শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০০৮

আমাদের ধর্মে আমাদের বিজয়

আমাদের ধর্মে আমাদের বিজয়


পৃথিবীতে এমন কোন জাতি নেই যাদের কোন বিজয় দিবস নেই, সুখ-শান্তির জাতীয় দিন নেই। মানব জাতির প্রতি এ বিজয় রাব্বুল আলামিনের বিশেষ দান ও করুণা। অন্যায়-অবিচার, অশান্তি ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তিলাভের দিনকেই বলা হয় বিজয় দিবস বা নাজাত দিবস।
ষোল ডিসেম্বর এমনি একটি বিশেষ দিবস, যা আমাদের জাতির জন্য মহা দিবস, মহা বিজয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল এ জাতির এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। এমন কোন মানুষ ও এমন কোন ঘর আমাদের ছিল না, যা এ যুদ্ধে শত্রুদের অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের শিকার হয়নি। পাকহানাদার বাহিনীর এ সীমাহীন গণঅত্যাচার যেন ফেরাউনের অত্যাচার-উৎপীড়নকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আল কোরআনের ভাষায় বনি ইসরাইলের ওপর নিপতিত ফেরাউনের অত্যাচার-উৎপীড়ন ও জোর-জুলুম ছিল ‘বালাউন আজিম’ বা মহাবিপর্যয়। আমাদের জন্যও একাত্তরের নয় মাস ছিল বালাউন আজিম। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মনিবেদিত লড়াই ও জনগণের সর্বান্তকরণ ত্যাগ-তিতিক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে দান করলেন সাহায্য ও বিজয়। যাদের চোখ আছে, মন আছে, আছে অন্তর্দৃষ্টি ও আধ্যাত্মিক নজর, তারাই কেবল বুঝতে পারেন ষোল ডিসেম্বরের বিজয় শুধু আল্লাহপাকেরই খাস রহমত, বিশেষ করুণা ও বিজয়।
একাত্তরের ষোল ডিসেম্বর যারা ঢাকায় ছিলেন তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন কিভাবে জনতার ঢল নেমেছিল ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ও রেসকোর্স ময়দানে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা যেন চাঙ্গা হয়ে ওঠে ঢাকাবাসীর বিজয় উল্লাসে। সেদিন ঈমানদার, আল্লাহওয়ালা মানুষের অন্তরে যেন আল কোরআনের বাণী নতুন করে ইলহাম হতে লাগল- ‘ইযা জা আ নাসরুল্লাহ ওয়াল ফাত্‌হ্‌ ওয়ারাইতান্নাসাই ইয়াদখুলুনা ফি দিনিল্লাহি আফওয়াজা!’ যখন নেমে এলো আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং দেখতে পেল মানুষ ফৌজে ফৌজে প্রবেশ করছে আল্লাহর দিনে। বিজয় উল্লাস ও আনন্দ উল্লাসও আল্লাহর দিন বা ফিতরাত তথা স্বভাব। আল্লাহর স্বভাব গণমানুষের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে উপচেপড়া জোয়ারের মতো, বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো। ষোল ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স পরবর্তী সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাই ঘটেছিল। অন্যায়, অবিচার, জুলুম, অত্যাচার, ব্যভিচার, গণহত্যা, পোড়ামাটিনীতি প্রভৃতি ফেরাউন-হিটলারি অপরাধযজ্ঞের পর অর্জিত বিজয়ে মানুষের মুখে যে হাসি ফুটেছিল তা ছিল আল্লাহর হাসি, আল্লাহরই খুশি ও রেজামন্দি।
আজ সাঁয়ত্রিশ বছর পর যখন একাত্তরের বিজয় দিবস নিয়ে ভাবি তখন চিন্তাগ্রস্ত হই, উৎকণ্ঠিত হই ও শংকিত হই। বিজয়ের যে হাসি, খুশি ও আনন্দ সেদিন আসমান থেকে নেমে এসেছিল মাটির ধরায়, তা বেশি দিন টেকেনি। কেন?
ভাবনার বিষয়, গবেষণার বিষয় নিশ্চয়ই। তবে কঠিন কোন থিসিসের ব্যাপার নয়। এ ভাবনা ও গবেষণার উপাত্ত রয়েছে আল কোরআনের ভেতরই, যা আমরা খোঁজ করিনি, তালাশ চালাইনি। সূরায়ে নাসরের ভেতরই বাকি অংশের প্রতি আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়নি। বিশেষত আমাদের বিজয় অর্জনকারী নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপকরা সেদিকে তাকাননি। সেখানেই ছিল টেকসই বিজয়ের বাণী ও চাবিকাঠি। বলা হয়েছিল, ‘ফাসাব্বিহ বিহামদিহি রাব্বিকা ওয়াস্তাগফিরহু। ইন্নাহু কানা তাওয়াবা।’ আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং জনসমর্থন পাওয়ার পর তা টেকসই করার শর্ত দেয়া হয় যে, রবের গুণগান, প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো, তাঁর কাছে ভুলত্রুটির জন্য অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনা করো।
তিনি অত্যন্ত দয়াবান, ক্ষমাশীল ও করুণাময়। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, আমরা এক সাগর রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করলাম, আগুনের পাহাড় ডিঙিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম এবং অবশেষে বিজয় অর্জন করলাম, কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। আল্লাহর রহমতের চাদর ও সামিয়ানা আমাদের মাথার ওপর থেকে সরে গেল আমাদেরই কারণে, আমাদেরই খোদাবিমুখতার জন্য। বনি ইসরাইল যেমন নাজাত লাভ করেও সামেরির কুমন্ত্রণায় বিপথগামী হল, আল্লাহকে ভুলে গিয়ে শয়তানের পথ ধরল, তেমনি আমরাও আল্লাহকে ভুলে গেলাম, শয়তান ও শয়তানি শত্রুদের আশ্রয়-প্রশ্রয় নিলাম। ফলে যা হওয়ার গত সাঁয়ত্রিশ বছরে তাই হল। বুশ পরিবার ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সরকার আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুশমন ছিল, তারাই হল আমাদের দোস্ত। ব্যস স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয় দিবসের সব ফল-ফসল ওরাই বস্তায় ভরে নিয়ে গেল, ভাগ-বাটোয়ারা করল আমাদের তেল, গ্যাস, কয়লার ময়দান ও ব্লক, পকেটস্থ করল আমাদের জাতীয় ভাগ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতি। আমাদের নেতারা, আমলারা, ব্যবসায়ীরা এবং সমাজপতিরা শয়তানি বিশ্ব শত্রুর খপ্পরে পড়ে তাদের দয়ালু দাতা, মনিব ও ইলাহ হিসেবে মেনে নিল।
ষোল ডিসেম্বরের মহান বিজয় দিবসের মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাই আজ কামনা করি আমাদের সম্বিৎ ও চেতনা। রাব্বুশ শুহাদা ও মুজাহিদিন আমাদের পথ দেখান সিরাতুল মুস্তাকিমে চির নাজাতের দিকে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান

কোন মন্তব্য নেই: