে বসে খাওয়ার মাধ্য পার্থক্য কী মানবীয় জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। রাসূল সাঃ ইশরাদ করেছেন,‘নিজ হাতে উপার্জনকারী ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বান্দা। অপর একটি হাদিসে রাসূল সাঃ বলেছেন, ওই ব্যক্তিই উত্তম যে নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে।’ জনৈক সাহাবি রাসূল সাঃ-এর কাছে ভিক্ষা চাইতে এলে রাসূল সাঃ তাকে ভিক্ষা না দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের উপায় বাতলিয়ে দেন। সাহাবায়ে কেরাম রাঃ ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। সবাই নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কেউ কারো গলগ্রহ হয়ে থাকেননি।
শেষ কথাঃ উরোল্লিখিত আলোচনা থেকে আমাদের কাছে এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হলো যে, নবী-রাসূর সাঃ সবাই ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। সবাই নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কাজ যত ক্ষুদ্র হোক না কেন তারা তা করতেন। কোনো কাজকে অবহেলা করতেন না। বৈধ যেকোনো কাজ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। ভিক্ষাবৃত্তি বা পরজীবী হিসেবে জীবনযাপনকে শুধু নিরুৎসাহিতই করেননি বরং ঘৃণা করেছেন। আমাদের উচিত নবী-রাসূল সাঃ এর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়া, নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহ করা। আল্লাহ আমাদের এ আলোচনা থেকে শিক্ষা নেয়ার তাওফিক দিন।


লেখকঃ এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই: