শনিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০০৯

মানুষের মুক্তি লাভের উপায়

মানুষের মুক্তি লাভের উপায়



মানুষ পরস্পর ভাই ভাই। পৃথিবীতে তারা তাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আলস্নাহ তাআলার নির্দেশনায় চলবে এবং সেখানে কোন প্রকার অন্যায়-অবিচার করবে না, অহেতুক ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হবে না এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে না, এটাই ছিল মহান আলস্নাহ তাআলার অভিপ্রায়। সুসময়ে মানুষ আলস্নাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং অসময়ে, বিপদাপদে, ও দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণে এর সমাধানের পথ বেছে নিবে। যারা মহান আলস্নাহ তাআলার নির্দেশনা থেকে মুখ ফিরাবে এবং এর বিরম্নদ্ধাচারণ করবে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। কেননা, তাঁর নির্দেশ অমান্য করাতে এর মধ্যে পৃথিবীর বহু মানব জাতি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আলস্নাহ তাআলা বলেনঃ “অতঃপর যখন আমার পড়্গ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের কোন নির্দেশ আসবে, তখন যারা আমার সৎ পথের নির্দেশ অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। আর যারা অবিশ্বাস করবে ও আমার নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করবে, তারাই অগ্নিবাসী সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (সূরা বাকারা-৩৮-৩৯)।
পৃথিবী এখন আশান্ত এবং নানা কারণে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার জালে নিমজ্জিত হয়ে আছে। তদুপরি সারা বিশ্বের ড়্গমতাধর মানুষেরা ক্ষমতার লোভে এবং আত্মকলহের দ্বন্দ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত রয়েছে। তাই মহান আলস্নাহ রাব্বুল আলামীনের কঠোর বাণী এদের সম্পর্কে পবিত্র আলকুরআনে বর্ণিত হয়েছে। মহান আলস্নাহ বলেন, “তোমরা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে না, নিশ্চয়ই আলস্নাহ তাআলা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা কাসাস-৭৭) মহান আলস্নাহ আরো বলেন, “শৃঙ্খলাপূর্ণ পৃথিবীতে তোমরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না। (সূরা আ’রাফ-৫৬)। আলস্নাহ তাআলা মানুষকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসাও প্রীতির বন্ধন দিয়ে।
কিন্তু মানুষ আলস্নাহ তাআলার এ নিয়ম ভুলে গিয়ে পরস্পরে অপরাধ ও দুর্নীতিতে আবদ্ধ হয়েছে। তাই মানুষ যেন আলস্নাহর নির্দেশে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও প্রীতি প্রেমের বন্ধনে আসক্ত হয়, এ সম্পর্কে নির্দেশ দেন। আলস্নাহ তাআলা বলেন, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতি পালককে ভয় কর। যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দু’জন থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) বিস্তার করেন। এবং আলস্নাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচাই কর, জ্ঞাতি বন্ধন ছিন্ন করাকে ভয় কর অর্থাৎ তোমরা মানুষ হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই। নিশ্চয়ই আলস্নাহ তাআলা তোমাদের উপর তীড়্গ্ন দৃষ্টি রাখেন।” (সূরা আন্‌-নিসা-০১)। পৃথিবীর শাসকদের প্রতি মহান আলস্নাহ তাআলার নির্দেশনা এই যে, হে ড়্গতার অধিকারীরা! ড়্গমতা পেয়ে অন্যায় ও অবিচারে এবং মানুষের অকল্যাণে নিজকে নিয়োজিত করো না। সকল ক্ষমতার মালিক মহান আলস্নাহ তাআলাই। তিনিই সম্মান ও ঐশ্বর্য দানের মালিক। তিনিই জীবন ও মরণের মালিক এবং সকল প্রতিপত্তির অধিকারী।
এ সম্পর্কে মহাগ্রস্থ আল কুরআন ইরশাদ হচ্ছে “(হেনবী) আপনি বলুন! ‘হে সার্বভৌম শক্তির মালিক মহান আলস্নাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর, এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নাও, এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত কর, আর যাকে ইচ্ছা অপমানিত কর। যাবতীয় কল্যাণ তোমারই হাতে। নিশ্চয়ই তুমি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। তুমি রাতকে দিনে, দিনকে রাতে পরিবর্তন কর, এবং তুমিই মৃত হতে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটাও, আবার জীবন্ত থেকে মৃতের আবির্ভাব ঘটাও। তুমি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করে থাকো।” (সূরা আল-ইমরান- ২৬-২৭)।
পৃথিবীতে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি তখনই আসবে, যখন মানুষ ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করবে। এছাড়া পরস্পরে হানাহানি, আত্মকলহ, ও হিংসা-বিদ্বেষ বন্ধ করে, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও সমঝোতার দিকে হাত বাড়াবে এবং সকল প্রকার স্বার্থের মাথায় আঘাত করে ত্যাগের বিনিময়ে মানুষের মন জয় করতে সচেষ্ট ও নিবেদিত প্রাণের অধিকারী হবে। এই অস্থায়ী পৃথিবীতে ত্যাগেই আনন্দ এবং ভোগে শুধু শুধু দুঃখ ও অশান্তির যন্ত্রণা বাড়ে।

মহান আলস্নাহ তাআলা মানবজাতির দায়িত্ব রক্ষা এবং এর সৎ ব্যবহার সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বিবৃত করে বলেন, ‘ইরশাদ’ হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে ও সৎ কাজ করে আলস্নাহ তাআলা তাদের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন যে, তিনি তাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব (শাসন ক্ষমতা) দান করবেনই, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন, সুদৃঢ় করবেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদের নিরাপত্তা দান করবেনই। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার কোন অংশী করবে না, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারাই সত্য ত্যাগী। যথাযথভাবে নামাজ আদায় কর, যাকাত দাও (দান কর) এবং রাসূলের অনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ ভাজন হতে পার। তোমরা অবিশ্বাসীদের পৃথিবীতে প্রবল মনে করো না। ওদের আশ্রয়স্থল অগ্নি; কতই না নিকৃষ্ট এ পরিণাম।(সূরানূর-৫৫-৫৭)

মহান আলস্নাহ পূর্ববর্তী নবী রাসূলের উম্মতদের সম্পর্কে বলেন, “(হে সামুদজাতি) স্মরণ কর তখনকার কথা, যখন তিনি (আলস্নাহ) আদ কওমের পরে তোমাদেরকে খলিফা (শাসক) নিযুক্ত করেছিলেন।”(সূরা-আরাফ-৭৪)
হে দাউদ, আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলিফা নিযুক্ত করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে পরম সততা সহকারে নির্দেশ চালাও।”(সূরা ছোয়াদ-২৬)
পৃথিবীতে শৃঙ্খলা সৃষ্টি, শান্তি স্থাপন এবং মনাব সমাজকে আলস্নাহর পথে দিক-নির্দেশনা দিতে হলে, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নামের হাদীসগুলো খুবই প্রণিধানযোগ্য।
রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) সাহাবাগণকে সম্বোধন করে বলেন, এমন একটি সময় আসবে যখন অন্ধকার রাত্রির ন্যায় ফিতনা-ফাসাদ সমগ্র দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। একজন সাহাবী (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আলস্নাহর রাসূল (সাঃ) সেই বিপদ হতে বাঁচার উপায় কী? রাসূলুলস্নাহ (সাঃ) বলেন, আলস্নাহর কুরআনে, আলস্নাহর দেয়া বিধানই বাঁচবার একমাত্র উপায়। তাতে অতীতের জাতিগুলোর ইতিহাস আছে। ভবিষ্যতের মানব বংশের অবস্থা ও ঘটনাবলী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এবং বর্তমানের প্রেড়্গাপটে তোমাদের পারস্পরিক বিষয় সম্পর্কীয় রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনও তাতে রয়েছে। বস্তুত উহা এক চূড়ান্ত বিধান, উহা কোন সাধারণ জিনিস নহে। (সহীহ্‌ তিরমিযী)।
রাসূলুলস্নাহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি এই বিধান (কুরআন) অনুসারে জীবন-যাপন করবে, যে, উহার প্রতিফল লাভ করবে। যে উহার অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, তার শাসন সুবিচারপূর্ণ হবে এবং যে উহাকে দৃঢ়রূপে আঁকড়িয়ে ধরবে, সে সঠিক এবং সত্যিকার কল্যাণের পথে পরিচালিত হতে পারবে।
মাওলানা মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ইবনে ইউসুফ

মহিমাময় আলস্নাহর অপার অনুগ্রহ

মহিমাময় আলস্নাহর অপার অনুগ্রহ


মানুষ, জন্তু-জানোয়ার ও উদি্‌ভদ জগতের ওপর পানির প্রভাব অপরিসীম। এগুলোর অসিত্ব-স্থিতি-জীবন নির্বাহ পানির ওপর ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বলা হয় পানির অপর নাম জীবন। ‘ওয়াটার সাইকেল’ অর্থাৎ পানি-চক্র তথা পানির উৎপত্তি ও গতিপ্রৈকৃতি বিষয়টি যুগে যুগে দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোকে বেশ আলোচিত হয়েছে। কিন্তু সটিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অনেক সময় লেগে যায়।
খৃষ্টপূর্ব ৭ম শতাব্দিতে বৈজ্ঞানিক মিলেটুসের থেলেস এ মতবাদ পোষণ করতেন যে সমুদ্রের পানি বাতাসের তাড়নায় দ্রম্নতগতিতে মহাদেশের অভ্যন্তôরে ঢুকে পড়ে। এ কারণে পানি ভূমিতে আছড়ে পড়ে এবং সে পানি পরে মাটির ভেতরে প্রবেশ করে। অন্যদিকে এরিস্টটলের ধারণা ছিল মাটির পানি বাষ্প হয়ে ঠাণ্ডা পর্বতের গভীর গহ্বরে জমা হয় সেখানে ভূগর্ভে এক গভীর হ্রদ সৃষ্টি হয় এবং এ হ্রদের পানিই ঝরনা হয়ে বয়ে যায়। ‘ওয়াটার সাইকেল’ সম্পর্কিত প্রথম সুস্পষ্ট মতবাদ চালু হয় অনেক পরে অর্থাৎ ১৫৮০ সালে বার্ণাড প্যালিসির মাধ্যমে। তিনি অভিমত দেন যে ভূগর্ভস্থ পানির উৎস হলো মাটি চোয়ানোর বৃষ্টি পানি। ১৭ শত শতাব্দিতে বৈজ্ঞানিক ম্যারিয়াট এবং পি, প্যারলট কর্তৃক তা সমর্থিত হয়। অথচ ৭ম শতাব্দিতেই অর্থাৎ প্রায় এক হাজার বছর পূর্বেই এ তত্ত্ব আরো বিশদভাবে আল কোরআনে আগে বিধৃত ছিল।
আসুন এখন আমরা কোরআনের দিকে দৃষ্টি দেই। সূরা নাফ আয়াত ৯-১১, সূরা আল মুমিনুন আয়াত ১৮-১৯, সূরা আর রূম আয়াত ৪৮, সূরা রাফ আয়াত ১৭, সূরা যুমার আয়াত ২১, সূরা মুরসালাত আয়াত ১-৪ ইত্যাদির সারাংশ হিসেবে আলস্নাহ বলেন, আমি বাতাস, প্রবাহিত করি যা ভারবাহী মেঘমালাকে বহন ও সঞ্চালন করে, বিচ্ছিন্ন করে, টুকরো টুকরো করে অঞ্চলে অঞ্চলে পাঠিয়ে দেই এবং দেখতে পাও সে মেঘ থেকে ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়ে এবং তা মৃত জমিতে প্রবেশ করিয়ে বিভিন্ন শস্যাদি, তৃণ, সবজি, ফলাদি উৎপন্ন করি মানুষ ও জানোয়ারের জন্য। সূরা ওয়াকিয়াতে আয়াত ৬৮-৭০ এ আলস্নাহ প্রশ্ন রেখে বলেন, তোমরা যে পানি পান কর সে মন্বন্ধে চিন্তা করেছে কি? “তোমরা কি তা মেঘ থেকে নামাও না আমি বর্ষণ করি? আমি ইচ্ছা করলে তা লবণাক্ত করে দিতে পারি। তবু তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না?” সূরা আল ফুরকান আয়াত ৫৩ এ আলস্নাহ বলেন “আমি দুই সাগর সৃষ্টি করেছি। একটির পানি মিষ্টি/ সুপেয়, অপরটির লোনা।” সবই মানুষের কল্যাণে। আবার সূরা নাবা আয়াত ১৩ এ বলেছেন “ আমি আকাশে স্থাপন করেছি একটি জ্বলন্ত প্রদীপ (সূর্য)।
এখন এগুলো বিশেস্নষণ করা যাক।

উপরোক্ত বক্তব্যগুলো থেকে প্রতিভাত হচ্ছে যে পানি-চক্র সৃষ্টিতে সূর্য, সমুদ্র এবং বাতাসের ত্রিমুখী ভূমিকা রয়েছে। সূর্যকে আল্রাহ এক জ্বলন্ত প্রদীপ করে সৃষ্টি করেছেন তাপ, আলো দেয়া ও সময় নির্ধারণের জন্য। সূর্যের বাইরের তাপ হলো ৪০০০-৬০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সূর্যের এ তাপের ২০০ ভাগের মাত্র এক ভাগ পৃথিবীতে আসে। কোর্রনিক তথ্য বিশেস্নষণ করে জানা যায় সারা বিশ্বে পানরি অংশ ৭১ ভাগ এবং মাটির অংশ ২৯ ভাগ। আলস্নাহ বাতাস সৃষ্টি করেছেন এবং বিশাল জিনিষকে বহন ও ধাক্কা দিয়ে চালনা করার জন্য এ বাতাসকে দিয়েছেন অকল্পনীয় প্রচণ্ড শক্তি। সূর্য সমুদ্রের জলরাশির ওপর তাপ বিকিরণ করে বাষ্পের সৃষ্টি করে। এ বাষ্প ওপরে উঠে বায়ুমণ্ডলে গিয়ে ঘনত্ব লাভ করে মেঘে পরিণত হয়। সে মেঘ সমুদ্র বিশেষে ৮,০০০ থেকে ১০,০০০ মাইল লম্বা এবং ৬-৮ মাইল চওড়া হয়ে থাকে। অভাবনীয় পানি ভরা এ বিশাল মেঘমালাকে ধাক্কা দিয়ে চালনা করার জন্য আলস্নাহ বাতাসকে হুকুম করেন। পরে তারই আদেশে এ বাতাস আবার ঘূর্নিপাকে এ বিশাল মেঘমালাকে বিচ্ছিন্ন করে টুকেরা টুকরো করে এক এক টুকরো মেঘ এক এক দেশ বা অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয় মানুষ ও প্রাণির মঙ্গলার্থে। যদি এ বিশাল শেঘমালা থেকে কোন একটি অঞ্চলে বারিবর্ষণ হতো তা হলে সে অঞ্চল/ দেশ পানিতে ভেসে যেত এবং বিরাট বিরাট নদী হয়ে যেত। তাই দয়ার সাগর আলস্নাহর আদেশে বাতাস কর্তৃক ক্রমাগত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার কারণে সে বৃষ্টি ধারা চুলের মত চিকন তারে ফোটা ফোটা হয়ে পড়ে। মোটা মোটা ধারায় পড়লে শস্য ও ফুল-ফলের ক্ষতি হতো। এ বৃষ্টির পানি সমুদ্রে পৌঁছার সাথে সাথে বৃষ্টি ও গতিচক্রের পুনরাবৃত্তি শুরম্ন হয়ে যায়। অন্যদিকে বৃষ্টি যখন ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয় তখন উদি্‌ভদ জগৎ তা গ্রহণ করে। উদি্‌ভদ জগৎ আবার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত বৃষ্টির পানির কতকাংশ বাষ্পাকারে আকাশের বায়ুমণ্ডলে পাঠাতে থাকে। অবশিষ্ট পানি চুয়ে চুয়ে মাটির ভেতর চলে যায়। সেই পানি যা সূর্যোতাপে সমুদ্র থেকে বাষ্পাকারে উত্থিত হয়ে প্রথমে মেঘ ও পরে বৃষ্টিতে পরিণত হয়েছিল তাই বিভিন্ন নদী-নালা-খাল বেয়ে আবার সে সমুদ্রেই গিয়ে পড়ে। এভাবে পানি-চক্রের পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকে।
এ ব্যাপারে সংশিস্নষ্ট আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রায় সব সমুদ্রের পানিই তিক্ত নোনা। তাতে রয়েছে অক্সিজেন-হাইড্রোজেন ও লবণ। আলস্নাহ তার কুদরতি শক্তি বলে সূর্য থেকে বিকীর্ণ ২০০-২৫০ সেলসিয়াস তাপে কেবল অক্সিজেন-হাইড্রোজেন সম্বলিত পানিই বাষ্পাকারে তুলে নিচ্ছেন আর লবণ সমুদ্রেই রেখে দিচ্ছেন। মানুষ শিল্প প্রক্রিয়ায় এ লবণ পানিকে খাদ্যোপযোগী লবণে পরিণত করে আমাদের খাদ্য সম্ভারকে সু-স্বাদু ও মজাদার করে থাকে। তবে আলস্নাহ কিন্তু তার সার্বভৌম ক্ষমতা বলে ১২০০-১৪০০ সেলসিয়াস তাপে লবণকেও বাষ্পাকারে তুলে লবণ বৃষ্টিপাত করতে পারতেন। তা হলে লবণের কারণে কোন তৃণলতা, গাছপালা-শাকসবজি-ফলমূল কিছুই উৎপন্ন হতো না। অন্যদিকে এ অত্যুচ্ছ তাপে সমুদ্রের পানি শুকে যেত। ফলে মানব-প্রানি-উদি্‌ভদ জীবন বিপন্ন হয়ে পরতো। তাই দয়াশীল আলস্নাহ তাদের সবার কল্যাণ কল্পে তা করেননি। অন্যদিকে সমুদ্রের উপরিভাগে লবণ না থাকলে শীতকালে সমুদ্রের পানি বরফ হয়ে যেত। ফলে, সমুদ্রের অভ্যন্তরে অবস্থিত মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণি তীব্র হিম পানিতে ধ্বংস হয়ে যেত। সমুদ্রের পানিতে তীব্র লবণ থাকায় পানি সহজে জমে না। ও তীব্র শীতল হয় না। তাই মাছ ও জলজপ্রাণি পানির অভ্যন্তরে মানুষের কল্যাণে বেঁচে থাকে। আলস্নাহ তায়ালার এ সব কুদরতি রহমতের জন্য তিনি সূরা ও কিয়াতে মানুষকে শোকর গুজারি করতে বলেছেন। আসুন আমরা আমাদের দয়াল প্রভুর এ সব অনুগ্রহের জন্য তার সকাশে সবিনয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আনত হই।

মুহাম্মদ কাসেম

ওরছ শরীফের তাৎপর্য


ওরছ শরীফের তাৎপর্য


ওরছ আরবী শব্দ যার আভিধানিক অর্থ শাদী। অর্থাৎ মিলন, মহা মিলন। আলস্নাহর অলিগণের ওফাত বা বেছালত দিবস তাদের জন্য ইয়াউমুল ওরছ অর্থাৎ মহামিলন দিবস। এই দিবসের মধ্যেই অলীগণে আলস্নাহর এবং রাসুল (দঃ)-এর সাথে পরম সানিধ্য ঘটে থাকে। তাই তাছাউদ পন্থিগণ ও হক্কানী তাফসির কারকগণ ওরছ শব্দের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া আলস্নাহ এবং রাসুল (দঃ) এর সাথে অলিআলস্নাহগণের পবিত্র আত্মাসমূহের মিলনকেই বুঝিয়াছেন। এই সম্পর্কে মিস্কাত শরীফে আজাবুল কবর অধ্যায় প্রথম ভাগেই একখানা হাদিছ রহিয়াছে। হাদীছ খানাতে বলা হইয়াছে মুনকার, নকির, ফেরেস্তা কখন কবরে মাইয়্যাতকে পরীড়্গা নেয়ার জন্য এসে তিনটা প্রশ্ন করবে।

সেই প্রশ্নের উত্তর মাইয়্যাত সঠিকভাবে দিলে তখন ফেরেস্তাদ্বয় মাইয়্যাত বলবে।নামকা নাওমাতিল উরম্নছিললাতি লা ইয়াওকেজাহু ইলস্না আহাব্বু আহলিহি ইলাইহি অর্থাৎঃ আপনি সেই কনের মত শুয়ে পড় ন যাকে ওর প্রিয়জন ছাড়া আর কেউ উঠাইতে পারে না। হাদীছ শরীফে ইহাও উলেস্নখ আছে। নবীজি উম্মতের কবরে উপস্থিত হইবে এবং নবী পাককে দেখাইয়া ফেরেস্তাদ্বয় জিজ্ঞাসা করিবে ওনার সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? তিনিইতো সৃষ্টিজগতের দুলহা এক কথায় জামে আম্বিয়া ওয়ালিয়াগণের সৃষ্টিকর্তার সাথে মহামিলনকেই ওরছ বলে।বাস্তব অর্থে প্রতি বৎসর ওলী আলস্নাহগণের ওফাত বা বেছাল দিবসে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, কোরআনখানী, মিলাদ মাহফিল, জিকির আজগার, মোরাকাবা, মোশাহেদার তালকিন দান, সদকা, তবারক বিতরণ ইত্যাদির ছাওয়াব পৌঁছানের অনুষ্ঠানকেই আমরা ওরছ শরীফের অনুষ্ঠান বলে থাকি। এই ওরছের উৎস হাদীছ শরীফ ও ফকিরগণের বিভিন্ন উক্তি থেকে প্রমাণ আছে। যেমন ফতুয়ায়ে শামীর প্রথম খন্ডে জিয়ারাতুল কুবুর অধ্যায় বর্ণিত আছে। এবারও ইবনে আবি শাইবাতা আম্নান নাবিয়্যি ছালস্নুলস্নাহু আলাইহে অছালস্নাম কানা ইয়াতি কুবুরা শুহাদায়ে বি আহাদিন আলা রা আছি কুলিস্ন হাওলিন।ইবনে আবিশাইবা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হুজুর (দঃ) প্রতি বৎসর উহুদ যুদ্ধের শহীদদের কবরে তাশরিফ নিতেন। তাফছিরে কবির ও তাফছিরে দুর্রে মনসুরে উলেস্নখিত আছে নবীজি উহুদ যুদ্ধের শহীদানদের কবরে প্রতি বৎসর উপস্থিত হইয়া তাহাদেরকে ছালাম দিতেন। এমন কি চার খলিফা থেকেও অনুরূপ প্রমাণ পাওয়া যায়।বিশেষ করে মদিনা মোনোয়ারার আলিমগণ হযরত আমির হামজা (রাঃ) ওরছ মোবারক মহা ধুমধামে এখন পর্যন্তô করে থাকেন যাহার মাজার শরীফ উহুদ পাহাড়ে অবস্থিত।

মোট কথা অলিগণের রম্নহানী ফায়েজ হাছিলের জন্য আওলিয়াগণের বেছাল দিবসে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পূর্বে থেকে আজও পর্যন্তô নেককার বান্দাগণ করে থাকে আমরাও করি।কেয়ামত পর্যন্ত চলবে কোন প্রকারে বন্ধ হবে না ইনশাআলস্নাহ। এমনও প্রমাণ আছে স্বয়ং নবী পাক প্রাণ প্রেয়সী হযরত খাদিজা (রাঃ) আনহার ওফাত দিবসে উট, দুম্বা জবাই করে সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন তবারক হিসাবে। আর তা দেখে হযরত আয়শা (রাঃ) আনহা নবীজিকে বলতেন ইয়া রাসুল (দঃ) কার জন্য এই অনুষ্ঠান করেন নবীজি বলেন আমি আমার খাদিজার ওফাত দিবস পালন করলাম।মুফতি গোলাম আম্বিয়া

ধৈর্যশীলতা হচ্ছে সফলতার সোপান

ধৈর্যশীলতা হচ্ছে সফলতার সোপান


বিপদে ধৈর্যধারণ করা একটি মহৎ গুণ। যার মধ্যে এই গুণ আছে সে চরম সংকটের সময়ও নিজের লক্ষ্যপথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যার মধ্যে ধৈর্যধারণের ক্ষমতা নেই তিনি সামান্য প্রতিবন্ধকতা কিংবা বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়লেই স্বীয় লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়ান। এই শ্রেণীর দুর্বল চিত্তের লোকদের সমাজে কোনো মূল্য নেই এবং জনগণের কাছেও তারা নগণ্য। জগৎসংসারে যতো সমস্যাই আসুক না কেন তা ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করতে হবে। ধৈর্য না রাখতে পারলে ব্যর্থতা এসে জীবনকে গ্রাস করে নিবে এবং ব্যক্তিত্বও নতমুখী হয়ে যাবে। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব অর্জনের জন্য ধৈর্যধারণ যেমন অপরিহার্য, তেমনি সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যও তা প্রয়োজন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যারা ধৈর্যধারণ করেছে তারাই কামিয়াব হয়েছে। পৃথিবীর নবী, পয়গম্বর এবং জগৎবিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনে এর প্রমাণই পাওয়া যায়।আরবি ’সবর’ শব্দটি বাংলায় ধৈর্য ও সহনশীলতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থে ’সবর’ হলো-বিরত রাখা বা সংযত রাখা। অর্থাৎ স্বীয় নফসকে অধীরতা ও ভীতিপ্রদ অবস্থা থেকে বিরত রেখে স্বস্থানে বহাল রাখা এবং সুদৃঢ় রাখা। শব্দটি ছোট্ট হলেও এর অর্থ ব্যাপক। আল-কোরআনে বহু স্থানে এ শব্দটি এসেছে এবং মুমিনদেরকে এ গুণটি সঞ্চয় করে জীবনের সমস্যা-সংকুল সুবিশাল পথ পাড়ি দিতে বলা হয়েছে।
জীবনে সাফল্য পেতে চাইলে ধৈর্য আবশ্যক। ধৈর্যধারণ ছাড়া কোনো কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। নামাজ পড়তে গেলে সময় দিয়ে ধৈর্য ধরতে হবে। রোজার ড়্গেত্রেও তাই। সেখানে ড়্গুধার যন্ত্রণা এবং নিষিদ্ধ কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকতে হবে। হজ্জ করতে গেলেও ধৈর্য আবশ্যক। সেখানে সময় এবং অর্থ দুটোই দিতে হবে। যাকাত দিতে গেলেও ধৈর্যের পরীড়্গা রয়েছে। সেখানে সম্পদ ব্যয় করতে হবে। অনুরূপভাবে প্রতিটি ইবাদতেই ধৈর্যের প্রয়োজন রয়েছে। জাগতিক ড়্গেত্রেও যদি হালাল রিযিক উপার্জন করতে হয় তাতেও ধৈর্য আবশ্যক। সৎভাবে চলাটা কঠিন কাজ। কিন্তু যারা সহনশীলতাকে জীবনের সঙ্গী করে নিয়েছেন তারাই সফলকাম হয়েছেন। আলস্নাহ বলেন ৈ”যারা এমন যে, যখন আলস্নাহর বিধান উলেস্নখ করা হয়, তখন তাদের অন্তôর ভীতিপূর্ণ হয় আর যারা নিজেদের উপর আপতিত মুসিবতে ধৈর্যধারণ করে এবং যারা নামাজের পাবন্দী করে এবং যা কিছু আমি দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।” (সূরা হজ্জ, আয়াতঃ ৩৫এৈর পূর্বের আয়াতে এই সমস্ত গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাফল্যের শুভ সংবাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আলস্নাহপাক পবিত্র কোরআনে সূরা যুমারের ১০ নং আয়াতে বলেছেন “দৃঢ়পদ ধৈর্যশীল লোকগণ অগণিত পুরস্কার লাভ করবে।”
মানুষ ধৈর্যশীল হলেই কেবল যে-কোনো পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবেলা করতে পারে। ধৈর্য থাকলে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মস্তিôষ্ককে কাজে লাগিয়ে সংকট মোচনের জন্য সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়। যার ধৈর্য নেই সে অযথা দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে এবং হিংসাত্মকভাবে সমস্যার সমাধান করতে চায়। যার ফলে সমাজে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম কখনো সহিংসতা পছন্দ করে না।
হাদীস শরীফে উলেস্নখ করা হয়েছে ”সহনশীলতা উত্তম মর্যাদার অধিকারী; আর সহিংসতা অপেড়্গা সহনশীলতা শ্রেষ্ঠ।”
বিপদে ধৈর্যধারণ করা অর্থ পিছিয়ে আসা নয়; বরং আবেগতাড়িত না হয়ে জ্ঞান-বুদ্ধি প্রয়োগ করে যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করা। ধৈর্য ধরলে সাফল্য আসবেই। মহানবী (সা•) সারাজীবন ধৈর্যধারণ করেছেন। ৬৩ বছরের জীবনে কখনো তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। এজন্যই তিনি বিশ্বময় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে সড়্গম হয়েছিলেন।
এবার আমরা সবর বা ধৈর্যের তাৎপর্য নিয়ে কিছু বলব। সবরের অনেক তাৎপর্য এবং বিশেষত্ব রয়েছে। এর প্রথম তাৎপর্য হলো- যথার্থ সময়ের প্রতীড়্গা করা। সকল দুঃখ, কষ্ট, বেদনা ও প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্যের সাথে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সাধনে সুদৃঢ় থাকা। যত বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন আস্থার সাথে কাজ করে যাওয়া। যথা সময়ে সাফল্য আসবেই। আলস্নাহ বলেন- ”আর তুমি দৃঢ়পদে প্রতীক্ষf করতে থাক এ পর্যন্ত যে, আলস্নাহপাক ফায়সালা করে দেবেন। কেননা তিনিই উত্তম ফায়সালাকারী।” (সূরা ইউনুস, আয়াতঃ ১০৯)
সবরের দ্বিতীয় তাৎপর্য হলো- বিপদের সময় অস্থির না হওয়া; বরং এর মধ্যে কোনো কল্যাণ আছে বলে সানন্দে বরণ করে নেয়া। একই সাথে এই বিশ্বাসও করা যে, যখন সময় আসবে তখন আলস্নাহ তা স্বীয় রহমতে বিদূরিত করবেন। বিপদের সময় ধৈর্যহারা না হয়ে বরং দোয়া করাই উচিত। কেননা ধৈর্য এবং দোয়া এ দুটোই পারে বান্দাকে বিপদ থেকে মুক্তি দিতে। আলস্নাহপাক বলেন ৈ“আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে ভয়, ড়্গুধা, সম্পদহানি, স্বাস্থ্যহানি, ফল ও ফসলহানির মাধ্যমে পরীড়্গা করব। তবে সুসংবাদ রয়েছে ধৈর্যশীলদের জন্য- যারা মুসিবতে নিপতিত হবে বলে অবশ্যই আমরা আলস্নাহর জন্য এবং অবশ্যই আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাবো। তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পড়্গ থেকে অফুরন্ত অনুগ্রহ ও শান্তি এবং তারাই সঠিক পথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।”(সূরা বাকারা, আয়াতঃ ১৫৫-১৫৭)
সবরের তৃতীয় বিশেষত্ব হলো কাঙিড়্গত লড়্গ্যে পৌঁছার জন্য যে সকল বিপদ ও সংকট আপতিত হবে বা যে সকল প্রতিবন্ধকতা আসবে তার দ্বারা যেন অন্তরে দুর্বলতা ও ভয়-ভীতির সঞ্চার না হয়ঃ বরং এর মধ্যে যেন দৃঢ়তা ও অবিচল থাকার ভাব ফুটে ওঠে। আলস্নাহপাক বলেন- ”নামাজ কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, মন্দকাজের নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ।” (সূরা লুকমান, আয়াতঃ ১৭) সবরের চতুর্থ বিশেষত্ব হলো- শত্রম্নর কষ্টদায়ক পদচারণার প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে তাকানো।
তার দুর্ববহারের প্রতিশোধ না নিয়ে বরং তাকে ড়্গমা করলে সে পরবর্তীতে ভালো আচরণ করার সুযোগ পাবে। আলস্নাহপাক রাসুলুলস্নাহ (সা•) কে উদ্দেশ্য করে বলেন- “যদি আপনি শাস্তির পথ গ্রহণ করেন তাহলে তদনুরূপ শাস্তির পথ তারাও গ্রহণ করবে, আর যদি আপনি ধৈর্যধারণ করেন তাহলে তা ধৈর্যশীলদের উপকারে লাগবে। তাই আপনার উচিত তাদের কথিত বাক্যাবলী ও আচরণের উপর ধৈর্যধারণ করা, আপনার ধৈর্য আলস্নাহর সাহায্যেই বাস্তবায়িত হবে। তাদের কাজে চিন্তান্বিত হবেন না, এমনকি তাদের ষড়যন্ত্রের জন্য বিষন্নও হবেন না।” (সূরা নাহল, আয়াতঃ ১২৬-১২৭) এভাবে আলস্নাহ নবীজীকে ধৈর্যের শিক্ষা দিয়েছেন। শত্রুর এমন রূঢ় ব্যবহারে ধৈর্যধারণকারীর কোনো ড়্গতি নেই বরং সমাজের উপকারই বেশী।
পৃথিবীতে সুখ ও দুঃখ হচ্ছে আপেড়্গিক বিষয়। বৃহৎ কিছু পাবার পর মানুষ আনন্দে আত্মহারা হতে পারে আবার কিছু হারানোর বেদনায় সে অস্থিরও হতে পারে। এই উভয় অবস্থায় ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে কাজ করা খুবই কঠিন। কিন্তু আত্মসংযমের এটাই আসল সময়। তাই আনন্দ ও বেদনা জীবনে যা-ই আসুক না কেন নিজেকে স্থির রেখে সকলের সাথে শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। সহনশীলতার মহৎ গুণ অর্জন করে সর্বড়্গেত্রে নিজেকে বিজয়ী করাই মুমিনের মূল লক্ষ্য।

মীযানুর রহমান রায়হান

দৈনন্দিন জীবনে নিজের প্রতি মানুষের কর্তব্য

দৈনন্দিন জীবনে নিজের প্রতি মানুষের কর্তব্য


মানুষ নিজের জীবনে যেকোনো পন্থাই অবলম্বন করুক না কেন এবং যেকোনো রাস্তায়ই চলুক না কেন, প্রকৃত সৌভাগ্যের পরিচিতি অর্জন তার নিজেকে চেনার বা আত্মপরিচিতিরই অংশবিশেষ। অর্থাৎ আমরা যদি নিজেদেরকে চিনতে না পারি, তা হলে যেসব প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ করার মধ্যে আমাদের সৌভাগ্য নিহিত তা-ও চিনতে পারব না। সুতরাং এটা মানুষের অপরিহার্য কর্তব্য যে, সে যেন নিজেকে চেনে এবং এর মাধ্যমে নিজের প্রয়োজন পূরণ করার চেষ্টা করে। তার একমাত্র সম্পদ নিজের মূল্যবান আয়ুকে সে যেন বিনষ্ট না করে। হজরত রাসূলে কারিম সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পেরেছে, সে তার আল্লাহকে চিনতে পেরেছে।’ আমিরুল মু’মিনীন হজরত আ’লী রাঃ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পেরেছে, সে মা’রেফাতের সুউচ্চশৃঙ্গে আরোহণ করতে পেরেছে।’
মানুষ নিজেকে চেনার পর লক্ষ করে যে, তার সবচেয়ে বড় কর্তব্য হচ্ছে নিজের মানবতার মূল্যবান সম্পদগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। এরূপ সুউজ্জ্বল রত্নকে পদদলিত না করা এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পবিত্রতার দিকে লক্ষ রাখা, যাতে চিরস্থায়ী, সুন্দর ও মনোরম জীবন লাভ করা যায়। আমিরুল মু’মিনীন হজরত আলী রাঃ ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তার কাছে কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসা খুবই নগণ্য।’
মানুষের অস্তিত্ব দু’টি বস্তুর সমষ্টি। তা হচ্ছে আত্মা ও শরীর। মানুষের কর্তব্য হচ্ছে­ এ দু’টি বস্তুর পবিত্রতা ও দৃঢ়তা সংরক্ষণে সচেষ্ট হওয়া। পবিত্র ইসলামে এ দু’টি বিষয় সম্বন্ধে খুবই সূক্ষ্ম ও পর্যাপ্ত নির্দেশাদি প্রদান করেছে। কাজেই মানুষের উচিত নিজের শরীর ও আত্মার পবিত্রতা রক্ষার্থে সচেষ্ট হওয়া।
ইসলামের পবিত্র জীবনবিধান শারীরিক পবিত্রতা সম্বন্ধে বেশ ক’টি বিধি ও নিয়মাবলি নির্ধারণ করেছে। যেমন রক্ত, শবদেহ, কিছু জীবজন্তুর মাংস এবং বিষাক্ত খাবার গ্রহণ থেকে নিষেধ করেছে। আর নেশা জাতীয় ও নাপাক পানীয় পান করা, পেটপুরে খাওয়া ও শরীরের ক্ষতি সাধন করা হতে বিরত থাকা এবং আরো কিছু নির্দেশ প্রণয়ন করেছে, যার বিস্তারিত বর্ণনা এখানে সম্ভব নয়।
‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা’ পবিত্রতা রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ নিয়মাবলির অন্যতম। এজন্য পবিত্র ইসলামের বিধিবিধানে এ বিষয়টির প্রতি খুবই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, অন্য কোনো আদর্শে সেরূপ গুরুত্ব দেয়া হয়নি। হজরত রাসূলে কারিম সাঃ ইরশাদ করেছেন- পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ।
বলা বাহুল্য, এ হাদিসে যে ভাষায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রশংসা করা হয়েছে, তার চেয়ে অধিক প্রশংসার কোনো ভাষা নেই। গোসল করার ব্যাপারে দীনি দার্শনিকরা বারবার তাগিদ করেছেন। হজরত মূসা ইবনে জাফর ওরফে ইমাম মূসা কাজেম রহঃ বলেছেনঃ একদিন পর একদিন গোসল করলে মানুষ মোটাতাজা ও শক্তিশালী হয়। হজরত আলী রাঃ ইরশাদ করেছেন, ‘গোসলখানা কতই না উত্তম ঘর, যা মানুষের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে।’
এ ছাড়া ইসলাম সব ধরনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন, হাত-পায়ের নখ কাটা, মাথা ও শরীরের অতিরিক্ত চুল কেটে ফেলা, আহারের আগে ও পরে হাত ধোয়া। চুল আঁচড়ানো, কুলি করা ও নাকে পানি দেয়া, ঘর ঝাড়ু দেয়া, পথঘাট, ঘরবাড়ি ও গাছের ছায়া পরিষ্কার রাখা এবং এ ধরনের আরো অনেক আদেশ।
এসব নির্দেশ ছাড়াও ইসলাম কিছু ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছে যেগুলো সম্পাদন করতে হলে স্থায়ী পরিচ্ছন্নতা ও পাকপবিত্রতা অর্জন করতে হয়। যেমন শরীর ও পোশাককে নাপাকি থেকে পবিত্র করা, নামাজের জন্য দিনে কয়েকবার অজু করা এবং নামাজ-রোজার জন্য গোসল করা। যেহেতু অজু ও গোসলের সময় শরীরে পানি ব্যবহার করতে হয় যা পুরো শরীর বা শরীরের সংশ্লিষ্ট অংশে অপরিচ্ছন্নতার আবরণ পড়তে দেয় না। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাকে পরোক্ষভাবে ফরজ করা হয়েছে।
মন ও দেহের পবিত্রতা অর্জনের পর তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে পোশাকের পরিচ্ছন্নতা। হজরত রাসূলে আকরাম সাঃ-এর নবুয়তের প্রথম দিকে যেসব সূরা নাজিল হয়েছে, তার মধ্যে পবিত্র সূরায়ে মুদাচ্ছির অন্যতম। এ সূরার চতুর্থ আয়াতে আল্লাহতায়ালা পোশাক-পরিচ্ছদের পবিত্রতার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেনঃ ‘তোমরা পরিচ্ছদ পবিত্র রাখো।’
নামাজের ক্ষেত্রে পোশাক-পরিচ্ছদের পবিত্রতা ফিকাহ্‌ শাস্ত্রের বিশেষ অর্থে ফরজ। কিন্তু সার্বিকভাবে সর্বাবস্থায় নাপাকি ও ময়লা-আবর্জনা থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা মুস্তাহাব বা প্রশংসনীয়। প্রত্যেক মনীষীই এ ব্যাপারে বারবার তাগিদ করেছেন। হজরত রাসূলে কারিম সাঃ ইরশাদ করেছেন, ‘যে কেউ পোশাক পরিধান করে, তার তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা উচিত।’
পোশাক-পরিচ্ছদ ও শরীরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিধান ছাড়াও একজন মুসলমানের যথাসাধ্য উত্তম বা রুচিসম্মত পোশাক পরিধান করা উচিত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চেহারা নিয়ে মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করা উচিত। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে­ ‘বলো আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তাকে কে হারাম করেছে?’ (সূরায়ে আ’রাফঃ আয়াত ৩২)।
দৈনন্দিন জীবনে এসব ইসলামী আচরণ আমরা মেনে চললে আমাদের ব্যক্তিত্ব, পরিবার ও সমাজ মাধুর্য এবং বরকতে ভরে উঠতে বাধ্য। ইসলাম শুধু আমাদের পরকালীন নাজাতের কথাই বলে না; পথনির্দেশ করে দুনিয়ার সমুদয় কল্যাণ আর সুন্দরের।


অধ্যাপক মাওলানা মনিরুল ইসলাম রফিক
ওয়াহাব এসি মসজিদ, হালিশহর, চট্টগ্রাম

আল্লাহতায়ালার প্রতি ভালোবাসা


আল্লাহতায়ালার প্রতি ভালোবাসা


যাকে ভালোবাসা যায়, জান দিয়ে তার সন্তুষ্টির জন্য নৈকট্য অর্জনই ভালোবাসার প্রকৃত পরিচয়। এটিই হচ্ছে আল্লাহর প্রতি সঠিক মুহাব্বত ও অন্তরের গভীরতম প্রদেশ থেকে সঠিক ভালোবাসার নমুনা। এ সম্পর্কে রাসূলে করিম সাঃ এরশাদ করেছেন­ আল্লাহপাক পরওয়ার দেগারের ইচ্ছায় রাজি (খুশি) থাকাই হচ্ছে মুহাব্বতের বড় দরজা। ভালোবাসা প্রবল ও খাঁটি হলে অন্য কোনো কিছু সেখানে দাঁড়াতে পারে না। কোনো রকম প্যাঁচপয়জার ছাড়াই মুহাব্বতই কেবল প্রাধান্য লাভ করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি মুহাব্বত সব কিছুর ঊর্ধ্বে। সুতরাং এই মুহাব্বত ও ভালোবাসা সত্যিকারভাবে প্রমাণিত হবে আল্লাহপাকের প্রতি আনুগত্যের ভেতর দিয়ে। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি-মর্জি যে চায় সে উচ্চ মরতবায় পৌঁছে যায়। কেননা সে তো যেকোনো কোরবানি (ত্যাগের) পরিবর্তে আলামিনের খুশি তালাশ করে। অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে দুঃখ-কষ্ট অ্লান বদনে হজম করে। রাজহাঁসের মতো পানি ও দুধ থেকে পানিটুকু (দুঃখ) উগরে ফেলে দুধ (সুখ) টুকু সে শুষে নিতে জানে। মনের জোর উন্নয়নের ধারায় বজায় রেখে আল্লাহপাকের হুকুম-আহকাম নিবেদিত চিত্তে পালন করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি মুহাব্বত সম্পর্কে হজরত হাসান বসরি রহঃ বলেছেন, আল্লাহর মুহাব্বত যার হাসিল হয় সে সত্যিকারভাবে আল্লাহকে খাসভাবে ভালোবাসতে শুরু করে। আর যে দুনিয়াকে কিনে ফেলে সে দুনিয়াকে মুহাব্বত করতে শুরু করে। সে আর রাব্বুল আলামিনের মুহাব্বত করতে পারে না। মুমিন মুসলমান কেবল আদেল অবস্থায় খুশি হতে পারেন। কেননা যার মধ্যে আল্লাহর স্মরণ থাকে সে চিন্তিত না হয়ে পারে না। একবার হজরত ঈসা আঃ কিছু লোককে জীর্ণশীর্ণ বেশে দেখতে পান। তাদের প্রশ্ন করেন তাদের এ হাল কেন। উত্তরে তারা বলেন, সারাক্ষণ তারা খোদার ভয়ে ভীত থাকেন। হজরত ঈসা আঃ তখন বলেন, আল্লাহপাক তোমাদের ভালোবাসেন।
কাজেই এ কথা বলা যেতে পারে দুনিয়ার সব কাজকর্ম এবং নেক আমল আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি ভালোবাসা দৃঢ় করার উপলক্ষ মাত্র। রাহমানুর রাহিমের মুহাব্বত অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে বহু রৈখিক সংগ্রাম দিয়ে তার প্রতি গভীর ধ্যান-আত্মসমর্পণ ও মনোনিবেশ করা। রাসূল সাঃ এরশাদ করেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহপাক ও তার পেয়ারা রাসূলকে দুনিয়ার সব কিছু হতে ভালো না বাসে তার ঈমানের আকিদা পূর্ণ নয়। ঘটনাচক্রে এক সাহাবি হজরত মুহাম্মদ সাঃ-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘ঈমান কী’? জবাবে রাসূল সাঃ বলেছিলেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এবং তদীয় প্রিয় রাসূল সাঃ-এর সাথে সর্বাপেক্ষা অধিক মুহাব্বতের নাম ঈমান। কেউ পূর্ণ মুসলমান হতে পারবে না যতক্ষণ সে তার পরিবার-পরিজন ধনদৌলত এবং দুনিয়ার সব কিছু থেকে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাঃ-কে অধিকতর মুহাব্বত ও ভালোবাসবে।
মোটকথা মানুষের ভালোবাসার একমাত্র লক্ষ্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আমাদের জীবনে ডুবন্ত নৌকা থেকে পানি ঝেড়ে ফেলার জন্য এক আল্লাহ ব্যতীত মুহাব্বত বা ভালোবাসার কেউ নেই। যে আল্লাহকে ভুলে দুনিয়া নিয়ে মত্ত থাকে তার মতো জাহেল ব্যক্তি আর কেউ নেই। যারা মাতা-পিতা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়স্বজন এবং গরিব-দুঃখীজনকে মানবতার দৃষ্টিতে যথারীতি ভালোবাসে, সে মূলত আল্লাহরই হুকুমের তাঁবেদারি করে। যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে মুহাব্বত করে এবং হজরত মুহাম্মদ সাঃ ও অন্য নবী-পয়গম্বর, অলি-আউলিয়াদের মুহাব্বত করে তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর রহমত, বরকত, নেয়ামত ও অশেষ করুণা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি মুহাব্বত ও ভালোবাসার দৃষ্টান্ত অনেকই আছে। যারা আল্লাহ পাকের খুশি ও মর্জিতে খুশি থাকে এবং আল্লাহ মহানের জন্য সর্বাবস্থায় আত্মসমর্পিত থাকে এবং যত বড় দুঃখ-কষ্ট আসুক না কেন তারা আল্লাহর কথা স্মরণ করে নিজেকে ধীরস্থির রাখতে পারে, তারাই কার্যত আল্লাহপাকের মুহাব্বত ও ভালোবাসায় নিজেকে নিবেদিত চিত্তে উৎসর্গ করতে পেরেছে। কথিত আছে­ হজরত আয়েশা রাঃ একটি নখ এক সময় উপড়ে যায়। তা দেখে হজরত মুহাম্মদ সাঃ বলেন­ তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। উত্তরে আয়েশা রাঃ বলেন, এ কষ্ট যন্ত্রণার বদলে পরবর্তী পুরস্কারের আনন্দ অ-নে-ক বেশি। অতএব বলা যেতে পারে, দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হবে। কেননা পরকালে আল্লাহ পাকের মুহাব্বত ছাড়া অন্য কোনো সম্বল নেই। সুতরাং সেই ব্যক্তি সবচেয়ে সৌভাগ্যশালী, যে আল্লাহর মুহাব্বতের রঙে রঞ্জিত। নিজেকে যে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করেছে সে-ই মঙ্গল ও কল্যাণ লাভ করেছে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে বিফল মনোরথ হয়ে পড়বে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের হুকুম-আহকাম যথাযথ পালন করে সত্যিকারভাবে মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে ইহ ও পরলৌকিক সুখ ও শান্তিময় করে রাখতে সচেষ্ট হই। রাব্বুল আলামিনের মুহাব্বত ও ভালোবাসার স্বীয় জীবনের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস অতিবাহিত করতে পারি­ আল্লাহপাক যেন আমাদের সেই তৌফিক দেন।
রেহানা ফারুক

দাওয়াত ও তাবলিগ কী এবং কেন?

দাওয়াত ও তাবলিগ কী এবং কেন?


কোনো দেশ, কোনো অঞ্চল বা কোনো গোষ্ঠীবিশেষের জন্য ইসলাম ধর্ম প্রেরিত হয়নি। ইসলাম সমগ্র বিশ্বের সব যুগের সব মানুষের ধর্ম। তাই দুনিয়াবাসীর জন্য ইসলামই হলো একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ। পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে পথের দিশা দিতে যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত ১ লাখ মতান্তরে ২ লাখ ২৪ হাজার নবী ও রাসূল দাওয়াত ও তাবলিগের দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করে গেছেন। হজরত আদম আঃ থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ সাঃ-এর আগমন ও ওফাতের মাধ্যমে এ ধারার সমাপ্তি ঘটে। হুজুর সাঃ-এর পর থেকে এ দায়িত্ব খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবেতাবেইন, সলফে সালেহিন এবং আলেমরা পালন করছেন। ১৯৪১ সালে দিল্লির মেওয়াতে মাওলানা ইলিয়াস রহঃ তাদেরই পদাঙ্কা অনুসরণ করে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু করেন। যার সম্প্রসারিত রূপ আজকের টঙ্গীর তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমা। মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবি হাসিলের উদ্দেশ্যে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং আমলে সালেহ (সৎ কাজ বা ভালো কাজ) করাই এ দাওয়াতের মুখ্য বিষয়।
আল্লাহতায়ালা এ দাওয়াতি কাজটি ব্যক্তিগতভাবে, সমষ্টিগতভাবে সবার ওপর সমানভাবে দিয়ে দিয়েছেন। তাই প্রত্যেক মানুষের ওপরই তার স্বীয় ক্ষমতা অনুযায়ী সত্যের প্রচার করা ফরজ। বিদায় হজের ভাষণে রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘আমার পর আর কোনো নবী আসবে না। অতএব আমার একটি বাণী হলেও অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’
পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মের নামকরণ হয়েছে কোনো বিশেষ ব্যক্তির নামে। খ্রিষ্টধর্মের নাম হয়েছে এর প্রচারক যিশুখ্রিষ্টের নামে। বৌদ্ধ ধর্মের নাম হয়েছে মহাত্মা বুদ্ধের নামে। তবে ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা কোনো ব্যক্তি বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের নামকরণ করেছেন মহান আল্লাহপাক। একমাত্র আল্লাহর ওপর দৃঢ়বিশ্বাস রেখে তাঁর দেয়া বিধিবিধান যথাযথভাবে পালন করা ব্যতীত কোনো লোক প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। ইসলাম অর্থ আল্লাহর কাছে আনুগত্য প্রকাশ করা, আত্মসমর্পণ করা, শান্তির পথে চলা। মূলত যিনি ইসলামের বিধান মেনে চলেন তিনিই মুসলমান। ইসলাম আল্লাহতায়ালার মনোনীত একমাত্র দীন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মুসলমানকে আল্লাহর মনোনীত ব্যবস্থার আলোকেই জীবনযাপন করতে হয়। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম হচ্ছে ইসলাম।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৯)। তাই আল্লাহর নির্দেশ, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২০৮)। পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করতে হলে নিজের ঈমান ও আমল ঠিক করতে হবে এবং মানুষকে ভালোবেসে মানুষের মঙ্গলের জন্য আল্লাহর রাস্তায় সময় ও সম্পদ ব্যয় করতে হবে। মানবজীবনের একমাত্র কামিয়াবি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের হুকুম পালন করার মধ্যেই নিহিত।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আমি চাই তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক হোক যারা মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করবে, ভালো কাজের আহ্বান করবে, আর মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। ওই দলটাই হলো সাফল্য লাভকারী।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৪)
পথভোলা মানুষকে পথের সন্ধান দেয়া, বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে আনা, মানুষকে সুপরামর্শ দেয়া, চরিত্রবান ও সৎ সাহসী করা, অভাবগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত, দুস্থ, এতিম, অসহায়ের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া, মহৎ কর্মের উপমা সৃষ্টি করা, ভালো কাজে উৎসাহী করা, মন্দ থেকে বিরত রাখা, কর্মচঞ্চল করা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া, এক কথায় ইহকাল ও পরকালের শান্তির জন্য মানুষকে সত্য ও সরল পথে চলার আহ্বানই হচ্ছে দাওয়াত বা তাবলিগ।
মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হলে, ভালো দিয়ে মন্দের মোকাবেলা করতে হলে বিনয়ী ও ধৈর্যশীল হতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। হৃদয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসা পয়দা না হলে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ করা সম্ভব নয়। হজরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা দীনের দাওয়াত সহজ করো, কঠিন কোরো না। সুসংবাদ দাও, বীতশ্রদ্ধ কোরো না।’ (বুখারি ও মুসলিম)। আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকে ডাকো কৌশল সহকারে উত্তম নসিহতের মাধ্যমে এবং বিতর্ক করো উত্তম পন্থায়।’ (সূরা নাহল, আয়াত-১২৫)।
দাওয়াত ও তাবলিগে সময়, জান ও মাল উৎসর্গ করে আল্লাহর প্রকৃত প্রেমিক হতে হবে। তবেই মানুষ আহ্বানে সাড়া দেবে। ‘আল্লাহর রাস্তায় একটা সকাল বা একটা বিকাল ব্যয় করা সারা দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।’ ‘হে মুমিনগণ, তোমাদিগকে কি এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দান করব যা তোমাদেরকে কঠোর আজাব থেকে রক্ষা করবে? তা হলো, তোমরা আল্লাহর ওপর ও আল্লাহর রাসূলের ওপর ঈমান আনবে, মেহনত করবে আল্লাহর রাস্তায় মাল ও জান দিয়ে।’ (সূরা আস-সাফ, আয়াত-১০)। আল্লাহর রাস্তায় জান ও মাল দিয়ে মেহনত করার অর্থই হচ্ছে সৃষ্টিকে ভালোবেসে স্রষ্টাতে বিলীন হওয়া। এই পৃথিবীতে আল্লাহর দীন কায়েমের মাধ্যমে মানুষের স্থায়ী (পরকালীন) মুক্তির ব্যবস্থা করে দেয়া এবং দুনিয়াবি কল্যাণ করা। ‘তার কথার চেয়ে উত্তম কথা কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নেক আমল করে এবং সে বলে, আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত-৩৩)।
আসুন, আমরা আমিত্ব ও স্বার্থের বন্ধন ছিন্ন করে ঈমানদার ও ভালো মানুষ হই। নিজে আমলে সালেহ করি এবং কথা, কাজ, বক্তৃতা ও লিখনীর মাধ্যমে আল্লাহর দীনের সুস্পষ্ট চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরি। বাস্তব জীবনে এর উজ্জ্বল নমুনা পেশ করি। দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে মানুষকে প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে ‘আল্লাহর রজ্জু’কে মজবুত করে ধরতে শিখি। আধুনিক যুগে নৈকিতা ও মূল্যবোধের দারুণ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য, বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াত ও তাবলিগের কোনো বিকল্প নেই।


মোশারেফ হোসেন পাটওয়ারী

ইসলাম ও বিশ্ব-প্রকৃতি


ইসলাম ও বিশ্ব-প্রকৃতি


কোনো মুসলমানই বুকে হাত দিয়ে এ কথা বলতে পারবে না যে, সমসাময়িক বিপর্যস্ত বিশ্বপ্রকৃতির কথা বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামী বিশ্বই প্রথম তুলে ধরে। এর পুরো কৃতিত্ব একান্তভাবে ঈলৎদ সফ Club of Rome-এর, যাদের ‘প্রবৃদ্ধির সীমা’ সংক্রান্ত রিপোর্টটি ১৯৭২ সালে পশ্চিমা বিশ্বকে বোম শেলের আঘাত করে। জার্মান বিদেশ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী স্টাফের একজন সদস্য হিসেবে আমার এখনো মনে পড়ে। কী অপরিসীম গুরুত্বের সাথে তখন আমাদেরকে বৈদেশিক নীতির ওপর এই রিপোর্টের হতাশাব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়ার মূল্যায়ন করতে হয়েছিল।
এখনো যে ইসলামী বিশ্ব এ ব্যাপারে বিশেষ সচেতন, তাও নয়। ১৯৯১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণদানকালে জার্মান বিদেশমন্ত্রী Hans-Dietrich Genscher-এর মন্তব্যঃ ‘মানুষ এখনো সৃষ্টির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে!’ যদিও কথাটি তাদের নিজেদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। অবশ্য বেশির ভাগ ইসলামী রাষ্ট্র যেহেতু অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের সদস্য, তাদের কাছে বিশ্বায়তনে প্রতিবেশ রক্ষার যে ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলো পশ্চিমা বিশ্ব উত্থাপন করে চলছে, তাকে নিতান্তই বিলাসিতা বলে মনে হচ্ছে, যা একমাত্র শিল্পোন্নয়নে অতি উচ্চস্তরে অবস্থিত পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষেই নির্বাহ করা সম্ভব। আবার অন্য দিকে James P. Pinkerton-এর মতো ব্যক্তিত্বের কাছে এই শোরগোলকে নিতান্তই কল্পনাবিলাসী রোমান্টিক প্রকৃতিপ্রেম বলে মনে হচ্ছে।
অবশ্য তার এই মন্তব্যের মাঝে বাস্তবতার ইঙ্গিত আছে। বর্তমানে ইউরোপীয়রা যে প্রচণ্ড উৎসাহের সাথে একেবারে প্রকৃতিবাদী মিশনারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন, তার মাঝেও যথেষ্ট অসঙ্গতি লুকিয়ে আছে। বাস্তবিকই, এই অতিসচেতনতা পেছনের (প্রতিবেশগত) দরজা দিয়ে নব্য উপনিবেশবাদের অনুপ্রবেশের চোরাপথ খুলে দিতে পারে।
সামগ্রিকভাবে জার্মানি এবং সে সূত্রে জার্মান মুসলমানরা, যেমন­ Ahmad Von Denffer, Harun Behr এবং অপিল Axel Kohler, প্রকৃতি বিপর্যয়ের লক্ষণগুলো প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই একটি বিশ্বমাত্রিক পরিবেশসংক্রান্ত নৈতিকতার নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালের ১৭ মে ইসলামী সেন্টার কর্তৃক আয়োজিত তাদের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানের মূল বিষয়ই ছিল ‘ইসলাম ও পরিবেশ’।
ইসলামের ‘আগে পৃথিবী’ নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে দেয়া গেলঃ
১. বর্তমানের প্রকৃতি বিধ্বংসী বিপর্যয়ের মূল কারণ হচ্ছে মানুষের আধুনিকতার ঔদ্ধত্য যে তার সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গেছে, যে নিজেকে নির্বাক প্রকৃতির একচ্ছত্র অধীশ্বর জ্ঞান করে ভোগ-লালসার সীমাহীন উল্লাসের প্লাবনে বিশ্ব প্রকৃতিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়, যেন এর অক্ষত থাকার কোনো অধিকারই নেই। পক্ষান্তরে একজন মুসলমান জানে যে, এখানকার কোনো কিছুর ওপরই তার কোনো মালিকানা নেই, মালিকানা একমাত্র আল্লাহ্‌র। বাইবেলের ধারণা মতে সে এখানে আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাস করে না বরং এখানে সে অবস্থান করে একজন খায়খালাসি স্বত্বসম্পন্ন মানুষের মতো, প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর দায়িত্বশীল ব্যবহারকারী হিসেবে।
২. সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ (যিনি এগুলোর প্রকৃত মালিক) মানুষের কাছ থেকে সর্ববিষয়ে মধ্যপন্থী আচরণ পছন্দ করেন এবং কোনো অবস্থাতেই সম্পদের অপচয় পছন্দ করেন নাঃ
‘.... আল্লাহ্‌তায়ালা অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ [সূরা আল আনআম (৬ঃ ১৪১)]
এভাবে তিনি চাকচিক্য, জৌলুশ ও বিলাসিতাকে ত্যাগ করার নির্দেশ দেন, একইভাবে উদর পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও খাদ্য গ্রহণ অব্যাহত রাখাটা লালসার অভিব্যক্তি বিধায় তাকে বর্জন করার উপদেশ দেন।
সাধারণভাবে বিচার করলে এই নির্দেশ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশেই গিয়ে পৌঁছায়। কুরআনের ভাষায়ঃ
‘আল্লাহ্‌র জমিনে বিপর্যস্ত সৃষ্টি কোরো না, যা তিনি এত সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করেছেন।’ [সূরা আল আ’রাফ (৭ঃ ৫৬)]
এই প্রেক্ষাপটে একজন মুসলমান হচ্ছে প্রকৃতির জন্মগত প্রতিরক্ষক, যদি সম্যক বিপর্যয়ের কোনো কারণ নাও থাকে।
৩. সমগ্র কুরআনজুড়ে প্রকৃতির যে
বিস্তৃত বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনে আল্লাহ্‌র সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলা (এই সাথে এটা আল্লাহর অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণও বটে)। একজন মুসলমানের জন্য মহাবিশ্ব হচ্ছে একটিমাত্র পরিবার যার ঐকতান হচ্ছে আল্লাহতায়ালার প্রেমময় মর্যাদা ও মহিমার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূচিপত্রের দিকে একবার চোখ বুলালেই এই ধারণার সত্যতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যেখানে বেশ কতকগুলো সূরার শিরোনাম দেয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রাণী ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলির নামানুসারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বুঝে নেয়া দরকার যে বিশ্বপ্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে মানুষকেও একটি বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাণিজগতের অন্যান্য সদস্যের সমপর্যায়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই সত্যটিকে কুরআন মজিদ সুন্দর কাব্যিক ভাষায় বর্ণনা করেঃ
‘‘পৃথিবীর বুকে বিচরণশীল যেকোনো জন্তু কিংবা নিজ ডানার ওপর ভর করে উড়ে চলা কোনো পাখিই (তোমরা দেখো না কেন) এগুলো সবই তোমাদের মতো (আল্লাহ্‌র বিচিত্র সৃষ্ট) জীব।’ [সূরা আল আনআম (৬ঃ ৩৮)]
এ ব্যাপারে আমাদের ধারণাটি যথেষ্ট পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন যে একজন মুসলমানের জন্য বন্য প্রাণিগুলো, দেওয়ানি আইনের ধারামতো, লা-ওয়ারিশ জীবন্ত বস্তু নয়, বরং এক-একটি উম্মাহ্‌র সদস্য (বিড়াল, কুকুর, ঘোড়াদের উম্মাহ), ঠিক যেভাবে একজন মুসলমান ইসলামী উম্মাহ্‌র একজন সদস্য! এই চেতনার বশবর্তী হয়ে রাসূল সাঃ অত্যাচারিত বা ক্ষুধার্ত প্রাণীদের সপক্ষ হয়ে প্রায়ই মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে বাধা প্রদান করতেন। তার মমতাময় প্রযত্ন থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাখিও বাদ যেত না।
অবশ্য এর দ্বারা এমন কথা বলা হচ্ছে না যে মানুষ প্রাণিজগৎ থেকে তার ফায়দা উঠাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই নির্দিষ্ট সীমার মাঝে আচরণ করতে হবে। ক্রীড়া-কৌতুকের জন্য প্রাণী হত্যাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তাদেরকে অযথা উত্ত্যক্ত করাও সমানভাবে নিষিদ্ধ।
৪. কুরআন প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ নয়, কিন্তু তবুও এর মাঝে প্রকৃতি জগতের আশ্চর্য সব ঘটনাবলির প্রাণবন্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে A. Von Denffer সূরা আল ওয়াকিয়াহর ৬৮-৭০ নম্বর আয়াতগুলোর মাঝে অ্ল বৃষ্টির যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেনঃ
‘কখনো তোমরা সেই পানির (সূত্র) সম্বন্ধে চিন্তা করে দেখেছ কি, যা তোমরা (নিত্য) পান করো। (আকাশের) মেঘমালা থেকে এই পানি কি তোমরা বর্ষণ করো- না আমিই এর বর্ষণকারী? অথচ আমি চাইলে এই (সুপেয়) পানিকে লবণাক্ত করে (পানের অযোগ্য করে) দিতে পারি। আমার সৃষ্টির এসব কলাকৌশল জানা সত্ত্বেও তোমরা কেন আমার কৃতজ্ঞতা আদায় করছ না?’ (৫৬ঃ ৬৮-৭০)
৫. ‘পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক’ নবী করীম সাঃ-এর এই উক্তিটি প্রতিবেশগত বাস্তবতার ওপর প্রয়োগ করলে আমরা দেখতে পাই যে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে আজ যে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চলছে তার শুরু হচ্ছে এর অপরিচ্ছন্নকরণের মাঝ দিয়ে।
Holger Schleip-এর ‘প্রকৃতির কোলে প্রত্যাবর্তন’ ধর্মের মাঝে, যা কেতাদুরস্থ ‘গ্রিন’ রোমান্টিকতার আশ্রয়ে আমরা প্রকৃতি দূষণের এই মহা বিপর্যয় থেকে বের হয়ে আসার কোনো পথ খুঁজে পাবো না। প্রকৃতির ওপর দেবত্বারোপ করেও সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করার স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক পরিণতি থেকে আমরা রক্ষা পাবো না।
Ferdinand Fellmann, যিনি নব্য প্রকৃতি দর্শনের অবাস্তব আবেগ প্রবণতা সম্পর্কে আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, যথার্থই বলেছেন, ‘প্রকৃতি জগতের মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কাকে সামনে রেখে আমাদের সত্যিকার দর্শনতাত্ত্বিক আরব্ধ যা, তা প্রকৃতির নতুন দর্শন নয় বরং প্রযুক্তির নতুন দর্শন। আজকের আমাদের যা প্রয়োজন তা একটি আবেগসর্বস্ব নব্য সর্বখোদাবাদ নয় বরং দানবীয় স্বেচ্ছাচারী প্রযুক্তি বিজ্ঞানের হৃত বিবেককে ফিরিয়ে আনা। মোট কথা, আমাদেরকে আমাদের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি নতুন আবেদনের আশ্রয় নিতে হবে।
অবশ্য ‘গ্রিন’ আন্দোলনের মধ্যকার অনেক তরুণই ব্যাপারটি বুঝতে শুরু করেছে এবং এটাও বুঝতে শিখেছে যে, তারা যা করছিল তা ‘সবুজপূজা’ (Greenolatry) ছাড়া আর কিছু নয়। তারা লক্ষ করছে যে, অহঙ্কারী নরসর্বস্ব মনোবৃত্তি বিশ্বপ্রকৃতির যে ক্ষতি ইতোমধ্যেই করে ছেড়েছে কেবলমাত্র স্বেচ্ছাপ্রণোদিত আত্মসংযমের প্রতিকার করতে যথেষ্ট নয়। বিশ্বপ্রকৃতিকে বাঁচাতে গেলে সর্বাগ্রে যা করতে হবে তা হচ্ছে ভোক্তা হিসেবে পশ্চিমা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন। কেবল যখন সে নিজেকে মুসলমানের মতো আবদ (আল্লাহর বান্দা) হিসেবে দেখতে শিখবে তখনই তার পক্ষে ভোক্তা হিসেবে নিজের বিবেককে কাজে লাগান সম্ভব হবে এবং কেবল তখনই এমন একটি বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হবে।
এ কারণেই মিছে মায়ার পিছে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে অনেক ‘গ্রিন’ সদস্যই ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের অনেকেই তাদের অস্তিত্বগত ঝুঁকির আশঙ্কায় কাতর হয়েছিলেন। মূলত তাদের এই আশঙ্কাটি পশ্চিমাসমাজের মূল্যবোধ সঙ্কটের একটি লক্ষণ মাত্র। পরে এই আশঙ্কাই সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাগিদে পরিণত হয়, যার বিনিময়ে তারা খুঁজে পায় তাদের চির কাঙ্ক্ষিত শান্তি। এটাই ইসলাম।

মুরাদ হফম্যান

শুক্রবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০০৯

জাতীয় মসজিদের জন্য কেমন খতিব চাই


জাতীয় মসজিদের জন্য কেমন খতিব চাই


জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এ দেশের মুসলমানদের মসজিদভিত্তিক জাতীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এ মসজিদ এক দিকে যেমন ইসলামি ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার ও স্থাপত্য শিল্পের উজ্জ্বল নিদর্শন, ঠিক তেমনি এর সাথে রয়েছে দল-মত নির্বিশেষে এ দেশের প্রতিটি মুসলমানের অবিমিশ্র ঈমান ও আত্মার সম্পর্ক। এ মসজিদ আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ ও জাতিসত্তার পরিচায়ক ও স্মারকও বটে। যিনি মসজিদের খতিব হবেন তিনি ১৪ কোটি বাংলাদেশী মুসলিম জনগোষ্ঠীর মুরুব্বিও। তিনি অবশ্যই সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং সম্মানিত হবেন। আর এমন একজন ব্যক্তিত্ব দল, মত ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে থেকে জাতিকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেবেন।
এ মসজিদের যিনি খতিব হবেন তিনি অবশ্যই অত্যন্ত উঁচু দরের একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব হবেন এবং একই সাথে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও হবেন সুপরিচিত। বিশ্ব ইসলামি সংস্থা ও সংগঠনগুলোতে তার সম্পৃক্ততা এবং গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক ইসলামি ব্যক্তিত্ব বা স্কলারদের সাথেও তার সখ্য ও অভিন্ন আকিদা থাকতে হবে।
মরহুম মাওলানা উবায়দুল হক রহঃ বহুলাংশে সেই মানের লোকই ছিলেন। তার ইন্তেকালের পর সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য চাই সেই মাপের একজন মানুষ। উপমহাদেশের দীনি শিক্ষার ধারা মূলত দু’টি­ একটি কওমি নেসাব আর অন্যটি হলো আলিয়া নেসাব। কওমি নেসাবের প্রাণকেন্দ্র দেওবন্দ মাদ্রাসার কথা বাদ দিলে এ দেশে এলমে দীনের কথা কল্পনাও করা যায় না। বলা বাহুল্য, মরহুম মাওলানা উবায়দুল হক রহঃ ছিলেন সমান তালে এ দু’টি ধারায় সঞ্জীবিত এক সার্থক পুরুষ। যিনি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন তাকে অবশ্যই এ দু’টি মৌল ধারার সাথে সম্পৃক্ত থাকা প্রয়োজন। আগেই বলা হয়েছে, বায়তুল মোকাররম আমাদের ঈমান, আকিদা ও ইসলামি আদর্শবাদের জাতীয় প্লাটফর্ম এবং তার খতিব হলেন জাতির মুখপাত্র। আমাদের এ জাতীয় প্লাটফর্মের কেন্দ্রীয় সদর দফতর হলো পবিত্র মক্কা- মদিনা। সুতরাং আমাদের জাতীয় মসজিদের সম্মানিত খতিব সাহেব স্বভাবসিদ্ধভাবেই সদর দফতর কাবাকেন্দ্রিক জীবনাদর্শে উজ্জীবিত হবেন।
যিনি জাতীয় মসজিদের খতিব হবেন তার বংশ পরিচয়, ছেলেবেলা, শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি বা কর্মজীবন, অর্থনৈতিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, আকিদা-বিশ্বাস, দীনদারি-পরহেজগারি, দেশ-জাতি, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং অবস্থান ইত্যাদি ব্যাপারে জাতির কাছে সুস্পষ্ট স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। তিনি দেশ, মানুষ ও সমাজের জন্য কী অবদান রেখেছেন? স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবস্থান কী ছিল? ইসলামের জন্যই বা তার কী অবদান আছে? এ জাতীয় সব প্রশ্নের স্বচ্ছ এবং সুস্পষ্ট ইতিবাচক ধারণা থাকা প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় এসব কোনো কিছুই বিবেচনা না করে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বায়তুল মোকাররমের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের খতিব নিয়োগে উদ্যোগী হলে এ পদের ভাবমর্যাদা এবং সম্মান দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
আমরা বায়তুল মোকাররমের খতিব নিয়োগ নিয়ে যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুর্ভাগ্যজনক মনে করি। আমরা এ ইস্যুতে সকল বিতর্কের অবসান চাই। চাই এমন একজন মানুষ যার ব্যাপারে কারো পক্ষ থেকে আমলে নেয়ার মতো কোনো বিতর্ক থাকবে না।


মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম

মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোই তার অন্যায়ের সাক্ষ্য দেবে


মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোই তার অন্যায়ের সাক্ষ্য দেবে


আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেবো। তাদের হাতগুলো আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পাগুলো তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে’ (সূরা ইয়াসিনের ৬৫ নম্বর আয়াত)। আলোচ্য আয়াতে মানুষের পার্থিব জীবনের বিভিন্ন অপকর্মের সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে হাত ও পায়ের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। কুরআনের অন্য আয়াতে মানুষের কর্ণ, চক্ষু ও চর্মের সাক্ষ্য দানের কথা উল্লেখ রয়েছে। হাশরের বিভীষিকাময় ময়দানে উপস্থিত হওয়ার পর সব মানুষ তার পরবর্তী অবস্থা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়বে। প্রকৃত অপরাধীরা সেদিন আল্লাহর ভয়াবহ আজাব থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে।

প্রথমে প্রত্যেকেই আত্মরক্ষার্থে যা কিছু বলার ও ওজর পেশ করার তা করতে পারবে এবং নিজেদের অপরাধ আড়াল করার উদ্দেশ্যে অপরাধীরা মিথ্যার আশ্রয় নেবে। মুশরিকরা সেখানে কসম করে কুফর ও শিরক অস্বীকার করবে। কেউ কেউ বলবে, ফেরেশতারা আমাদের আমলনামায় যা কিছু লিখেছে আমরা তা থেকে মুক্ত। তখন আল্লাহতায়ালা তাদের মুখে মোহর এঁটে দেবেন। যাতে তারা কোনো কিছুই বলতে না পারে। অতঃপর তাদেরই হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ, চর্ম ও অন্য অঙ্গগুলোকে রাজসাক্ষী করে কথা বলার যোগ্যতা দান করা হবে। এসব অঙ্গ-প্রতঙ্গ একটা একটা করে পার্থিব জীবনে অপরাধী কর্তৃক সম্পাদিত সব অন্যায় কার্যাবলি উন্মোচিত করে দেবে। অপরাধীরা তখন হতবাক হয়ে যাবে এই ভেবে যে, পার্থিব জীবনে যে হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ, চর্ম কখনো কথা বলতে পারত না, তারাই আমাদের অপরাধগুলো এভাবে আল্লাহর সামনে প্রকাশ করে দিচ্ছে! আজকের এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবনে আমরা একবারও ভেবে দেখি না যে, আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোই এক সময় আমাদের শত্রু হিসেবে আল্লাহর দরবারে সাক্ষ্য দেবে।

যদি ভাবতাম তাহলে আমাদের দ্বারা কি চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, জেনা, ব্যভিচার, মাদক সেবন, দুর্নীতি, অন্যের হক নষ্ট প্রভৃতি অন্যায় কাজ করা সম্ভব হতো? পৃথিবীর এই সংক্ষিপ্ত জীবনকে একটু আরামদায়ক করার জন্য, স্ত্রীর মন জয় করার জন্য কিংবা সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবনকে শান্তিময় করার উদ্দেশ্যে আমরা আমাদের হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ, মুখ, জিহ্বা ব্যবহার করে কতই না অন্যায় কর্ম করে যাচ্ছি। কিন্তু হাশরের ময়দানে আমি নিজে যখন কঠিন মসিবতে পড়ব, আমার এসব অঙ্গ যখন আমাকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য আমার অপরাধগুলো প্রকাশ করে দেবে তখন আমাকে কে রক্ষা করবে? অতএব, পরকালীন জীবনের লাঞ্ছনা এবং জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত আল্লাহ প্রদত্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোকে আল্লাহ ও তার রাসূল সঃ-এর হুকুম অনুযায়ী ব্যবহার করা।


আবুল কালাম আজাদ

মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম


মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম


বাংলাদেশে প্রায় ৩ লাখ মসজিদ রয়েছে। প্রতিটি মসজিদে কমপক্ষে একজন করে ইমাম আছেন। যেখানেই জনপদ সেখানেই মসজিদ সেখানেই ইমাম। একজন ইমাম একজন ধর্মীয় নেতা হিসেবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এক ব্যক্তিত্ব। বলা যায়, তার অবস্থান সর্বজনীন। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তিনি হতে পারেন সমাজপতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা অন্য কিছু। কিন্তু অবস্থানগত কারণে তার কথা সবাই শুনতে চান না বা শুনলেও সবাই আস্থা রাখেন না। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেন ইমাম। তিনি যা বলেন তা আমজনতা শুধু শোনেন-ই না, বরং দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করেন। ফলে একটি সমাজ তথা একটি দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনে একজন ইমামের ভূমিকা অপরিসীম। এই শুভবোধ থেকেই জাতিসঙ্ঘ টঘঋচ-এর মাধ্যমে, মানবসম্পদ উন্নয়নে ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্তকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে ইমামদের প্রশিক্ষণ দান করে আসছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির মাধ্যমে ইমামদের ৪৫ দিনের লং কোর্স প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তাদের অংশীদারিত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। উপরোল্লিখিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে রিসোর্সপারসন হিসেবে উপস্থিত থাকেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইমাম সাহেব তার ধর্মীয় চিন্তাচেতনার সাথে সমসাময়িক বিশ্বের বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করে সমাজে তার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হন। তিনি ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে নিাক্ত বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির প্রয়াস চালান।
১. নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ২. কুসংস্কার প্রতিরোধ, ৩. ধর্মীয় গোঁড়ামির উৎসাদন, ৪. ধর্মীয় লেবাসের জঙ্গিবাদ নির্মূল, ৫. যৌতুক প্রথা রোধ, ৬. এইচআইভি অওউঝ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি, ৭. জাতীয় যক্ষ্মা নির্মূল অভিযান জোরদারকরণ, ৮. মাদকাসক্তি ও ধূমপান রোধ, ৯. শিশুদের টিকাদান, ১০. বৃক্ষরোপণ, ১১. সন্ত্রাস ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, ১২. কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ, ১৩. পরিকল্পিত পরিবার গঠন ও ১৪. স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক মোটিভেশন।
ইমামদের মাধ্যমেই সব সরকার তাদের পলিসি সহজেই জনগণের কাছে পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে ইমামদের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাব সবাই অবগত আছেন, যে কারণে তাদের কোনো কাজের দায়িত্ব দেয়া হলে তারা তা স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পন্ন করেন। কিন্তু কী নৈতিকতাবোধ আমাদের, যারা সমাজের জন্য দেশের জন্য এত কিছু করছেন আমরা কি তাদের খোঁজ রাখি? আমরা সরকারের আমলা, বড় রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কত কিছু; কিন্তু আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পাড়ার মসজিদে যেই লোকটি আমাদের আদর করে সূরা শিখিয়েছেন, অক্ষর শিখিয়েছেন, আদব-কায়দার হাতেখড়ি দিয়েছেন, আমরা কি তার কথা একবারো চিন্তা করি? সমাজের জন্য অবিশ্রান্ত খেটেখাওয়া এই মানুষের কোনো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নেই, নেই চাকরির নিশ্চয়তা। নূøনতম খেয়ে-পরে থাকার কোনো ব্যবস্থা কি আমরা তার করতে পেরেছি। সম্পূর্ণ সমাজের দয়ার ওপর নির্ভর এই শ্রেণীর আর্থিক সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কোনো উদ্যোগ কি নেয়া হয়েছে। মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০০৬ নামে একটি অধ্যাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস হয়েছে।

কিন্তু নীতিমালা রাষ্ট্রীয় গেজেটেই সীমাবদ্ধ আছে। বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ পরিকল্পিত হচ্ছে না। সরকারের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অন্যতম লক্ষ্য দেশকে ২০১৫ সালের মধ্যে নিরক্ষরমুক্ত করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারের বাস্তবানুগ কর্মতৎপরতা কতটুকু তা জানি না। তবে ১৯৯২ সালে স্বল্প পরিসরে শুরু হওয়া একটি প্রকল্প ‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম’ এই লক্ষ্য অর্জনে সরকারকে সহযোগিতা করছে। মসজিদের অবকাঠামোগত সুবিধা গ্রহণ করে স্বল্প ব্যয়ে এ প্রকল্পের মাধ্যমে মসজিদের প্রশিক্ষিত ইমামদের দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত অনগ্রসর শ্রেণীকে শিক্ষার মূল ধারায় যুক্ত করা হচ্ছে। প্রকল্পটির যথাযথ সাফল্য লক্ষ্য করে সব গণতান্ত্রিক সরকার প্রকল্পটির কলেবর জ্যামিতিকহারে বৃদ্ধি করেছে। এ প্রকল্পটির মাধ্যমেই দায়িত্বশীলতার সাথে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। ইতঃপূর্বে এ ধরনের সব কার্যক্রমই টেকনিক্যাল ত্রুটিজনিত কারণে ব্যর্থ হওয়ায় ওই কার্যক্রমটি আশার আলো জ্বালিয়েছে।
এ কার্যক্রমের ফলে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের স্কুলভীতি দূর হচ্ছে, ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির হার আশানুরূপ বাড়ছে এবং ঝরে পড়ার হার কমছে। শিশুশিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভালো পারফরম্যান্স প্রদর্শন করতে পারছে।

এ কার্যক্রমের ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসচেতন করা হচ্ছে। তাদের সঠিক নিয়মে দাঁত মাজা, সেন্ডেল পায়ে টয়লেটে যাওয়া, টয়লেট থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, খাওয়ার আগে হাত ধোয়া, বেশি করে পানি খাওয়া, নিয়মিত খেলাধুলা করা ইত্যাদি ভালো অভ্যাসগুলোর অনুশীলন করানোর ফলে সুস্থ-সবল জাতি গঠনে এ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আগে উল্লেখ করা দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে দেশের হতদরিদ্র ইমামরা এই ‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা’ কেন্দ্র পরিচালনা করে মাসিক ১ হাজার ২০০ টাকা সম্মানী পেয়ে থাকেন। স্বল্প আয়ে সংসারে মাসিক এই নগণ্য অর্থ তাদের জন্য অনেক কিছু। কষ্টে শিষ্টে জোড়াতালি দিয়ে চালানো সংসারে সরকারিভাবে প্রাপ্ত এই সামান্য সম্মানী পেয়ে তারা আরো বেশি দায়িত্ববান হন। প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান।
পরিশেষে বর্তমান সরকারের কাছে সবিনয় আহ্বান জানাই, প্লিজ আপনারা দেশের সুবিধাহীন হতদরিদ্র ইমাম আর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দিকে তাকিয়ে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পটি পাস করুন এবং এটি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করুন।


খালেদ মোঃ শামছুল ইসলাম

আল্লাহর সৃষ্টিরীতির জ্ঞান


আল্লাহর সৃষ্টিরীতির জ্ঞান


ইসলাম যুক্তি ও অনুসৎিসার ধর্ম। এ কারণে পর্যায়ক্রমে সহিষ্ণুতা ও সঠিক পূর্ণতায় তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে দ্রুতির প্রবণতা অন্তর্নিহিত। অবশ্য এটি আমাদের যুগের বৈশিষ্ট্য। এ জন্য আজ ফসল বুনে কালই তা কাটতে চায়। কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টিরীতি অনুযায়ী এ রূপ দ্রুতির কোনো অবকাশ নেই। গাছ থেকে ফল আহরণ করতে হলে এর পর্যায়ক্রম অতিক্রম করতে দিতে হবে। মানুষের সৃষ্টি তো এর প্রকৃষ্ট নজির। কুরআন বলছে­ ‘অতঃপর আমি শুক্রকে পরিণত করি রক্তপিণ্ডে, তারপর রক্তপিণ্ডকে পরিণত করি মাংসপিণ্ডে, তারপর মাংসপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপঞ্জরে, পরে অস্থিপঞ্জরকে মাংসে আবৃত করে দিই; অবশেষে তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান!’ (২৩ঃ১৪)
এমনভাবে মানুষও শিশু থেকে পর্যায়ক্রমে প্রাপ্তবয়স্কে পরিণত হয়। একইভাবে আল্লাহর সুনান অনুযায়ী মানুষের জীবনও বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে। অনুরূপভাবে আল্লাহর দীন বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে অবশেষে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। তখন এই আয়াত নাজিল হয়েছে­ ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, এই ইসলামকেই তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।’ (৫ঃ৩)
বিষয়টি অত্যন্ত সহজ-সরল; কিন্তু চার দিকের অবস্থা দেখে উৎসাহী তরুণরা এতই বিক্ষুব্ধ যে, এই জ্ঞান তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তারা রাতারাতি ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে চায়। কিন্তু এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, বিপরীত বাস্তবতাকে কেবল ইচ্ছা হাতিয়ার দিয়ে পাল্টানো যাবে না। প্রসঙ্গত একটি অমূল্য বইয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিঃ ‘হাত্তা ইয়ুগাইয়িরু মা বিআনফুসিহিম’ (যতক্ষণ না তারা নিজেরা পরিবর্তিত হয়)। এটি লিখেছেন সিরীয় মনীষী জাওদাত সাঈদ (রহঃ)। বইটিতে আত্মা ও সমাজের পরিবর্তন ধারা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে কুরআনের এই আয়াতঃ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।’ (১৩ঃ১১) এবং ‘কারণ, আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়কে প্রদত্ত সৌভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই পরিবর্তিত করে দেয় নিজের জন্য নির্ধারিত বিষয়।’ (৮ঃ৫৩)
বইটির ভূমিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছেঃ ‘মুসলিম তরুণদের মধ্যে অনেকেরই ইসলামের জন্য জান ও মাল কোরবানির দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদের মধ্যে মাত্র মুষ্টিমেয়সংখ্যক তরুণ জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখায় অথবা দুর্বোধ্য সত্যকে উন্মোচিত করার লক্ষ্যে অধ্যয়নে উৎকর্ষ অর্জনে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। উদাহারণস্বরূপ ঈমান ও আমল তথা বর্ণনা ও বাস্তবের শ্রেণী বিভাগ ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে। এসব বিষয় এমন সমস্যা সৃষ্টি করে যার বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যপূর্ণ সমাধান না হলে গঠনমূলক সংস্কার অসম্ভব। ইসলামি বিশ্ব এখনো গবেষণা ও লেখনীর মর্ম উদ্ধার করতে পারছে না। কারণ তারা এখনো মনে করে যে, ‘মসির চেয়ে অসি শক্তিশালী।’ এ জন্যই আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা স্থবিরতায় পর্যবসিত হয়েছে। ঝাঁপ দেয়ার আগে চিন্তা করার কথা আমরা ভুলেই গেছি। ফলে উপরিউক্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। এসবের মধ্যকার পারস্পরিক সমন্বয় ও শৃঙ্খলার বিষয়টি আমরা অধ্যয়ন বা উপলব্ধির চেষ্টা করছি না।
তদুপরি মুসলিম বিশ্বে ঈমানের অবস্থা সম্পর্কেও আমরা এখানে সতর্ক পর্যালোচনা করছি না। এটার অর্থ এই নয় যে, মুসলমানদের ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান নেই। আমরা বরং মানসিক অবস্থার কথা বলতে চাই যা অবশ্যই মনের গহিন থেকে পরিবর্তন করতে হবে। আর ওই পরিবর্তনই কেবল ঈমানের শর্ত পূরণ করতে পারে অর্থাৎ ঈমান ও আমলের সাযুজ্যের পরিবেশ সৃষ্টিতে সক্ষম।
আত্মত্যাগ ও সাদকার প্রকৃত মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি না করে এখনো বিশ্বাস করা হয়, ওই দু’টো সবচেয়ে মহত্তম পুণ্য। সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত কৌশলের অনুপস্থিতিতে কেবল কোরবানি করলেই এর লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না। অবুঝ বিশ্বাস তরুণ মনে জানমাল কোরবানির আবেগ সৃষ্টি করে বটে, এর তাৎপর্য অধ্যয়ন ও উপলব্ধির চেতনা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। তাৎক্ষণিক ভাবাবেগ বা চাপ থেকে কোরবানির প্রেরণা আসে; কিন্তু জ্ঞানের অন্বেষার জন্য দরকার অবিশ্রান্ত অধ্যবসায়, চৈতন্য, অন্তদৃêষ্টি ও সমীক্ষার মানসিকতা। আর এটিই পরিশেষে নিশ্চিত সাফল্যের সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল করে।
অবশ্য কোনো কোনো তরুণ বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়ন-পঠনের কাজে মনোনিবেশ করলেও শেষাবধি একঘেয়ে ক্লান্তি অনুভব করে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং জ্ঞান-গবেষণা হিমাগারে আশ্রয় নেয়। আমাদের গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই জড়তা ও স্থবিরতার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
আত্মোপলব্ধি ও আত্মসচেতনতা ছাড়াই দ্রুত পরিবর্তন সাধনের প্রবণতা অবান্তর। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি এক জিনিস, আমাদের নিজস্ব ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা অন্য জিনিস। এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আল কুরআনের এ শিক্ষার ওপরেও আলোকপাত করা হয়েছে। কুরআনে সমস্যার অন্তস্তল হিসেবে খুদী বা অহমকে চিহ্নিত করা হয়েছে, বাইরের অসদাচরণ বা অনাচার নয়। কুরআনুল করীমে সম্পদের যে কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে তার মূল কথা হলো এটাই। এই সহজ-সরল সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং তখন নৈরাশ্য, বৈরাগ্য ও স্বৈরাচারী দর্শনের উদ্ভব ঘটে।
অতএব মারাত্মক স্বআরোপিত অবিচার হচ্ছে মানুষ, মহাজগত ও সমাজের অন্তর্নিহিত অনুষঙ্গ অনুধাবনে ব্যর্থতা। ফলে কোনো অবস্থানে নিজেকে স্থাপিত করলে মানুষ আল্লাহর সুনান (রীতি) অনুযায়ী মানবীয় ও প্রাকৃতিক সম্ভাবনাকে সর্বোত্তম উপায়ে আহরণ করতে সক্ষম, তার বিচার করতে ভুল করে সে ব্যর্থতার গ্লানি বহন করে। এই দৃষ্টিতে সমস্যার সম্মুখীন হলে দু’টি মানসিকতার উদ্ভব হয়। প্রথমত, এটা বিশ্বাস করা যে, সমস্যাটি নির্দিষ্ট ধারায় নিয়ন্ত্রিত, অতএব একে সমাধান ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, এই বিশ্বাস দ্বারা চালিত হওয়া যে, এটি রহস্যময় ও অতিপ্রাকৃতিক, অতএব কোনো রীতি দ্বারা এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। এই দুই চরম মানসিকতার মধ্যে বহুবিদ মধ্যবর্তী দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে যা মানুষের অনুসৃত পন্থা, আচার-আচরণ ও ফলাফল থেকে আঁচ করা যায়।
ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মুসলমানদের জীবন নির্বাহে ব্যর্থতা একটি সমস্যা যা সহজেই অনুমেয়। এটি মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গির কোনটি মুসলমানদের পোষণ করা উচিত? বস্তত এরূপ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সচেতনতা সৃষ্টি করলেই মুসলমানরা সমস্যার সমাধানে কোন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে এবং কোনটি পরিহার করবে তা নির্ণয়ে সহায়ক হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দুই দৃষ্টিভঙ্গি গুলিয়ে গিয়ে প্রতিটিই অবান্তর হয়ে গেছে। সুতরাং এর সমাধান বহুলাংশে নির্ভর করে পরিচ্ছন্ন অন্তদৃêষ্টির ওপর।’
লেখকঃ মিসরীয় বিখ্যাত পণ্ডিত। তিনি মিসর সরকারের আওকাফ মন্ত্রণালয়ের বোর্ড অব রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্সের একজন সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি ওআইসি’র ফিকাহ একাডেমিসহ বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য।


ড. ইউসুফ আল কারজাভি

ইসলামে আমানতদারি


ইসলামে আমানতদারি


গচ্ছিত জিনিসের সংরক্ষণ ও হেফাজত করার নাম আমানতদারি। হেফাজতের দায়িত্ব যার ওপর ন্যস্ত করা হয় তাকে ‘আমিন’ অর্থাৎ আমানতদার বলা হয়। সমাজে প্রচলিত অর্থে আমিন বলা হয় ওই ব্যক্তিকে বা জমিজমার খোঁজখবর রাখেন ও জরিপ করেন। বিশিষ্ট তাফসিরবিদ আল্লামা কুরতুবি রহঃ-এর দৃষ্টিতে আমানতদারির বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক। ইসলামী জীবনপদ্ধতির সব কিছুর সাথে আমানতদারির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অর্থাৎ ফরজ, ওয়াজিব, ইবাদত, মুয়ামালাত (দৈনিক আচার ব্যবহার) সব কিছুই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। আর এ সব আমানত আল্লাহপ্রদত্ত।
আল্লাহর অবতীর্ণ কুরআন মাজিদ (জীবনপদ্ধতির শ্রেষ্ঠগ্রন্থ) একটি আমানত। তাই কুরআনে এ মহাগ্রন্থকে আমানত নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর দেয়া খেলাফত একটি আমানত। যাকে খেলাফতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তিনিও আমিন। সালাত, সাওম, জাকাত, হজের মতো মুয়ামালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান সন্ততি, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বু-বাব এমনকি প্রতিটি মানুষের হাত-পা, চোখ-কান, নাক, মাথা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সবই আমানতের আওতাভুক্ত। হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ সবটাই আমানত।
রাষ্ট্র পরিচালনা, সরকারি ও বেসরকারি দাফতরিক কাজকর্ম, শিক্ষকতা, সমাজের নেতৃত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, মজুরি, শ্রম-মেহনত, দেশপ্রেম ইত্যাদি সবই আমানত। সুতরাং আমানত শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হয়। অনেকে অর্থ সম্পদের মধ্যে আমানতটি সীমিত রাখে, যা সম্পূর্ণ ভুল। বরং মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সাথে আমানত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই প্রতিটি ব্যক্তি একজন আমানতদার। আমানতদার ব্যক্তি সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয়, সুনামি ও সুখ্যাত। আমানতদারি এমন এক মহৎ গুণ, যার ওপর জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল।
এরই বিপরীত হলো খেয়ানত। কোনো দেশ যা জাতীয় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য, দেউলিয়াপনা, অকার্যকরতা সৃষ্টি হয় আমানতকারীর অভাবে এবং খেয়ানতের কারণে। মানুষ যখন আমানতদারিকে বিসর্জন দিতে থাকে এবং খেয়ানতকে আসল সম্বল হিসেবে গ্রহণ করে তখন তার বিপর্যয় ঘটতে থাকে। ইসলামী বিধানে ইমাম, মোয়াজ্জিন ও উপদেষ্টাকে আমিন উপাধি দেয়া হয়েছে।
আল্লাহর সৃষ্টি অসংখ্য ফেরেশতা আমানতদারঃ জিব্রাইল, মিকাইল, ইস্রাফিল, আজরাইল প্রমুখ ফেরেস্তা আমানতদারির ব্যাপারে প্রসিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে জিব্রাইলকে অনুগতশীল এবং আমিন বলা হয়েছে। আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তারা বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেন না। সে জন্য তারা সবাই আল্লাহর কাছে নির্দোষ। আমানতের মহান দায়িত্ব পালন করছেন বলে আল্লাহ জিব্রাইলকে ওহি বহনের কাজ অর্পণ করেন। সৃষ্টিলগ্ন থেকে যে ফেরেশতা যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা হুবহু দায়িত্ব পালন করছেন।
আল্লাহর নবী-রাসূলগণ আমানতদারঃ বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাঃ নবুয়ত প্রাপ্তির বহু আগে থেকেই আমানতদার ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার আগে প্রেরিত সব নবী-রাসূল আমানতদারির সুনাম অর্জন করেছিলেন। নিজ নিজ জাতির কাছে নিজেদের পরিচিতি পেশ করার সময় তারা বলেন, ‘ইন্নিলাকুম রাসূলুন আমিন’ আমি তোমাদের জন্য একজন আমানতদার রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।
আমানতদারির গুরুত্বঃ ১. আমানত রক্ষার ওপর নির্ভর করে দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের উন্নতি। সম্ভাবনাময় জাতির জন্য আমানত একটি অপরিহার্য ব্যাপার।
২. আমানতদারি না থাকলে জাতির বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। বর্তমানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধ্বংসের একমাত্র কারণ আমানতের খেয়ানত, আত্মসাৎ, লুটতরাজ, অবৈধ উপার্জন ইত্যাদি।
৩. সমাজের মধ্যে ঐক্য, সংহতি, হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা, স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা সৃষ্টির মূল হলো আমানতদারি। পরস্পরের আস্থা প্রতিষ্ঠার একটি মাত্র উপায় হলো আমানতদারি।
৪. পারিবারিক জীবন হোক অথবা ব্যক্তিগত জীবন, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, হাটবাজার, ব্যবসায়-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে আমানতদারি বিশেষ প্রয়োজন। এগুলোর পাশাপাশি আমাদের হাত, পা, চোখ, কান, জিহ্বা, পাকস্থলী, বুক ইত্যাদি অঙ্গ-প্রতঙ্গ আমানত হিসেবে দেয়া হয়েছে। এ সবের ব্যবহারের বেলায় আমানতদারি পালন করা প্রয়োজন। কুখাদ্য-ধ্বংসাত্মক খাদ্য থেকে শরীর ও স্বাস্থ্য রক্ষা করা, রোগের চিকিৎসা করা আমানতদারি।
৫. এ ভূমণ্ডলে মানবজাতির শান্তি ও উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে সব মানবরচিত বিধিবিধানের পরিবর্তে এক আল্লাহর জীবনবিধান চালু করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমানত।
ভোট একটি আমানতঃ রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সাথে জাতীয় সংসদে সৎ, যোগ্য, বিচক্ষণশীল, প্রজ্ঞাবান, মুত্তাকি ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে পাঠানো একটি বড় আমানত। অতএব দেশের প্রতিটি ভোটার আমানতদার। আমানতের সঠিক প্রয়োগ না করার অর্থ বড় ধরনের খেয়ানত করা, যা দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
সংবাদ সংগ্রহ এবং তথ্য সরবরাহ একটি আমানতঃ মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম জাতি ও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ অবদান রখে। যেকোনো ভুল তথ্য ও মিথ্যা সংবাদ সরবরাহের কারণে একটি দেশের ভিত নড়বড়ে হতে বিলম্ব হয় না। বিরাট হুমকির সম্মুখীন হতেও সময় লাগে না। সুতরাং সঠিক তথ্য সরবরাহ ও সংগ্রহ একটি বড় আমানত। অন্যভাবে বলতে গেলে সাংবাদিকতা একটি বড় আমানত। এই আমানতের খেয়ানত দেশ ও জাতির কাম্য হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, হে মুমেনগণ, কোনো অনৈতিক ব্যক্তি যখন তোমার কাছে সংবাদ বহন করে থাকে, তখন তুমি সেটা ভালো করে যাচাই-বাছাই করো। (তারপর তার ওপর আমল দাও) যাচাই-বাছাই ছাড়া সংবাদে আমল দেয়ায় একটি জাতি সমূলে বিপর্যস্ত হতে বাধ্য, তখন তোমাদের আক্ষেপ করা ছাড়া কিছু করণীয় থাকবে না। (সূরা হুজুরাত-৬)
ভেজাল খাদ্য, কুখাদ্য, কৃত্রিম সঙ্কট, মূল্যবৃদ্ধি বড় খেয়ানতঃ ইসলামে ব্যবসায়ীদের যথেষ্ট মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাঃ বলেছেন, সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের ময়দানে আমার সঙ্গ লাভ করবে।
আমানত রক্ষায় ইসলামী বিধানঃ আমানত রক্ষায় ইসলামের বিধান হচ্ছে আমানতের হেফাজত করা। খেয়ানত না করা। যার জিনিস তার কাছে হুবহু পৌঁছে দেয়া। কুরআনে বলা হয়েছে­ ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে খেয়ানত করো না। তোমরা কী করে খেয়ানত করতে পার, অথচ তোমরা অবগত।’ (সূরা আল-আনফাল-২৭) অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেয়া যাবতীয় বিধানগুলোর অমান্য করাই খেয়ানত। সূরা নিসার প্রসিদ্ধ আয়াতে আল্লাহ আমানতের হকদারদের আমানত দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (আয়াত ৫৮) গচ্ছিত জিনিসের মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন বৈধ নয়। এখানে তিনটি মৌলিক গুণ আমানতদারের মধ্যে থাকতে হবে। ১. আমানত যার কাছে রাখা হয় তাকে পবিত্র নিষ্ঠাবান হতে হবে। ২. আমানত রক্ষার ব্যাপারে সার্বিক দায়দায়িত্ব পালন করতে হবে। ৩. আমানতের হুবহু জিনিসটি মালিকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। ‘যে আমানত রক্ষার ব্যাপারে স্বচ্ছ না, সে মুমিন নয়’। অন্য হাদিসে আল্লাহর নবী সাঃ বলেছেন, ‘আমানতের খেয়ানতকারী ইসলামচ্যুত গণ্য হবে।’ রাসূলুল্লাহ সাঃ আমানত লঙ্ঘনকারীকে মুনাফেক সাব্যস্ত করেছেন। কোনো লোক নেক আমল করা সত্ত্বেও আমানতের খেয়ানতের কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। হাশরের মাঠে তিনি আমানত আদায়ের জন্য হুকুম দেবেন। হাদিসে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি আল্লাহর পথে শাহাদতবরণ করেন, কিন্তু সে মানুষের আমানত না বুঝিয়ে মারা যান। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে বলবেন, মালিকের কাছে আমানত ফেরত দাও। কিন্তু সে মালিককে খুঁজে পাবে না। তখন আমানতের বোঝা তার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এ লোক বান্দার অধিকার নষ্ট করার কারণে জাহান্নামের ভাগী হলো।
বনি কোরাইজা যুদ্ধের সময় আল্লাহর নবী সাঃ কোরাইজার ইহুদিদের সাথে সংলাপের জন্য আবু লুবাবা ইবনুল মুনজের রাঃ-কে সেখানে পাঠালেন। সংলাপ চলাকালীন সময়ে তিনি আকার ইঙ্গিতে কথায় আমানত রক্ষা করতে পারেননি বলে নিজ অপরাধ স্বীকার করে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর দরবারে হাজির হন। এক পর্যায়ে তিনি তওবা মাফের লক্ষ্যে মসজিদে নববির একটি খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে দিলেন। তিন দিন অনবরত তওবা করার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ক্ষমা ঘোষিত হওয়ার পর আল্লাহর নবী সাঃ স্বহস্তে তার বাঁধনটি খুলে দিলেন। মসজিদে নববির ভেতরে আবু লবাবা খুঁটিটি এই নামে এখনো বিদ্যমান আছে, যা আমানতের খেয়ানত করার পরিণাম সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ নবুয়তের মহা আমানত পালন করার ব্যাপারে বিদায় হজের ভাষণে সমবেত হাজার সাহাবির সাক্ষ্য গ্রহণ করে বললেন, বল তো তোমরা, আমি কি আমানতের হক আদায় করতে পেরেছি? উপস্থিত সবাই একযোগে জবাব দিলেন, আপনি রিসালাত ও আমানতের অর্পিত দায়িত্ব সম্পূর্ণ পালন করেছেন। তখন আল্লাহর নবী হাতের শাহাদাত আঙুল ওপরের দিকে উত্তোলন করে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো। আমানত রক্ষা প্রসঙ্গে ইসলামের ইতিহাসে বহু ঘটনা রয়েছে।
মানুষ কখন আমানতের খেয়ানত করে? আমানতের খেয়ানত করা হয় কয়েকটি কারণে।
যেমনঃ ১. ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের জ্ঞানের অভাব। ২. নৈতিকতার অভাব। ৩. ধন-সম্পদের লোভ। ৪. পরকালের জবাবদিহিতার অনুভূতির অভাব। ৫. হঠকারিতা, অহমিকা ও দাম্ভিকতা।
আমানতদারির অনুভূতি সৃষ্টির উপায়ঃ ১. হালাল উপার্জন, ২. পরকালের জবাবদিহিতার স্মরণ, ৩. ঈমান ও আমলে সালেহ মনে নিয়োজিত থাকা, ৪. মনের তুষ্টি ও তৃপ্তির অন্বেষণে থাকা, ৫. সবসময় ইস্তেগফার করতে থাকা, ৬. সবসময় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকা।


ড. হাসান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন

শুক্রবার, ২ জানুয়ারী, ২০০৯

ইসলামে সামাজিক দায়বদ্ধতা


ইসলামে সামাজিক দায়বদ্ধতা


পৃথিবী বাস উপযোগী হতেই মহান আলস্নাহ্‌তায়ালা মানুষকে প্রেরণ করেন এ জগতে। তখন তারা নতুন পরিবেশে পরিবার সৃষ্টি করে বিবাহের মাধ্যমে। আর পরিবারের বিস্তৃতিতে গড়ে ওঠে সমাজ। মানুষ নিজের অস্তিôত্বের কারণেই সমাজবদ্ধভাবে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ওই সমাজবদ্ধ জীবন-যাপনে নানা ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে ইসলাম। কালক্রমে বংশবৃদ্ধির কারণে মানুষের মাঝে সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্য বহুলাংশে বেড়ে যায়। সে চাহিদা মেটাতেই সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি সর্বাধিক গুরম্নত্ব প্রদান করেছে ইসলাম।
সামাজিক জীবন-যাপনে অনেক নিয়ম-কানুন ও পদ্ধতি প্রতি পালন করতে হয়; কর্তব্য কর্ম দায়িত্বসমূহ নিষ্ঠার সাথে অনুশীলন করে প্রতিনিয়ত তৎপর হওয়া অপরিহার্য। আর এরই মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন ঘটে থাকে। তবে ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে তা বেশিকাল টেকেনি। তখনকার সামাজিক দায় টেকশই না হওয়ায় মানুষ সামাজিকভাবে বিভ্রান্তিতে পড়ে। আর তারা হয়ে পড়ে পরস্পরে বিচ্ছিন্ন। আরব জাতি তখন তিনশত গোত্রে বিভক্ত একটি জাতিতে পরিণত হয়। জীবনপ্রবাহকে সে সময় বিশৃঙ্খল করে তোলে। সে কারণে সমাজে হানাহানি, শত্রম্নতা প্রকটরূপে দেখে দেয়। মানুষ অন্য মানুষের প্রভু হয়ে বসে পেশীশক্তির বলে।
আরবের অরাজক এক অবস্থায় বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আবির্ভাব ঘটায় নবুয়্যতলাভের পর ইসলামের দাওয়াত মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের উপর মানুষের প্রভূত্বকে উৎখাত করেন এবং এক আলস্নাহ্‌র প্রভুত্বের ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেন। সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি (সাঃ) ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় গুরম্নত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। তৎকালীন বিশৃঙ্খল আরব জাতিকে সুসংগঠিত করে বিশৃঙ্খল জীবন-প্রবাহ থেকে সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থায় নিয়ে আসেন। তিনি অনুকরণযোগ্য নিয়ম-কানুন, নীতি-পদ্ধতি সুসংগঠিত সমাজ গঠনে প্রতিষ্ঠা করেন।

নবী করীম (সাঃ) -এর প্রদর্শিত সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হলে পরিবার ও সমাজে মিলেমিশে থাকতে হবে। ওই মিলেমিশে থাকার মাঝে শান্তিô আর শান্তি, সুখ আর আনন্দ। পবিত্র কোরআনের সূরা-নাহ্‌ল-এর ২৮ আয়াতে আছে ‘আমরা কোন মন্দ কর্ম করতাম না’। এবং নিশ্চয়ই তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আলস্নাহ সবিশেষ অবহিত।” মানুষের উচিত নয় নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। সূরা-নাহ্‌ল-এর ১৯ আয়াতে আছে “তোমরা যা গোপন রাখ এবং যা প্রকাশ কর আলস্নাহ তা জানেন”। সমাজে তথা পৃথিবীতে যারা অশান্তি সৃষ্টি করে তাদের জন্য আলস্নাহ সূরা আল বাকারার২৭ আয়াতে হুঁশিয়ারী দিয়েছেন-এভাবে- ‘যে সম্পর্ক অড়্গুণ্ন রাখতে আলস্নাহ আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তারাই ড়্গতিগ্রস্ত।’ এছাড়াও সূরা-রা’দ এর২৫ আয়াতে আলস্নাহ্‌ ইরশাদ করেছেন, ‘যে সম্পর্ক অড়্গুণ্ন রাখতে আলস্নাহ আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্য আছে লা’নত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস।’ উলেস্নখিত আয়াত সমূহ থেকে আমরা অবহিত হলাম অশান্তি সৃষ্টি, সম্পর্ক ছিন্ন করা সমাজিক দায়বদ্ধতার পরিপন্থী ও ধ্বংসের পথে ধাবিত হওয়ার সামিল। যারা ঈমান এনেছে, অর্থাৎ হয়েছে মুসলমান, তারা আলস্নাহ্‌র নির্দেশ, নবী করীম (সাঃ) এর পরামর্শ থেকে অন্য পথে যেতে পারে না। তাইতো সূরা আল বাকারার ৮৩ আয়াতে আলস্নাহ্‌ ইরশাদ করেন, ‘মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন ও দরিদ্র্যদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে এবং মানুষের সঙ্গে সদালাপ করবে, সালাত কায়েম করবে ও যাকাত দিবে---’। অন্যত্র ৮৪ আয়াতে আছে--- ‘তোমরা পরস্পরে রক্তপাত করবে না এবং আপনজনকে স্বদেশ হতে বহিষ্কার করবে না’,--। সূরা তাহ্‌রীম -এর ৬ আয়াতে আলস্নাহ ইরশাদ করেছে ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে রড়্গা কর দোজখ হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর’।

হ্যাঁ, ওই দোজখের আগুন থেকে বাঁচার জন্যই সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি অবশ্য যত্নবান হতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে সামাজিক দায়বদ্ধতা যেন আমাদের কোনরকম আচরণে ক্ষুণ্ন না হয়। প্রতিটি মানুষকে তাই সর্বোত্তম আচরণের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার প্রয়াস চালাতেই হবে। হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেন, “সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে” (মিশকাত শরীফ)। হাদীসে আরো পাই “সেই ব্যক্তি মু’মিন হতে পারে না, যে ব্যক্তি নিজে পেট ভরে পানাহার করে, কিন্তু তার পার্শ্বেই প্রতিবেশী খাদ্যের অভাবে অভুক্ত থাকে।” (মিশকাত-বায়হানী)। তাই নবী করীম (সাঃ) -এর পরামর্শমতো চলতে হবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখতে হবে জান্নাতে যেতে চাইলে এবং মু’মিন হতে হলে প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর অবশ্যই রাখতে হবে। এ সবের জন্যই সামাজিক দায়বদ্ধতায় সকলের সাথে মিলেমিশে থাকতে হবে। নবী করীম (সাঃ) আদর্শ স্থানীয় ভাবে সকলের সাথে মিলেমিশে থাকতেন, স্বাতন্ত্র্য মর্যাদা বজায় রেখে চলতেন না। মাঝে মাঝে তিনি (সাঃ) হাসি-কৌতুকও করতেন। তবে সে কৌতুকও হতো সত্য কথায় বাস্তôবসম্মত। কাউকে কটাড়্গ করে বা অবাস্তব কথা বলে তিনি কৌতুক করতেন না (শামায়িলে তিরমিজী-১৫)। রাসূলে আকরাম (সাঃ) স্বীয় পরিবারের লোকদের ব্যাপারেও খুব লড়্গ্য রাখতেন। যাতে তার জন্য তাদের কোন রকম কষ্ট না হয়। এজন্য রাতে ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন হলে অত্যন্ত ধীরস্থির ভাবে উঠে জুতা পরিধান করতেন এবং নিঃশব্দে দরজা খুলে বের হতেন। অনুরূপ ভাবে ঘরে প্রবেশ করার সময়ও নিঃশব্দে প্রবেশ করতেন, যাতে কারো ঘুমের কোন প্রকার ব্যাঘাত না ঘটে (মিশকাত-১৮১-১৮২)।

নবী করীম (সাঃ) পারিবারিক দায়িত্ববোধ থেকে এবং সামাজিক কর্তব্য থেকেও দিনের সময়কে তিন ভাগ করে এক ভাগ আলস্নাহর ইবাদত ও দ্বীনের কাজ, একভাগ পরিবার -পরিজনের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য এবং আর এক ভাগ ব্যক্তিগত কাজ ও নিজের শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য নির্দিষ্ট করে নেয়ার তালীম দিতেন (উসওয়ায়ে রাসূলে আকরাম, ১০৪)। একবার ক’জন সাহাবীর সাথে আলাপ করলে নবী (সাঃ) বলছিলেন, ‘জিবরাইল (আঃ) প্রতিবেশীদের সাথে কি ধরণের সম্পর্ক থাকা উচিত এবং তাদের প্রতি, দায়-দায়িত্ব পালনে কেমন আচরণ করা উচিত সে বিষয়ে গুরম্নত্বের পরামর্শ দিতে গিয়ে শেষপর্যন্ত সম্পদের অংশীদারিত্ব দিয়ে দিতে বলেন কিনা তেমন চিন্তায় পড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ধরনের পরামর্শ আসেনি। এ থেকে প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কের গুরম্নত্ব অনুধাবন করা যায়।

কোন আত্মীয়ের দুর্ব্যাবহার পেলে তাকে মাফ করে দিয়ে তার সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে (বুখারি শরীফ-২:৮৮৬১। অমন পরামর্শ আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ)’র ছিল। প্রতিবেশীর প্রতি দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নবী করীম (সাঃ)-এর প্রবল তাগিদ, তিনি বলেছেন- “সে আমার উম্মত নয়, ‘যে প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর করে না।” তিনি এও পরামর্শ দিয়েছেন, পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তôানসহ সকল আত্মীয়-স্বজন ও মুসলমানদের হক আদায়ে সচেষ্ট থাকতে হবে। মোট কথা, মানুষের হকের ব্যাপারে খুব বেশি ফিকির রাখা অবশ্যম্ভাবী, নতুবা সমস্ত ইবাদত বিফলে যাবে। ওই ‘হক’ হচ্ছে পারিবারিক-সামাজিক দায়বদ্ধতা। এ দায়বদ্ধতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে ব্যক্তির ইবাদতসমূহ কোন কাজে আসবে না।
মুসা (আঃ) আলস্নাহকে এক সময় বলেন, আলস্নাহ্‌ আমি তো তোমার জন্য ইবাদত করি, রোজা রাখি, তোমার নির্দেশ অন্তôর দিয়ে পালন করি, তুমি কি আমাকে ড়্গমা করবে না? তখন-এর জবাবে আলস্নাহ্‌ বলেন, তুমি নামাজ পড়ো দোজখের শাস্তি থেকে রড়্গা পেতে, রোজা রাখো আগুন থেকে রড়্গার ঢাল হিসেবে, ইবাদত করো তোমার কল্যাণের নিমিত্তে এগুলো সব তোমার নিজের জন্য আমার জন্য কিই বা করলে? হে আলস্নাহ্‌ তাহলে! তুমি কি মানুষকে ভালোবাসা দাও! মানুষকে ভালোবাস তবেই আমার জন্য কিছু করা হবে। এখানেও মানুষ তথা সামাজিকবৃন্দের প্রতি অশেষ গুরম্নত্ব প্রদান করেছেন আলস্নাহ রাব্বুল আলামীন। অন্যদিকে মুসলিম হাদীসে উলেস্নখ রয়েছে- “যে বান্দা তার ভাইয়ের সাথে শত্রম্নতা পোষণ করে সে ছাড়া প্রত্যেক মুমিন বান্দাকে মাফ করে দেয়া হয়।”

সমাজকে গতিশীল রাখার জন্য শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আদর্শও বাস উপযোগী সমাজ প্রতিষ্ঠায় মানুষের অনেক কিছু করনীয় রয়েছে। দায়বদ্ধতা নিয়ে তা করতে হবে। তাই সামজের মাঝে মানুষে মানুষে বিরোধ দেখা দিলে তা মিটিয়ে ফেলার প্রয়াস নিতে হবে। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের সূরা-শূরার ৪০ আয়াতে আছে” যে ড়্গমা করে দেয় ও আপোষ নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আলস্নাহর নিকট আছে। আলস্নাহ জালিমদেরকে পছন্দ করেন না।’ অন্য এক আয়াতে (সূরা-শূরা-আয়াত-৪৫) আছে--- ‘ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যারা নিজেদের ও নিজেদের পরিজনবর্গের ড়্গতিসাধন করেছে।’ জেনে রাখ জালিমরা অবশ্যই ভোগ করবে স্থায়ী শাস্তিô। সমাজকে সুদৃঢ় সহঅবস্থান এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্যে দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ রাখতে হলে প্রয়োজন ধৈর্য ও ড়্গমা।

সমাজে নানারকম বৈষম্য দেখা যায়। বৈষম্যের কারণে মানুষে মানুষে নানারকম অবস্থার সৃষ্টি হতে থাকে। ফলে সমাজ হয়ে পড়ে বন্ধনহীন, ওই বন্ধন অটুট রাখার লড়্গ্যে আলস্নাহ পাক ইরশাদ করেছেন- ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে (দান খয়রাত দেয়, অপরকে সাহায্য করে) এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ড়্গমাশীল; আলস্নাহ্‌ সৎকর্মপরায়ণদেরকে ভালোবাসেন, (সূরা-আল-ইমরান-আয়াত-১৩৪১)। সামাজিকদের মাঝের বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে মনুষ্য সমাজের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা প্রতিপালন এভাবেই করা অবশ্যই সম্ভব। আর এর ফলে মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধন মজবুত হয়। এর পাশাপাশি হাদীসে আছে-অন্যের রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জত তোমার কাছে পবিত্র আমানত, এর খেয়ানত করা হারাম।’ হাদীসে সামাজিকতাকে অনেক গুরম্নত্ব দেয়ায় আমরা সেখানে পাই- ‘যে বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমার উম্মত নয়’। এর চাইতে শক্ত কথা আর কি হতে পারে। এ হাদীস থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় সমাজকে আদর্শের রজ্জুতে বাধতে হলে এ ধরনের কাজ সকলকে অবশ্যই করতে হবে। তাহলে সমাজের প্রবহমানতা স্বচ্ছভাবে বিদ্যমান থাকবে।

‘মানবতার সেবায় যিনি নিজের জীবন নিঃশেষে বিলিয়ে দিতে পারেন, তিনিই মহামানব। যার থেকে (প্রতিবেশীর) ড়্গতির কোন আশঙ্কা নেই তিনি উত্তম একজন মানুষ, ঈমানদার একজন মানুষ।’ হাদীসের এসব বাণীতে সামাজিকতার প্রতি কতটা গুরম্নত্ব দেয়া হয়েছে তা উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না। এমনকি বিপদগ্রস্তেôর পাশে দাঁড়াতে হাদীসে তাগিদ রয়েছে। এও বলা হয়েছে, ‘রোগীর সেবা ও শুশ্রূষাকারী নিজ গৃহে ফিরে না আসা পর্যন্ত বেহেস্তের পথে চলতে থাকে’। মানবতার অনুরূপ সেবা সামাজিক দায়বদ্ধতার উজ্জ্বলতম উলেস্নখযোগ্য দৃষ্টান্ত। স্বজনত্যাগীর পরিবারে আলস্নাহর রহমত অবতীর্ণ হয় না। তাইতো হাদীসে এসেছে -“সকল মুসলমান (সম্মিলিতভাবে) যেন একটি প্রাচীর, যার প্রতিটি অংশ বাকি অংশগুলোকে দৃঢ় করে। এমনিভাবে তারা নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠিত হবে একে অন্যের সহায়তায়”। ‘মুসলমান ভাইকে মুসলমান ভাই সাহায্যে করবে, সে অত্যাচারিত হোক বা অত্যাচারী হোক’। কিন্তু সে অত্যাচারী হলে কিভাবে আমারা সাহায্য করব? রাসূলে আকরাম (সাঃ) বললেন, ৈ‘তাকে অত্যাচার করা থেকে নিষেধ ও নিরস্তô করবে’। মানুষের সাথে আচরণে শিষ্টতা, কর্মে ধীরতা ও সর্ব বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন নবূয়াতের চব্বিশ ভাগের এক ভাগ’। ওই মানুষ (মুসলমান) জনসাধারণের সাথে মিশে তাদের সৃষ্ট অসুবিধাগুলো সহ্য করে, সে তার চেয়ে উত্তম যে তাদের সাথে মেশে না ও সহ্য করে না।’ এছাড়াও বলা যায় ৈ‘লোকে তোমাদের ভাল করলে তোমরা তাদের ভাল করবে, আর তারা তোমাদের পীড়ন করলেও, তোমরা তাদের পীড়ন করবে না।’ জ্ঞাতিদের উপকার করা, তারা না করলেও’। সেইসাথে লোকজনের সঙ্গে, নম্র ব্যবহার করবে, কঠোর হবে না; তাদের প্রফুলস্ন করবে, নিন্দা করবে না।’ এ সকল হাদীস মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখে থাকে। ফলে সামাজিক সহঅবস্থান আরো ভাল হয়, সম্পর্কের বন্ধন হয় অটুট।
মুসলমানদের গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ভাগ হতে বলেননি, বরং ধ্বংসের/বিনাশের হাত থেকে বাঁচার জন্য নবী করীম (সাঃ) ও তাঁর প্রিয়জনের অনুগামী থাকার মতাদর্শে সংলগ্ন থাকারই জন্য সতর্কতা প্রদান করেছেন। এ ব্যপারে আলস্নাহ্‌ পাক ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা সকলে আলস্নাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না। তোমাদের পতি আলস্নাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, তোমরা ছিলে পরস্পর শুত্রম্ন এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা তো অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তেô ছিলে আলস্নাহ তা থেকে তোমাদের রড়্গা করেছেন”---

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে হলে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে অনুশীলনের প্রয়াস ঐকান্তিôকতার সাথে চালাতে হয়।”
মূলকথা হচ্ছে ইসলামের গুরম্নত্বনুযায়ী মহানবী (সাঃ)- এর জীবনাদর্শ ও শিড়্গাকে অনুশীলন করে সামাজিক দায়বদ্ধতার গুরম্নত্বকে যথাযথ অনুধাবনের মাধ্যমে জীবন-যাপন করতে হবে। দুনিয়ার সুখ-শান্তি অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে আমাদের সকল প্রকার বিদ্বেষ, ঈর্ষা ভুলে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও সামাজিকবৃন্দের সাথে সুসম্পর্ক গড়ায় আরো সর্তক, সচেতন ও আন্তরিক হওয়া সমীচীন!

জাহাঙ্গীর হাবীব উলস্নাহ

মুজাদ্দিদ-ই-আল্‌ফ-ই-সানি

মুজাদ্দিদ-ই-আল্‌ফ-ই-সানি


শেখ আহমেদ শিরহিন্দী একজন মহান মরমী চিন্তাবিদ। তিনি সাধারণত মুজাদ্দিদ-ই-আল্‌ফ-ই-সানি নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। ইসলামের পুনরম্নজ্জীবনকারী হিসেবে তাঁকে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হওয়ার পর তা’ একটি ভিন্নরূপ ধারণ করে। এখানে এসে ইসলাম বিভিন্ন ভাবধারার সাথে সংমিশ্রিত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপড়্গে, ভারত সুফীবাদের সক্রিয় কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এখানে বহু উপদলেরও সৃষ্টি হয়। কালের গতিতে সুফীবাদ মানুষের মনে এত বেশি প্রভাব ফেলে যে তারা ইসলামের সত্যিকার ভাবধারা থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়ে পড়ে। সময়ের অগ্রগতিতে বহু অনৈসলামি ভাবধারা ইসলামে প্রবেশ করে। মুসলমানগণ বহু কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে শুরম্ন করে এবং মরমীবাদের বহু সম্প্রদায়েরও উদ্‌ভব ঘটায়। ফলে ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, এমন কি জীবন সম্পর্কে সমগ্র ধারণারও পরিবর্তন হতে শুরম্ন করে।

ইসলামের এহেন অবস্থার মধ্যেই আর্বিভাব ঘটে মহান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও সুফি মুজাদ্দিদের। তিনি ইসলামি মরমীবাদের নব দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন এবং মূল ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি এমন এক সময়ে আবিভূêত হন যখন প্রায়োগিক ধর্ম হিসেবে ইসলাম তার মূল প্রাণশক্তি ও গতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সুফি ও সাধারণ মানুষ ইসলামের মূল ভাবধারার চেয়ে এর আচার ও আনুষ্ঠানিকতাকে ঘিরেই জড়িত থাকে। ইসলামের মূল উৎস কোরআন ও হাদীসকে উপেড়্গা করা হয়। অন্ধ ও আচারি ভাবধারা বিরাজ করতে থাকে এবং ইসলামের মূল ভাবধারাকেও খর্ব করা হয়। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতির দুর্বলতার জন্য ইসলামকে ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করার সম্রাট আকবরের নীতিও এজন্য অনেকাংশ দায়ী ছিল। মুজাদ্দিদ তাকলিদ (কর্তৃত্বের অন্ধ অনুকরণ)-এর বিরোধী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় মতবাদের ব্যক্তিগত বোধ ও ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন।

সময়েরই প্রয়োজন ছিল ইসলামের একজন সত্যতা প্রতিপাদনকারী ব্যক্তির আবির্ভাবের। ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই মুজাদ্দিদের আবির্ভাব ঘটে। তিনি তৎকালীন অনৈসলামি ভাবধারার বিরম্নদ্ধে রম্নখে দাঁড়ান এবং তাঁর পুনরভ্যুদয়ের ক্রিয়া-তৎপরতার দ্বারা বৈপস্নবিক পরিবর্তন আনয়ন করেন। সুফিদের সর্বেশ্বরবাদী মতবাদের বিরম্নদ্ধে তিনি বলেন, আলস্নাহ ও জগৎ ভিন্ন, তারা এক নয়। ধর্মতত্ত্ববিদগণের বিরম্নদ্ধে তিনি বলেন যে, মুসলমানদের কোরআন ও হাদিসে ফিরে যেতে হবে। তৎকালীন দূষিত প্রভাব থেকে ইসলামকে মুক্ত করার জন্য তিনি সুদূর গ্রামাঞ্চলে প্রচারকবৃন্দকে প্রেরণ করেন। তাঁরা সেখানে কোরআন ও হাদিসের মৌলিক শিড়্গা প্রচার করে বেড়ান।

যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সমস্ত মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তিকে তাঁর মতবাদের প্রতি আস্থাবান হওয়ার জন্য আবেদন জানান। তিনি জনগণের নিকট থেকে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পান এবং ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা অনুভব করে সম্রাট জাহাঙ্গীর বিচলিত হয়ে উঠেন এবং অচিরেই তাঁকে কারারম্নদ্ধ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি মুক্তি পান এবং সম্রাটের বিশেষ পরামর্শক নিযুক্ত হন।

মুজাদ্দিদ কোরআন ও হাদিসের গুরম্নত্ব পুনরম্নজ্জীবন করতে সড়্গম হন যা থেকে জনগণ বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল। তবে মরমীবাদে তাঁর অবদান ছিল বিপস্নবাত্মক। তিনি আলস্নাহ্‌ ও জগতের অভিন্নতার সর্বেশ্বরবাদীর ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে স্রষ্টা ও সৃষ্টি দ্বৈততা এবং আলস্নাহ্‌র অতিবর্তিতা (Transcendence) প্রতিষ্ঠিত হয়। নবী-পত্যাদেশ (ওহি) ও সুফীবাদের ভাবোচ্ছ্বাস (ইলহাম) এর মধ্যে প্রকারগত পার্থক্য নির্দেশ করা হয়। ইলমে বাতিন (গূঢ় রহস্যের জ্ঞান) এবং ইলমে জাহির (প্রকাশ্য জ্ঞান)-এর মধ্যে পার্থক্য করা হয়। এই অভিমতও ব্যক্ত করা হয় যে, অজ্ঞাত গূঢ়রহস্যকে জ্ঞাত অভিজ্ঞতাভিত্তিক ঘটনার দ্বারাই জানা যেতে পারে।

তবে, ইলমে বাতিন-২ জ্ঞানের জন্য সুফিকে হাদিস পাঠ ও অধ্যয়ন করতে হবে।

তাওহিদ বা আলস্নাহ্‌র একত্ব এবং এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাঁর ধারণা ছিল অত্যন্ত গুরম্নত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁর এই ধারণা ছিল আলস্নাহ্‌র সম্পর্কে সর্বেশ্বরবাদীর ধারণার বিপরীতে। তিনি সুফীদের প্রথমে হাদিস অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তারপর যিকর (স্মরণ) ও ফিকর (অনুধ্যান) অবলম্বন করার পরামর্শ দেন। তন্ময়াবস্থা অর্জনের জন্য সুফীদের কর্তৃক গ্রহীত সঙ্গীত ও অন্যান্য চর্চাকে নিন্দে করা হয়। অলস অনুধ্যানের চেয়ে সক্রিয় সমাজসেবাকে উৎকৃষ্টতর বলে মনে করা হয়। কোরআন ও হাদিস অনুসরণে সকল প্রকার নবসংযোজন (বিদাত) নিন্দে করা হয়। মুজাদ্দিদ মনে করেন যে, ইমামদের অন্ধ অনুসরণের ফলেই কালের অগ্রগতিতে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে এবং ইসলামের প্রকৃত ভাবধারা ও উৎস থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছেন।


প্রফেসর এম এ হালিম

যৌতুক লেন-দেন বৈবাহিক সম্পর্ককে শিথিল করে


যৌতুক লেন-দেন বৈবাহিক সম্পর্ককে শিথিল করে


বিয়ে-শাদী এমন একটি পবিত্র বন্ধন ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থার ফলে সুস্থ, সুসংহত এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে জীবন-যাপন করার নিশ্চয়তা লাভ করে সমাজ। মানুষের পারিপাশ্বিকতাই মানুষকে সুস্থ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলে। আর সুস্থ পরিবেশের প্রথম ধাপই হচ্ছে সংসার জীবন। শৈশবে পিতা-মাতার স্নেহ বন্ধন কাটিয়ে কৈশোরে পরবর্তীকাল অর্থাৎ যৌবনে নারী-পুরম্নষে বিয়ে বন্ধনের মাধ্যমে সংসার ধর্মে পদার্পণ করে।

বিয়ে বন্ধন ব্যবস্থা বিভিন্নভাবে সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে বিয়ে বন্ধনকে অত্যন্ত উঁচু মর্যদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। বস্তুত ইসলামের সব ক’টি বিধানই নির্ভুল আর সর্বাঙ্গীন সুন্দর মানবতা, ন্যায় ও মূল্যবোধের বিশ্বজনীন পরম সত্যের ঘোষণা নিয়ে জীবনকে শুভ, পবিত্র ও সুন্দর করে গড়ে তোলার লড়্গ্যে ইসলামকে ব্যাপক গভীর এর সুদূর প্রসারী ভূমিকা রেখে এসেছে সে কথা বলাই বাহুল্য। অথচ এই শান্তিপূর্ণ বিয়ে বন্ধনের মাঝে অস্বস্তিôকর যে ব্যবস্থাটি আমাদের সমাজ শক্তভাবে আসন গেড়েছে- তা’হলো বিয়ে ব্যবস্থায় যৌতুক প্রথা।

কালের আবর্তে সমাজে এই যৌতুক ও পণপ্রথার জন্ম। এতে ইসলামে আলস্নাহর নির্দেশিত বিয়ে প্রথা চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। যৌতুকের ভয়াল গ্রাসে পিতা-মাতা হয়েছে সর্বশ্বান্ত ও কন্যাদায় গ্রস্ত। ইসলামে যৌতুক লেন দেনের স্থান নেই। প্রাকইসলামিক যুগে কন্যা সন্তানকে পিতৃ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হতো। তাই পিতার সম্পত্তির একটা অংশ উপহার হিসাবে বিয়েতে প্রদান করা হতো। হিন্দু বিধান মতে এবং বিয়ের সময় কন্যাকে পিতার অর্থ সম্পদ যা যৌতুক হিসাবে এখন সমাজে প্রচলিত বিধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অনৈসলামিক বিধি ব্যবস্থা ও বিয়ে কর্মকান্ড থেকেই যৌতুক প্রথার উৎসারণ। অন্যদিকে আমাদের মুসলিম সমাজে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী নববধূর দ্রব্য সামগ্রী প্রথম পিতৃ গৃহ থেকে স্বামীর গৃহে গমনকালে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম গহনাপাতি দান জেহজ রূপে প্রদান করা হয়। এখানে শর্ত জরবদস্তি কিংবা দর কষাকষির কোন বালাই নেই। স্ব-ইচ্ছায় ও সুন্তষ্ট চিত্তে এসব দান-জেহাজ দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া ইসলামে বিয়ে বন্ধনে মোহরানার গুরম্নত্ব অনেক। এটি ইসলামের জন্ম থেকেই মুসলীম সমাজে কড়াকড়িভাবে আরোপিত। মোহরানা কন্যার প্রাপ্য। এই মোহরানা কেবল বর কর্তৃক অনেকে স্বেচ্ছাকৃত উপহার হিসাবে প্রদান করা হয় বা স্ত্রীর নিজস্ব সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা নারী দিগকে মোহরানা প্রদান করো, সূরা নেসায় বলা হয়েছে, পুরম্নষরা নারীদের ভরণ পোষণ, লালন-পালন সংরড়্গণ তথা সবকিছুর জন্য দায়ী। আল-কোরআনে আরো সুস্পষ্ট ঘোষিত হয়েছে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে কোন কিছু দেয়াই রীতি সংগতভাবে বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে মোতৃরানা নির্ধারণি অতি অপরিহার্য। পবিত্র কোরআন, হাদীস এবং ফেকাহ শাস্ত্রবিদদের মতে, বিয়ে-শাদীতে মোহরানা প্রদান অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। এখানে দরাদরি বা চাওয়া বা পাওয়া শরীয়তের বিধানে অনুপস্থিত।

প্রসঙ্গতঃ উলেস্নখ্য যে, বদর যুদ্ধে মালে গণীমতের অংশ রূপে হযরত আলী (রাঃ) যে বর্মটি পেয়েছিলেন তা বিক্রয় করে তিনি একশত পঁচিশ দেরহাম হযরত ফাতেমা (রাঃ) কে মোহরানা হিসাবে প্রদান করেন। হযরত আলী (রাঃ)-এর মোহরানা দেয়ার মতো কোন সম্পদ ছিল না। হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও হযরত আলীর এই পবিত্র শাদী মোবারকে হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) স্ব-ইচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে গৃহস্থালির কিছু সরঞ্জাম উপহার দেন। এখানে বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য যে, হযরত রাসূলে পাক (সাঃ)-এর এই উপহারকে যৌতুকের পর্যায়ভূক্তকরণ নিঃসন্দেহে ইহা বোকামির নামান্তর মাত্র।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মানব সমাজ আজ বিয়ে শাদীতে যৌতুকের শিকারে পড়ে যে বিষ্ময় তথা অভিশপ্ত, কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করে চলেছে তা বলাই বাহুল্য। যৌতুক গ্রহণ ও প্রদান দণ্ডনীয় আইন থাকা সত্ত্বেও (অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও) এর ফাঁকে ফাঁকে যৌতুকী বিয়ে সম্পাদিত হচ্ছে। পরিণামে মা বোন হচ্ছে লাঞ্ছিত অনেকেই করছে আত্মহত্যা, চলছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। যদিও নারী সমাজ এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তথাপি পুরম্নষ সমাজের তথাকথিত স্বার্থান্বেষী মহলের মন মানসিকতার কোন পরিবর্তন লড়্গ্য করা যায় নি। যা অতীব দুঃখজনক। প্রসঙ্গতঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনেকরি যৌতুক প্রতিরোধে দেশের গোটা আলেম সমাজই হচ্ছে নায়েবে রাসূল। সমাজ যখন বিপথগামী, পরস্পর হানাহানি দ্বন্দ্ব কলহে নিত্য-নিয়ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তখন আলেম ওলামা ও ইমাম সমাজই এর প্রতিরোধে কেবল এগিয়ে আসতে পারে। এবং এজন্য বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ তাঁদের দ্বারাই বিয়ে-শাদীর কার্যাদা সম্পন্ন হয়ে থাকে। আমাদের প্রিয় ভূমি এই বাংলাদেশে প্রায় সত্তর হাজারের মতো গ্রাম রয়েছে- এতে রয়েছে লড়্গ লড়্গ মসজিদ -এবং প্রতিটি মসজিদে, রয়েছে ইমাম তথা আলেম সমাজ। এই কু-অভিশপ্ত প্রথা সমাজ থেকে উচ্ছেদের ব্যাপারে সঠিক কর্মকাণ্ড পথ নির্দেশনা অন্যদের থেকে অনেক অনেক বাস্তব সম্মত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই আমি দেশের বৃহত্তর আলেম সমাজ নারী, ইমাম, পীর-মাশায়েখ এবং ইসলামী সামাজিক সংগঠনসমূহ তথা সরকারের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করছি।

(১) যৌতুক একটি বি-জাতীয় প্রচলন ও নারী নির্যাতনমূলক এক অভিশপ্ত প্রথা। এর বিরম্নদ্ধে গড়ে তোলার জন্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। (২) যৌতুক লেন-দেন হয় এমন বিয়েতে কালেমা বা খুতবা পাঠ না করিয়ে সামাজিকভাবে যৌতুকী বিয়ে বয়কট করতে হবে। (৩) ওয়াজ মাহফিল ও জুমআর খুতবার সময় যৌতুক যে শরীয়ত পরিপন্থি কু-প্রথা এবং এর কুফল ও পরিণতি সম্পর্কে জনসাধারণকে অভিহিত করাও যৌতুক বর্জন করার প্রতি মন-মানসিকতা তৈরি করা। (৪) নিজ নিজ এলাকার সর্বস্তরের সমাজ কর্মীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী যৌতুক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। (৫) যৌতুক বিরোধী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের দাবী বিশেষ করে কবিন নামা ফরমে যৌতুকের কোন দাবী নাই এই মর্মে আদালতগ্রাহ্য হলফ নামায় স্বাড়্গর দানের দারা প্রবর্ত্তনের দাবী সরকারের কাছে তুলতে হবে। (৬) কন্যা দায়গ্রস্থ গরীব পিতা-মাতার বিয়েযোগ্য কন্যাদের বিয়ে সুসম্পন্ন করার জন্য ধনাঢ্য বিত্তবান ও সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় মহিলা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করার দাবি করতে হবে। (৭) বেতার ও টিভি চ্যানেলসমূহে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা ব্যাপকতর করতে হবে। এবং এর পরিণতিও কুফল সম্পর্কে জনসমড়্গে তুলে ধরতে হবে। (৮) এছাড়া অবিবাহিত শিড়্গিত যুবক দ্বারা যৌতুক লেনদেনকে চরম ঘৃণা করে তারা সমাজে যৌতুক বিহীন বিয়ে করে সমাজে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। (৯) এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, বিয়ে-শাদী মানব জীবনের একটি পবিত্রতম শুভ কাজ। ধর্মীয় নীতিমালায় যৌতুক বিয়ে শাদীর কোন স্থান নেই। যৌতুকী বিয়ে সম্পূর্ণ পরিহারযোগ্য। অতএব, দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, মসজিদের ইমাম, কাজীসহ সুধী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক সাংবাদিক তথা দেশের প্রতিটি সচেতনশীল নাগরিকের উচিত, এই অশুভ চরম ঘৃণিত পরিহার- যোগ্য অভিশপ্ত কু-প্রথার বিরম্নদ্ধে সাধারণ মানুষের মনমানসিকতা গড়ে তোলা এবং এ দেশের পবিত্র ভূমি হতে যৌতুক শব্দটি চিরতরে বিদায় দেয়ার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানোর জন্যে জোর আহ্বান জানাচ্ছি।
উপসংহারে বলতে চাই, আসুন আলস্নাহ ও পরোকালে ভয় রেখে বিয়ে-শাদীতে যৌতুক লেন-দেন থেকে বিরত থাকি।

মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার

হিজরী নববর্ষের তাৎপর্য


হিজরী নববর্ষের তাৎপর্য


গত মঙ্গলবার ছিলো পয়লা মহররম, হিজরী নববর্ষের প্রথম দিন। হিজরী নববর্ষকে খোশ আমদেদ জানাই। হৃদয়ের সব উষ্ণতা দিয়ে তোমাকে গ্রহণ করি। তুমি কেবলই যুগে যুগে নয় শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্বমুসলিমকে নতুন প্রেরণায় উদ্দীপ্ত করে আসছো। তোমাকে আমরা স্মরণ করি। তুমি এলে আমরা আত্মসচেতন হই। নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। দেখতে না দেখতেই আমাদের মাঝ থেকে কালের গর্ভে হারিয়ে গেল ১৪২৯ হিজরী। চলে এলো ১৪৩০ হিজরী। আমরা জানি হযরত ঈসা (আ·) এর তিরোধানের পর হতে খ্রীষ্টাব্দ গণনা করা হয়ে থাকে। আর মুহাম্মদ (সা·) এর মক্কা হতে মদীনায় হিজরতের দিন অর্থাৎ-৬২২ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই হিজরী সালের গণনা করা হয়। হিজরী সালের ক্যালেন্ডার রসূল (সা·) এর সময় হতে প্রচলিত না হলেও তাঁর খলিফা আমিরম্নল মুমেনীন হযরত ওমর (রা·) এর শাসনামলে ১৭ হিজরী বা রসূলের ইন্তেকালের সাত বছর পর হতে এই হিজরী সনের প্রচলন করা হয়। সে সময় হযরত ওমর (রা·) অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা ছিলেন। তখন রাজ্যের বিভিন্নস্থানে চিঠিপত্র প্রেরণের ড়্গেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হয়। তাই তিনি সমসাময়িক সাহাবায়ে কেরামদের পরামর্শক্রমে এই কার্যক্রম পরিচালিত করেন। পৃথিবীতে আজ নানারকম আগ্রাসনে অসহায় মানুষ দিশাহারা। ধর্মগত, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত প্রভাবে উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। তা থেকে বের হয়ে আসার কোন উপায় যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

যার কারণে হিজরী নববর্ষ নিয়ে কোন সাড়া-শব্দ নেই। মহররম আসে আমাদের পুরাতন বছরের জরাজীর্ণতাকে মুছে দিয়ে নতুনরূপে, নতুন স্বপ্নে ডানা মেলে, নতুন প্রত্যাশার ভেলায় চড়ে আজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার ও দুরন্ত সাহসীকতার পথে নির্ভীক পথ চলার কল্যাণময় শুভ বার্তা নিয়ে। গভীরভাবে লক্ষ্য করুন যদি এই নববর্ষ নিরবে নিঃশব্দে চলে যায় তাহলে আমরা কিভাবে নতুন শপথ ও প্রত্যয় নিয়ে পথ চলবো? সবচেয়ে বড় কথা হলো- হিজরী সনের যে প্রেড়্গাপট তা যে কোন মুমিন মুসলামান হৃদয়ে নবী প্রেমের অকৃত্রিম ভালবাসা ও যশোগাঁথা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা কি হয়? হয় না তার কারণ আমরা হিজরী সনের মর্মকথা পটভূমি ও প্রেক্ষাপট জানি না, জানার চেষ্টাও করি না। সে দিন ছিল ১২ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রীষ্টাব্দ। হযরত মুহাম্মদ (স·) মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেছিলেন আলস্নাহ তায়ালার নির্দেশে। কারণ পৃথিবীতে যত নবী রসুল এসেছিলেন সকল নবীও রসুলেরা নির্যাতিত হয়েছেন।

অনেকেই হিজরত করতে বাধ্য হয়েছেন। তেমনিভাবে হযরত মুহাম্মদ (স·) ৬১০ খ্রীষ্টাব্দে নবুওয়াত পাওয়ার পর আলস্নাহ অস্বীকারকারীদেরকে এক আলস্নাহর দিকে আহ্বান করেছিলেন তখন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষেরা বিরোধীতা শুরম্ন করেছিল। গোপনে গোপনে তিন বছর দাওয়াত দিয়েছিলেন। এর পর আলস্নাহর নির্দেশে সাফা পাহাড়ে প্রাকশ্যে এক আলস্নাহর উপর ঈমান আনয়নের ঘোষণা করেছিলেন। তখন থেকেই আরম্ভ হয়েছিল নির্যাতন। পথে প্রান্তে তাকে অপমানিত লাঞ্চিত করা হতো। নামাজরত অবস্থায় উটের নাড়ী ভুড়ি তাঁর পিঠের উপর চাপিয়ে দেয়া হতো। গমনা-গমনের পথে কাটা বিছিয়ে রাখা হতো। শিয়াবে আবু তালিব নামক শিবিরে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এরপর তার সঙ্গি সাথী সাহাবীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছিল। তাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো হযরত খাব্বব (রা·), তালহা (রা·), আবদুর রহমান বিন আউফ (রা·), হযরত বেলাল (রা·) আম্মার ইয়াছির ও সুমাইয়া। হযরত বেলাল (রা·)কে তো মুরম্ন ভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশির উপর চিৎ করে শোয়ায়ে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো। এই অবস্থায় অত্যাচারী উমাইয়া বিন খলফের চাবুকের প্রচন্ড আঘাতে তার গোটা শরীর জর্জরিত হয়ে যেত। হযরত আম্মার ইয়াছির, সুমাইয়া এদের উপরও এই নির্যাতনের ষ্টিম রোলার চালানো হয়েছে। কাফেলারা নবীজীকে শারীরিক নির্যাতনে যখন দ্বীনের দাওয়াত থেকে স্তôব্ধ করতে পারলোনা তখন মানুষিক নির্যাতন দেয়ার জন্য নানা রকম ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগলো। তারা তাকে পাগল, কবি, জাদুকর ইত্যাদি বলে অপপ্রচার করতে থাকলো। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না। বরং মুহাম্মদ (স·) তাঁর মিশন সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন। একদিন তারা নদওয়া নামক তাদের মন্ত্রণাগৃহে সকল গোত্র পতিদের একটি বৈঠক করলো। সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, “আমরা নানা রকম কৌশল করে মুহাম্মদ (সাঃ) কে ঠেকাতে চেয়েছি। কিন্তু সে তো থেমে থাকার লোক নয় বরং তার চেয়ে আমরা মুহাম্মদ (সাঃ) কে দুনিয়া হতে সরিয়ে দেই”। সকলে এই সিদ্ধান্তেôর উপর সমর্থন করলো, তারা সকল গোত্র হতে শক্তিশালী যুবকদের বাছাই করলো। তাদেরকে ঘোষণা দিল, ‘যে মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন্তô অথবা মৃত দেহ এই নদওয়া গৃহে হাজির করতে পারবে। তাকে একশত উট পুরস্কার দেয়া হবে।” যেই কথা সেই কাজ। মক্কার সকল গোত্র হতে শক্তিশালী পাহলোয়ান যুবকেরা একত্রিত হয়ে শপথ নিয়ে বের হলো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাড়ী ঘেরাও করে তাকে আজ রাতেই তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাবে।

এদিকে আলস্নাহতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে নির্দেশ করলেন হে নবী মক্কার মানুষ আপনাকে চায় না। মদীনার মানুষেরা আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেড়্গা করছেন। আপনি মদীনায় হিজরত করে চলে যান। মহানবী (সাঃ) আলস্নাহতায়ালার এই ঘোষণা পাওয়ার পর রাতের অন্ধকারে নিজ বিছানায় হযরত আলী (রাঃ) কে শায়িত রেখে মদীনার পথে রওনা দিলেন। সাথী হিসেবে বন্ধু আবু বকর (রাঃ) কে সঙ্গে নেয়ার জন্য তাঁর বাড়ীর সামনে গিয়ে, আবু বকর! বলে একবার ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আবু বকর (রাঃ) বেরিয়ে এলেন। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এলে? জিজ্ঞাসা করলেন হযরত (সাঃ)। আবু বকর (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসুলুলস্নাহ (সাঃ)! যেদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন, ‘ হে আবুবকর মক্কার কাফেলারা বড়ই ড়্গিপ্ত হয়ে উঠেছে। কবে কখন হয়ত মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করতে হতে পারে। সেদিন হতে একটি রাতের জন্যও আমি বালিশে মাথা রেখে ঘুমাই নাই। কারণ আমি আরাম করে ঘুমিয়ে থাকবো আর কাফেরেরা আপনাকে ধাওয়া করবে আপনি আমাকে ডেকে ডেকে পাবেন না। কাফেরেরা আপনাকে আঘাত করবে, যখম করবে। আমি আবু বকর এটা সইতে পারবো না। মহানবী (সাঃ) বললেন আবু বকর! চলো আর নয় এখানে। কারণ আলস্নাহর নির্দেশ মদীনায় হিজরতে যাওয়ার।’ তারা চললেন মদীনা অভিমুখে। চলতে চলতে রাত শেষ হয়ে সুবহে সাদিক হয়ে গেল। রসুল (সাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) তখন মক্কার অনতি দূরে সওর নামক পর্বতের সন্নিকটে। তারা ভাবলেন কাফেরেরা হয়ত তাকে বাড়ীতে না পেয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। সুতরাং এখানে রাতে আত্মগোপন করে থাকা যাক। তারপর তারা কিছুটা নিবৃত হলে আবার রওনা দেওয়া যাবে। সে হিসেবে সওর পর্বতের একটি গুহার মধ্যে ঢুকলেন। এই গুহায় বিষধর সাপ ছিল। হযরত আবু বকরকে সাপে দংশন করেছিল। মহানবী (সাঃ) তাঁর মুখের থুথু বা লালা আবু বকরের ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিষ চলে গেল।

এদিকে সকাল পর্যন্ত কাফেরেরা রসূল (সাঃ)-এর বাড়ীর চুতুষ্পার্শ্বে ঘিরে থেকে তাকে বের হতে না দেখে বাড়ীতে ঢুকে পড়লো। তারা রসূল (সাঃ)-এর ঘরে হযরত আলী (রাঃ)-কে পেয়ে তাকেই জিজ্ঞাসা করলো -বল! মুহাম্মদ (সাঃ) কোথায়? হযরত আলী (রাঃ) বললেন, মুহাম্মদ (সাঃ) কোথায় সেটা তোমরা দেখ, আমি কি বলবো? এমতাবস্থায় কাফেরেরা সিদ্ধান্ত নিল-মুহাম্মদ (সা·) হয়ত মক্কা হতে মদীনার পথে রওনা দিয়েছে। সুতরাং আর কালড়্গেপন না করে এখনই চলো তা না হলে আমাদের শিকার হাতছাড়া হয়ে যাবে। তারা পথে প্রান্তেô না পেয়ে ভাবছে মুহাম্মদ (সাঃ) নিশ্চয়ই মক্কার আশে পাশে কোন গুহা অথবা অন্য কোন স্থানে আত্মগোপন করে আছে বিধায় কেবলমাত্র পথ নয় পাহাড়-পর্বত এর মাঝে গর্ত গুহা থাকলে সবই খুঁজতে হবে। এসময় কাফেরেরা রসূল (সাঃ) ও আবুবকর যে গুহায় ছিলেন সেদিকে আসছিল। দূর হতে তাদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) ভয় পাচ্ছিলেন। আর বলছিলেন, ‘হে মুহাম্মদ (সাঃ)! ঐ দেখুন শত্রম্নদের পদধ্বনি শোনা যায়। তারা হয়ত আমাদের ধরে ফেলবে।’ মহানবী (সাঃ) তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘ভয় পেওনা আবুবকর! আলস্নাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ কুরআনে আলস্নাহতায়ালা এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আয়াত নাযিল করেছেন, “ইজহুমা ফিল গারে, ইজ ইয়াকুলু লিসাহিবিহি লা তাহবান ইন্নালস্নাহা মাআনা” অর্থাৎ হে নবী (সাঃ) সেই সময়ের কথা স্মরণ করম্নন। যখন আপনি ও আপনার মহানবী গুহার মধ্যে ছিলেন আর আপনার সাহেবী বলছিলেন, ঐ দেখুন শত্র্র্রু আমাদের ধরে ফেললো! তখন আপনি বলেছিলেন ভয় পেওনা, আলস্নাহ আমাদের সঙ্গে আছেন’। তারপর আলস্নাহ কি করলেন? ঐ গুহায় মাকড়সা পাঠিয়ে দিলেন। তারা মুহূর্তের মধ্যে পুরা গুহার মুখ জাল বুনে ঘিরে ফেললো। একটি কবুতর পাঠিয়ে দিলেন। যে ডিম পেড়ে গুহার মুখে’তা দিতে থাকল।

কাফেলারা যখন ঐ গুহার পাশে এলো তখন একজন বললো, দেখ দেখ এই গুহাটিও দেখ। কারণ এখানেও তো তিনি থাকতে পারেন। অন্য একজন বললো, এই গুহায় যে মুহাম্মদ (সা·)নেই তা আমি নিশ্চিত বলতে পারি। কারণ গতরাতেই যারা এসেছে তারা যদি এই গুহায় ঢুকতো তাহলে মাকড়সার জাল ছেড়া থাকতো। আর যে গুহায় লোক থাকে তার মুখে কবুতর ডিমে তা দেয় কেমন করে? সুতরাং অন্যদিকে চলো। এরপর কাফেররা মক্কা থেকে মদীনায় যাওয়ার সকল পথে পাহারাদার নিযুক্ত করলো। কিন্তু মহানবী (সাঃ) এই গুহায় তিনদিন তিন রাত থাকার পর অচেনা-অজানা পথে লোহিত সাগরের তীর দিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে চলতে থাকলেন। পথে আরবের বড় পীর সুরাকা মহানবী (সাঃ)কে হত্যা করতে এসে নিজেই মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। বারিদা নামক অন্য আরেকজন পুরস্কারলোভী ৭০ জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের নিয়ে পথে দাঁড়িয়েছিল। তারাও মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। এরপর মদীনায় পৌঁছলেন। মদীনার আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সকলে মহানবী (সাঃ)-কে স্বাগতম জানালেন। তাকে মদীনার মানুষেরা নেতা মেনে নিলেন। তিনি মদীনা রাষ্ট্রের অধিপতি হলেন। অনেকগুলি যুদ্ধ-বিগ্রহ হলো। সবশেষ মক্কা বিজয় হলো। সমগ্র আরব ভূ-খন্ডে ইসলামের আদর্শ, কুরআনের আলো প্রজ্বলিত হলো এবং তাঁর ইন্তেôকালের পর খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর খেলাফতকালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা হতে মরক্কোর রাবাত পর্যন্ত মুসলমানদের করতলগত হলো। এরপর ইসলামের মহিমা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। যা কেয়ামত অবধি টিকে থাকবে। রাসুলুলস্নাহর (সাঃ)-এর হিজরতের এই প্রেড়্গাপট, পটভূমি যদি হিজরী নববর্ষে স্মরণ করা হয় তাহলে প্রতিটি মুমিন হৃদয়ের আমূল পরিবর্তন হতে পারে।
মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী

পবিত্র আশুরা ও ঐতিহাসিক কারবালার শিক্ষা


পবিত্র আশুরা ও ঐতিহাসিক কারবালার শিক্ষা


মহররম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আরবি ‘আশারা’ অর্থ দশ। সেই সুবাদে ওই তারিখ আশুরা বলে উল্লেখিত হয়ে আসছে। কারো মতে, হিজরী ৬১ সনের ১০ মহররম ঐতিহাসিক কারবালার প্রান্তরে অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের বাহিনী কর্তৃক হজরত ইমাম হোসাইন রাঃ-কে যে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়, সেই হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণেই পালিত হয় আশুরা। মহররমের ১০ তারিখ বা আশুরা যেসব কারণে তাৎপর্যমণ্ডিত, তা নিচে আলোকপাত করা হলো।
আল্লাহপাক এ তারিখে আসমান, জমিন, লওহে কলম সৃষ্টি করেছেন এবং এই ১০ মহররম মহাপ্রলয় বা কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে।
আল্লাহতায়ালা আদি পিতা হজরত আদম আঃ-কে ১০ মহররম দুনিয়ায় প্রেরণ করেন।
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম আঃ ঈমানের মহা কঠিন পরীক্ষা দিতে নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ১০ মহররম।
১০ মহররম খোদাদ্রোহী ফেরাউন বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে নীল দরিয়ার অতল তলে তুবে মরে আর হজরত মুসা আঃ বনি ইসরাইলদের নিয়ে পানির ওপর দিয়ে পার হয়ে যান।
হজরত ইউনুছ আঃ ৪০ দিন মাছের পেটে অবস্থানের পর ১০ মহররম নাজাত পেয়েছিলেন।
হজরত নূহ আঃ ৪০ দিনের মহাপ্লাবনের পর ১০ মহররম নৌকা থেকে বেলাভূমিতে অবতরণ করেন।
হজরত ঈসা আঃ ইহুদিদের অত্যাচার, নির্যাতন শূলদণ্ড থেকে মুক্তি লাভের জন্য সশরীরে চতুর্থ আসমানে উপস্থিত হন ১০ মহররম।
হজরত ইয়াকুব আঃ তাঁর হারানো ছেলে হজরত ইউসুফ আঃ-কে ফিরে পান এবং দৃষ্টিশক্তি আবার ফিরে পান ১০ মহররম।
ধৈর্য, সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক হজরত আইউব আঃ ১৮ বছর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত থেকে আল্লাহপাকের ইচ্ছায় ১০ মহররম আকস্মিকভাবে আরোগ্য লাভ করেন।
কাবাঘরের নির্মাণকাজে সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং ঐতিহাসিক কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা সংগঠিত হয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
কারবালার এই মর্মান্তিক ঘটনা দ্বারা হজরত ইমাম হোসাইন রাঃ মুসলিম জাতির জন্য এই শিক্ষাই রেখে গেছেন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, রাজনীতিকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা রোধের নিমিত্ত, কুরআনি শাসনের পরিবর্তে মানবরচিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন ঠেকানোর উদ্দেশ্যে, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠাকল্পে অত্যাচারীর হাত থেকে মজলুম জনগণকে রক্ষা করার নিমিত্ত, বাতিল মতবাদ রুখে দেয়ার মানসে, জীবনের সর্বস্তরে ইসলামী নীতিমালা বাস্তবায়নে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে।

মাওলানা শাহ মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান

আশুরার সংস্কৃতিই আমাদের পথনির্দেশক


আশুরার সংস্কৃতিই আমাদের পথনির্দেশক


আশুরা হলো হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের দশম দিবস। এ দিবসটি মানবেতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ দিবসে বহু ঐতিহাসিক ও বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বিধায় এ দিবসটি খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত। হাদিস শরিফে এসেছে, এ দিবসটি মহান আল্লাহর কাছে বছরের অন্যান্য সব দিবস থেকে অপেক্ষাকৃত মর্যাদাবান। এ দিনে রোজা রাখার জন্য হাদিস শরিফে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর আগে বা পরে আরো একটি রোজা রাখার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে ইহুদি জাতির সংস্কৃতির সাথে মুসলিম সংস্কৃতি একাকার হয়ে না যায়। এ কথার অন্তর্নিহিত অর্থ খুবই তাৎপর্যবহ।
পবিত্র আশুরার দিনে মহান আল্লাহ ভূমণ্ডল, নভোমণ্ডল, লওহ, কলম ও সাগর-মহাসাগর প্রভৃতি সৃষ্টি করেছিলেন। এ দিনে হজরত আদম আঃ ও হজরত হাওয়া আঃ-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল। জান্নাত-জাহান্নাম এ আশুরার দিনে সৃষ্টি হয়েছিল। এ আশুরার দিনে আদম আঃ ও হাওয়া আ.-এর তওবা কবুল হয়েছিল। হজরত নূহ আঃ-এর কিশতি দীর্ঘ ৪০ দিন পর এ আশুরার দিনে জুদি পাহাড়ের চূড়ায় এসে থেমে যায়। এ দিনে হজরত ইদ্রিস আঃ-কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়। হজরত ইব্রাহিম আঃ-এর জন্ম এ দিনে হয়। এই দিনে তিনি জালিম নমরুদের বিশাল অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি লাভ করেন এবং খলিলুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত হন। হজরত মূসা আঃ ৬ লক্ষাধিক বনি ইসরাইলের সাথে নিয়ে সদলবলে লোহিত সাগর পার হয়ে এ দিনে জালিম ফেরাউন থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। হজরত আইয়ুব আঃ কঠিন ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন এই দিনে। পবিত্র মহররমের এই দশম দিনে হজরত ঈসা আঃ এই ভূপৃষ্ঠে এসেছিলেন এবং তাকে এ আশুরার দিনেই আসমানে অধিরোহণ করে নেয়া হয়।
পবিত্র আশুরার দিনটি উল্লিখিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ছাড়াও আরো নানা কল্যাণকর ও বিস্ময়কর ঘটনার প্রেক্ষাপটেই চিরভাস্বর ও চিরস্মরণীয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানবেতিহাসের ঊষালগ্ন থেকেই নানা জাতি নানা কারণে এ দিনে রোজা রাখত। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মক্কা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় গিয়ে দেখতে পেলেন ইহুদিরা এ দিনে রোজা পালন করতে। রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলে তারা উত্তর দিলো, এই দিনে আল্লাহতায়ালা জালিম ফেরাউনকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে হজরত মূসা আঃ-কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং দান করেছিলেন চিরবিজয়। তাঁর কৃতজ্ঞার্থে এ দিনটিতে আমরা রোজা পালন করে থাকি। এ কথা শুনে প্রিয় নবী বলেছিলেন, হজরত মূসা আঃ-এর সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরো গভীর। তাই রাসূলুল্লাহ সাঃ হজরত সাহাবায়ে কিরামকে এ দিনটিতে রোজা রাখার নির্দেশ দেন এবং ইহুদিদের বিরোধিতা করে এ দিনটির আগে বা পরে আরো একটি করে রোজা রাখতে উৎসাহিত করেন, যাতে আমাদের সভ্যতা- সংস্কৃতি ইহুদি জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতির সাদৃশ্য না হয়ে যায়। (বুখারিঃ ১/২৬৮, মুসলিমঃ ১/৩৭৮)
বাংলা নববর্ষ পালনের নামে ঢাকাসহ সারাদেশে উচ্ছৃঙ্খল একশ্রেণীর তরুণ-তরুণী যে দৃশ্যের অবতারণা করে থাকে, তা দেখে তো মনে হয় না, এটা মুসলিম দেশ এবং তারা মুসলিম পরিবারের সন্তান। ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে এ আশুরার দিনে রাসূল দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন রাঃ যেমনিভাবে হায়দারি হুঙ্কার ছেড়ে অন্যায় আর অসত্যের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তেমনিভাবে আজ আমাদেরকে অপসংস্কৃতি ও অপশক্তির মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে সদা তৎপর থাকতে হবে। হজরত হুসাইন রাঃ সপরিবারে অকাতরে শাহাদত বরণ করে এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন যে, ‘শির দেগা আমামা নেহি দেগা’। এ হোক আজ আমাদের বজ্রশপথ। হোক দৃঢ়প্রত্যয়।

মাওলানা ওসমান গনী হাজীপুরী