শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০০৮

কুরআন-হাদিস চর্চায় প্রযুক্তি


কুরআন-হাদিস চর্চায় প্রযুক্তি



কম্পিউটার শিক্ষা শুধু বিজ্ঞান গবেষক বা বিজ্ঞান নিয়ে পড়া-লেখা করেন তাদের জন্য প্রয়োজনীয়। অন্যদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইসলামি শিক্ষার ছাত্র বা গবেষকদের এর প্রয়োজনীয়তা কম বা তা থাকলেও শুধু কম্পোজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এ ধরনের একটা ধারণা উভয় প্রকার লোকদের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু আসলে কি তাই? না, বরং কুরআন-হাদিস তথা ইসলাম চর্চায় প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। প্রযুক্তির বদৌলতে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি প্রাপ্তি যেমন সহজ ও স্থায়ী হয়েছে তেমনি যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তথ্য অনুসানও হয়েছে সহজ। পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত বের করা, একটি নির্দিষ্ট শব্দ পবিত্র কুরআনে কতবার এসেছে ও কোন কোন সূরায় বর্ণিত হয়েছে এবং শত শত গ্রন্থের মধ্য থেকে একটি হাদিস অনুসান করা এখন কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। তাই বর্তমানে কুরআন, হাদিস বা ইসলাম নিয়ে গবেষণার জন্য কম্পিউটার জানা অতীব প্রয়োজন।

তবে সব কম্পিউটারেই যে এ প্রোগ্রামগুলো ডিফল্ড হিসেবে থাকে তা কিন্তু নয়, বরং কম্পিউটারে এসব প্রোগ্রামগুলো ইনস্টল করে নিতে হয়ে। তাই ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতরা যদি কম্পিউটার শিক্ষায় আরো একটু এগিয়ে আসেন তবে ইসলাম নিয়ে গবেষণা আরো সহজ হবে এবং মানুষের কাছে ইসলাম আরো সুন্দর ও যুগোপযোগী হিসেবে উপস্থাপিত হবে। এ জন্য কম্পিউটার শিক্ষাকে শুধু কম্পোজ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ইনস্টল করা, উইন্ডোজের ছোট ছোট সমস্যাগুলো সমাধান করা, ইন্টারনেটে তথ্য অনুসান করতে পারা, ইন্টারনেট থেকে ফাইল ডাউনলোড করা ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা রাখতে হবে।
উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থাঃ প্রযুক্তির বদৌলতে আজ বিভিন্ন গ্রন্থাদি সংরক্ষণ অনেক সহজ হয়েছে এবং স্থায়িত্ব পেয়েছে। সিডি, ডিভিডি, হার্ডডিস্ক, সার্ভার ইত্যাদির মাধ্যমে ছোট একটি ব্রিফকেসে বড় একটি লাইব্রেরি যেমন রাখা সম্ভব, তেমনি সম্ভব দ্রুত তা থেকে একটি বই খোঁজা। কম্প্যাক্ট ডিস্কের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো সিডি এবং এ নামেই এটি অধিক পরিচিত। বর্তমানে যেসব নরমাল সিডি পাওয়া যায় সেগুলোর ধারণক্ষমতা ৭০০-৮০০ মেগাবাইট, যার বাজার মূল্য ১৫-২৫ টাকা। এ ধরনের একটি ডিস্কে কমপক্ষে আড়াই লাখ পৃষ্ঠার সমপরিমাণ বই সংরক্ষণ করা যায়। আর ভালো মানের একটি ডিস্কের মূল্য ১০০০-১৫০০ টাকা। যার কিনা ১০০ বছরের গ্যারান্টি দেয়া হয়ে থাকে। আর ডিভিডি’র ধারণক্ষমতা ১ গেগাবাইট (১ গেগাবাইট= ১০২৪ মেগাবাইট)। তাই সিডি/ডিভিডিতে সংরক্ষণের কারণে যেমন অনেক জায়গার প্রয়োজন হয় না তেমনি বইগুলোর পৃষ্ঠা কয়েক বছর পরেই লাল হয়েও যায় না। অতএব বুখারি, মুসলিমসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি সিডিতে সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। ইতোমধ্যে তা অবশ্য শুরুও হয়ে গেছে। এতে যেমন বইটির স্থায়িত্ব বাড়বে তেমনি অধ্যয়ন করাও সহজ হবে। কেননা কয়েক শত পৃষ্ঠার একটি বইয়ের ভেতরের যেকোনো পৃষ্ঠায় বা অনুচ্ছেদে যেতে কোনো পৃষ্ঠাও উল্লাটে হবে না আবার অনেক দিন ধরে না পড়ার কারণে বইটির ধূলাও ঝাড়তে হবে না।
গবেষণা সহায়ক প্রোগ্রামঃ লেখা-লেখির জন্য ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় সফটওয়্যার হলো এমএস ওয়ার্ড। কম্পিউটারে ব্যবহৃত সব সফটওয়্যারই হলো এক-একটি প্রোগ্রাম। অনুরূপভাবে কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি গদ্য-পদ্য ইত্যাদি বিষয়েও বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রামার তৈরি হয়েছে। পবিত্র কুরআনের শব্দ বা আয়াত অনুসান, সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসির ইত্যাদি নিয়ে যেসব সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘আল-মুসহাফ আর-রাকমি’। এর মাধ্যমে মুহূর্তেই বের করা যাবে আয়াতটি কোন সূরার বা এ শব্দটি কুরআনে কতবার এসেছে। এ ছাড়াও যেকোনো আয়াতের ওপর ক্লিক করলেই পাওয়া যাবে সেই আয়াতের একাধিক গ্রন্থের তাফসির। সুতরাং কোনো আয়াত বের করে সেই আয়াতটি আবার তাফসির গ্রন্থের কোন খণ্ডে আছে তা বের করতে অনেক সময় ব্যয় হলেও মাত্র কয়েক মিনিটেই আমরা কাঙ্ক্ষিত আয়াতটি বের করে তার তাফসির পড়তে পারি এক জায়গায় বসে আঙুলের একটি মাত্র চাপে।

আবার অনেক প্রোগ্রাম তৈরি হয়েছে পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াতকে প্রাধান্য দিয়ে, যাতে মাখরাজসহ প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ রাখা হয়েছে। শ্রোতরা এ প্রোগ্রামের সাহায্যে পূর্ণাঙ্গ কুরআনের তেলাওয়াত শোনাসহ শুদ্ধ করে তেলাওয়াত শিখতেও পারবে। এ রকম আরো একটি প্রোগ্রামের নাম আলিম সফট। এতে পুরো কুরআনের তেলাওয়াত শোনা ও পাঠ করাসহ ইংরেজি অনুবাদ পড়া যাবে এবং বিষয়ভিত্তিক আয়াতও খুঁজে বের করা যাবে। এহেন অনেক প্রোগ্রাম আছে যেগুলোর সাহায্যে কুরআন বুঝা ও গবেষণা করা অনেক সহজ হয়েছে সব ভাষাভাষী লোকদের জন্য।
হাদিস নিয়েও এ রকম অনেক প্রোগ্রাম তৈরি হয়েছে। এগুলোতে শুধু হাদিস গ্রন্থই নয়, বরং এর ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোও স্থান পেয়েছে। তাই সঠিক হাদিসটি চিহ্নিত করা ও মেনে চলা এবং কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে হাদিসে নববীর দলিল পেশ করা আজ অত্যন্ত সহজ। একটিমাত্র শব্দ দিয়ে হাজার-হাজার হাদিসের গ্রন্থ থেকে মিনিটেই একটি হাদিস খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এ ধরনের একটি প্রোগ্রামের নাম হলো ‘মাকতাবাতু আলফিয়াতুস সুন্নাহ আন নাবুবিয়্যাহ’। এতে হাজারের অধিক বই সংরক্ষিত আছে। ধরা যাক, আপনি একটি হাদিস খুঁজছেন। কিন্তু এর আংশিক স্মরণ হচ্ছে অথবা হাদিসটি কোন গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে তা জানা দরকার, এমতাবস্থায় আপনার পক্ষে সব হাদিসের গ্রন্থ পড়ে হাদিসটি খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আপনাকে কোনো হাদিস বিশারদের স্মরণাপন্ন হতে হবে। তবে তার কাছ থেকেও তাৎক্ষণিক উত্তর পাওয়া সব সময় সম্ভব নাও হতে পারে। অথচ আপনি শুধু সেই হাদিসের একটিমাত্র শব্দ লিখে সার্চ দিলেই মুহূর্তেই জানতে পারবেন হাদিসটি কোন গ্রন্থে আছে বা আদৌ হাদিসটি আছে কি না। আর আপনি জোরালোভাবেই হাদিসটির বিশুদ্ধতা বা জাল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন। কেননা মানুষের অনুসানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও কম্পিউটার কখনো ভুল করে না যদি তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা হয়। সুতরাং কুরআন-হাদিসের চর্চায় এহেন সফটওয়্যার যেমন তথ্য অনুসানে সময় বাঁচাবে তেমনি গবেষকের আগ্রহ বাড়াবে এবং গবেষণাকে সমৃদ্ধ করবে।
ইন্টারনেটঃ তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির অন্যতম সুফল হলো ইন্টারনেট। কোথায় কোন গবেষণা হচ্ছে, কত দূর এগিয়েছে তার সর্বশেষ খবর মুহূর্তেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি ইন্টারনেটের মাধ্যমে। সুতরাং ইসলাম নিয়ে যে প্রান্তেই কাজ হোক আর যতটুকুই হোক না কেন তা সাথে সাথেই জানতে পারছে সব প্রান্তের লোকেরা। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে মুহূর্তেই বের হয়ে আসবে কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের ফলাফল। ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত হলো এসসবলপ, ণথভসস, অলয়থঠমঢ়য়থ, গঢ়ষ ইত্যাদি। ইদানীং ঈৎমল নামক আরো একটি সাইট আত্মপ্রকাশ করেছে। আরবি বই/বিষয় অনুসান করতে আরবিতে সার্চ করাই বেশি ফলপ্রসূ। এ ক্ষেত্রে উইন্ডোজটি অ্যারাবিক এনাবল করে নিতে হবে।
এ ছাড়াও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তাফসির ও হাদিস মূল আরবি গ্রন্থগুলো এবং হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলো সর্বত্র পাওয়া যায় না। তাই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত অনেক গ্রন্থের মূল টেক্স না পাওয়ায় ফটোকপি করে তা পড়ানো ও পড়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকবার ফটোস্ট্যাট করার কারণে লেখাও অস্পষ্ট হয়ে থাকে। এতে পাঠকও বইটি পড়তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অথচ এ ধরনের অনেক বই বিনা মূল্যে ইন্টারনেট থেকে ফ্রি পড়া যায় এবং ডাউনলোড করা যায়। এমনই একটি সমৃদ্ধ চমৎকার সাইট হলো আল-মেশকাত, এতে পাওয়া যাবে কুরআন, উলুমুল কুরআন, হাদিস, উসুলে হাদিস, হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলো, ইসলামি সাহিত্য, আরবি সাহিত্য, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থাবলি। এ ছাড়াও এখানে বিভিন্ন পত্রিকা ও যুগোপযোগী প্রবগুলো পড়া এবং বিভিন্ন বিষয়ের মাসআলা জানা যাবে। এ রকম আরো কয়েকটি সাইট হলো ইসলামওয়েব, ইসলাম ওয়ানলাইন, সাঈদনেট, আল-মাকতাবা, ইসলামিক বুক স্টোর, খাইমা, ইসলামওয়ে ইত্যাদি। ইদানীং বাংলা ভাষায় রচিত বা অনুবাদকৃত বই নিয়েও কিছু কিছু সাইট বের হয়েছে। যেমন­ ইসলাম হাউস, বাংলাকিতাব ইত্যাদি। এ সাইটগুলো থেকে বাংলা ইসলামি বইগুলো ফ্রি ডাউনলোড করে যাবে। ইসলাম হাউস সাইটটিতে আরবি, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি, কুর্দি, হিন্দি, বাংলা, ফরাসি, জার্মানিসহ ২৫টি ভাষার বই পাওয়া যাবে।
সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা আলেমদের ফতুয়া, বক্তৃতা, বিভিন্ন সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এ ধরনের ওয়েবসাইটের সংখ্যাও অনেক। যেমন সৌদি আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতি শাইখ আবদুল আজিজ বিন বাজ, শাইখ ওসাইমিন প্রভৃতি ব্যক্তির বক্তৃতা, ফতুয়া, মাসায়েল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সাইট রয়েছে। যেগুলো থেকে গবেষকরা যেকোনো মুহূর্তে তাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি সংগ্রহ করতে পারবেন। আর এ বিষয়গুলো একাধিক ভাষায় পড়ারও ব্যবস্থা আছে। ইদানীং বাংলা ভাষায়ও কিছু কিছু সাইট আত্ম প্রকাশ করেছে।
এই একবিংশ শতাব্দী তথ্য-প্রযুক্তির শতাব্দী। যাকে বলা হচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ। তাই মানুষ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই থাকুক না কেন পৃথিবী তার হাতের মুঠোয়। আর তাই প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে ইসলামকে আরো সুন্দর করে সবার কাছে উপস্থাপন করতে হবে, আবারো প্রমাণ করতে হবে ইসলাম-ই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ট ধর্ম, যার প্রকৃত অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।


লেখকঃ অফিসার, শরীয়াহ্‌ কাউন্সিল, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড

কোন মন্তব্য নেই: